উপন্যাস

উপন্যাস।। ছায়াপথ ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। শেষ পর্ব

Relatedness is important for a good theme and literature. Composition of theme, establishment a strong and logical relationship with the elements of that composition and excellent conclusion can make a thing different. But make clear the objective.

আমার কী মনে হয় জানো আসিফ, আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো যে কোনো সৃষ্টির জন্যই প্রযোজ্য। আসিফ খুব অবাক হয়ে শুনছিল নাদিমের বাবার কথাগুলো। সে যেন লজ্জায় মুষড়ে যাচ্ছিল। মনে মনে ভাবল, সত্যিই এমনটি তো কোনোদিন ভাবিনি। সৃষ্টির জন্য শেকড়ের প্রয়োজন। আর এই শেকড়ই হলো ইনসাইট। বাস্তবতা বা প্রকৃতি হল ভূমি। চিন্তা হল লাঙলের ফলা। কর্ষণ কর আর ফসল ফলাও।

নাদিমের বাবা আবার বললেন, চিন্তা শক্তিকে পাওয়ারফুল করো আগে তারপর লিখো। তুমি উঠে আসবে আমার বিশ্বাস। কবিতার পাশাপাশি পত্রিকায় কলাম লেখো। গদ্য লিখো। তাহলে পরিচিতি আর রোজগার দুটিই পাবে। তোমার দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছো বলে তার মানে এই নয় যে, তুমি শেষ হয়ে গেছো। তুমি যে প্রতিভাবান ছেলে, তুমিও কিছু করে বড় হতে পারো মানুষের এক অনন্য উদাহরণ।

আসিফের লজ্জার পরিসীমা বেড়ে গেলেও মনের ভেতরে স্বপ্নের পাখিরা যেন কলকলিয়ে ওঠে। কলাম তো সে লিখতে পারবে। কিংবা অন্য কিছু আকর্ষণীয় কিছু লেখার চেষ্টা করবে। আসিফ ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। ভাবল জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললাম। আর একটি মুহূর্তও নষ্ট করব না। আসিফ আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে আর ভাবে আমার সুচিকিৎসার টাকা আমাকেই যোগাড় করতে হবে।

চা-নাশতা খেয়ে নাদিমের বাবা নিশার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, নে রাখ। তোদেরকে দেখা আমার কর্তব্য। সানাইটা বেতন টেতন পাচ্ছে? নাকি শুধু মূলার বোঝা বইছে? নিশা কোনো উত্তর দিল না। টাকা নিতে সংকোচবোধ হলো। কিন্তু যেভাবে দিয়েছে তাতে টাকা না নিয়ে উপায় নেই। নিজের বাবাও এমন আদর করে নিশাকে কিছু হাতে তুলে দিত কি না সন্দেহ।

নাদিমের বাবা আবার শুরু করেন, নাদিম যখন তার মায়ের পেটে আসে তখন আমি একটি মেয়ে আশা করছিলাম। বুঝলে নিশা আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। কিন্তু নাদিম হওয়াতে আমি দুমাস ওকে দেখতেও যাইনি। একদিন রাগে ভাতও খাইনি। পরে পাজিটা আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। পরে দীপালীকে আনলাম। সেও চলে গেলো। বাবার কাছে মেয়ে খুব প্রিয় তাই নারে? নিশা ঠোঁটের ফাঁকে হাসে। এত বড় হৃদয়ের মানুষ সে কোনোদিন দেখেনি। আস্তে আস্তে বলল, বাবা আপনি খুব বড় মাপের মানুষ। নিশার চোখে পানি।

নাদিমের বাবা প্রায়ই ভুলে যান একটি কথা বলার জন্য। আজকে মনে হলো নিশাকে বলতে, তুই তো আমার মেয়ে হতে পারলি না। নাদিমরা আমাকে ‘তুমি’ করে ডাকে। আর তুই কি না আপনি আপনি করছিস? আর যদি আপনি আপনি করিস তাহলে তোদের বাসায় আর আসব না। নিশার চোখ দুটি আনন্দে ছলছল করে ওঠে। এত সুখ কি ধরে রাখা যাবে? নিশার চোখে আনন্দের পানি। নিশা বলল, আচ্ছা তুমি করেই ডাকব। নিশা হাসে। হাসেন নাদিমের বাবা। এই তো তুই আমার মেয়ে হতে পারলি।

গলির রাস্তা ধরে নাদিমের বাবা বগলের নিচে কাগজগুলো চেপে হেঁটে যাচ্ছেন। যতদূর দেখা যায় নিশা গেটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। অনেক দুঃখ-বেদনা-সুখ-আনন্দে এলোমেলো হয়ে নিশা দাঁড়িয়ে রইল। ক্রমশ সন্ধ্যা জ্বালায় নিয়মের বাতি। শহরের পথবাতিগুলোও ধীরে ধীরে আলো ছড়াতে থাকে। নাদিম সামনে এসে দাঁড়াল কিন্তু নিশার চমক কাটেনি। কী ব্যাপার আমাকে দেখতে পাচ্ছো না? হ্যাঁ পাচ্ছি। ঘরে চলো। নাদিমের হাতে নিশা টাকাগুলো দিয়ে বলে, বাবা দিয়ে গেছে।

বাবার টাকার ওপর নাদিমের অধিকার আছে। অন্তত অভাবের সংসারে এতে ছোট হওয়ার কিছু নেই। অন্য কারও টাকা হলে হয়তো হাজারো রকমের প্রশ্ন শুনতে হতো কিন্তু এখন কোনো প্রশ্ন নেই বরং কড়কড়ে নোটগুলোতে হাত বুলাতে ভালোই লাগছে। মনের সুখে টাকাগুলো কয়েকবার গুণে নিশাকে রাখতে দিল নাদিম। বলল, তুমিই বরং খরচ করো নিশা। তোমার বাবা তোমাকে দিয়েছে, আমাকে তো দেয়নি। নিশা হাসল। আজ বাবা আমাকে বললেন, তাঁকে ‘তুমি’ করে ডাকতে। আমার যে কি ভালো লাগছে তা প্রকাশ করতে পারব না। নিশার কথায় হাসল নাদিম। বলল, আমার বাবাটা আসলেই মহামানব।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আসিফের কাছে এসে নাদিম বসল। নিশা হাড়ি-পাতিল গুছিয়ে রাখছে শব্দ শোনা যাচ্ছে এখান থেকে। এটা একটা বিরক্তিকর কাজ। রাতে ধুয়ে রাখতে হয়। এগুলো ধুয়ে না রাখলে আবার চিকা, মুষিক, ইঁদুর এসে চাটাচাটি করে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ চোখে পড়ে না, অথচ খাটনি কম নয়। নিজে করতে গেলেই বোঝা যায় কত শ্রমের এইসব কাজে।

নাদিম বলল, আমার চাকরিটা কনফার্ম হয়ে গেলো। মাস্টার্সের রেজাল্ট ভালো করতে পারলাম না। ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করা আর হল না। অবশ্য এই কলেজটা সরকারি হয়ে যাবে। সরকার জনপ্রিয় হওয়ার জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে অনেক কলেজকে সরকারি করে দিচ্ছে। জ্বর এলে কি আর পাতলা বাইনের কাঁথায় শীত মানবে? নাদিম ঘরঘর করে কথাগুলো বলে শেষ করল।

আসিফ কিছুটা বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে বলল, সরকারি চাকরির প্রতি যেন তোর একটা মোহ আছে?
তা আছে বৈকি? কম কাজ করে জীবনের নিরাপত্তা পাওয়া যাচ্ছে। লাইফ ইজ গ্যারান্টেড। তারপর বল তোর লেখালেখির কি হলো? কী কী লিখেছিস দেখি?
আগের লেখাগুলোর সম্মানীর টাকাটা আনবি না?

আনব। এসব নতুন লেখকদের টাকা পেতে দেরি হয়। অনেক সময় টাকা পাওয়াও যায় না। কবিতার পাশাপাশি কলাম লেখা শুরু কর। গল্প কিংবা প্রবন্ধ, উপন্যাস। মনে কর বেঁচে থাকার জন্যই তোর এই আমরণ চেষ্টা।

কোচিং সেন্টার নিয়ে কি কিছু ভাববি?

হ্যাঁ। একটা চিন্তা আছে মাথায়। বেতন টেতন পাওয়া শুরু হলেই দেখি কী করা যায়। তুই হবি কোচিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল। নাদিম হাসল। আসিফও হাসল। টেবিলের ওপর ভাঙা ক্যাসেট প্লেয়ারে আবৃত্তির ক্যাসেট ছেড়ে দিল নাদিম। আবৃত্তি হচ্ছে। ওরা দুজন কান পেতে শুনছে বিভোর হয়ে

‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়…
হেলাল হাফিজের একটি কবিতাই মানুষের জন্য যথেষ্ট কী বলিস আসিফ?
হ্যাঁ, আমিও একটা কবিতা লিখতে চাই।
আবৃত্তির ক্যাসেট শেষ হল। নিশাও এলো। নিশাকে আসিফ বলল, তোর ভেড়ো গলায় একটা গান করত রে নিশা?
নিশা জানতে চায়, ভেড়ো গলা আবার কী?
আসিফ ব্যাখ্যা করল, ভেড়ার মত আওয়াজ যে গলায় তাকে বলে ভেড়ো গলা। ওরা তিনজনেই হাসল প্রাণ খোলে। হাসি প্রাবহটি ছলকে পড়ে জরাজীর্ণ এই রুমটিতে।

দিনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাতায় পাতায়। দুপুরে রোদটা চামড়ায় চিমটি কাটছে যেন; চিনচিন করছে। ঘাম ঝরছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ঢুকলেই মন বড় হয়ে যায়। চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীর নগর, রাজশাহী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ঢুকলেই মন বড় হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটাও তেমনি অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। নাদিম তাকিয়ে দেখে—বিপুল সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে। নাদিম খুঁজে পায় রোজীকে।

গাছের নীচে বসে নাদিম বলল, আসিফকে কী আপনার মনে পড়ে?
রোজীর কথা যেন থমকে যায়। তার গাল বেয়ে পানি পড়তে থাকে। অনেকক্ষণ পর বলল, আসিফ কেমন আছে?

কেমন থাকবে তা তো বুঝতেই পেরেছেন?
ও কি আপনাকে পাঠিয়েছে?
না, আমার ইচ্ছেতেই এসেছি।
ও কি আমার কথা মনে পড়ে।

বলতে গেলে দিনে অনেক বার। কত আক্ষেপ করে। আপনার ছবিটা হাতিয়ে দেখে, বলে, এই তো চোখ এখানে, এই তো চুলের গোছা… যাক সে কথা। রোজী চোখ মুছে বলল, আমি জানি ও এমন করবে। ও বিশাল বড় মনের মানুষ। আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কীভাবে যাব। বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস থাকলেও মেয়েদের অনেক দিক চিন্তা করতে হয়। তবে আসিফকে ভুলিনি। আমার বিশ্বাস ও আবার চোখে দেখবে।

এদেশের ডাক্তার বলেছেন, উন্নত চিকিৎসা হলে ভালো হতে পারে।
এমন প্রতিভাবান একটা মানুষ! উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়?
ওর তো টাকা নেই। এখন কী করব বুঝতে পারছি না।

টাকার ব্যবস্থা যেভাবেই হোক করতে হবে। আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনি একটু দেখেন কীভাবে কোথায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়? সে তো কারো সাহায্য নিবে কি না? এর আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের সাহায্য নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তা প্রত্যাখান করল।

সেটা অন্য ব্যাপার। আমি ব্যবস্থা করলে ও নিশ্চয়ই প্রত্যাখান করবে না। খুব গোপনেই করা হবে। আপনি শুধু খোঁজ-খবর নেন। ঢাকার ভালো ডাক্তারের সাজেশন নেন। পরে দেখা যাবে কী করা যায়? আমার কথা বলবেন যেন সে ভেঙে না পড়ে। আপনার মতো এমন একজন বন্ধু পাশে থাকলে একজন মানুষের আর নির্ভরতার জায়গাটি যে কত শক্ত তা বোঝার ক্ষমতা ওর নিশ্চয়ই হয়েছে।

দীর্ঘ আলোচনার পর নাদিম ঢাকায় ফিরে রাত এগারোটায়। বাসার কেউ-ই বুঝতে পারেনি নাদিম কোথা থেকে এসেছে।

ছুটির দিন। দুপুরে তিনজন খেতে বসেছে। আসিফকে খুব ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে আজ। কয়েদির মতো। এতগুলো দিন পার হয়ে গেল এই ছোট্ট একটা বাসা থেকে সে আর বের হয়নি কোনদিন। নাদিমও ভাবেনি যে আসিফকে মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। মাত্র একদিন গিয়েছিল চন্দ্রিমা উদ্যানে। আজ আসিফের মনে আনন্দও আছে। নিশার দুঃখটা তীব্র। নাদিমের এই বাড়াবাড়ি নিশার ভালো লাগছে না। গতরাতও কেঁদেছে ভীষণ। কেন ভাইয়াকে তুমি মিথ্যে প্রলোভন দেখাচ্ছো? তোমার কী লাভ? নাদিম নিশার কথায় পাত্তা দেয়নি। শুধু অনুযোগের সুরে বলল প্লিজ নিশা আসিফ যেন বুঝতে না পারে। তাহলে যে বিশ্বাস আমার প্রতি তার আছে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন আমার প্রতি যে ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হবে তাতে সে আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে যাবে। নিশা নীরবে কাঁদে। নাদিম আশার জাল পাতে। তার বিশ্বাস এ জালে একদিন ওঠে আসবে সত্যিকারের রুপালি মাছ। কোনো সাহিত্য প্রেমীদের নজরে এখনো সে আসতে পারছে না তাই এমন হচ্ছে। প্রতিভার আগুন কোনোদিন চাপা থাকে না। তার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেই।

নিশাকে গতরাতেও নাদিম বলল, জীবনকে যত দুঃখ দিতে পারো জীবন তত খাঁটি হয়ে উঠবে। একে বেশি সুখ দিতে যেয়ো না, কিছুই পাবে না সমাজ সংসারে। পৃথিবীর নিয়মে তা নেই। কষ্টের ভূমি যে যত কর্ষণ করেছে সে তত সুখ পেয়েছে।
নিশা নাদিমের কথা শুনতে চায়নি। নিশা বলল, মানুষ ঠেকায় পড়লেই এসব তত্ত¡ কথা বেশি বলে। কোমরের যাদের জোর আছে তারা এত তত্ত¡কথা বলে না। মান অভিমান ভরা ভার মুখখানি দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে রাখে নিশা।

নাদিম আবার বলতে থাকে। আমাদের জীবনের প্রাপ্তি সংঘাত থেকেই, সংকট থেকেই। আসিফের জন্য তোমার দুঃখ হয় আর আমার বুঝি হয় না? নিষ্ঠুরতা থেকেই সমাজ সংসারের সমৃদ্ধির জন্ম হয়েছে। আমার এই নিষ্ঠুরতা থেকে দেখো একদিন আসিফের উত্থান হবে Ñ একজন ভালো লেখক হবে।

দুপুরে আসিফ যখন বলল বাইরে বেড়াতে যাবে, নিশা যাবে না বলে দিয়েছে। তোমরা দুজন যাও। তিনজন বেড়াতে যাওয়া ঝামেলা ছাড়া কিছু না। হয় চারজন না হয় দুজন। ত্রিমাত্রিক আলোচনায় জোশ পাওয়া যায় না। ঠিক হলো ওরা দুজনই মঞ্চ নাটক দেখতে যাবে। আসিফের আপত্তি নেই। সে শুনবে। ছাত্রজীবনে তারা প্রতি সপ্তাহে নাটক দেখত। আসিফ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ার পর আর নাটক দেখতে যাওয়া হয়নি কোনোদিন। দেখার তো কিছু নেই।

মহিলা সমিতি মঞ্চে ওরা দুজন নাটক দেখতে গেল। ওরা পাশাপাশি বসল। আসিফ খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। প্রতিটি সংলাপই যেন তার মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি চিত্রই তার মনের চোখে চিত্রিত হয়ে যাচ্ছে।
নাটক শেষে ওরা রিকশায় ওঠে। রিকশা ভিড় কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ঝিরঝিরে বাতাস। আসিফ বলল, নাদিম আমার সারাটা দিন আজকে খুব ভালো কেটেছে কেন জানিস?

নাদিম বলল, না। কেন?

গতরাত রোজীকে স্বপ্ন দেখেছি। সে বলছে, তুমি অন্ধ হলেও তো মরে যাওনি। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। আসিফের দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। চারদিক নীরব হয়ে আসে। নাদিম কোনো কথা বলতে পারেনি। আসিফ বলল, এমন কী হতে পারে?
নাদিম বলল, পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে যা মানুষের চিন্তার বাইরে। এমনও হতে পারে রোজী একদিন চলে এসেছে।

পরিবেশটা হঠাৎ করেই ভারি হয়ে গেল। আসিফ ভারি পরিবেশকে কিছুটা হালকা করতে চাইল। সে বলল, আজকের নাটকে ট্রেজেডির দিকে গেল না কেন? নাট্যকারের আরও একটু সাবধান হওয়া দরকার ছিল। জোর করে নায়িকার সঙ্গে মিলন দেখাতে গিয়ে কাহিনীটা বালকি সিনেমাটিক হয়ে গেছে। আর সময় বাড়ানোর জন্য ঘটনার বাহুল্যতা ভাঁড়ামি হয়ে গেছে। মিনতির ক্যারেক্টারটা জোর করে ঢুকানো হয়েছে। এটা না হলেও একটা পরিচ্ছন্ন নাটক হতো।

নাদিম বলল, আমার মনে হয় মানুষকে জোর করে হাসানোর চেষ্টাটাই ভাঁড়ামি। মিনতির ক্যারেকটারটা ঘটনাপ্রবাহে না এসে আরোপিত হয়ে গেছে। আরোপিত বিষয়কে আলগা আলগা লাগে। ভালো লাগে না।

আসিফ হাসে। নাদিম জিগ্যেস করল, হাসছিস কেন?

যদি রোজী সত্যি সত্যি একদিন চলে আসে তাহলে এই নাটকের গল্পের মত হয়ে যাবে। আবার ওরা দুজন গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হয় কারও মুখে কোনো কথা নেই। গভীর নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে ওরা অনেক দূর চলে এসেছে। এক সময় রিকশা এসে একটা ট্রাফিক জ্যামে পড়ল। এখান থেকে বের হতে অনেক সময় লেগে গেল। রাস্তায় মানুষের ভিড় লেগেই আছে। আসিফ বলল, অনেক দিন পরে শহরে বের হলাম তাই না?

নাদিম বলল, হ্যাঁ। আরও ঘুরবি?

আসিফ বলল, আজ দিনটা আমার খুব ভালো গেল। চল আরও একটু ঘুরে বেড়াই।

ওরা শহরের বড় রাস্তা ছেড়ে গলির রাস্তায় ঢোকে। এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়ায়। গলির মধ্যে ধুমসি অন্ধকার। বড় রাস্তায় যেমন আলোর ঝলকানি ছিল গলির রাস্তাগুলোতে তা নেই। ওরা দুজন উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতে লাগল। আসিফের আজ সত্যি ভালো লাগছে। ওরা বাসায় ফিরে এসে দেখে নাদিমের বাবা বসে চা খাচ্ছেন। তাকে খুশি খুশি লাগছে। সামনে একটা পত্রিকা। ওরা যখন বাসায় ঢুকল তখনই নাদিমের বাবা হা হা হা করে হেসে উঠলেন। বলছিলাম না আসিফ লিখে যাও। এই দেখো তোমার লেখা একটা কবিতা দৈনিক সংবাদে ছাপা হয়েছে। এই নাও। তিনি পত্রিকাটি মেলে ধরলেন।

আসিফ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। নাদিমের চোখ দুটি ছলছল করছে। নিশাও কাছে এসে দাঁড়াল। নাদিমের বাবা পত্রিকাটি নিশার হাতে তুলে দিলেন। নে পড়ে শোনা। তোর ভাইয়ের কবিতা। ভালো করে আবৃত্তি করিস কিন্তু। আতুপাতু আবৃত্তি করলে চলবে না।

নিশা বলল, বাবা তুমি এতক্ষণ আমাকে বলোনি কেন? এত বড় একটা খুশির খবর এতক্ষণ চেপে রেখেছো? নাদিমের বাবা হাসলেন হা হা হা। তোর কবিতা তো ছাপা হয়নি যে তোকে বলব। নে আবৃত্তি কর। নিশা কবিতাটি আবৃত্তি করে। আর ঝরঝর করে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে পত্রিকার পাতায়।

নাদিমের বাবা বললেন, তুমি গদ্য লেখা শুরু করো। কলাম লিখো। কবিতাও লিখো। তোমার কবিতা উত্তীর্ণ মানের। আমি কয়েকবার পড়েছি। আসিফ কিছু বলেনি। শুধু শুনে গেল নাদিমের বাবার কথা। নাদিমের বাবার কথা শেষ হলে বাসায় নেমে এল এক প্রকার স্তব্ধতা।

নাদিমের বাবা বললেন, আজকে আসি।

নিশা বলল, তুমি ভাত খেয়ে যাবে। আজকে না খেয়ে যেতে পারবে না।  একটা ভারো খবর নিয়ে এলে আর না খেয়ে চলে যাবে? তা হবে না। তুমি বসো আমি রান্না করছি। নাদিমের বাবা বললেন, না, আজ কাজ আছে। আমি যাই। নাদিমের বাবা বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। নিশা গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। নাদিমের বাবা রাস্তায় এসে রিকশা নেন। নিশা দাঁড়িয়ে থাকে নাদিমের বাবাকে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়।

না, আর হেরে যাব না, দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আসিফ মনে মনে বলল। তৈরি হয়ে গেল রাতের মধ্যেই। নিশা আর নাদিম তো আছেই। দিনের বেলায় নিশা আর রাতের বেলায় নাদিম আসিফকে সময় দেয়। আসিফ একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। উপন্যাসটি দ্রুতই এগিয়ে যেতে লাগল। পাশাপাশি অন্যান্য লেখাও।

ছয় মাসের মধ্যে উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে গেল। দিনরাত্রি পরিশ্রম করে ওরা তিন জন একটা ভালো উপন্যাসই তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে হলো। নাদিম তো খুবই আশাবাদী। এবার সাড়া পড়ে যাবে। বাংলা সাহিত্যে এমন উপন্যাস কটি হয়?

উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির ফটোকপি করে দৈনিক সংবাদের অফিসে গেল নাদিম। সাহিত্য সম্পাদককে পাণ্ডুলিপিটি দিয়ে বলল, আমি সাহিত্যের কিছু বুঝি না। সমাজ বিজ্ঞানে ছাত্র। তবে এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটা সম্পদ হতে পারে। আর আমি আপনার অনুগ্রহ চাই। আমার বন্ধুটা যদি আপনার মাধ্যমে একটা জীবন ফিরে পায়।

সম্পাদক বললেন, একটু বসুন। আমি খুব দ্রুত পড়তে পারি যা আপনি চিন্তাও করতে পারবে না। একটা ঘন্টা সময় দিন।

নাদিম বসে রইল। সম্পাদক এক ঘণ্টায় একশ বিশ পৃষ্ঠার বইটি তিনি পড়ে ফেললেন। নাদিম আশ্চর্য হয়ে গেল লোকটি পড়ার নমুনা দেখে। তিনি চোখ তুলে বললেন, আপনি এখন যেকোনো উপন্যাসের কাহিনি ভালো-মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আমি পুরো গল্প, ভাষার গাঁথুনি ইত্যাদি সবই বলে দিতে পারব। আপনি পরখ করতে চান?

মাফ করবেন। আমি বিরল প্রতিভার মানুষ। আপনার কাছ পর্যন্ত আসতে পারাটাই মনে হচ্ছে আমার পরম সৌভাগ্য। এখন কী করা যায় বা কেমন উপন্যাস হলো দয়া করে বলু। এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হবে। আপনার বন্ধু সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাবান। এই বইটি আমার পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপতে চাই। যদি লেখক অনুমতি দেন। এজন্য অবশ্যই সম্মানীও পাবেন।

অনুমতি দেবে আবার কী! আপনি কথা দিন ছাপাবেন।

অবশ্যই ছাপাবো। এবং এর পরই দেখবেন প্রকাশক ভিড় করবে লেখকের বাসায়। আমি অনেক পত্রিকায় আলোচনা করিয়ে দেব। প্রয়োজন বোধে ভালো প্রকাশকের মাধ্যমে প্রকাশও করিয়ে দেব।
নাদিমের আনন্দ যেন আর ধরে না। এখন মনে হচ্ছে উড়ে আসবে আসিফের কাছে।
অনেকটা রাত হয়ে গেছে। আসিফ বলল, নাদিম আজকে আমার মন খুব বেশি এলোমেলো হয়ে পড়েছে। আমার ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে? তুই কি আমার সাথে একটু বের হবি?

নাদিম বলল, চল বের হই।
নিশা বলল, আমিও তোমাদের সাথে যাব।

বাসা থেকে নেমেই ওরা একটা ভ্যান দেখতে পেল। নাদিম বলল, আমাদের তিনজনকে নিয়ে দুঘণ্টা ঘুরে বেড়াবে। ভ্যান চালক রাজি হলো। ওরা ভ্যানে বসল। ভ্যানটি আস্তে আস্তে ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বের হল।

এক সময় নাদিম বলল, আমি তোকে আরও একটি সুখের খবর বলি। আমি রোজীর সাথে কয়েকবার দেখা করেছি। সে তোকে খুব ফিল করে এখনো। চিটাগাং ইউনির্ভাসিটিতে ইতিহাসে ভর্তি হয়েছে। আগামি মাসে ঢাকায় আসবে এবং তোর সাথে দেখা করবে, আমাকে কথা দিয়েছে। তারপর আরও কিছু কথা হয়েছে যা বলব না। এই কথায় নিশার একবার সন্দেহের সৃষ্টি হলেও কবিতার কথা, উপন্যাসের কথা মনে পড়াতে সে সন্দেহটি মনের ভেতরে দানা বাঁধতে পারেনি। শুধু জিগ্যেস করল, সত্যি বলছো? না কি চালাকি করছো?

নাদিম বলল, আমি কি কোনোদিন চালাকি করেছি, নিশা?
নিশা আর কী বলবে? যদি চালাকি করত তাহলে হাতজোড় করত। নিশা কথা বলেনি।
আসিফ স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে একবার জিগ্যেস করল, আর কিছু বলেনি।

বললাম তো, অনেক কথাই হয়েছে। ও যখন তোর সাথে দেখা করবে তখন বুঝতে পারবি। আগামী মাসের পঁচিশ তারিখ তোদের বাসায় আসবে।
আসিফের চোখে পানি। আজ এত ভালো ভালো খবর কেন? নাদিম বলল, নিশা তোমার ভেড়ো গলায় গান ধরো। নিশা আস্তে আস্তে গায়… আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে…।

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ১১ম পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *