উপন্যাস

উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোল

২৩

বৃষ্টিধোয়া বিকেলগুলোয় হাঁটতে হাঁটতে আসাদ দেখতে পায় গ্রামের মানুষ বিলের জলে নানা রকম জাল ফেলে মাছ ধরছে। গ্রামের বাড়িগুলোয় যেন উৎসব উৎসব ভাব। এখন মানুষ বেশ নিশ্চিন্ত সময় কাটাচ্ছে। ধান বেচে নগদ টাকা হাতে পাচ্ছে। তারা বেশ আনন্দেই আছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর পর আসাদ করিমকে গ্রামের লোকজন শিক্ষক হিসেবে নতুন করে চিনেছে। এখন সে হাঁটতে বের হলে লোকজন এগিয়ে এসে কথা বলে। শিক্ষার্থীরা পথে ঘাটে দেখতে পেলে বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। সে না যেতে চাইলে, পথে দাঁড় করিয়ে রেখেই কেউ কেউ দৌড়ে বাড়ি গিয়ে ফলমূল বা কিছু একটা নিয়ে এসে তার হাতে তুলে দেয়। এমন কি কোনো অভিভাবক সকাল বেলায় তাদের ছেলেমেয়েদের দিয়ে পিঠা-পায়েশও পাঠিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম অস্বস্তি বোধ করলেও এখন সে এগুলো বেশ উপভোগও করে। তারা যে একেবারেই অন্তর থেকে এমনটি করে সে বুঝতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ গ্রামের এই সহজসরল মানুষগুলোকে দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক মনে করতেন। তিনি এইসমস্ত নিরুপায় নিতান্তনির্ভরপর সরল চাষাভুষাদের আপনজন ভেবে মনে সুখ পেতেন। তাদের কাছে এসে আপনার লোক হয়ে থাকতে চাইতেন। এইসব অশিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষায়ও তিনি এক অনাবিল মাধুর্য দেখতে পেতেন। কবি লিখেছেন, ‘এদের ভাষা শুনতে আমার এমন মিষ্টি লাগে! তার ভিতর এমন স্নেহমিশ্রিত করুণা আছে! এরা যখন কোনো-একটা অবিচারের কথা বলে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে! অন্য নানা ছলে আমাকে সামলে নিতে হয়।’তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ‘এরা অনেক দুঃখ অনেক ধৈর্য-সহকারে সহ্য করছে, তবু এদের ভালোবাসা কিছুতেই ম্লান হয় না।’এইসব গ্রামের মানুষের সরলতা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল; সে যেন গঙ্গার মতো, তার মধ্যে স্নান করে সংসারের অনেক তাপ দূর হয়ে যায়।

আসাদ করিম এখন রাবীন্দ্রিক অনুভব নিয়ে মানুষগুলোকে দেখতে চেষ্টা করছে। এই ভাবনা থেকেই সে মানুষের সঙ্গে আরো বেশি বেশি মিশতে শুরু করেছে। এই মেশার মধ্য দিয়েই সে গ্রাম আর মানুষকে জানতেও পারছে।

আসাদ নদীর ধারে নিত্য দিনের মতোই হাঁটছিল। সে আকাশ আর মেঘ দেখতে দেখতে কখন যে গ্রামের পাশে চলে এসেছে বুঝতে পারে নি। সহসা একটি কিশোরী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়াল। আসাদ দেখল সে আলেয়া।

স্যার, আসসালামু আলাইকুম।

কী খবর আলেয়া? এখানে তোমার বাড়ি?

স্যার, আসুন। এটা আমার বাপের বাড়ি। আসুন স্যার, একটু বসবেন।

বাবার বাড়ি! তোমার বাড়ি নয়?

না স্যার, মেয়েদের আসলে কখনো আমার বাড়ি থাকে না।

কেন? থাকবে না কেন?

আগে বসুন স্যার। মা পিঠা বানাচ্ছে। খেয়ে যেতে হবে।

আমি তো হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।

হাঁটতে হাঁটতে তো এ বাড়িতে চলে এসেছেন। এসেছেন যখন পিঠা খেয়ে যেতে হবে।

পিঠা না হয় খেলাম। কিন্তু তুমি বলছিলে তোমার কোনো বাড়ি নেই।

বিয়ের আগে এটা আমার বাপের বাড়ি ছিল। বিয়ের পর এখন শ্বশুর বাড়ি হয়েছে। এর কোনোটিই আমার বাড়ি না। আর আপনি তো জানেন, মেয়েদের কোনো বাড়ি থাকে না। তাদের বাপের বাড়ি অথবা শ্বশুরবাড়ি থাকে। আর যখন স্বামী আর বাপ-মা থাকে না তখন কারো বাড়িই থাকে না।

তুমি এত কিছু জানো! কেমন করে জানলে তুমি?

আমি স্যার, কিছুই বুঝতাম না। আপনি আর চাঁপা দিদি যদি আমাকে না বাঁচাতেন, পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো আমিও অন্ধকারে তলিয়ে যেতাম।

তুমি এখন কোথায় আছো?

আমি থাকি স্যার আমার বাপের বাড়িতে। কিন্তু, সেটা যে এখন আর আমার বাড়ি নয়, আমার বাপ-মা মাঝে মাঝেই আমাকে মনে করিয়ে দেয়।

কেমন করে মনে করিয়ে দেন?

মাঝে মাঝে আমার শ্বশুর অথবা দেবর আমাকে নিতে আসে। আমি যদি বলি আমার পড়া লেখার ক্ষতি হবে, আমার পরীক্ষা আছে, তবুও মানতে চায় না। জোর করে নিয়ে যেতে চায়। আর আমার আব্বা-আম্মাও জোর করেই পাঠাতে চায়। তারাও বলে, বিয়ের পর থেকে আমার আসল থাকার জায়গা শ্বশুর বাড়ি। তারা অসন্তুষ্ট হলে আমার অমঙ্গল হবে।

শুনেছি তোমার স্বামী বিদেশে থাকে। তোমার বাবার বাড়ি থেকে তারা তোমাকে নিয়ে যেতে চান কেন?

সে বিদেশে থাকলেও শ্বশুর বাড়ি তো দেশেই আছে। সেখানে শাশুড়ি আছেন। শ্বশুর বাড়িতে সংসারের কাজ আছে, আমি না থাকলে সংসারের কাজকর্ম কে করবে? ছেলের বৌ থাকতে তো আর বাড়ির কাজ করতে ঝি রাখবে না।

তুমি তো পড়ালেখা করছ। তোমার পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজ করতে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে?

গ্রামের মেয়েদের পড়ালেখা কোনো কাজের কাজ নয়। সংসারের কাজই হলো তাদের আসল কাজ। গ্রামের মেয়েরা পড়ালেখা যতটুকু করে সেটা সংসারের কাজ করার পর। পড়ালেখায় ফাঁকি দিলে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু সংসারের কাজ অসুস্থ হলেও করতে হয়। না করলে বকা তো আছেই, তাছাড়া কেবল স্বামীর নয়, শ্বশুর শাশুড়ির মারও কখনো কখনো সহ্য করতে হয়।

সংসারের কাজ করতে গিয়েই কি মেয়েদের স্কুল কামাই করতে হয়?

আপনি, স্যার, বেগম রোকেয়ার কথা বলেছিলেন। আপনার কথা শুনে আমি চাঁপাদির কাছ থেকে রোকেয়া রচনাবলী এনে পড়েছি। পড়তে পড়তে আমি ভেবেছি, বেগম রোকেয়ার স্বামীর মতো যদি এখনকার মেয়েদের স্বামীরা হতো! যদি এখনকার স্বামীদের এতটুকু মায়া মমতা তাদের স্ত্রীদের জন্য থাকতো! তাহলে মেয়েদের জবিন অত দুর্বিষহ হতো না। আমরা তো স্যার অন্ধকার যুগেই পড়ে আছি।

তুমি তো বেশ ভাবতে পারো!

আমার তো, স্যার, আপাতত একটা ব্যবস্থা আপনারা করে দিলেন। স্বামী বিদেশ থেকে আসার পর আমার কী অবস্থা হবে জানি না। কিন্তু আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এই একটা ঘটনা দিয়া আমি সকল মেয়ের জীবনে কী ঘটে তা ভাবতে পারি। আমি আন্দাজ করতে পারি, আমার মায়ের জীবনে, চাচীর জীবনে, ফুপুর জীবনে কী কী ঘটেছিল। কেন তারা তাদের স্বামীদের সামনে কথা বলতে পারে না। কীভাবে তাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছে, সেটাও বুঝি। ভাবতে পারি, আমার মতো যে মেয়েরা বড় হচ্ছে তাদের জীবনেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে কী ঘটবে, কেমন করে তারা তাদের বন্দীদশায় জীবন কাটাবে। স্যার, আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি বুঝতে পারি, এই দেশের মেয়েরা অভিশাপ নিয়াই জন্মায়, কিন্তু অভিশাপ নিয়া যে জন্মগ্রহণ করে সেটা বুঝতেও পারে না। তারা অনেকটা কোরবানির গরুর মতো, জীবনের পরিণতি কী বুঝতে পারে না।

মানে?

স্যার, কোরবানি সামনে রেখে বাছুরগরুকে খুব আদর করে খৈল, ভুষি, ঘাস খাইয়ে লালনপালন করা হয়। বাছুরগুলো মনের খুশিতে খৈল-ভুষি খেয়ে বড় হতে থাকে। বড় হবার পর সুন্দর করে গোসল করিয়ে মালাটালা দিয়ে সাজিয়ে গরুর মালিক পশুটাকে হাটে নিয়ে যায়। গরুর হাটে গরুটাকে সবাই এর রঙ, দাঁত চলাফেরা দেখতে থাকে। তখন গরুটা মনে করে হাটে সে বেড়াতে এসেছে। সবাই ওকে আদর করছে। তারপর দামদর করে বিক্রি হয়ে গেলে গরুটাকে আরেকজন তার বাড়ি নিয়ে যায়। কোরবানির আগ পর্যন্ত সে বাড়িতেও গরুটি খুব আদর-যত্ন পায়। কোরবানির জন্য যখন চারপা বেঁধে গলায় ছুরি চালানো হয় তখন হয়তো সে বুঝতে পারে কেন এতদিন তাকে আদর দিয়ে পুষেছিল। তখন আর করার কিছু থাকে না। আপনি স্যার, কল্পনা করে দেখুন, ঠিক মিলে যাবে, মেয়েরাও বিয়ের পর এইরকম করেই কোরবানি হয়ে যায়।

তুমি এমন করে ভেবো না। মানুষকে তো বিয়ে করতেই হয়। সংসার পরিবার ছাড়া কি মানুষ জীবন কাটাতে পারে? আর বিয়ে মানেই তো জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। সঠিক সময়ে, পছন্দমতো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে মেয়েদের জীবন কতটা সার্থক হতে পারে সে কথা তো তোমরা বেগম রোকেয়ার জীবন থেকেও জানতে পারছো। বরং তুমি ভাবতে পারোকী করে আমাদের সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে, মেয়েদের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া, এসব বিষয়ে মেয়েদের সচেতন করা যায়।

আমি আর কী করতে পারি? আমার কথা কে শুনবে?

তোমার মতো যাদের বয়স কিংবা যারা তোমার থেকে বয়সে ছোটো তাদের তুমি বোঝাতে পারো।

কীভাবে বোঝাবো, স্যার? এদেশে মেয়েদের কথা কেউ শোনে না, তাদের কথার কোনো দাম নেই। এমন কি মেয়েরাও মেয়েদের কথার কোনো দাম দেয় না, মা হলেও না।

তুমি চাঁপার নিকট থেকে যে বইটি এনেছো সেটি তোমার সমবয়সীদের পড়তে দাও। যে লেখাটি তোমাদের ভালো লাগে সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলো। কথা বললে তোমরা নিজেরাই বুঝতে পারবে কী করলে তোমাদের মঙ্গল হবে।

ক্লাসের বই ছাড়া অন্যকিছু পড়লে মুরব্বীরা বকা দেয়।

বকা দেয় কারণ, তারা মনে করে ক্লাসের বই না পড়ে অন্য বই পড়লে তোমরা পরীক্ষায় খারাপ করবে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করো, দেখবে, তখন আর কেউ বকা দেয় না। মুরব্বীরা তো তোমাদের ভালো চান, তাই না?

আমাদের ভালো চান? আপনি, স্যার, গ্রামের লোকগুলোকে চিনেন না।

আসাদ বুঝতে পারছে, আলেয়া ওর শিক্ষকের কথা মেনে নিতে পারছে না। আলেয়া ওর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলছে। এতটুকুন বয়সে সমাজ আর পরিবার সম্পর্কে ওর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে এর আলোকেই সে কথা বলছে। আসাদের মনে হচ্ছে, আলেয়া এতক্ষণ যা বলেছে যেন ঠিকই বলছে। ওর মূল্যায়নে যেন ভুল নেই। ফেরার আগে সে আলেয়াকে বলল,

মন দিয়ে পড়ালেখা করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে তুমি সামলে নিতে পারবে। তুমি চেষ্টা করো, দেখবে তোমার জয় হবেই।

স্যার, আমার জন্য দোয়া করবেন।

ভালো থেকো। দেখা হবে।

হাঁটতে হাঁটতে আসাদ আলেয়ার কথা ভাবতে থাকে। আলেয়া যেন রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্পের একটা চরিত্র। কিন্তু কোন গল্পের সেটা সে মনে করতে পারে না। আলেয়া ওর সমাজ আর পরিবারে আঁধারের স্বরূপ যে রকম করে দেখছে আসাদ দূর থেকে সেরকম করে সমাজের ভেতরটা দেখতে পায় না। সে গ্রামের সমাজ আর মানুষকে এখনো চিনে উঠতে পারে না। সে গ্রামের অন্ধকারও চেনে না। সে এখনো কেবল শহুরে চোখে প্রকৃতি আর নীরবতা উপভোগ করে। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে তিনি প্রকৃতির অংশ মনে করতেন। গ্রামের প্রকৃতি আর মানুষকে একসঙ্গে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, প্রকৃতির মধ্যে যেমন সুন্দর পাখপাখালী আছে তেমনই বিষাক্ত সরীসৃপও আছে। আসাদ সেই সরীসৃপ এখনো দেখেনি। এই দিকটির ইঙ্গিত করেই হয়তো প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেম আসাদকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে ভাবে, গ্রামের মানুষগুলোকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তাদের চিনতেও হবে। তা ছাড়া ওর লেখায় সত্যমূল্য প্রতিষ্ঠা পাবে না।

২৪

রাতে খুব বৃষ্টি হলেও সকালবেলায় ঝকঝকে রোদ উঠল। আর ঝকঝকে রোদেলা দুপুরে একটা খুনের ঘটনা ঘটল। সমসপাড়া হাটে খুনের ঘটনাটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। নদীর তীরে হাট। সবসময় জমজমাট থাকে। বেপারিরা ধান কিনে নৌকায় চালান দেয়। হঠাৎ খুনের ঘটনায় যারা ধান কিনতে এসেছিল তারাও গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। হাটের দু’তিনটা বড় মুদি দোকানও ঘটনার পর বন্ধ হয়ে গেছে। আর গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়, মানুষ যেন এখন কাঁদতেও ভয় পায়। প্রকৃতিও যেন আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আকাশে একটা বক বা চিলও উড়ছে না। যে বাছুরটি গাভির পেছন পেছন ছুটত সে ছুটছে না, গাভীটিও হাম্বা রবে ডাকছে না। যে শিশুরা নদীতে সাঁতার কাটত তাদেরও তেমন একটা দেখা যায় না।

খুন খারাবি গ্রামে গঞ্জে নতুন নয়। জমিজমা এমন কি সামান্য কথাকাটাকাটিও খুন পর্যন্ত গড়ায়। এখনো পত্রিকা খুললেই চোখে পড়বে, খুন আর চাঁদাবাজির খবর। অবশ্য আসাদ এখন আর নিয়মিত পত্রিকা পড়ে না। পড়তে পায়ও না। ঢাকায় পত্রিকায় কাজ করার সময় সর্বহারাদের দ্বারা খুনের খবর সে পত্রিকায় ছাপিয়েছে। তখন ওর মনে প্রশ্ন জাগত দিনে দুপুরে যারা খুন করে তারা কী করে মেহনতি মানুষের বন্ধু হতে পারে? আর এরকম করে কি কখনো মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? ইতিহাসে যে বিপ্লবের কথা আছে সে তো গণজাগরণ। গণজাগরণের মাধ্যমে সে বিপ্লব সংঘটিত হয় আর তার দ্বারা জনগণের মুক্তি আসে বলে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন। তবু তা কতখানি মুক্তি আনে সে নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক কম নয়। কেউ কেউ বলেন, সেও কেবল ক্ষমতার পালাবদল। ক্ষমতা যে পায় সে বুর্জোয়াই হোক আর প্রলেতারিয়েতই হোক ক্ষমতায় আরোহণের পর সে আর মানুষের কথা মনে রাখে না। কারণ, ক্ষমতা শাসক আর মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে। বিপ্লব কিংবা মানুষের মতামতের ভিত্তিতে─সে যেভাবেই ক্ষমতার পালাবদল হোক না কেন, যারা ক্ষমতা পায় তারা আবার নতুন এক ক্ষমতাবলয় গড়ে তোলে। সাধারণ মানুষের দ্বারা অর্জিত বিপ্লবের ফসল হলেও নতুন শাসন-কাঠামো নতুন শাসকদের জন্য একটি নতুন দুর্গ তৈরী করে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সেই দুর্গে প্রবেশ করার পর জননন্দিত নেতাও মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। ক্ষমতা পাওয়ার পর নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতা ধরে রাখার কথা ভাবে, মানুষের কথা নয়। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দাবার গুটির মতো চারপাশে পাহারাদার বসায়। যে মানুষগুলো নেতাকে ক্ষমতায় বসায় এই পাহারা তাদের থেকে তাকে দূরে রাখার সকল ব্যবস্থাই করে। একারণে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে যে নেতৃত্ব ক্ষমতা পায় সেও সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরে যায়। মানুষের মুক্তির জন্য মানুষ জীবন দেয়, তবু মুক্তি পায় না। আবার যখন নতুন করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক আসে, তখন মানুষের কাছে সে ডাক পৌঁছে নি। আর যাদের কানে ডাক পৌঁছেছিল তারা সে ডাকে সাড়া দেয় নি, বিশ্বাসও করে নি। মানুষ দেখেছিল, যে নেতৃত্বকে বিশ্বাস করে তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ত্রিশলক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে যখন তাদের মুক্তি আসে নি তখন আর সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে মুক্তি সম্ভব নয়। বিপ্লবের ডাক তাই ব্যর্থ হয়েছিল।

আসাদ ভাবে, শ্রেণীশত্রু খতম করার নামে সন্ত্রাস কী ভাবে গ্রাম দখল করে নেয়? মানুষ কেন তাদের প্রতিরোধ করে না? কী করে সন্ত্রাসীরা মিশে থাকে সাধারণ মানুষের মাঝে? যদি মিশে থাকতে না পারত তাহলে তো তাদের এতদিন টিকে থাকার কথা নয়। এত যে সাঁড়াশি অভিযান, এত আয়োজন তবু তো সন্ত্রাস বহাল তবিয়তে টিকে আছে। চেয়ারম্যানের খুন হওয়া শুধু একটা খুন নয় বলে আসাদ করিম মনে করে। সন্ত্রাসীরা যে লোকালয়ে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে তার নিশ্চয় একটা পশ্চাৎপট আছে, প্রেক্ষাপটও থাকার কথা। আসাদ ভাবছিল, কারো সঙ্গে কথা বলতে পারলে কিছুটা হয়তো এ বিষয়ে আন্দাজ করা যেত। কার সঙ্গে কথা বলা যায় সেকথা ভাবতে ভাবতে আর হাঁটতে হাঁটতে সে প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেমের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। আবুল কাসেম দরোজা খুলে দিলেন। তাঁকেও উৎকণ্ঠিত দেখা গেল।

আসুন। মনটা ভালো নেই। ঘটনাটা মানুষকে খুবই আতঙ্কিত করেছে।

কী করে খুন হলো, শুনেছেন কিছু?

লালপতাকার লোক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তুলে নিয়ে সমসপাড়া হাটে প্রকাশ্যেই মোজাম্মেল হককে জবাই করেছে। জবাই করার আগে মোজাম্মেল হকের কাছে জানতে চেয়েছে, এত ধন-সম্পদ করেছিস এখন এগুলোর কী হবে? চেয়ারম্যান নাকি বলেছে, আল্লাহর দোহাই। আমার সবকিছু দিয়ে দিব। আমাকে ছেড়ে দাও। যা চাও তাই দিব। তারা উত্তরে বলেছে, আমরা তো চিঠি দিয়েছিলাম। কিছুই তো দেস নাই। আবার ক্যাম্পে খবর দিয়েছিস। তাহলে তোকে কী করে বাঁচিয়ে রাখি। তোকে তো আর বাঁচানো যায় না, তাই না? বিলের জল আর তল সব নিয়েছিস। মানুষের দাঁড়াবার ঠাঁইও রাখিস নি। এরপর আর কী নিতে বাঁচবি? কিছু বাকী নেই। আর বাঁচবার দরকার নেই।

এই ঘটনা হাটের মানুষ কাছে দাঁড়িয়েই দেখেছে আর সব কথাবার্তাও নাকি টুঁ শব্দটি না করে স্তব্ধ হয়ে শুনেছে। একঘণ্টা পর থানার পুলিশ এসেছিল। কাউকে ধরতে পারে নি। আটদশজনের একটা দল কোথায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কেউ তাদের কাউকে দৌড়াতে দেখল না। কারো মুখে কোনো মুখোশও ছিল না। কেবল গলায় লাল গামছা ছিল। যাওয়ার সময় কী সব শ্লোগান দিয়ে গেছে। লিফলেটও বিলিয়ে গেছে। লিফলেটে সারা দুনিয়ার মজদুরকে এক হতে আহব্বান করা হয়েছে। জ্যৈষ্ঠের দুপুর বেলায় প্রকাশ্য হাটে একটা লোককে খুন করে চলে যেতে পারল!

সমসপাড়া হাট পতিসর থেকে পাঁচ মাইল। একেবারে আত্রাই সীমানার শেষে নদীর তীরে। নদীর ওপারে অন্য থানা আর জেলাও ভিন্ন। তবু খবরটা এখানে এসে পৌঁছাতে দেরী হলো না। এই খবরে এখানকার পথঘাট এমন কি মাঠেও লোকজন নামে না। দু’দিন আগেও পতিসর কাচারি বাড়ির প্রাঙ্গণ সরগরম ছিল। নানান জেলার শ্রমিক এসে জুটেছিল। তারা তাদের মজুরি হিসেবে পাওয়া ধান বস্তায় ভরে কুঠিবাড়ির বারান্দায় জড়ো করে রেখেছিল। একসঙ্গে সকলেরই যাওয়ার কথা। কিন্তু খবরটা পাওয়ামাত্র কারা কোন দিক দিয়ে কীভাবে চলে গেল কেউ যেন দেখতেই পায় নি।

আসাদ ভাবছিল। সে মন্তব্য করল, প্রকাশ্য হাটে কয়েকজন অপরিচিত লোক একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে সকলের সামনে গলাকেটে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে? এতগুলো মানুষের সামনে ঘটনাটা ঘটল কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে এল না!

সর্বহারাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষ জোতদার এবং সর্বহারাদের একই রকমভাবে ঘৃণা করে।

এই এলাকায় সর্বহারাদের এত দাপট কেন?

আপনি খেয়াল করবেন, যেখানে মানুষের মধ্যে বৈষম্য বেশি সেখানেই সর্বহারাদের দাপটও বেশি। বৃহত্তর চলনবিল ফসলের ভান্ডার। বিলের জমি বেশিরভাগই খাস। এই খাস জমি বিলের চারপাশের জোতদারগণই জবর দখল করে আছে। আর বেশির ভাগ মানুষ এখানে ভাগচাষী অথবা ক্ষেতমজুর, তারা পেটভরে খেতে পায় না। এই জমি আইন অনুযায়ী ভূমিহীন চাষীদের পাওয়ার কথা। কিন্তু তারা সেটা পায় না। কেউ বরাদ্দ পেলেও জমির দখল পায় না। ভূমিহীন বর্গাচাষী তাদের অধিকারের কথা জানে। কিন্তু ভয়ে মুখ খোলে না। জোতদাররাই এখানকার দন্ডমুন্ডের মালিক। তাদের ক্ষমতা যে কতখানি তা বলে শেষ করা যাবে না। এমন কি তারা ইচ্ছে করলে বিয়ে না করেও কোনো নারীর পেটে বাচ্চা দিয়ে দিতে পারে। আর কাউকে খুন করে ফেলা তো তাদের জন্য বিলে পাখি মারার মতোই ঘটনা। জোতদার ছাড়া কেউ এলাকার চেয়ারম্যান বা মেম্বার হতে পারে না। এইসব গ্রাম প্রকৃত পক্ষে জোতদারদের শাসনে চলে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও এইসব গ্রাম প্রশাসনের নাগালের বাইরে। রাস্তাঘাট নেই, সেজন্য প্রশাসনের পক্ষে নজরদারি করাও সম্ভব হয় না। অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থানায় খবর দেয়ার পরও লাশ তিনদিন পড়ে থাকে। কখনো কখনো শেয়ালেও খেয়ে ফেলে। আর এসব এলাকায় আলোর অভাব সব দিক থেকেই। রাতের আঁধারে এখানে যেমন শেয়ালেরা শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে তেমনি মানুষের সম্পদ হরণের জন্য বেরিয়ে পড়ে ডাকাতের দল। আমার তো মনে হয়, ডাকাতরাই এখন নতুন নামে, নতুন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই চলনবিল এলাকায় আগেও, সব সময় ডাকাতের উৎপাত ছিল। জমিদারি আমলেও ছিল। প্রমথনাথ বিশীর লেখায়ও আপনি ডাকাতের গল্প পাবেন। বিশীর বাড়ি জুয়ারি গ্রামে, চলনবিলের ধারে, গুরুদাসপুর। তাঁর লেখায় যে ডাকাতচরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, আসলে সেগুলো তাঁর মনের কল্পনা নয়। কিংবদন্তী আর ঐতিহাসিক সূত্র থেকেই বিশী সেগুলো তুলে এনেছেন। যাক, যে কথা বলছিলাম। বৃহত্তর চলনবিল এলাকার জমিদার ছিলেন সব হিন্দু। তারা সকলেই অনুপস্থিত জমিদার ছিলেন। তাদের নায়েব, পেয়াদা যে কী পরিমাণ অন্যায় আর অত্যাচার করত সেকথা ইতিহাসে লেখা আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কেউ শান্তিতে জমিদারি চালাতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সকলেই জমিদারি বিক্রিবাটা করে চলে যেতে বাধ্যই হয়েছিলেন। ডাকাতের ভয়ে জমিদার আর তাদের নায়েব-গোমস্তা আতঙ্কে থাকত। জমিদারদের কেউ কেউ ডাকাতি প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিজেরাও ডাকাতিতে নেমে পড়েছিল। একসময় চলনবিলের চারপাশের এইসব জমিদারি ডাকাত-জোতদারদের জমিদারিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে জমিদারি হাতবদল হতে হতে ডাকাতের সংখ্যা আর জোতদারের সংখ্যা সমান হয়ে যায়। দেশ ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হলে এইসব জোতদার স্বনামে বেনামে এমন কি গরু মহিষের নামেও জমির পর্চা বানিয়ে নেয়। ফলে লাঙল যার জমি তার একথা বলা হলেও যারা নিরীহ কৃষক ছিল তারা জমির মালিকানা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেল। সেই ধারা এখনো বংশ পরম্পরায় রয়ে গেছে। তারপরও কালীগ্রাম-পতিসরের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। এখানকার জমিদারি ঠাকুর স্টেটের এজমালি ছিল। দেবেন্দ্রনাথের সময় পর্যন্ত অবিভক্তই ছিল। তারপর ভাগাভাগি হলে রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে। অংশীদারগণ শিলাইদহের জমিদারি বিক্রি করে দিলেও রবীন্দ্রনাথ পতিসরের জমিদারি বিক্রি করেন নি। রবীন্দ্রনাথ জমিদারিকে কেবল আয়ের উৎস হিসেবে দেখেন নি। তিনি তাঁর লেখার এবং চিন্তার ক্ষেত্র হিসেবেই জমিদারিকে গণ্য করতেন। তাঁর উন্নয়ন ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য এখানে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তা না হলে লোকসানি জমিদারি তিনি রাখবেন-ই বা কেন? খরচ বাদে এখানকার বার্ষিক আয় ছিল মাত্র চার হাজার টাকার মতো। এখানকার মানুষের কাছে থাকার জন্য, আসার জন্যই কবি জমিদারি ধরে রেখেছিলেন। সবসময় তিনি পতিসরের মানুষের কথা ভাবতেন। তিনি কখনো জমিদারি ছেড়ে দেবার কথা ভাবেন নি। কবির মৃত্যুর পরও জমিদারি ছিল। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এখানে আসতেন। মানুষের কথা ভাবতেন। জমিদারি আয় দিয়ে জীবন চালানোর কথা তিনিও ভাবতেন বলে মনে হয় না। জমিদারি অধিগ্রহণের সময় তো রবীন্দ্র জমিদারি পরিত্যক্তই ছিল বলা চলে। আর এ সুযোগে যারা জমিদারের কাছারিতে কাজ করতেন তারাই জমিদারের ফেলে যাওয়া জমির মালিক হয়ে যায়। তারা যেহেতু সব কাগজপত্র সংরক্ষণ করত, তাদের কেউ কেউ নকল পাট্টা তৈরী করে নেয়। পাকিস্তান হয়ে গেলে এভাবে জমিদারের নায়েব গোমস্তা আর পত্তনি তালুকদার জমির মালিক হয়ে যায়। যারা চাষ করত, যাদের হাতে লাঙল ছিল তারা কিছুই পায় নি। যারা জমিদারিতে কাজ করত, লাঠিয়াল হোক আর নায়েব-গোমস্তাই হোক তারা এখনো জমিদারের মতো ভাব দেখায়। এই ভাবটা সাধারণ বর্গাচাষী, খেটেখাওয়া ক্ষেত মজুরের ভালো লাগবে কেন? তারা জমিতে চাষ দেয়, ফসল ফলিয়ে দেয়, ঘরেও তুলে দেয়। তাদের কী কষ্ট হবে না। লোভও তাদের হতেই পারে। এই লোভ থেকেও কেউ কেউ সর্বহারাদের আশ্রয় দিতে পারে।

শুনেছি এখানে বহু আগে থেকেই সর্বহারা ছিল।

বিশাল উত্তর বঙ্গ ছিল হিন্দু জমিদারদের। তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এদেশের কৃষকরা আন্দোলন করেছে। সে আন্দোলন ইংরেজ প্রভুদের সহায়তায় আর লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জমিদাররা দমন করলেও উত্তর বঙ্গের মানুষের চেতনাকে দমন করতে পারেনি। পাকিস্তান হলেও যখন জমিদারই নানা ছলে ভ‚মির মালিক রয়ে গেল তখনও এখানে কৃষক-আন্দোলন হয়েছিল। এখানে এক সময় নকশালবাড়ি আর তেভাগা আন্দোলনেরও প্রভাব পড়েছিল। আপনি ওহিদুর রহমানের কথা শুনে থাকবেন। তিনি অনেক বড় বাম নেতা ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি একজন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাও। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ভ‚মিকা এদেশের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। তিনি এই এলাকায় বামধারার ক্ষেতমজুর আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের ইলামিত্র আর বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ছিলেন তাঁর আদর্শ। তিনি কমিউনিস্ট হয়েও এমপি হয়েছিলেন। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সে সময়ের বাম রাজনীতির রেশ ক্ষীণ স্রোতের মতো বর্গাচাষী আর ক্ষেতমজুর শ্রেণীর মনে এখনো রয়ে গেছে। সে কারণে লাল পতাকার লোকজন সহজে গরীব মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারে বলে আমার ধারণা। আচ্ছা, আসাদ সাহেব, আপনার কি মনে হয় যারা নিজেদের লালপতাকা আর সর্বহারা বলে দাবী করে তাদের আদৌ কোনো আদর্শ আছে?

আমার মনে হয়তাদের আসলে আদর্শ বলে কিছু নেই, অথবা আদর্শ থেকে বিচ্যুত। মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তারা কী বোঝাতে চায় আমি বুঝি না। তারা যদি সমাজতন্ত্রের কথা বলে আমি বলব, সমাজতন্ত্রে বিপ্লব আছে, সেটা মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। মানুষ সঠিক নেতৃত্ব পেলে সমাজ বদলানোর জন্য বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এরা সমাজ বদলাবে কী? এরা তো নিজেরাই একে অন্যকে হত্যা করছে। আবার শোনা যায়, কাউকে খুন করার জন্য ভাড়াটিয়া হয়েও কাজ করছে। হয়তো কখনো এদের আদর্শ ছিল, ভুল নেতৃত্বের অনুসারী হয়ে হয়তো তারা ভুল পথে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারের জীব হয়ে গেছে। আর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতেও পারছে না। অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে থেকে হিংস্র জন্তুর মতো হয়ে গেছে। তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা দিন দিন বাড়ছে। তারা দেশের মেহনতী মানুষের রাজনীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। যারা সাম্যবাদের আদর্শ লালন করেন, মেহনতী মানুষের পক্ষে কথা বলেন, ডানপন্থী রাজনীতির লোকেরা তাদের ঘায়েল করার জন্য এখন তাদের সর্বহারা বলে চিহ্নিত করেন। এমন কি, গণতন্ত্রপন্থীরাও বামপন্থী নেতাদের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করার জন্য তাদেরকে সর্বহারাদের নেতা হিসেবে প্রচার করেন। আর সাধারণ মানুষ সে কথা বিশ্বাসও করে। ফলে, তথাকথিত সর্বহারাদের অপকর্মের কারণে মেহনতী মানুষের রাজনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। সর্বহারারা যে ভ‚মিহীন মানুষের পক্ষের লোক নয়, এটা মানুষ এখন বুঝতে পারছে। তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণাও তাই দিন দিন বাড়ছে। মানুষের ঘৃণার আগুনে একদিন তারা পুড়ে মরবে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব পনরোউপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *