উপন্যাস।। মরুঝর।। মোহিত কামাল।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// এক
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// পর্ব দুই
- উপন্যাস ।। মরুঝড় ।। মোহিত কামাল ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব চার॥
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব নয়
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। মরুঝর।। মোহিত কামাল।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আঠারো
॥ বার ॥
প্রতিদিনের মতো ঘের দেওয়া মরুর সীমানা থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে লতাপাতা, শিকড়বাকড় সংগ্রহ করছিল রুস্তম আর নোমান। কড়া রোদ্দুরে পুড়ে যাওয়া ত্বক এখন সইতে পারছে মরুতাপ, তৃষ্ণাও সইবার শক্তি বেড়েছে উটের মতো। বুকের আগুনের কাছে বাইরের আগুন ম্নান হয়ে গেছে। পোড়ানোর শক্তি কমে গেছে বাইরের রোদ্দুরের। হঠাৎ থমকে গেল দুজনেই। হেলিকপটারের শব্দ পেয়ে একসঙ্গে তাকাল ধু-ধু মরুর উত্তর দিকে। বুঝে গেল উত্তরেই রয়েছে জনপদ। কোনো আশার বাণী কি বয়ে আনছে হেলিকপটার? চটজলদি মাথায় আসা প্রশ্নটি মুখ ফুটে বলেই ফেলল নোমানকে।
‘বড্ডা আশা কইরেন না। বড্ডা আশা কইরলে দুক হাইবেন। আঁর মনে অয় হেলিকপটারের রক্ষীরা খারাপ খবর লই আইছে।’
‘ঠিকই বলেছেন। বড়ো আশা করা ঠিক নয়। সব আশার যেখানে গুড়েবালি, সেখানে আশা না-থাকাই ভালো।’
‘ইয়ান হাছা কথা। আঁর বেগ্গিন মিছা। বুজঝেননি?’
‘বুঝেছি নোমান। জীবন দিয়ে বুঝতে হচ্ছে সব। এখন বলুন, আমাদের কি ডেরায় ফেরা উচিত, নাকি চালিয়ে যাওয়া উচিত নিজেদের কাজ?’
‘আঁর মনে অয় হিরা উচিত। নইলে হেতেরা কুফিয়ার উরদি ঝুলুম চালাইতে হারে। কুফিয়া যে হাডু ভাঙি হরি আছে, হেই অজুহাত হুইনতো ন, যেতাইন লতাপাতা আঁডি জোগাড় অইছে, আইজকা চলি যাইব। চলেন যাই।’
প্রতিটি মুহূর্তে জুলুমের ফলভোগ করছে নিজেরা। অসুস্থ দুজনের ওপর যেন রক্ষীরা ঝাল ঝাড়তে না পারে, তার জন্য দ্রুত গুছিয়ে দুজনই হাঁটা শুরু করল সামনে।
মরুঘেরে ঢোকার পর নতুন একটা পরিবেশ দেখে ঘোর লেগে গেল চোখে। বাস্তবে ঘটছে সব, নাকি স্বপ্ন দেখছে?
নোমানের উদ্দেশে বলল, ‘ঠিক জায়গায় ফিরেছি তো আমরা?’
‘হিয়ানে কোনো সন্দেহ নাই। ঠিক জায়গায় আইছি। ইয়ানই আঙ্গো ঘের। ওই তো আঙ্গো তাঁবুঘর।’
ঘেরের গেট দিয়ে ঢোকার সময় সুসজ্জিত দুজন গার্ড সালাম জানিয়ে সম্মান জানানোর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। দ্রুত ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝল, ঘরেও রয়েছে আরও দুজন গার্ড। কুফিয়ার সঙ্গে কথা বলছে। রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে গার্ড দুজন একসঙ্গে সালাম জানাল রুস্তমের উদ্দেশে।
সালামের জবাব দেওয়ার কথা ভুলে কুফিয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিষয়টা কী ? এত মলিন লাগছে কেন আপনাকে? কোনো দুঃসংবাদ?’
‘আমাদের জন্য দুঃসংবাদ, আপনার জন্য সুসংবাদ।’
‘আপনার দুঃসংবাদ আমার জন্য সুসংবাদ হয় কীভাবে? কয়েদিদের জীবনে কোনো ভালো খবর কি আশা করা যায় এই মরুপ্রান্তরে?’
‘যায়। এই নিন। মহলের ফরমান এসেছে। পড়ুন। আরবি পড়তে পারেন তো ? নাকি আমি পড়ে শোনাব।’
‘পড়তে পারি। বুঝিও এখন।’ বলতে বলতে ফরমানটি হাতে নিয়ে একনিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করল রুস্তম।
মুক্তির সনদ পেয়ে নয়, হেলিকপটারের শব্দ শুনে চট করে মনে আসা ইনটিউশনটা মিলে গেছে দেখে অবাক হলো। নিজের মুক্তির কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে গার্ডদের উদ্দেশে প্রশ্ন করল, ‘আমি এখন মহলের অতিথি, কয়েদি নই। জানেন আপনারা ?’
‘জি। জানি। এও জানি, মহলের ছোটো আম্মি, কলি আম্মিজানকে আপনি বিয়ে করেছেন কিংবা করবেন?’
‘এ কথা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবেন না। ভুল জানার জন্য গর্দান কাটা যেতে পারে আপনাদের।’
রুস্তমের কথা শুনে শক্ত হয়ে গেল গার্ডদের শরীর।
কঠিন স্বরে রুস্তম আবার বলল, ‘ওপরের মহলে জানিয়ে দেন, একা যাব না। আমাকে অতিথির মর্যাদায় নিতে হলে সঙ্গীদেরও নিতে হবে। দুজন অসুস্থ, আর নোমানকে ফেলে একা যেতে পারি না আমি।’
‘আমাদের ওপর নির্দেশ হলো, আপনাকে নিয়ে যাওয়া। বাকি তিনজনকে নয়। আপনার বাড়তি আদেশ রাখার ক্ষমতা নেই আমাদের।’
‘ফিরে গিয়ে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেন। আর কিছু শর্ত আছে। সেগুলোও শুনুন। শর্ত এক. এই মরুকারায় কয়েদির সাজার নামে শ্রমিকের শ্রম শোষণ বন্ধ করতে হবে। শর্ত দুই. এখানকার পরিবেশ উন্নত করে, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা উন্নত করা যায়। রাখাল নিয়োগ করা যেতে পারে। তাদের বেতনভাতাও বাড়াতে হবে। মাঝে মাঝে তারা যেন বেড়ানোর সুযোগ পায়, বিনোদনের সুযোগ পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। শর্ত তিন. যোগাযোগের সহজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বেশিদিন একজনকে এরকম বিচ্ছিন্ন এলাকায় ফেলে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন। মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে শ্রমিক কিংবা রাখালের। কয়েদি হিসেবে পাঠানো যাবে না কাউকে। শর্ত চার. অসুস্থ দুজন ও এই নোমান—এদের সাজা মাফ করা যায় কি না, মূল্যায়ন করে দেখতে হবে। ওরা অমানবিকভাবে যে সাজা পেয়েছে, তার দায়ভার আল্লাহর তরফ থেকে কফিল বা মালিকপক্ষের ওপর বর্তাবে, নিশ্চিত আমি।
আপনারা ফিরে যান। বিশেষ কোনো খাবার নিয়ে এলে দিয়ে যান। আর মহলের আম্মিজানকে জানাবেন, এসব মানবিক শর্তপূরণ না হলে এই মরুপ্রান্তরে মরে পচে-গলে শহিদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত আমি।’
শর্তগুলো শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলল কুফিয়া। ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজে গেল গাল। বাঁহাতে চোখের পানি মুছে বলল, ‘আপনার শর্তগুলো পূরণ হোক বা না হোক, আফসোস নেই। নিজের চারিত্রিক দীনতার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমার চোখের সামনে। চিনতে পেরেছি জীবনের সঠিক পথ। নিশ্চয়ই আপনার মঙ্গল হবে। নিশ্চয়ই মঙ্গল হবে আমাদেরও।’
হেলিকপটার থেকে একটা ব্যাগ নামিয়ে আনল গার্ডরা। তালাবদ্ধ ব্যাগ আর চাবি রুস্তমের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘মহল থেকে পাঠানো হয়েছে আপনার জন্য। এটা গ্রহণ করে বাধিত করুন আমাদের। আপনি সশরীরে না গেলেও ব্যাগটা গ্রহণ করলে বুঝব, আমাদের আহ্বান শুনেছেন। মেনেছেন। শর্তপূরণ হলে ফিরে আসবেন বিদেশি অতিথিশালায়।’
ব্যাগ আর চাবি হাতে নিয়ে গার্ডদের দাবি মেনে নিল রুস্তম। গার্ডরা বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে হেলিকপটারের আওয়াজ ভেসে এলো কানে।
কুফিয়া বলল, ‘ব্যাগটা খুলুন। কী আছে দেখুন।’
চাবিটি কুফিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘আপনি হচ্ছেন বস। আপনিই খুলুন।’
‘লজ্জা দিচ্ছেন কেন ? আল্লাহর লীলা টের পাননি? উটের এক লাথিতে কীভাবে লুলা হয়ে গেলাম। বসগিরি কীভাবে ধূলিসাৎ হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে, টের পাননি?’
‘পেয়েছি। আল্লাহর লীলা বোঝা ভার। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। আবার ফকিরও রাজা হয়ে যেতে পারে। এটা অলীক কল্পনা হলেও জগতে ঘটেছে এমন ঘটনা। ইতিহাস তার সাক্ষী। তাই নিজের চেয়ার নিয়ে বেশি চোটপাট দেখানো ভালো নয়। পাওয়ার পর যে-কোনো মুহূর্তে পদচ্যুত হতে পারে কিংবা চেয়ারচ্যুত হতে পারে যে-কেউ। তবে শুনে রাখুন, বিপদগ্রস্ত আপনার পদচ্যুতি হয়নি। আপনিই আমাদের বস। খুলুন। ব্যাগটা খুলে দেখুন।’
রুস্তমের কথায় জাদু আছে, বুঝতে পারল কুফিয়া। ব্যাগটি খুলে চোখ ঝলমল করে উঠল। প্রথমে ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে তিন লিটারের দুটো মিনারেল ওয়াটারের বোতল, তারপর বেরোল একটা সিলগালা প্যাকেট। বাইরে লেখা খোরমা খেজুর। এরপর বেরোল দুবাইয়ের আমিরদের পোশাকের মতো চোখ ধাঁধানো ড্রেস। লম্বা জোব্বা─ পাজামা, পাঞ্জাবি (তোব), মাথার কাপড় (গোত্রা) ও মাথার চাকতি (তাগিয়া)।
খেজুর দেখে দুবাই-কলির কথা মনে পড়ল। খোরমা খেজুর দিয়ে তাকে আপ্যায়নের নির্দেশ দিয়েছিল কলি। খেজুর খাওয়ার সুযোগ পায়নি তখন। এই মুহূর্তে সবার উদ্দেশে বলল, চলুন খেজুর খেয়ে উদ্বোধন করি শুভদিনের।
উল্লাস বয়ে গেল মরূদ্যানের জীর্ণশীর্ণ ঘরে। খেজুর মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল নবিজির কথা। খোরমা খেজুর খেয়ে রোজা রেখেছেন, কঠোর শ্রম ঢেলেছিলেন এই ধরনের মরুপ্রান্তরে! কেন হতাশ হবে তারা? কেন পারবে না পূর্ণ শ্রম ঢেলে জীবনের শিক্ষা নিতে?
আলোর পরশে নতুন দ্বার খুলে যাওয়ার পর মনে আবার ভাবনার উদয় হলো—কী শক্তি কাজ করেছে নিজের সত্তায়? কীভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন? কীভাবে দাবিদাওয়া পাঠানোর সাহস পেল? নিজের মধ্যেই কি ছিল পুঞ্জীভূত, লুকোনো আরেকটি রুস্তম? সে রুস্তমের সঙ্গে কি নিরীহ রুস্তমের এবারই সাক্ষাৎ ঘটল? নাকি প্রতিটি মানুষের চৈতন্যের আড়ালে লুকোনো থাকে চৈতন্যহীন আরেক সত্তা? সুযোগ পেলেই কি তবে বিস্ফোরণ ঘটে সেই গোপন শক্তির? উত্তর খুঁজে পেল না। নিজেকেই চিনতে পারল না রুস্তম। মনে হচ্ছে এই রুস্তম সে-ই রুস্তম নয়। রোদে পোড়া, অবিচারের দাহ বুকে নিয়ে কি তবে ভয়ংকর কোনো রুস্তমে বদলে গেছে সে ? উত্তর খুঁজে না পেলেও দিশেহারা হলো না। যা ঘটবে ঘটুক। যে-কোনো পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো মনে মনে।
কুফিয়া বলল, ‘কী ভাবছেন ? মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে নেই আপনি!’
‘হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। সবার মধ্যে থেকেও নেই আমি।’
‘কোথায় আছেন তবে?’
‘আমার মধ্যে আছি আমি। ঘুরপাক খাচ্ছি আপন কেন্দ্রে। ঘুরে ঘুরে দেখছি—বালুচর থেকে রওনা দিয়ে পড়ে আছি দুর্গম বালুচরেই, এই মরূদ্যানে।’