স্বর ভাঙার গান: মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া।। মামুন রশীদ

কবি মাত্রেই শব্দকে নিজের ভেতরে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। শব্দের মালা গেঁথে কবিতা ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টায় কে কতটা সফল, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। সফলতা-বিফলতা নিয়ে সমকালীন বন্ধুদের মধ্যে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু সেই বিতর্কের অর্থ এই নয় যে, তা সর্বজনীন। তাই ধ্রুব সত্য। শিল্পের মতো নাজুক বিষয় নিয়ে বির্তক সম্ভব হলেও, ধ্রুব সত্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। শিল্প বিচারের চেয়ে তাই উপভোগের বলেই মনে হয় আমার। সেই উপভোগের জায়গা থেকেই কবিতাপাঠ। এক্ষেত্রে ভালোলাগারই প্রাধান্য। উপভোগের ক্ষেত্রে ভালোলাগারও বিচার-বিশ্লেষণ চলে না। কারণ, প্রাথমিক ভালোলাগার ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণের চেয়ে মন আমার চোখের তৃপ্তিকেই গুরুত্ব দেয়। শিল্পের ক্ষেত্রে, বিশেষত কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে যেহেতু দেখার চেয়ে মনের ভালোলাগা, মুগ্ধতা বেশি কাজ করে, তাই সেখানেও বিচার করি না, তুলনা করি না। কেন ভালো লাগালো, তার উত্তর খোঁজার চেয়ে ভালো লাগছে এই অনুভূতিই আমাকে তাড়িত করে। কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে সেই ভালোলাগাকেই আমি প্রণাম করি, আহ্বান করি। কারণ, মন যেখানে মুগ্ধ হতে পারে, যে পাঠের মধ্য দিয়ে রস গ্রহণ করতে পারে, সেখানে কেন কারণ অনুসন্ধান করতে যাবো? বিচারের দায়িত্ব মহাকালের। সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে কাঁধের বোঝা বাড়াতেও রাজি নই, বলেই সমালোচনায় আগ্রহ নেই। অদ্বৈত মারুত, সময়ের বিচারে একবিংশ শতকের প্রথম দশকের কবি। কবি, হ্যাঁ, কবিই বলি। এটাই সহজ সম্বোধন। যার ঝুলিতে ইতোমধ্যে দুইটি কাব্যগ্রন্থ জমা হয়েছে, তাকে কবি সম্বোধনে দ্বিধাও নেই।
প্রথম দশকের শুরু থেকেই নিজেকে কবিতা মাধ্যমে সচল রেখেছে মারুত। সেই সচল রাখার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত নিজেকে লেখার টেবিলে ধরেও রেখেছে, যার প্রমাণ তার দুইটি কবিতার বই। যদি সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে আমাদের সামনে বিচার্য মারুত দীর্ঘ দেড় দশক ধরে কি লিখেছে? সেগুলোর শিল্পমূল্য কতোটুকু? কালের বিচারে তার স্থান কোথায়? সামালোচনার ক্ষেত্রে এসবই তো বিচার্য। কিন্তু সমালোচকের দৃষ্টির পরিবর্তে আমি মুগ্ধতার দিকেই দৃষ্টি দিতে আগ্রহী। এই আগ্রহ আমার সীমাবদ্ধতা থেকেই। কারণ, শিল্প বিচারের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হয়, যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে তাকে তুলাদণ্ডে ফেলে পরিমাপ করতে হয়, শিল্পের মতো এতো নাজুক এবং অনুভূতিশীল বিষয়ের ক্ষেত্রে তাকে আমার অসম্ভবই মনে হয়। যে মানদণ্ড যে বিচারের ভার মহাকালের হাতে, তাকে কেন নিজের হাতে নিতে ক্ষতবিক্ষত করতে যাবো? তাই ভালোলাগার দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি কবিতার পাঠক। আর পাঠের সময়ে আমার মন মুুগ্ধই হতে চায়। অন্য কিছু নয়। এখন সোজা কথায় একটানে যদি মারুতের কবিতার ভ‚বনে চলে আসি, তাহলে প্রথম প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে, অদ্বৈত মারুতের লেখা কি ভালোলাগে? টানে? পাঠের আগ্রহ তৈরি করে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। একজন লেখকের সব লেখা পাঠককে টানবে তা যেমন অসম্ভব, তেমনি সব লেখাই ভালোলাগা অনুভূতি নিয়ে আসবে, তাও সত্যি নয়। একইসঙ্গে সব লেখাই পাঠের আগ্রহ তৈরি করবে, এই বাক্যেও সমর্থন দেয়া সম্ভব নয়। তবে অদ্বৈত মারুতের অনেক লেখাতেই এই বাক্যগুলোর সমর্থন আছে কিনা, তা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আর সেই মিলিয়ে দেখার কাজটিই আমার মন করেছে, তার কবিতাপাঠের সময়ে। মারুতের প্রথম কবিতার বইটিও পাঠের সুযোগ হয়েছিল, সে ধারাবাহিকতায়ই দ্বিতীয় বইটি পাঠের সুযোগ। কৌতূহলী পাঠকের আগ্রহ থেকেই আমি চেষ্টা করেছি কবিতাগুলোর পাঠের। অদ্বৈত মারুত যখন লেখেন-
‘প্রতিদিন বাড়ি ফেরার আগে দোকান হয়ে যাই। টুকটাক কিছু কিনি। কাউকে ফোন দেওয়ার ভান করে দেখে নিই পকেটের সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপরই খুঁজতে থাকি অসহ্য বেদনাবাহন!
প্রতিদিন নতুন কিছু খুঁজি- নতুন গাড়ি, নতুন বাড়ি; নতুন মানুষের বেষ্টনে গুঁজে রাখা মোবাইলটাও দেখে নিই কতটা দামি।
বাড়ি ফেরার পথে প্রতিদিন নতুন কিছু দেখি; নিয়ন আলোয় ভেজা শুকনো পাতার মতো বিচ্ছিন্ন কিছু…
ঘরে ফিরে শুধু তোমাকেই বন্ধু মনে হয়, আপন মনে হয়! ’
(বাড়ি ফেরার পর)
তখন ভালোলাগার আবেগ মনে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতার আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত তার গদ্যাংশ নির্মাণের দিকেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। এক্ষেত্রে কবিতাটি যেহেতু গদ্যেই লেখা, তার অতিরিক্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ছে না। বরং সহজ এবং প্রচলিত শব্দের ভেতরে দিয়ে উঠে আসা গল্পের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অনুভূতি। এখানে আবেগ রয়েছে, যুক্তি রয়েছে, দৈনন্দিনতা রয়েছে, সেইসঙ্গে রয়েছে কবিতাও। সবারই চেষ্টা থাকে লেখার ভেতরে নিজেকে নিজের অনুভূতিকে ধরে রাখার। আর সেই অনুভূতি যেন অন্যের মাঝেও সঞ্চারিত হয়, সে চেষ্টাও থাকে। কারণ লেখার ভেতর দিয়ে লেখকের অনুভূতি যখন অন্যের মাঝে সঞ্চারিত হবে তখনই সেই লেখাটি পাঠকের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। এই চেষ্টায় যিনি যতটা সফল, তিনি ততটাই সার্থক। আর তাই অন্তর্গত বেদনার সঙ্গে মিলিয়েই কবি তার চেনা দৃশ্য, চেনা পরিবেশ করে তোলেন অন্য এক জগৎ, যা একইসঙ্গে দৃশ্যমান এবং অদৃৃশ্য। আর এই দুইয়ের মিলনে যে রহস্যময়তা, তাই ঘোর তৈরি করে পাঠকের সামনে। যাতে করে পরিচিত দৃশ্যাবলী হয়ে উঠতে থাকে অদ্ভুত এবং স্বপ্নময়। যাতে করে ভালোলাগা তৈরি হয় মনের ভেতরে। চেনা শব্দরাই ভীষণ অচেনা হয়ে ওঠে। অদ্বৈত মারুতেরও চেষ্টা এখানেই। একইসঙ্গে আরো একটি কথা এই অবসরে বলে রাখা ভালো, ওর সময়ের কবিদের সাথে মারুতের পার্থক্য তাও খুঁজতে আমি যাইনি। তবে মারুত সময় ধরে রাখতে চেয়েছে। সময়ের ভেতর থেকে উঠে এসে দেখিয়ে দিতে চেয়েছে- ওর নিজস্ব স্বর। এক্ষেত্রে কবিতা নির্মাণের চেয়ে হয়ে ওঠার জন্য যে শ্রম তাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। শব্দ নিজের মতো করে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই চাওয়ার কারণ আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন। আমরা আধুনিক হয়ে উঠছি। কিন্তু আমরা যারা আজ আধুনিক হয়ে ওঠার সংগ্রাম করছি, তাদের সবারই শেকড় গ্রামে। এখনো আমাদের গায়ে কাদামাটির গন্ধ। আমরা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও মাঝরাতে এখনো ঝিঁঝিপোকা আমাদের ডাকে। পাটক্ষেতের শুয়োপোকার কিলবিল করে চলে যাবার দৃশ্য আমাদের পোড়ায়। বুকের মধ্যে ফেলে আসার নদীর জল তড়পায়। ফলে অদ্বৈত মারুতের শব্দরা উঠে আসে সোঁদাগন্ধ মাখা মাটি থেকে। সেখানে পাটশোলার বেড়া, বেনোজল, বাস্তুভিটার মতো ফেলে আসা জীবনের গল্প যেমন ভিড় করে, তেমনিভাবে মোবাইল, শ্যাম্পু, নিয়ন আলো, ট্যাপের মতো আধুনিকতার অনুষঙ্গমাখা শব্দরাও উঁকি মারে।
অসংখ্য কবিতা অথবা কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে এখানে শব্দসংখ্যা ভারি করতে চাই না। হাত ধরে দেখিয়ে দেবারও কিছু নেই। আর সে চেষ্টা যে আমার নয়, তাও শুরুতেই স্বীকার করেছি। ‘স্বর ভাঙার গান’ বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, মারুত চেষ্টা করেছে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দিতে। সেই চেষ্টা কতোটা সফল তা বিচারের ভার পাঠককেই নিতে হবে। আমি শুধু সূত্র ধরিয়ে দিতে চেয়েছি, আমার তাৎক্ষণিক অনুভূতির কথা, প্রথম পাঠের কথা বলতে চেয়েছি, জিজ্ঞাসু এবং আগ্রহী পাঠককে এখন নিজে থেকেই খুঁজতে হবে রসের ভাণ্ডার।
স্বর ভাঙার গান ।। অদ্বৈত মারুত ।। প্রকাশক : দেশ পাবলিকেশন্স ।। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ।। প্রচ্ছদ : দেওয়ান আতিকুর রহমান ।। মূল্য : ১২০ টাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *