উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব বারো
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// এক
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// পর্ব দুই
- উপন্যাস ।। মরুঝড় ।। মোহিত কামাল ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব চার॥
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব নয়
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। মরুঝর।। মোহিত কামাল।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আঠারো
॥ আট ॥
বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রুস্তমের মনে হলো মরুভূমিতে আছে সে। দূরে দেখা যাচ্ছে ঢেউখেলানো পাহাড়। মরুতে পাহাড় এলো কোত্থেকে? মনে প্রশ্ন আসার সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল পাহাড়চূড়া থেকে ধস নামা বালির ঢালের দিকে। ভোরের কচিরোদ আছড়ে পড়ছে ঢালে। চিকচিক করছে বালি। সূর্যের নরম আলো দেখে বোঝা গেল ভোরের সূচনা হয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম চিনতে পারল রুস্তম। ঘর থেকে বেরোনো দরকার। দরজা খুঁজতেই চোখ গেল কাঠের পাটাতনের মতো দরজার দিকে। ঘরের মধ্যে কোমরসমান উঁচু কাঠের মাচায় শুয়ে আছে আরও কয়েকজন! ওরা কারা? এখানে এলো কীভাবে? প্রশ্নভরা চোখে বিস্ময় নিয়ে একবার তাকাল বেঘোরে ঘুমোতে থাকা মুখগুলোর দিকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বিবর্ণ মুখ। মলিন পোশাক। এদের দুবাইয়ের লোক বলে মনে হলো না। ভিনদেশের মানুষের একটা ছোটো দলকে আলু-পটোলের স্তূপের মতো জড়ো করে রাখা হয়েছে গুদামঘরে। ভেতর থেকে দরজায় হুক লাগানোর ব্যবস্থা নেই। মুখোমুখি লেগে আছে দরজার ভারী দুটি পাটাতন। তবে কি বাইরে থেকে লাগানো রয়েছে হুক? ঘর তালাবদ্ধ?
দরজায় হাত দিয়ে একবার নিজের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করল। অনুভূতিশূন্য দেহ। ডান হাত রাখল বাঁহাতের ওপর। চিমটি দিলো। ব্যথা টের পেয়ে বুঝল, দুঃস্বপ্ন দেখছে না সে। জেগেই আছে। সাহস জাগল মনে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে দরজায় হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল পাটাতন! এ কি! সিসিম ফাঁকের মতো কাণ্ড ঘটছে কেন! জাদুর দেশে কি চলে এসেছে সে? পা বাড়াল সামনে। তলপেটে চাপবোধ করছে। বাথরুমে যাওয়া দরকার। বাইরে এসে চোখ কপালে উঠে গেল। বিস্ময় নিয়ে দেখল, চারপাশের গাছগাছাল্লি—বড়ো-ছোটো খেজুরগাছের মধ্যে রয়েছে নাম-না-জানা কয়েকটি অচেনা গাছ। চারপাশে বালির পাহাড়। পাহাড়ের ঢালের কেন্দ্রে সমতল এলাকায় প্রকৃতির বিস্ময়কর রূপ দেখে রুস্তমের পোড়া মনেও জেগে উঠল সবুজ রং।
বিস্তীর্ণ এলাকা ঘের দেওয়া। কাঠের দেয়ালের ভেতরেই সিমেন্টের পিলারে কাঁটাতার ঘেরা একটি অংশে রয়েছে নারী উটের দল। এটা কি মরূদ্যান? বালিময় অনুর্বর ভূমিতে কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে মরুঘাস, লতাগুল্ম, নাম-না-জানা ছোটো ছোটো গাছাগাছালি। ঘের দেওয়া অংশে ডান পাশে রয়েছে দুম্বার দল। একটু পরে আরেকটি জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছে ছাগল। মরুতে এভাবে উট, ছাগল কিংবা দুম্বার চাষ করে দুবাইয়ের বিত্তশালীরা। জনমানবশূন্য এসব এলাকায় খামারবাড়ির মতো মরুবাড়িতে কাজ করে সহজলভ্য বিদেশি শ্রমিকরা। যারা ছোটোখাটো অপরাধ করে, শাস্তিস্বরূপ তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় এরকম মানববর্জিত বিচ্ছিন্ন মরুদ্বীপে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে ছোটো একটা ঘর দেখল পেছনের দিকে। বুঝল, এটা বাথরুম। দুর্গম মরুতে যাযাবর উপজাতিদের থাকার জায়গার মতো ব্যবস্থা দেখে হতাশ হলেও ভেঙে পড়ল না রুস্তম। বাথরুমে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে বেরোনোর সময় দেখল, গিরগিটির মতো একটা প্রাণী ঝুপ করে লাফ দিয়ে ছুটে গেল বালির দিকে। মনে পড়ে গেল জনমানববিচ্ছিন্ন মরূদ্যানে উট ছাড়াও নির্বিঘ্নে বাস করে অন্যান্য জীবজন্তু। বাস করে সাপ, গিরগিটি, শেয়াল, অ্যাড্রেক্স অ্যান্টিলোপ, উটপাখি, গাজলা হরিণ। ছাগল-ভেড়া তো আছেই। এ ধরনের দুর্গম অঞ্চলের পানির উৎস হচ্ছে মরূদ্যান ও কূপ। বাথরুমের বাইরে পানির উৎস চোখে পড়ল না।
কীভাবে সে এখানে এলো, বিস্ময়ের ঘোরে ডুবে থাকার কারণে ভাবার সময় পায়নি। দেশের কথাও মনে আসেনি এতক্ষণ। ধীরে ধীরে চাপা পড়া আবেগের মুক্তি ঘটতে থাকল। আর মনে পড়তে লাগল মায়ের কথা। নববধূ কলির মুখও একঝলক ভেসে উঠল। তবে কি প্রাণে বেঁচে গেছে সে? বড়ো কোনো সাজার পরিবর্তে কি ছোটো শাস্তি দেওয়া হয়েছে? জান ফিরে পেয়ে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল। আর ভাবল, অবিচার করা হয়েছে তার ওপর। নিশ্চয়ই একদিন মুক্তি ঘটবে তার। দৃপ্তপায়ে এগিয়ে যেতে লাগল বালিপাহাড়ের ঢালের দিকে।
না। এগোনো গেল না। সামনে এগোতে হলে কাঠের দেয়াল পেরোতে হবে। দেয়ালের গেট কোন দিকে বুঝতে পারল না রুস্তম। আচমকা হোঁচট খেলো সে। ওপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। নিচের দিকে খেয়াল করেনি। পায়ে বেঁধেছে মরুলতা। হাঁটু গেড়ে বসে লতাগুল্ম টেনে তোলার চেষ্টা করল। ভেবেছিল, বালির ওপর লতাগুলো ভাসমান। আসলে তা নয়। এসব লতার চিকন সুতোর মতো শিকড় রয়েছে বালির গভীরে। টেনে তোলা সম্ভব হলো না। দেহের শক্তি কি নিঃশেষ হয়ে গেছে তার? শিকড় উপড়ানো যাচ্ছে না কেন? উপড়াতে না পেরে লতাগুল্মের সবুজ পাতায় হাত বোলাল। কচি সবুজ রং পেল কীভাবে পাতাগুলো? তবে কি বাতাস থেকেই পানি সংগ্রহ করে মরুলতা? চিকন শিকড় কি বালির স্তর ভেদ করে আরও নিচে চলে গেছে ? গভীরে পানির ঠিকানায়? দুর্গম মরুর বুকে মরুলতার বেঁচে থাকার সংগ্রাম দেখে মুগ্ধ হলো রুস্তম। হঠাৎ মনে হলো মরুলতার মতো তার নববধূ কলি জড়িয়ে রেখেছে তাকে। কলির অস্তিত্ব টের পেল দেহের কোষে কোষে। সে যেন বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা জানান দিয়ে গেল। মনে শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কর্মক্লান্ত হলে বউকে স্মরণ করার কথা বলেছিল কলি। শ্রমে নয়, ক্লান্ত হয়েছে নির্যাতনে। মানসিক নিপীড়নের কারণেই হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। খাবার না পেয়েও ক্লান্ত হতে পারে দেহ। কতদিন খাওয়া জোটেনি মনে করতে পারছে না সে। খাবারের চেয়েও বড়ো কষ্ট মায়ামমতার তৃষ্ণা জেগে আছে মনে। নববধূর কথা ভেবে আবার জোর ফিরে পেল মনে। মনে পড়ে গেল দুবাই-কলির শেষ চিৎকারও। সে বলছিল, ‘উনার পাসপোর্ট দেখুন। পাসপোর্টে স্পাউসের নাম থাকতে পারে। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য পাসপোর্ট দেখুন, আম্মিজান। উনি মুসলমান।’
কী সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কথা বলেছিল দুবাই-কলি! পাসপোর্ট দেখার কথা এমন আকুল হয়ে বলছিল কেন? বাংলাদেশের ছেলেটি বিবাহিত কি না যাচাই করতে কেন বলেছিল আম্মিজানের উদ্দেশে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগছে রুস্তমের মনে। উত্তরগুলো গোছাতে পারছে না। আবার মনে পড়ল, মহলের আম্মিজানের প্রশ্নটা: ‘আপনার বউয়ের নাম কী?’ উত্তরে বলেছিল ‘কলি’। স্মরণ করতে পারছে রুস্তম। ‘কলি’ নাম শুনে চিৎকার দিয়েই আবারও প্রশ্ন করেছিলেন : ‘কী নাম?’ উত্তর শুনেই চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন আম্মিজান। তারপরের ঘটনা স্মরণ করতে চাচ্ছে না। আকস্মিক প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যে সংযোগ খুঁজে পেল এই মুহূর্তে—নিশ্চয় নামবিভ্রাটের কারণে ভুল বুঝেছেন আম্মিজান। বউয়ের নাম ‘কলি’ বলাতেই কি আম্মিজান ধরে নিয়েছিলেন দুবাই-কলির কথা? মনোজগতে মোচড় দিয়ে ওঠা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল রুস্তম। হাহাকার করে উঠল পুরো সত্তা। দুবাই-কলির আরেকটি চিৎকারধ্বনিও কানে বাজতে লাগল: ‘আম্মিজান! নিশ্চয়ই বাংলাদেশি এই ভদ্রলোকের মাথায় গোলযোগ দেখা দিয়েছে। উনি একজন দক্ষ ও সৎ শ্রমিক। উনার ওপর কোনো অবিচার যেন না হয়।’
কথাগুলো মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুবাই-কলির প্রতি কৃতজ্ঞতায় গলে গেল মন।
মনে পড়ল আম্মিজানের আরেকটি প্রশ্ন, ‘বিয়ে করেছেন আপনি ?’
উত্তরে বলেছিল ‘জি’। তাৎক্ষণিক দেখেছিল দুবাই-কলির উজ্জ্বল মুখের আলো নিভে যেতে। কী কারণে? মায়ার কোনো বীজ কি রোপিত হয়ে গিয়েছিল ওর কচিমনে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজল না রুস্তম।
প্রশ্নটি ধারাবাহিকভাবে নতুন জিজ্ঞাসার শিকড় গেড়ে বসল বুকে। তার স্ত্রীর মনেও কি কোনো মায়ার শিকড় গেড়ে বসছে কচিবালক শৌর্যকে ঘিরে? জীবনের এক চিন্তার সূত্র ধরে কেন চলে আসে আরেক চিন্তা? মনের দাবানল চাপা দিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করল রুস্তম। টের পেল এত সকালবেলাতেই বাড়ছে তাপমাত্রা। দিন যত এগোবে, তাপ আরও বাড়বে। মাত্রাতিরিক্তি এই তাপ কি সহ্য করার শক্তি আছে দেহে? মনের ভেতরে চলতে থাকা ভাবনাগুলো হঠাৎ থমকে গেল। পাথরের মতো কী যেন ঠেকেছে পায়ে। হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে হাতে বালি সরিয়ে অবাক হয়ে দেখল একটা কালো পাথর। বালুর সমুদ্রে পাথরও থাকে? পাথরের চারপাশের বালিগুলো অন্য বালির মতো নয়। এই বালিতে কী মিশে আছে? শুনেছিল তামা, লোহা, ফসফেট ইত্যাদি অনেক খনিজ পদার্থ রয়েছে মরুর বালুতে। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলের মানুষ বিশ্বের ধনী জাতি হিসেবে পরিচিত হলেও একসময় এসব অঞ্চল ছিল যাযাবর অধ্যুষিত। তাদের পূর্বপুরুষরা জীবনসংগ্রামে জর্জরিত ছিল। আর উত্তরসূরিরা তেলের জোয়ারে হয়েছে ধনবান। তবু কি ধনবান হয়েছে তাদের মন? নাকি যাযাবর জীবনের শিকড়েই আটকে আছে তারা? মাথায় এসব প্রশ্ন নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর পর টের পেল জিহ্বা শুকিয়ে গেছে তার। তৃষ্ণা মেটাতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে পানি? পেটেও টের পাচ্ছে ক্ষুধা।
বেঁচে থাকতে হলে পানির প্রয়োজন। খাবারের প্রয়োজন। কী ব্যবস্থা আছে এখানে? পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে জেলখানা মনে না হলেও নির্দয় মরুজেলের গল্প শুনেছে এর আগে। বিস্তৃত মরু থেকে হেঁটে পালানোর পথ নেই। উটে চড়ে পালানো যেতে পারে। কোন দিকে পালাবে? উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম কোন দিকে যাবে সে? আর ভাবতে চাইল না রুস্তম। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল কাঠের ঘরের দিকে। ঘরে জলখাবার থাকতে পারে। কয়েকজন আছে ভেতরে। ওরা কারা? তার মতোই কি সবাই আসামি? নাকি মরুর উটপালক? ভেড়া আর ছাগলের দলও যেহেতু রয়েছে, রাখালও হতে পারে তারা। ইতিবাচক চিন্তার পরও কাটছে না অনিশ্চয়তা। চারপাশে আছে জীবনের চিহ্ন। অনিশ্চয়তার মধ্যেও বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজে পেল। এই প্রেরণার সঙ্গে স্মরণ করল নবিজির কথা। তিনিও তো মরুর বুকে চরিয়েছেন ভেড়ার পাল। সেই মরুতেই তাকেও হয়তো চরাতে হবে ভেড়া-ছাগল। দোহন করতে হবে উটের দুধ। তৃষ্ণায় কাতর মনে খেলে গেল আলোর ঝলক। নির্জীব হতে থাকা দেহেও জেগে উঠল ভিন্নরকম তেজ। মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে রইল আকাশপানে।
‘কী ভাই, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছেন?’
প্রশ্ন শুনে চমকে পেছনে তাকাল রুস্তম।
বোঝার চেষ্টা করল লোকটি কোথাকার? এ লোক দুবাইয়ের নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিত রুস্তম। আরবি ভাষায় কথা বললেও কথার টানে মনে হলো ভারতীয়। পাকিস্তানিও হতে পারে। ফিলিপাইন কিংবা ইন্দোনেশিয়ার কি না, তাও অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। রুস্তম জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল, ‘আমি কখন এসেছি এখানে? কীভাবে এসেছি? জানেন আপনি?’
‘আরও ঘণ্টাখানেক পর টের পাবেন সব।’
‘কেন? আপনি কী জানেন, বলুন না? একঘণ্টা তো অনেক সময়।’
‘একঘণ্টা মানে অনেক সময়? আপনি বলছেন এ কথা?’
‘হ্যাঁ, বললাম।’
‘আপনি বললে তো হবে না। সময়জ্ঞান উড়িয়ে দিতে হবে মাথা থেকে। বেঁচে থাকার কথা ভাবতে হবে। একঘণ্টাকে অনেক সময় ভাবলে বাঁচার জোর কমে যাবে। ভাবতে হবে এক বছর হচ্ছে একঘণ্টার সমান। এভাবে ভাবলে অনির্দিষ্টকাল বেঁচে থাকার শক্তি পাবেন এখানে।’
কে এই ছেলে? ঢালাও প্রশ্ন করার সাহস পেল না। কী প্রশ্নে কী উত্তর বেরোয়, ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল। বেঁচে থাকার প্রশ্নই যেখানে গুরুত্বপূর্ণ, আবেগ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। তবু দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না আবেগ। নববধূর উদ্দেশে কল্পনার পাখা উড়িয়ে বলল, চাঁদেই থাকো তুমি। চাঁদ উঠলে তোমাকে দেখব। দূর আকাশ থেকে পাব জোছনার পরশ। সেই পরশ থেকে খুঁজে নেব তোমার ছোঁয়া, চাঁদেই থাকো কলি! চাঁদ গলা আলোয় স্নান করে নেব আমি।
চোখ বেয়ে কি জল গড়িয়ে পড়ছে? ভেজা লাগছে কেন চোখের পাতা?
ছেলেটি বলল, ‘চোখের পানি মুছে ফেলুন। ঝলসানো রোদের তাপ থেকে কীভাবে বাঁচা যাবে, সেই কথা ভাবুন।’
‘এ কথা বলছেন কেন? আপনি কি এই ফার্মের কেয়ারটেকার?’
‘কেয়ারটেকার ভাবতে পারলে ভালো হতো। ভদ্র শব্দের আড়ালে লুকোনো যেত নিজের কষ্ট। কেয়ারটেকার ভাবতে পারছি না। নিজেকে চাকর ভাবতে পারলেও চলত। চাকরও ভাবার সুযোগ নেই!’
‘তবে? কে আপনি? কী নাম? আপনার দেশ কোথায়? কীভাবে এলেন এই মরুতে?’
‘এই মরুজেলের কয়েদি আমি। আপনিও কয়েদি হয়ে এসেছেন। আমার আর আপনার মধ্যে পার্থক্য নেই। দুজনের পদবি এখানে একই। আমার বাড়ি ইন্দোনেশিয়ায়, আমার নাম কুফিয়া। আর আপনার নাম রুস্তম। বাংলাদেশের, তাই না?’
‘আমার নাম, দেশ জানলেন কীভাবে, কুফিয়া?’
‘বয়সে হয়তো সমানই হব আমরা। তবে এই মরুকারাগারে আমার জুনিয়র আপনি। আমি সিনিয়র। সিনিয়রদের অনেক কিছু জানতে হয়। আমার নিয়ন্ত্রণে আপনি থাকবেন জুনিয়র হিসেবে। আমাকে বসও ভাবতে পারেন। আমার প্রশংসায় কমতে পারে আপনার সাজার মেয়াদ। আবার যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য কমতে পারে আমার সাজার মেয়াদও। তাই কখনো চাইব না, এখানকার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন আপনি।’
‘ওঃ! তাহলে কি প্রাণে বেঁচে গেছি আমি?’
‘হ্যাঁ। বেঁচে গেছেন। সেজন্যই তো এখন কথা বলতে পারছেন আমার সঙ্গে।’
‘নিশ্চিত আপনি? বেঁচে গেছি? শিরছেদ ঘটবে না আমার?’
‘এক প্রশ্ন বারবার করছেন কেন? আপনি কি হত্যা করেছেন কাউকে? বা অবৈধ সম্পর্ক করেছেন কোনো নারীর সঙ্গে?’
‘না। করিনি। তবে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা হয়েছে আমার ওপর।’
‘হত্যা করেননি। জেনা করেননি। তো শিরছেদের কথা ভাবছেন কেন? এ দেশে কিসাস প্রথা চালু রয়েছে। হত্যার বদলে হত্যা। অথবা ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার আইনও রয়েছে। লঘুতর দোষী মনে করে আপনাকে হালকা সাজা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মরুকারাবাসে। বুঝতে পারেননি এখনো?’
নিষ্পলক কুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রুস্তম। জবাব দিলো না।
কুফিয়া আবার বলল, ‘প্রস্তুতি হিসেবে সকালের জলখাবার খেয়ে নিন। ধাপে ধাপে কাজ শুরু করতে হবে। উটের পরিচর্যা, ছাগল-ভেড়ার দেখভাল করতে হবে আপনাকে। আমাকেও। পরিচর্যায় গাফিলতি হলে আমার জন্য তো শাস্তি বরাদ্দ আছেই, আপনিও রেহাই পাবেন না।
‘শির রক্ষা পাওয়ার কথা শুনে পরানে পানি টের পেলেও মরুকারাবাসের কথা শোনার পর বুক ভেঙে কান্না এলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না—পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা ছাড়া গতি নেই। মানিয়ে হয়তো চলা যাবে কিন্তু দেশের সঙ্গে কি যোগাযোগ করা যাবে না ? মনে জেগে ওঠা প্রশ্নটি মুখ ফুটে বলেই ফেলল রুস্তম।
প্রশ্ন শুনে হো-হো করে হেসে উঠল কুফিয়া।
রুস্তম প্রশ্ন করল, ‘হাসছেন কেন?’
কিছুক্ষণ থেমে কুফিয়া বলল, ‘শোনেন রুস্তম, এটা হাসি নয়। হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে কান্না। রোজ একবার করে কাঁদতাম বাড়ির স্বজনদের জন্য। তারপর তৈরি করতাম কল্পনার উড়োজাহাজ। সেই জাহাজে চড়ে চলে যেতাম নিজ দেশে। মেঘ আমাকে থামাতে পারত না, ঝড়ও না। কল্পনায় প্রবল বৃষ্টিপাতও উপেক্ষা করে উড়াল দিয়ে চলে যেতাম দেশের মাটিতে। সবার সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসতাম। এখন বালি কামড়ে পড়ে থাকি মরুতে। এভাবে কষ্ট কমানো যায়। আমার কৌশলটা আপনিও ব্যবহার করতে পারেন। এখানকার পরিবেশে মানিয়ে চলার ক্ষমতা বাড়ানো যায়। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের কথা ভাবলে যাতনা বাড়বে। সহ্যক্ষমতা হারালে, সহনশীলতা কমলে, টিকতে পারবেন না বেশি দিন। লাশ হয়ে ফিরতে হবে। শুনেছি লাশ হলে মুক্তি ঘটে। বিমান খরচ দিয়ে লাশ যার যার দেশে পাঠানোর বিধানও নাকি রয়েছে। এই কারা থেকেও কয়েকটি লাশ গেছে বিভিন্ন দেশে। লাশের মর্যাদারক্ষা করে দুবাই কর্তৃপক্ষ।’
নিজের লাশের ছবি ভেসে উঠল কল্পনায়। কে রিসিভ করবে এই লাশ? নববধূ কলি নাকি আম্মাজান? নাকি লাশ ছিনিয়ে নেবে দুবাইয়ের কলি? প্রশ্নগুলো তিরের মতো বিঁধল দেহে। সূর্যের দিকে পিঠ রেখে কথা বলছিল রুস্তম। তাপের জ্বলুনি টের পেয়ে তাকাল আকাশের দিকে। রোদ কেবল শরীরকেই পোড়াচ্ছে না, একইসঙ্গে পুড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশ থেকে পাওয়া অবজ্ঞা, অভিমান, বিবেক, মূল্যবোধ, কোমল অনুভূতি, ভালোবাসা।
পুড়তে থাকা ভালোবাসার চিতায় পানি ঢেলে দিচ্ছে না কেউ। ছাই হতে থাকা আবেগশূন্য রুস্তম বলল, ‘জলখাবার কোথায়? ক্ষুধা লেগেছে।’
কুফিয়া জবাব দিলো, ‘খুশি হলাম আপনার কথা শুনে। লাইনে এসে গেছেন। মায়ামমতা, জগৎসংসারের কথা চাপা দিয়ে ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রকৃতির এই প্রবৃত্তিটার টানেই বেঁচে থাকে পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, মানুষ, এমনকি লতাপাতাও। ক্ষুধা না থাকলে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতাম না। বেঁচে থাকার জন্যই খাটতে হবে। প্রতিবেলার খাবার সংগ্রহের সংগ্রামে লেগে থাকতে হবে। মনের কষ্ট এখানে দেহটা পোড়ানোর সুযোগ পাবে না। উদ্ধার পাওয়ার আশায় বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরি হবে এভাবেই।’
রুস্তম প্রশ্ন করল, ‘কী খাবার আছে? চলুন, খেয়ে নিই।’
‘আপনাকে রেখে যাওয়ার সময় মরুরক্ষীরা কিছু শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। লোভ সামলে খেলে দশ-পনেরো দিন চালিয়ে নিতে পারব সে খাবারে।’
‘মরুরক্ষীরা কোথায়? জনবিরল মরুতে তো মাত্র কয়েকজনকে দেখছি।’
‘হেলিকপটারে এসেছেন তারা। হেলিকপটারেই ফিরে গেছেন।’
‘আমি এলাম কীভাবে? প্রশ্ন করল রুস্তম।’
‘হেলিকপটারেই এসেছেন। সম্ভবত ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করেছিল আপনাকে। ঘুমের ঘোরে ছিলেন। আমাকেও রেখে গিয়েছিল একইভাবে। মনোবল ধরে রেখেছিলাম বলে বেঁচে আছি, টিকে আছি। আমাদের এই কারাগারে আরও দুজন আছেন। বয়সে কিছুটা সিনিয়র—একজনের অবস্থা খারাপ। বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না। কাজ করেন না বলে খাবারও দেওয়া যাচ্ছে না। হয়তো শিগ্গির মারা পড়বেন।’
সঙ্গী একজন মারা যেতে বসেছেন জেনেও বেদনার রেখাচিত্র ফুটে উঠল না কুফিয়ার চোখেমুখে। মরুর বুকে থেকে নির্মম হয়ে পড়েছে। পাষাণ হয়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না। কাজ না করলে নিজের ভাগ্য একইদিকে গড়াবে বুঝেও রুস্তম বলল, ‘যিনি অসুস্থ তাকে সেবা-শুশ্রষা করা দরকার না? আগে অসুস্থকে খাওয়াতে হবে না?’
‘মানবিকতা পুষে রাখলে নিজে বাঁচতে পারবেন না। নিজে আগে বাঁচুন। এ শিক্ষাই পেয়েছি মরু থেকে। এই দীক্ষা নিতে হবে আপনাকেও।’
আধপোড়া কোমল অনুভূতির ভেতর থেকে জেগে উঠতে পারল না রুস্তম। মসজিদের বাগানে ফুল দেখত রোজ। ফুল দেখে আনন্দ পেত। মালীরা অন্যের চোখেমুখে চমক ছড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হতো। শুনেছে মালী কিংবা ফুলবিক্রেতারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। পাষাণ বালির স্তরে কি ফুল ফোটানো যাবে? লতাগুল্ম দেখেছে বালিতে। লতাগুল্মে ফুল দেখেনি। দেখেছে সবুজ পাতা। পাতা যেহেতু আছে, ফুলও থাকতে পারে। খুঁজে দেখতে হবে। নরম কণ্ঠে বলল, ‘অসুস্থকে আগে খাবার দেন। প্রথম দিনটা অসুস্থের সেবা দিয়ে শুরু করতে চাই। পেয়েও যেতে পারি অসুস্থের দোয়া। আর সে দোয়ায় নিশ্চয়ই তখন আমাদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবেন হৃদয়বান কোনো মানব-মানবী।’
কুফিয়া বলল, ‘আপনাকে আগেই বলেছি, আমি বস। বসের প্রতিটি কথা মেনে চলতে হবে। বস ইজ অলওয়েজ রাইট—কথাটা মেনে চলবেন। আখেরে লাভ হবে আপনারই।’
‘জি। মেনে চলব। তবে আমার প্রথম আবদারটা রাখুন। মন বলছে, মৃতপ্রায় একজনকে সেবা করলে, প্রতিদান অবশ্যই পাব। সেই মুক্তির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি আমি। প্লিজ আমার এই কথাটা রাখুন।’
পরাজিত হলো কুফিয়া। রুস্তমের অনুরোধ মেনে নিল সে। দুজনই এগিয়ে গেল ঘরের দিকে।
ভেতরে ঢুকে দেখল, কাঠের মাচার তলে একটা বড়ো টিন।
টিন টেনে বের করল কুফিয়া। ঢাকনা খুলে বলল, ‘বড়ো টিনের মধ্যে রয়েছে আরও কয়েকটি ছোটো টিন। প্রত্যেকটিতে রয়েছে ড্রাই ফুড। কী খাবেন বলুন?’
উত্তর না দিয়ে কাঠের মাচায় শোয়া দুজনের দিকে তাকাল রুস্তম। আর তখনই অনুভব করল মরুকারার ভয়াবহতার কথা শুনেও মরে যায়নি নিজের মূল্যবোধ। পেটে তুমুল ক্ষুধাসত্ত্বেও এককভাবে বেঁচে থাকার লোভ সামলে উত্তর দিলো, ‘ওরাও উঠুক। একসঙ্গে খাব সবাই।’
উত্তর শুনে কিছুটা অবাক হয়ে কুফিয়া বলল, ‘মনের দরদ মনেই রাখুন। বুঝেছি, আরও পুড়তে হবে আপনাকে। সেইসঙ্গে পোড়াতে হবে মূল্যবোধ, মানবিক গুণ। নইলে এই অনির্দিষ্টকালের দুঃসহ জীবন পাড়ি দিতে পারবেন না।’
বিষাদে ছেয়ে গেল মন। আঁধারে ওত পেতে থাকা ভয়াল অনিশ্চয়তার ছোবল খেলো রুস্তম। বুকের এ যন্ত্রণা নিয়েই হাত রাখল অসুস্থ বয়স্ক লোকটির মাথায়। একবার চোখ খুলেই চোখ বন্ধ করলেন তিনি। শরীর গরম বুঝেই রুস্তম বলল, ‘সেকি! উনার শরীর তো পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মাথায় পানি দেওয়া দরকার।’
‘পানি কোথায় পাবেন? খাবার পানি জোগাড় করতেই জান বেরিয়ে যাবে। মাথায় দেওয়ার পানি জোগাড় করা তো সম্ভব নয়।’
অসহায় চোখে রুস্তম তাকাল কুফিয়ার দিকে। একটা টিন খুলে বের করেছে কুফিয়া। দেখতে বিস্কুটের মতো খাবার। নির্লিপ্ত গলায় কুফিয়া বলল, ‘ভালো খাবার দিয়েছে। একটা বিস্কুট খেলে চব্বিশ ঘণ্টা দেহের পুষ্টি নিশ্চিত হয়ে যাবে। নিন একটা। আজ সারা দিন হাই ভোল্টেজ পুষ্টিকর এই বিস্কুট দিয়েই চালিয়ে দেন।’
বস ইজ অলওয়েজ রাইট মানলেও, বসের কথামতো অসুস্থ লোকটিকে ফেলে খেতে ইচ্ছা করল না। নিজের বিস্কুট লোকটির দিকে এগিয়ে শরীরে ধাক্কা দিয়ে রুস্তম বলল, ‘উঠুন। খেয়ে নিন। শরীরে জোর না থাকলে জ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না।’
চোখ খুলে আবার বন্ধ করলেন লোকটি। বিস্কুটটি হাতে নিলেন। দুর্বল কবজি তুলতে পারেননি বিছানা থেকে। কেবল হাতের আঙুল ছড়িয়ে ধরেছিলেন। বিস্কুটটি তালুতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রসারিত আঙুলগুলো অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরল। রুস্তমের এই কীর্তি খেয়াল করল কুফিয়া। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আপনার সকালের নাশতা কিন্তু উনাকে দিয়ে ফেলেছেন। এখন আর পাবেন না। উপোস থাকতে হবে আপনাকেই।’
কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে রুস্তম বলল, ‘বস হিসেবে আপনাকে মেনে নিয়েছি। আপনার ন্যায় আচরণ, ন্যায় শাসন, ন্যায় সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেব। কিন্তু অন্যায় কোনোকিছু যে মানতে পারব—এই গ্যারান্টি দিতে পারব না। আমার খাবার দেন। রোগীরটা দিয়েছি রোগীকে। এটা তার প্রাপ্য অধিকার। সে অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। কেন দোষ তুলে নেবেন নিজের ঘাড়ে? দেন, আমার খাবার আমার হাতে দেন।’
‘নৈতিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেজন্য আরেকটি বিস্কুট দিলাম আপনাকে। তবে বলে রাখছি, বাঁচতে হলে, নিষ্ঠুর বাস্তবতাও মেনে নিতে হবে। সংঘর্ষে যাওয়ার আগে আরেকবার কথাটা স্মরণ করিয়ে বলছি, যদি রোগীর শুশ্রƒষা করতে চান, করবেন। নিজের কাজ শেষ করেই তা করবেন। এখন কূপ থেকে পানি এনে কাপড় ভিজিয়ে জলপট্টি দেন। মাথায় পানি ঢালার মতো পর্যাপ্ত পানি পাবেন না। এটাই রূঢ় বাস্তব। এই কঠিন বাস্তবতা মেনে চলতে হবে আপনাকে। বলে রাখলাম।’
রুস্তম বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। নিজের কাজের তালিকা পরে নেব। এখন বলুন কূপ কোথায়?’
‘ওয়াশরুমের পূর্ব পাশেই রয়েছে গভীর কূপ। কূপ থেকে পানি তোলার ব্যবস্থা আছে। পাশে ছোট্ট একটা মগ বাঁধা আছে দড়িতে। মগটি কূপের তলায় নামিয়ে দেখুন তোলার মতো পানি জমেছে কি না। কূপের তলানিতে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে। চব্বিশ ঘণ্টায় কয়েক মগ পানি জোটে। এই পানি নিজেদের জন্য, উটের জন্য, ছাগল ও ভেড়ার জন্যও। মনে রাখবেন অযত্নে উট, ভেড়া কিংবা ছাগল মারা গেলে শাস্তি হিসেবে এখানে থাকার মেয়াদ বেড়ে যাবে। পানি ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।’
‘বলেছিলেন, অনির্দিষ্টকাল থাকতে হবে। আবার বলছেন বাড়তি সাজার মেয়াদকাল ঠ্যাকানো যায়। কোন কথাটা ঠিক?’
‘দুটোই ঠিক। এবার যেতে পারেন। কথা বাড়াবেন না আর।’
কথা বলার সময় তৃতীয়জন, প্রায় সমবয়সি, ঘুম থেকে উঠে একবার তাকাল রুস্তমের দিকে। তারপর হাঁটা দিলো ওয়াশরুমের দিকে। পরিচিত হওয়ার জন্য রুস্তম বলল, ‘আমি রুস্তম, আপনি ?’
ছেলেটি নিরাসক্তভাবে একবার তাকাল রুস্তমের দিকে। আবার তাকাল কুফিয়ার দিকে। তারপর বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রুস্তমের কথার কোনো জবাব দিলো না।
পানি তুলতে গিয়ে হতাশ হলো রুস্তম। মগের তলানিতে সামান্য পানি উঠেছে। নিজের তৃষ্ণা মেটাতে হবে। অসুস্থজনের মাথায়ও জলপট্টি দিতে হবে। রুমালের মতো ছোটো কাপড় নিয়ে এসেছিল রুমের ভেতর থেকে। সেটা সামান্য ভেজানো যাবে। অন্যদের খাওয়ার পানির সংকটেও পড়তে হবে। এক ঢোক পানি গলায় চালান করে দিলো। বাকি পানির কিছুটা রুমাল ভিজিয়ে সামান্য একটু রেখে দিলো মগে। কূপের চারপাশ ঘেরা পাথরের ওপর থেকে নামার সময় দেখল, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে-ই যুবক। এবার নিজে থেকে পরিচয় দিলো। ‘আন্নের আরবি উচ্চারণ হুনি মনে অইছে বাংলাদেশেত্তে আইছেন। আঁইও বাংলাদেশের হোলা। আঁঙ্গো বাই হেনি। আঁর নাম নোমান।’
ফেনীর উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধা হলেও বাংলাদেশের একজনকে কাছে পেয়ে হঠাৎ রুস্তম হাতে পেল আকাশের চাঁদ। প্রশ্ন করল, ‘আপনি কেন এসেছেন এই কারাবাসে।’
‘হেই কথা আর কী কমু! লেবার সাপ্লাই কোম্পানির হাল্লায় হরিয়ারে আঁর আইজ এই দশা। বেগগিন দুই লম্বরি কাজ। হাঁচ লাক্ টাকা লইয়ারে দুবাই আনি ছাড়ি দিছে। আঁর গ্রুপে কও্গগা মাইয়াও আইছে দেশেত্তে। উটতিবয়সি উগ্গা মাইয়ারে জোর করি সাপ্লাই দিছে ডিসকো বারে। আঁই ফতিবাদ কচ্ছিলাম। আঁরে হাঁদে হ্যালাইছে কোম্পানির দালালরা। হাঁদে হরিয়ারে আইজ এই দশা আঁর।’
রুস্তম বলল, ‘নোমান, আপনার উচ্চারণ বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হলেও, অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আপনি মুখ ধুয়ে নিন। অসুস্থ ওই লোকটার মাথায় জলপট্টি দিয়ে আসি আমি।’
নোমান বলল, ‘কুফিয়া হালার হুত আন্নেরে বাদা দিব। সাবদানে যাইয়েন।’
‘আচ্ছা। সাবধানে যাব। আপনি আসুন ফ্রেশ হয়ে।’
রুমে ঢোকার আগে মনে হলো, কুফিয়া নিশ্চয় জানে নোমানের বাড়ি বাংলাদেশে। চারজনের মধ্যে দুজন এক দেশের একজোড় হয়ে থাকতে পারে ভেবে হয়তো একত্রে থাকতে দেবে না কুফিয়া। তবু কৌশলী হতে হবে। অসুস্থজনের বাড়ি কিংবা নাম-ঠিকানা জানা দরকার। ভাবনা নিয়ে রুমে ঢুকে রুস্তম দেখল, কুফিয়ার গালভরতি খাবার। অর্থাৎ নিজের ভাগের চেয়ে বেশি অংশ মুখে পুরে চাবাচ্ছে। তার কথা ও কাজের অমিল দেখে রুস্তম বুঝে গেল, পদে-পদে জ্বালাবে এই কুফিয়া। তাকে ছাড় দেওয়া যাবে না।
অসুস্থ লোকটির মাথায় জলপট্টি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। সেবার পরশ পেয়ে চোখ বেয়ে ঝরতে লাগল কৃতজ্ঞতা। হাত তুলে ধরতে চাইলেন রুস্তমের হাত। পারলেন না। দুর্বল হাত ওপরে উঠল না। টের পেয়ে রুস্তমই নিজের হাত রাখল লোকটির হাতে। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল লোকটির পুরো শরীর। একসময় চোখ বড়ো করে তাকালেন রুস্তমের দিকে।
কুফিয়া এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনাকে দরদি লোকই মনে হচ্ছে। রোগীর উপকার করছেন, করুন। আরেকটু উপকার করার পথ দেখিয়ে দিচ্ছি—এই খামারে প্রায় ২০টি নারী উট রয়েছে। এ প্রজাতির নারী উটদলের দুটো ‘দেরাদুবাই’তে (পুরোনো দুবাই শহর) অনুষ্ঠিত বিউটি কনটেস্টে যোগ দেবে। চিকন গলা ও সবচেয়ে লম্বা গলার উটদুটোর শরীরের রোমগুলো চকচকে। ওই দুই উটের পরিচর্যায় থাকতে হবে আপনাকে। ওই উটের যত্ন-আত্তি করা সম্মানের ব্যাপার। সম্মানের বোঝা আপনার ওপর দিলাম। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে। অর্পিত দায়িত্ব মাথা পেতে নিলাম। আগে বলুন, উনাকে আরেকটু বেশি উপকার করার পথটা কী?’
‘পথটা সহজ। কাজটাও আরও সহজ। উটের দুধ দোয়াতে হবে। সেই দুধ এনে খাওয়াতে পারেন রোগীকে। উটের দুধ খেলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন। নিশ্চিত আমি।’
‘আমি তো দুধ দোয়াতে জানি না।’ অসহায়ভাবে বলল রুস্তম।
‘জানি না, পারি না বলে কোনো শব্দ নেই এই মরুকারাবাসে। প্রয়োজনে বালি খেয়েও শুয়ে থাকতে হবে। আর দুধ দোয়াতে পারবেন না?’
‘একবার দেখিয়ে দেন। দেখিয়ে দিলে অবশ্যই পারব।’
কুফিয়া হিসাব করে দেখল, বাধ্য কয়েদির মতোই আচরণ করছে রুস্তম। তার অসহায়ত্বকে পুঁজি করলে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে ভেবে রাজি হয়ে জবাব দিলো, ‘ঠিক আছে—একবারমাত্র দেখিয়ে দেবো। বাকি পুরো কাজ সারতে হবে আপনাকে।’
‘অবশ্যই।’ জবাব দিলো রুস্তম।