উপন্যাস

উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব দশ

ছয়

রুস্তমের চাকরির জন্য সুপারিশকারী দুবাইয়ের বাসিন্দা প্রকৌশলী আমির হামজা আল শামস ক্রিমিনাল সেলের ইনচার্জের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে রুস্তম অন্দরমহলের ছোটো মেয়ে কলিকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছেন?’
‘কী বলছেন? প্রপোজাল নয়, সে দাবি করেছে কলি তার বউ।’
‘শিয়োর। দাবি করেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘মেয়ে কি স্বীকার করেছে সেকথা?’
‘তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি।’
‘সাক্ষ্য ছাড়া একজনকে অপরাধী বলা যায়?’
‘অন্দরমহলের সর্বেসর্বা কলির আম্মিজানের কাছে নিজের মুখে স্বীকার করেছে আসামি। স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট। প্রমাণের প্রয়োজন নেই আর।’
‘না। হিসাব মিলাতে পারছি না। যে রুস্তমের চাকরির ব্যবস্থা করেছি, সে অত্যন্ত উঁচু মনোবলের ছেলে, মানমর্যাদা আর নৈতিক দিক থেকে অনেক উন্নত। এমন ছেলে এ ধরনের কাজ করতে পারে, বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার নয়। সবার সামনে স্বীকার করেছে সে।’
‘অ্যারেস্ট করার পরে তার কথা কি শুনেছেন ? যতটুকু জানি এ সময় আসামির কথা শোনা হয় না।’
‘ট্রায়ালের সময় শোনা হবে।’
‘এ মুহূর্তে রুস্তমের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কোনো অবিচারের শিকার হচ্ছে কি না আমার নিরীহ কোনো শ্রমিক দুবাইয়ের বাসিন্দা হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব আছে আমারও।’
‘ওপরের কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। অনুমতি ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।’
‘কলির সঙ্গে কি কথা বলা হয়েছে?’
‘না। তাকেও অন্তরিন করা হয়েছে। তাছাড়া কলি তার বউ- আম্মিজানের কাছে কলির সামনেই খোলামেলা স্বীকার করেছে রুস্তম!’
‘বিশ্বাস করতে পারছি না কথাটা। তবু জানতে চাচ্ছি, বিচারে সাক্ষী থাকবেন কারা?’
‘কারা সাক্ষী থাকবেন, জানি না। সাক্ষীর প্রয়োজন আছে কি না, তাও বলতে পারি না। অন্দরমহলের সবাই নারী। কিসাস (Qisas) অপরাধী বিষয়ে নারীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না চার কারণে:
এক. নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। আবেগ সাক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
দুই. নারীরা সাধারণত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায় না, সুতরাং যা দেখেন, সেটার অন্তর্নিহিত সত্য ভালোভাবে বুঝতে পারেন না।
তিন. নারীরা পুরোপুরি পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সর্বশেষ পুরুষমানুষটি যা বলে দেবে সাক্ষী হিসেবে সেটাই বলবেন তারা।
চার. নারীরা সহজে ভুলে যায়। তাদের সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে করা হয় না।’

‘নারীদের সাক্ষ্য নেওয়া যাবে না অথচ অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে! অভিযোগের সময় আবেগপ্রবণ হতে পারেন না তারা?’ ভেবে উদ্বিগ্ন আমির হামজা তীব্রচোখে তাকালেন ক্রিমিনাল সেলের ইনচার্জের দিকে। মাথা ঝাঁকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘ভাষাগত কোনো সমস্যা হলো কি না খতিয়ে দেখা উচিত। রুস্তমের পক্ষে কোনো ধরনের অশোভন আচরণ করা সম্ভব নয়। এই ধনাঢ্য পরিবারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখে সে। এই পরিবার বা পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কোনো অপরাধ করা রুস্তমের বৈশিষ্ট্যে নেই। দুর্ব্যবহারের জবাব সুবিচারের মাধ্যমে দিলে আপত্তি নেই আমার। অবুঝ ব্যবহারের জবাব নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে প্রকাশ করলে দেশের আইন লঙ্ঘিত হবে বলেই মনে করছি। বিচারের মুখোমুখি করার আগে পুরো ঘটনা আরেকবার মূল্যায়নের অনুরোধ রাখতে পারি কি না, পথ বাতলে দেন।’

‘সরি। এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারব না। তবে ওর স্বজন কেউ এলে দেখা করার সুযোগ করে দিতে পারি।’
‘এ দেশে ওর স্বজন আমি। বাইরে অপেক্ষা করছে কয়েকজন সহকর্মী ও রুমমেট। সঙ্গে আছে ওর প্রাক্তন সুপারভাইজারও।’

প্রশ্নের জবাব শুনে মাথা চুলকালেন ইনচার্জ। তাকে কিছুটা নমনীয় মনে হলো। স্বর তরল করে বললেন, ‘আপনারা ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করুন। রুস্তমের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।’

ওয়েটিং রুমে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আমির হামজা আল শামস। রুস্তমের কলিগ তন্ময় সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার কিছুদিন ধরে লক্ষ করছিলাম শেখদের বাড়ির সিঁড়িঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে রুস্তম। সিঁড়িঘরে লাল রুমাল উড়ত, সেদিকে তাকিয়ে থাকত। ঘটনার সঙ্গে লাল রুমালের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, খোঁজ নেওয়া যাবে, স্যার?’

‘সম্পর্ক থাকতেও পারে। এ বাড়ির অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটি যদি লাল রুমাল ওড়ায়, কেন দোষী হবে রুস্তম ? মেয়েটিও তো প্রলুব্ধ করে থাকতে পারে। পারে না?’
‘জি স্যার। কথাটা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’

প্রাক্তন সুপারভাইজার হায়দার আলি খানও এসেছেন খবর শুনে। তিনি বললেন, ‘ছেলেটা একরোখা। কিন্তু সৎ। বাড়ির প্রতি মমতা বেশি। দেশপ্রেমও তার প্রখর। একবার আমি বলেছিলাম- ও হচ্ছে মিসকিন দেশের এক মিসকিন। শুনে বিদ্রোহ করেছিল। আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল।’

আল শামস বললেন, ‘এসব নেতিবাচক কথা বলার সময় নয় এখন। ইতিবাচক থাকলে কিছু বলুন।’

হায়দার আলি খান বললেন, ‘ইতিবাচক কথা হলো, চান্স পেলে দেশের বাড়িতে রেখে আসা নতুন বউয়ের সঙ্গে কথা বলত রুস্তম। যার বউয়ের প্রতি এত টান থাকে, সে এত বিত্তশালী পরিবারের মেয়ের দিকে নজর দিতে পারে না, স্যার।’

‘হ্যাঁ। এটা একটা পয়েন্ট। সে নববিবাহিত। অর্থ রোজগার করে পরিবারকে সুখী করার জন্য এই মরুর দেশে এসেছে। তার সততায় কোনো খাদ নেই। কারও সঙ্গে অসদাচরণ করতে পারে, তেমন প্রমাণ নেই।’

হায়দার আলি খান বললেন, ‘সে কিছুটা আবেগপ্রবণ। এই দুর্বলতা ছাড়া আর কোনো খুঁত নেই ওর।’
সুপারভাইজারকে দমিয়ে দিয়ে আল শামস বললেন, ‘রুস্তমের বাড়িতে কি জানানো হয়েছে বিষয়টি?’

তন্ময় বলল, ‘না। জানানো যায়নি। দেশের স্বজনদের মোবাইল নম্বর সেভ করা ছিল ওর ব্যক্তিগত ফোনসেটে। অন্য কোথাও পেলাম না ওর বাড়ির নম্বর। মোবাইল সেট তো সিজ করেছে সিকিউরিটিরা।’

‘ওর পাসপোর্ট হাতে পেলে ভালো হতো।’
‘মূল পাসপোর্ট তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে ব্যক্তিগত লকারে। ফটোকপি থাকতে পারে আমাদের অফিসে।’

আল শামস আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘যাক। অন্তত একটা সূত্রের সন্ধান পাওয়া গেল। প্রয়োজনে পাসপোর্টের ফটোকপি কাজে লাগাতে হবে। মোবাইল ফোন উদ্ধার করা যায় কি না, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ দেশে আমরাই ওর স্বজন। ওকে মুক্ত করতে হবে আমাদেরকেই।’

কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন ক্রিমিনাল সেলের ইনচার্জ। হাসিমুখে বললেন, ‘আসামির জন্য আপনাদের উদ্বেগে আমিও চিন্তিত। বিশেষ করে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জোরালো কথাবার্তা শুনে চিন্তিত হয়েছি। এখন আপনাদের দুশ্চিন্তা একটু কমাতে পারি। খবর পেলাম দুই ধরনের। প্রথমে ভালো খবরটা দিই: দেশের বাড়ি থেকে একজন ফোনে কথা বলত। সে-ই মেয়েটির নামও কলি। রুস্তমের বউয়ের নামও কি কলি? আর দুবাইয়ের এ বাড়ির মেয়েটির নামও কলি। নামবিভ্রাটের কারণে কিছুটা গোলমাল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেগেটিভ কথা হলো: বেশ কিছুদিন ধরে এ বাড়ির কলির সঙ্গে মোবাইলে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা হয়েছে রুস্তমের। এই আলাপের সঙ্গে তদন্ত কর্তারা ফিশি গন্ধ পাচ্ছেন। এই গন্ধ বিপজ্জনক দুর্গন্ধও ছড়াতে পারে। আশার কথা এই যে, অধিকাংশ কলই রিসিভ করেছে। কখনো কল করেনি রুস্তম। তাই নিষ্কৃতি পেয়েও যেতে পারে। তবে গোপন সম্পর্ক বেশিদূর গড়ালে শাস্তি ভয়াবহ হতে পারে।’

‘দোষী সাব্যস্ত হলে কী কী শাস্তি পেতে পারে?’ প্রশ্ন করল তন্ময়।

‘অন্দরমহলের আম্মিজানের চোখে দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেছে সে। দোষের ধরনটা এখনো স্পষ্ট নয় আমার কাছে। তবে ব্যভিচারের দায়ে দোষী হলে চাবুক মারা হয় দোষীদের। পুরুষদের দাঁড়ানো অবস্থায় চাবুকের ঘা দেওয়া হয়, মেয়েদের পেটানো হয় বসা অবস্থায়। মুখ, মাথা-সহ দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রেহাই দেওয়া হয় আঘাত থেকে। চল্লিশ ঘা হচ্ছে সাধারণ বরাদ্দ, তবে ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তিত হতে পারে সংখ্যা। ক্রাইমের ধরন অনুযায়ী শাস্তির ধরনও ভিন্ন। অভিযুক্ত যদি বিবাহিত হয়, তবে তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। শিরছেদ কিংবা গুলি করে মারারও অনুমোদন দেওয়া হয়। কমন শাস্তি হচ্ছে পাথর ছুড়ে মারা। এসব ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণের জন্য চারজন সাক্ষীর চাক্ষুষ সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়।’

শাস্তির বিবরণ শুনে কেঁপে উঠল তন্ময়। আল শামসও স্তব্ধ হয়ে গেছেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আমির হামজা আল শামস বললেন, ‘তাহলে তো শাস্তি চূড়ান্ত হয়নি। সাক্ষীর প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিশ্চিত ভাষাগত সমস্যার কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নামের বিভ্রাটের কারণে মহলের আম্মিজান ভুল বুঝেছেন, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে নিশ্চয়ই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

‘আপনি-আমি সেকথা বললে তো হবে না, প্রমাণ লাগবে।’ ইনচার্জ বেশ শক্ত গলায় বললেন।
আমির হামজা আল শামস বললেন, ‘অবশ্যই প্রমাণ জোগাড় করব।’সেইসঙ্গে তিনি তন্ময়কে নির্দেশ দিলেন পাসপোর্টের ফটোকপি সংগ্রহ করতে।

ক্রিমিনাল সেলের ইনচার্জ আবার বললেন, ‘আসামির পক্ষে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানের চিফ অফিসার। ইলেকট্রিক সার্কিট ঠিক করার জন্য তিনিই সিলেক্ট করেছিলেন রুস্তমকে। এখন তাকেও জবাবদিহি করতে হবে। যেহেতু চিফ অফিসার রুস্তমের পক্ষে কথা বলছেন, পুনর্বিবেচিত হওয়ার একটা সুযোগ আছে অপরাধসংক্রান্ত বিষয়টি। সুযোগটা এখনো স্পষ্ট নয়। আমার মনে হচ্ছে, যেহেতু এ বাড়ির মেয়ে কলি সবার আদরের, সবার প্রিয়, ঘটনা চাউর না করে, হজম করেও নিতে পারেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিষয়টি ধর্মীয় পুলিশের হাতে গেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। স্বয়ং বাদশাহও শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত। শরিয়া আইনের মূল সোর্স হচ্ছে পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস। এ আইন লঙ্ঘন করার অধিকার কারও নেই। মামলাটি শুরা কাউন্সিলে উঠলে ব্যভিচারের শাস্তি পেতেই হবে দোষীকে।’

আমির হামজা আল শামস বললেন, ‘এসব কথা জানা আছে আমার। এও জানা আছে, নিরীহ কাউকে সাজা দেওয়ার বিধান নেই কোনো আইনে। ধর্মীয় মতাদর্শে তো নেই-ই। শুরা কাউন্সিল অন্ধ নয়। ভাষাগত কারণে ভুল বোঝাবুঝির বিষয়টি আমলে নেবেন কাউন্সিল, নিশ্চিত আমি। ভুলকে ভুল হিসেবে তুলে ধরতে হবে। খেয়াল রাখবেন, যেন রুস্তমের ওপর টর্চার করা না হয়। সে যেন অবিচারের শিকার না হয়।’

ক্রিমিনাল সেলের ইনচার্জ আবার বললেন, ‘আমার সেলের নিশ্চয়তা দিতে পারি আমি। আবারও বলছি, আমারও মনে হয়েছে ছেলেটি ভদ্র। সৎ। ভালো ছেলের জন্য সব দিক থেকে সুপারিশ আসছে। বিদেশি আসামির জন্য এত প্রশংসা আগে আর দেখিনি। প্রশংসা অর্জনকারীর পক্ষেও থাকবে আইন। আইনের এই উদারতা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। আগামীকাল আসুন, ওর পাসপোর্টের ফটোকপি পাওয়া গেলে স্পাউসের নাম জানা যাবে। বিভ্রাট হয়তো কেটেও যেতে পারে।’

ইনচার্জের কথায় আশ্বস্ত হলেন আমির হামজা আল শামস। তন্ময়ও স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘স্যার, অফিসে চলুন। পাসপোর্ট-ফটোকপি থেকে রুস্তমের বউয়ের নাম পাওয়া যায় কি না খুঁজে দেখি। বউয়ের প্রসঙ্গ এলে খুব কাতর হয়ে যেত ও। কখনো নাম উচ্চারণ করত না। বউ বলেই সম্বোধন করত। দেশের বাড়িতে এখনই কি বর্তমান অবস্থার মেসেজ পাঠানো উচিত, স্যার?’

‘পরিস্থিতি বলছে, জানানো উচিত।’ বললেন হায়দার আলি খান।

আমির হামজা আল শামসও বললেন, ‘জানানো উচিত। কখন কী হয় না হয়, জানি না। তবে হঠাৎ কোনো খারাপ খবর শুনলে টলারেট করতে পারবে না রুস্তমের স্বজনেরা। ধীরে ধীরে জানালে ভালো হতো। আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করা যেতে পারে।’

তন্ময় বলল, ‘জি স্যার। বিষয়টি স্পর্শকাতর। দেশেও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ওর পরিবার। রয়েসয়ে জানানো উচিত বলে মনে করছি আমিও। বাংলাদেশ দূতাবাসে এখন জানানো ঠিক হবে না। অপরাধ পুনঃতদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। আরও একটু অপেক্ষা করি। এর মধ্যে আমরাও প্রচেষ্টা রাখি ওকে উদ্ধারের জন্য।’

গাড়ি পার্কিঙের দিকে এগিয়ে গেলেন আমির হামজা। পেছনে পেছনে এগিয়ে এসে তন্ময় প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি অফিসে যাবেন এখন, স্যার।’
‘হ্যাঁ। অফিসেই যাচ্ছি।’
‘আমি তাহলে উঠি আপনার গাড়িতে?’
‘হ্যাঁ। ওঠো। একসঙ্গে যাই। পরে আর সময় থাকবে না হাতে।’

তন্ময় খুশি হলো। রুস্তমের জন্য অন্যরকম একটা তাড়নাবোধ করল। দূরদেশে ভিনদেশের মানুষের জন্য এই তাড়নার সঙ্গে যুক্ত আছে মায়ের ভাষার টান, মনুষ্যত্বের মানবিক লক্ষণ— অনুভব করে রুস্তমের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করার প্রেরণাবোধ করল সে।

গাড়ি পার্কিং এলাকায় এসে তন্ময় তাকাল শেখবাড়ির সিঁড়িঘরের দিকে। লাল পতাকা কিংবা লাল রুমাল কি উড়ছে সিঁড়িঘরে? প্রশ্ন নিয়ে চোখ সরু করে তাকাল…না। রুমাল উড়ছে না। কড়া রোদের তেজ অনুভব করল কেবল। দূর থেকে দেখল আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত রোদের ধু-ধু স্তর। আকাশে ভাসমান বালিকণার ভেতর দিয়ে রোদের ঝলসানো পতন ধারালো ছুরির ফলার মতো চকচক করছে। চট করে প্রশ্ন ঢুকল মনে, ছুরির ওই ফলা কি শিরছেদ ঘটাবে রুস্তমের?

আমির হামজার নির্দেশে বের করা হয়েছে রুস্তমের ফাইল। পাওয়া গেছে পাসপোর্টের কপি। পাসপোর্টে লেখা আছে বাবার নাম: মৃত মনসুর আলি। মায়ের নাম: রুশনা বেগম। স্পাউসের নাম: নূরে জান্নাত।

দেখে ঘামতে শুরু করলেন আমির হামজা। রুস্তমের বউয়ের নাম তো ‘কলি’ নয়, নূরে জান্নাত! এখন উপায়?
‘স্যার, আমাদের উপমহাদেশে ডাকনাম-প্রথা চালু আছে। আসল নাম একটা, নিকনেম বা ডাকনাম আরেকটা। ডাকনাম সাধারণত অফিসিয়াল ডকুমেন্টে লেখা থাকে না।’

‘ডাকনাম কলি—বলে দিলেই তো কেউ মানবে না। এভিডেন্স থাকতে হবে। আইনের চোখে প্রমাণ ছাড়া মুখের কথার কোনো দাম নেই।’
বসের কথা শুনে ঘামতে শুরু করেছে তন্ময়। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। থেমে গেছে পলক ফেলার মতো স্বয়ংক্রিয় কাজটি। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বসের মুখের দিকে।
আমির হামজা আল শামস প্রস্তাব দিলেন, ‘চলো চিফ অফিসারের সঙ্গে দেখা করি। উনি হয়তো বিস্তারিত জানাতে পারবেন।’

রুস্তমকে ঘিরে একবার আশার আলো জ্বলে উঠছে, আবার দেখছে অন্ধকার। চিফ অফিসারের প্রসঙ্গ ওঠাতে স্বস্তি পেল তন্ময়। রুস্তমের নিকটতম স্বজন বলতে এখন ও নিজেই। আমির হামজার ভূমিকাও খুব ভালো। চিফ অফিসারও রুস্তমের পক্ষে আছেন। বিমর্ষতা ঝেড়ে তন্ময় সাড়া দিয়ে বলল, ‘চলুন স্যার।’

চিফ অফিসার বললেন, ‘মহলের আম্মিজানের অভিযোগের পেছনে কাজ করেছে ভীতি। আবেগপ্রবণ হয়ে তাৎক্ষণিক দায়ী করেছেন রুস্তমকে, অপরাধী ভেবেছেন। তিনি ভেবেছেন, রুস্তম বিয়ে করেছে ছোটো মেয়ে কলিকে। তাঁদের ভাষ্য, রুস্তম জোরালোভাবে দাবি করেছে কথাটি। তাছাড়া ওই পরিবারের এক মেয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশের এক রুস্তমের সঙ্গে ভেগে গেছে। ভীতির অন্যতম কারণ আগের এই অভিজ্ঞতা। ভীতি থেকেই বোধ হয় অতিসতর্ক হয়েছেন তাঁরা।’

‘এখন উপায়?’ প্রশ্ন করলেন আমির হামজা আল শামস।
‘প্রথম কাজ হচ্ছে মহলের আম্মিজানের ভুলটা ভাঙানো। তিনি যদি অভিযোগ ফিরিয়ে নেন, ভুল স্বীকার করেন, সমস্যার সহজ সমাধান হবে।’

‘কিন্তু বিষয়টি এখন নাকি আম্মিজানের হাতে নেই, মহলের সিকিউরিটি বিভাগের হাতে চলে গেছে। ধর্মীয় পুলিশের হাতে গেলে স্বয়ং সুলতানও দিতে পারবেন না কোনো সমাধান। শুরা কাউন্সিলের হাতে অপরাধ ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

‘ধর্মীয় পুলিশের হাতে অভিযোগ যেন না যায়, সেই চেষ্টা করছি আমি।’
‘ভুল হলেও, আম্মিজান কি স্বীকার করবেন নিজের ভুল? কী ধারণা আপনার?’ প্রশ্ন করলেন আমির হামজা।

‘ভুল স্বীকার করলে নিজের সম্মানহানি ঘটবে। এ কারণে স্বীকার নাও করতে পারেন। আবার স্বীকার করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেহেতু নিজের মেয়ের মানমর্যাদা এতে জড়িত, রুস্তমকে অভিযুক্ত করার মুহূর্তে এতসব ভাবার সুযোগ না পেলেও, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন নিজের ভুল। কলির সঙ্গে তিনি আলাপ করলে ভুল ভেঙে যাবে, তা বলছি না। কলিকেও অবিশ্বাস করতে পারেন আগের ঘটনার জেরে। কিছুদিন ধরে কলি যোগাযোগ করে যাচ্ছিল রুস্তমের সঙ্গে। বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছিল। ফোনে কিংবা মসজিদ-প্রাঙ্গণে দুষ্টুমির ছলে কথাও বলেছে। এসবকে তখন আম্মিজান হয়তো ছেলেমানুষি মনে করেছেন। তাহলেও। কলির মূল উদ্দেশ্য যাই থাকুক, এখন ছেলেমানুষি হিসেবে দেখবেন না। মেয়েকে সতর্ক করতে গিয়ে রুস্তমকে ফাঁসিয়েছেন। মেয়েও যে জড়িয়ে গেছে বিপদে, সেটা তিনি টের পেলে লাভ হবে রুস্তমেরই। এটাই এখন ভরসা।’

দুজনের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তন্ময়। আবারও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে সে। তবু দূরে জমাট বাঁধতে থাকা জটিল মেঘের ঘনঘটাও মন থেকে দূর করতে পারল না। মেঘ সরিয়ে বলল, ‘স্যার, আমার বিশ্বাস, নিরপরাধ রুস্তমের কিছুই হবে না। মাঝখান দিয়ে ভোগান্তি হচ্ছে ঠিকই। নিশ্চয় উদ্ধার পেয়ে যাবে সে।’

চিফ অফিসার বললেন, ‘উদ্ধার পেলেই ভালো। না পেলে ওর সুপারিশকারী হিসেবে হামজা সাহেবও বিপদে পড়বেন। সঙ্গী হিসেবে আপনিও ফেঁসে যেতে পারেন। আর চিফ অফিসার হিসেবে আমারও ক্ষতি হতে পারে। চাকরিও খোয়াতে পারি আমরা সবাই।’

আমির হামজা বললেন, ‘আমার দেশের আইনকে এত নিষ্ঠুর মনে করি না। এত নেতিবাচক চিন্তার প্রয়োজন নেই। আমরা সবাই স্বচ্ছ। রুস্তমও স্বচ্ছ। স্বচ্ছতার কারণে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিশ্বাস হারানো ঠিক হবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।’
চিফ অফিসার বললেন, ‘ভরসা পেতে আমার কাছে এসেছেন আপনারা। উলটো আমিই সাহস পেলাম আপনার কথায়। ধন্যবাদ হামজা সাহেব।’

নীরব শ্রোতা হয়ে তন্ময় শুনল তাদের কথোপকথন। রুস্তমের বিপদকে আর আলাদা কারও বিপদ হিসেবে ভাবতে পারল না। ভাবল, এটা নিজেরই বিপদ। মুক্ত আকাশতলে মুক্ত নেই রুস্তম। সে এখন বন্দি। নিজেকেও বন্দি মনে হচ্ছে তন্ময়ের। রুস্তম তো তার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়! তবু কেন টান অনুভব করছে ওর জন্য? এই টানের গভীরে কি আছে ভাষার শিকড়? শিকড়ের টানেই কি মনে ছড়িয়ে পড়ছে গভীর কোনো সম্পর্কের অনুরণন? ভাষা! হ্যাঁ! মধুর আমার মায়ের ভাষা! ভাবতে গিয়ে আরও শক্ত দায় অনুভব করল তন্ময়! এই দায় বন্ধুত্বের। এই দায় মমতার উর্বর ভূমিতে প্রবহমান ভাষার। নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল তন্ময়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, রুস্তমকে উদ্ধার করার জন্য যে-কোনো ঝুঁকি নেবে সে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব নয়উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব এগারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *