উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// এক
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// দুই
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিন
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিলো, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব চার
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।।পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব পনরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব
৮
আসাদ করিম স্কুলে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এখন ওর মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। প্রতিদিন রুটিন মাফিক স্কুলে যাওয়া, ক্লাসে পাঠদান, ক্লাসের অবসরে শিক্ষকদের সঙ্গে গল্পকরা এসব করে করে দিন বেশ কেটে যাচ্ছে। এখন সব কিছু নৈমিত্তিক হয়ে গেছে। সে ওর মতো করে পাঠ পরিকল্পনাও করে নিয়েছে। এখানে এসে সে দেখতে পেয়েছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরাও ঠিকমতো উচ্চারণ করে বাংলা পড়তে পারে না। উচ্চারণ কী করে ঠিক করা যায় সে বিষয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় ওর মনে পড়লÑকবিতা আবৃত্তি দিয়ে শুরু করা যায়। আগে মুখের জড়তা দূর করতে হবে। গলা খুলে ভাব প্রকাশ না করতে পারলে উচ্চারণ ঠিক করা যায় না। তার পর কবিতা কী এ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে সে ক্লাসে বলল। কেন কবিতা আবৃত্তি করে পড়তে হয় সেটাও নিজে আবৃত্তি করে বুঝিয়ে বলেছে। সে যখন ‘অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধুলি, ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি’ আবৃত্তি করতে করতে দূরের গ্রামগুলো এমনই দেখাচ্ছে কি না এই রকম জানতে চায় তখন ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে বলে,
ঠিকই স্যার, গ্রামগুলি তো এরকমই।
তাহলে আমরা যদি কবিতাকে, ছবির মতো মনে করে, আমাদের চেনা পরিবেশ আর প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে যেমন, ‘নীল নবঘন আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে, ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’ এমন একটি কবিতা আষাঢ় মাসে, বৃষ্টির দিনে, দিনটির আবহাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ি তখন দেখবে কবিতা খুব মজার।
তাহলে স্যার গদ্য কীভাবে পড়ব?
গদ্যও সুন্দর করে পড়তে হবে। যেখানে কোনো চরিত্রের উক্তি আছে, সেটা সেই চরিত্রটাকে কল্পনা করে পড়তে হবে। যেমন তোমাদের পাঠ্য ‘দইওয়ালা’। এটা কার লেখা তোমরা জান তো?
জ্বী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
আচ্ছা, তোমরা কি দইওয়ালা দেখেছো?
দেখেছি স্যার। দইওয়ালা তো আমাদের গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। আমরা ত তার কাছ থেকে দই-মাঠা কিনি।
সে কী রকম?
তার কাঁধে একটা ভার থাকে। ভারের দুই পাশে দুইটা কলসিতে দই।
সে কীভাবে হাঁটে?
একটি ছেলে হাত তুলে বলল, স্যার, আমি হেঁটে দেখাবো?
দেখাও।
ছেলেটি পরনের শার্ট খুলে ফেলে দরোজার পাশে রাখা বেতটা হাতে নিয়ে সেটা কাঁধে নিয়ে ধরে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁকতে লাগল দই লাগবে, দই, মিষ্টি দই, মাঠা-আ।
তোমরা তো বেশ অভিনয় করতে পারবে বুঝতে পারছি! এসো, আমরা অমল আর দইওয়ালার পাঠটা করি। প্রথমে আমরা শুধু মুখের কথায় অমল আর দইওয়ালার কথাগুলো তাদের মতো করে বলতে চেষ্টা করব। তার পর কথাগুলো যখন বুঝতে পারব তখন সকলের সামনে অভিনয় করে দেখাবো। ঠিক আছে?
জ্বি স্যার আমরা সবাই অভিনয় করবো।
ক্লাসের ভেতর শিক্ষকের টেবিল আর চেয়ারটা সরিয়ে দিয়ে ওরা অভিনয় করছে─ একটি ছাত্র দইওয়ালার এবং আরেকটি অমল। ছেলেদুটোর একজন এমন সুন্দর করে অভিনয় করল যে আসাদের মনে হলো সে সত্যি সত্যি অমল। সে যেন কোনো অভিনয় করেছে না। অভিনয় শেষ হলে সকলেই হাত তালি দিল। তারপর আরো অনেকেই হাত তুলল− ওরাও অভিনয় করতে চায়।
তা হলে তোমরা বাড়িতে গিয়ে ভালো করে দইওয়ালা পড়বে। মনে মনে পড়লে হবে না, গলা খুলে শব্দ করে পাঠ করতে হবে।
আসাদ খেয়াল করে নি, কনকচাঁপা দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের অভিনয় দেখছিল। এ সময় ওর প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস নেবার কথা। হয়তো কোনো কাজে এসে থাকবে। কিন্তু ওর ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের অভনয় দেখার সঙ্গে কাজের বিষয়টা মেলাতে পারছে না। তবে কি আসাদকে ও কিছু বলতে চায়? সে ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলো।
আপনি কখন এলেন?
অনেকক্ষণ। ওদের গলা শুনে এগিয়ে এসে দেখি আপনার ক্লাস। আবার ছোটোরা ডাকঘরের অমল আর দইওয়ালা অভিনয় করছে দেখে খুব ভালো লাগছিল। না দাঁড়িয়ে পারলাম না।
কী কাজে এসেছিলেন?
এসেছিলাম হেড স্যারের কাছে।
স্কুলের কোনো কাজে?
আমাদের স্কুলের, মানে আপনাদের ক্লাস এইটের এক ছাত্রীকে ওর পরিবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার স্বামী বিদেশে চলে যাচ্ছে। ওর স্বামী বলছে বিদেশে চলে যাবার পর মেয়েটিকে ওর শ্বশুর বাড়ি থাকতে হবে। এবার ওর নাইনে ভর্তি হওয়ার কথা। নাইনের রেজিস্ট্রেশনের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা পড়ালেখায় বেশ ভালো। আমরা আশা করছি সে বৃত্তিও পাবে। সেটা পাক বা না পাক, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেয়েটি কান্নাকাটি করছে। ওর স্কুল যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সে ব্যাপারে হেড স্যারের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম।
ঐ যে হেড স্যার ক্লাস থেকে ফিরছেন।
আপনিও আসুন না।
ঠিক আছে। চলুন।
আসাদ আর কনকচাঁপা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে একসঙ্গেই প্রবেশ করল।
কনকচাঁপা? আসো।
আদাব স্যার।
আদাব, তুমি কেমন আছো?
আমি স্যার ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো তো?
আর আছে একরকম। তুমি কী কিছু বলতে চাও?
জ্বী, স্যার। আমি এসেছিলাম
এ সময় মৌলবী আব্দুস সোবহান প্রবেশ করলেন। মৌলবী আব্দুস সোবহান ঘরে ঢুকলে কনকচাঁপা একবার সোবহান আর একবার আসাদ করিমের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল।
মৌলানা সাহেবকে তো আর বাড়তি ক্লাস নিতে হচ্ছে না, তাই না?
না।
প্রধান শিক্ষক ভাবলেন, কনকচাঁপা আসাদকে দেখে ইতস্তত করছে। তিনি আসাদকে পরিচয় করিয়ে দেন।
উনি আসাদ সাহেব। আমাদের বাংলার শিক্ষক, সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। বাংলায় এমএ। লেখালেখিও করেন।
স্যার, আসাদ সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
কখন, কী ভাবে?
এখানে আসার পর দিনই। বাবা সঙ্গে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। আর আজকে তার ক্লাস নেওয়া দেখলাম। ছেলেমেয়েদের দিয়ে চমৎকার অভিনয় করাচ্ছিলেন।
তাই নাকি? খুব ভালো। জানেন, আসাদ সাহেব, কনকচাঁপা আমাদের লক্ষীমেয়ে। ওর গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
স্যার, এ রকম কথা তো আপনি সব সময় বলেন। আপনার এই মেয়ের একটামাত্র গুণ কি আপনি কারো সামনে তুলে ধরতে পারবেন? মেয়ে বড় হলে মুরব্বীরা মেয়েকে পাত্রস্থ করবার সুবিধার্থে এ রকম করে অন্যদের সামনে বলে থাকেন, সেটা সকলেই জানে। আমি তো স্যার শীঘ্রই আপনাদের ছেড়ে চলে যেতে চাই না। তাহলে কেন এরকম করে বলছেন?
সে কি আমরা জানি না? তবু সৎপাত্র জুটতে তো সময় লাগে। মানুষকে জানিয়ে রাখা দরকার− আমাদের একটা গুণবতী মেয়ে আছে।
স্যার, আমার কথা বাদ দেন। আমি এসেছি আপনার আরেকটা মেয়েকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। আপনারা থাকতেও মেয়েদের কপাল পুড়বে সেটা কী ভালো দেখায়?
কার কপাল পুড়ল রে মা?
আপনার ছাত্রী আলেয়ার। আপনি শোনেন নি?
আমি বিষয়টা শুনেছি। মেয়ের বাপ যদি মেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছা ভালো-মন্দ না বোঝে তাহলে বাইরে থেকে আমরা কী করতে পারি রে মা! এই দেশে মেয়েরা অভিশাপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
স্যার, এ যুগেও মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য থাকবে না? আপনারা এখনো চুপ করেই থাকবেন? আর মেয়েরা অভিশপ্ত জীবন সহ্য না করতে পেরে এ যুগেও চোখের জল ফেলবে? এদেশের মেয়েরা যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে তো সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই, তাই নয় কি?
তুমি ঠিকই বলেছো, মা। আমাদের মানসিকতা বদলাতে না পারলে মেয়েদের চোখের জলের অবসান হবে না। এখন তুমি কী বলতে এসেছো?
আলেয়ার তো অনেকখানি ক্ষতি হয়ে গেছে। এখনো ওকে একটু সহযোগিতা করলে ওর কষ্ট কিছুটা লাঘব হতে পারে।
কী করতে পারি আমি মা?
ওর বর বিদেশে চলে যাচ্ছে। ওর বর বলে যাচ্ছে আলেয়ার আর লেখাপড়া করবার দরকার নেই। যতটুকু লেখাপড়া করেছে তাতে বিদেশে সে স্বামীর কাছে চিঠিপত্র ভালোই লিখতে পারবে। আর ঘরের বউকে পর পুরুষ দেখবে, এটাও তার পছন্দ নয়। এটা নাজায়েজ। আপনি তাকে বলেন, আলেয়ার পড়ালেখাটা যেন সে বন্ধ না করে দেয়।
আমার কথা কি মোসলেম শুনবে?
মোসলেম তো আপনারও ছাত্র। আমার ক্লাসমেট হিসেবে ওকে আমি বোঝাতে গিয়েছিলাম। সে আমাকে পাঁচ কথা শুনিয়ে দিল। আমি ওর সাথে তর্ক করি নি। তাতে মেয়েটার দুর্দশা আরো বেড়ে যেত।
মৌলানা সোবহান এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। তিনি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না।
আলোয়ার পিতা মেয়ের মঙ্গলের কথা ভেবে ওর বিয়ে দিয়েছে। তুমি ওর বিষয়ে কথা বলার কে?
আমি একটি মেয়ে হয়ে অন্য একটি মেয়ের জীবনটা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আমি মনে করি আমারও একটা দায়িত্ব আছে, ওর জন্য কিছু করা দরকার।
তুমি কী করতে চাও?
আমি চাই আলেয়ার লেখাপড়া বন্ধ না হোক।
ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বাপ আর স্বামী-শ্বশুর যা ভালো মনে করছে সেটা করছে। তাদের পারিবারিক বিষয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছো কেন?
তারা আলেয়ার জীবনটা ধ্বংস করে দেবে আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো?
তারা তোমার কথা না শুনলে কী করতে পারো তুমি?
আমি কিছু করতে পারব না। আপনারা তাদের বোঝাতে পারেন।
একেই বলে মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশী।
ওর পিতা অশিক্ষিত মানুষ। আমি সে বিষয়ে যাচ্ছি না, বিয়ে যখন হয়ে গেছে এখন এসব বলে আর কী হবে? আমি চাই মেয়েটার পড়ালেখাটা চলুক। ওর স্কুলটা যেন বন্ধ না হয় সে ব্যবস্থা নিতেই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ।
বিয়ে হয়ে গেছে, এখন পড়ালেখার আর দরকার নেই।
স্যার, আমি হেড স্যারের কাছে বিষয়টা জানাতে এসেছি। তিনি যা ভালো মনে করবেন, একটা কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
হেড স্যারই কি সব? আমরা কি কিছু না?
স্যার, আপনি তো আলেয়ার মামা, ওর একজন অভিভাবক। আর মোসলেমের বিয়ের একজন সাক্ষীও, তাই না?
হ্যা, সাক্ষী। তাতে কী হয়েছে?
মেয়েটার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?
হয় নি মানে? সে মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তুমি হিন্দুর মেয়ে, মুসলমান মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার বিয়ে নিয়ে ভাবো। তোমার ধর্মেও তো বার বছর হলেই বিয়ে দেবার বিধান, তুমি বিয়ে করছ না কেন?
বাংলাদেশের আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স আঠারো। এর কম বয়সে বিয়ে দেয়া আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি স্যার না বলে পারছি না, সাক্ষী হিসেবে আপনিও আইন ভঙ্গ করার অপরাধে অপরাধী।
তুমি আমাকে আইনের ভয় দেখাচ্ছো? একটা হিন্দু মেয়ের কতবড় স্পর্ধা দেখেলেন, স্যার!
স্যার, আমাকে মাফ করবেন। আমি হিন্দু কি মুসলিম সেটা বড় কথা নয়। আলেয়ার বিয়ে যখন হয়ে গেছে, তখন সেটা নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যদি মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া হয়, সেটা ওর জন্য ভালো হবে না। ওর প্রতি অন্যায়ও করা হবে। ওর স্কুলে আসার একটা বিহিত করতে পারলে ভালো হয়।
কনকচাঁপা ঠিক কথাই বলছে। আমি মোসলেমকে ডাকব। বুঝিয়ে বলবো। আশা করি সে আমার কথা ফেলবে না। মৌলানা সাহেব, আপনিও একটু আপনার ভগ্নিপতি আর মোসলেমকে বোঝান।
আমি এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে পারব না। একটা হিন্দুর মেয়ে আমাকে আইনের ভয় দেখায়। আমি আল্লাহর আইন ছাড়া আর কোনো আইন মানি না।
এখন আর সে যুগ নেই। আমাদের সকলকেই আমাদের মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। আর মেয়েদের চোখকানও এখন খুলে গেছে। অধিকার সম্পর্কে এখন আগের চাইতে ওরা অনেক বেশী সচেতন। তাছাড়া মোসলেম তিন বছরের জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। এতদিন মেয়েটা কীভাবে কাটাবে? নিশ্চয় এত অল্প বয়সের একটি মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থাকতে পারবে না। মা-বাবার সঙ্গেই থাকবে। আলেয়াকে পড়ালেখা করতে দিলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। বরং মেয়েটা শিক্ষিত হলে ও যখন মা হবে তখন সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে আগ্রহী হবে।
স্যার, আমি আসি। আদাব।
কনকচাঁপা উঠে গেলেও আসাদ আর মৌলানা আব্দুস সোবহান বসে রইলেন। আসাদ ব্রিবত বোধ করে চুপচাপ বসে রইল। কনকচাঁপার সাহস আর যুক্তিবোধ দেখে ও মনে মনে খুশি হলো। আসাদ উঠতে যাচ্ছিল তখন মৌলানা আবার কথা বলতে শুরু করলেন। মৌলানার রাগ তখনো মাথা থেকে নামে নি।
ক্লাসে নাটক করতে হবে কেন? ক্লাস কি নাটকের জায়গা?
বুঝলাম না।
আমি পাশের ক্লাসেই ছিলাম। গানবাজনার কারণে ক্লাসই নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন পাশের ক্লাসে যাত্রাপালা চলছে।
তাই বলুন। বাচ্চারা আসাদ সাহেবের ক্লাসে অভিনয় করছিল। কনকচাঁপা তো বেশ প্রশংসাই করে গেল।
এ সব না জায়েজ কাজ তো হিন্দু ধর্মেরই আচার।
মৌলানা সাহেব, আমি দুঃখিত। কথা না বলে পারছি না। বাচ্চাদের অভিনয় করাটা আপনার পছন্দ নয় সেটা আপনার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। কিন্তু বাচ্চাদের আবৃত্তি আর অভিনয়ের মধ্যে আপনি ধর্ম টেনে আনছেন কেন?
শোনেন, আসাদ সাহেব, আপনি আমাকে ধর্মের জ্ঞান দিতে আসবেন না। আপনি ধর্মের কী বোঝেন?
সরি, আমি সে কথা বলতে চাই নি। ধর্ম আমি আপনার চাইতে বেশী বুঝি সে দাবীও করছি না। আমি কেবল আনন্দের মধ্য দিয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে চাই। আনন্দের মধ্য দিয়ে শেখানো হলে সেটা অন্তরে প্রবেশ করে─ শিক্ষাও ভালো হয়।
স্কুল কি রঙ্গশালা যে আপনি যা ইচ্ছে তাই করবেন?
আমি যা ইচ্ছে করছি না। আমি আমার মতো করে ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছি মাত্র।
সোবহান সাহেব, আপনি থামুন। আপনার ধর্মের ক্লাস আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন সেভাবে করবেন। বাংলার ক্লাস আসাদ সাহেবেরতাঁর ক্লাস নিয়ে তাঁকেই ভাবতে দিন।
মৌলানা আব্দুস সোবহান জবাব না দিয়ে একবার আসাদ করিমের দিকে কটাক্ষ করে উঠে গেলেন। আসাদ বুঝতে পারছে না, প্রধান শিক্ষককে কী বলা উচিত। প্রধান শিক্ষক চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। উঠে যাওয়ার আগে আসাদ প্রধান শিক্ষকের চোখে আরেক বার চোখ রাখল।
আসি, স্যার।
আসাদ সাহেব, গ্রামের মানুষ চিনতে আপনার আরো সময় লাগবে। ছায়াসুনিবিড় গ্রামগুলো এখন আর শান্তির নীড় নয়। আপনি বুদ্ধিমান। তবু আমি বলবো, অভিজ্ঞতা দিয়েই মানুষকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে। আর সতর্কও থাকতে হবে। আমি কী বলতে চাইছি− বুঝতে পারলেন?
জ্বী, স্যার।