উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// এক
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// এক
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// দুই
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// তিন
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিলো, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব চার
- উপন্যাস// মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল// নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর// পাঁচ পর্ব
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল ।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।।পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব পনরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। পর্ব আঠারো
- উপন্যাস।। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।। শেষ পর্ব
এককৃষ্ণপক্ষের চাঁদটা নিঃসঙ্গ পথিকের মতো দূরের আকাশপথ পাড়ি দিচ্ছে। আর পুরোগ্রামটা স্নান জ্যোৎনার ছায়ায় রাত্রির কোলে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত।
গ্রাম থেকে বেশদূরে আন্তঃজেলা সড়কের পাশে গাড়িটাকে রেখে অতি সন্তর্পণে হেঁটে চৌকষ দলটিতখন লক্ষ্যবস্তুর কাছে এসে পৌঁছে যায়।
কেউ তা দেখে নি। কেবল শিমুলডালে বসা লক্ষ্মীপেঁচাটা জেগে ছিল; কিন্তু কী ভেবে দ্বিপ্রহর নিশুতির ঘোষণা না দিয়ে সে দলটিরগোপন অভিসার দেখছে।
জানা ছিল, একটি পরিত্যক্ত ছাত্রাবাসে লোকটি অবস্থান করছে। ছাত্রাবাসটি আসলেএখন আর ছাত্রাবাস নয়।
এখন কে বলবে এই ছাত্রাবাস একসময় জমিদারের কর্মচারী-পাইক-পেয়াদার আস্তানা ছিল। কালের ধারায় জমিদারের কর্মচারিদের স্মৃতি মুছেগিয়েছে।
জমিদার চলে গেলে পর পেয়াদার আস্তানাটি জমিদারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ছাত্রদেরআস্তানায় রূপ নিয়েছিল।
জমিদারি অধিগ্রহণের পর পরিত্যাক্ত এই ঘরটিতে দূরের গ্রামথেকে হাই স্কুলে পড়তে আসা ছাত্ররা আশ্রয় নিত।
তখন তো এই জনপদে কোনো রাস্তাইছিল না। গ্রামটার চারপাশে বিল সারা মাসই জল থৈ থৈ। নদীপথেই চলাচল ছিল।
জমিদারওবজরায় করে আসা যাওয়া করতেন। কালে ভদ্রে শুকনো মৌসুমে আসতে হলে আসতেনপালকি চড়ে। রাস্তা বলতে গেলে ছিলই না।
বিলের উপর দিয়ে কী আর রাস্তা হবে।জমিদারি এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। তবে জমিদারির কয়েকটি চিহ্নএখনো রয়ে গেছে।
জমিদারের কাচারি বাড়িটা শুকনো নাগরের তীরে কালের সাক্ষী হয়েদাঁড়িয়ে আছে। পেয়াদাছাউনিটাও আজো টিকে আছে।
তবে নাম বদলে নিয়েছে। জমিদারের ছেলের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এ গাঁয়ে কালের সাক্ষী হয়েহারিকেনের টিমটিমে আলোর মতো
শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখার ব্যর্থ ব্যর্থ চেষ্টা করেযাচ্ছে।
সেই স্কুলের ছাত্ররা বর্ষাকালে অথবা পরীক্ষার আগে পরিত্যক্ত এই পেয়াদাছাউনিতেএকসময় আশ্রয় নিত।
এখন এই ছাত্রাবাসে আর কোনো ছাত্র বাস করে না। এখন আর দূরদূরান্ত থেকে ছাত্র এ গাঁয়ের স্কুলে পড়তে আসে না।
এখন তাদের গাঁয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানহয়েছে। ছাত্রাবাসটিও এখন পরিত্যক্তই বলা যায়।
কমান্ডার মনে করেন, ছাত্ররা আর থাকে নাবলেই হয়তো এটি গোপন সন্ত্রাসীদের আস্তানায় রূপ নিয়েছে।
গল্পে যেমন পরিত্যক্ত ভবনেভুতপ্রেত আশ্রয় নিতে দেখা যায় তেমনি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতা আসাদ এখানেআশ্রয় নিয়েছে।
কিন্তু সে জানে না, এলিট বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েথাকা সম্ভব নয়।পরিত্যক্ত এই ছাত্রাবাসটির সামনে এক চিলতে চত্বর ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া।
একপাশে জমিদারির অন্যান্য ছাউনির ভগ্নাবশেষ। আর অন্যপাশে ভাঙা দেয়াল দেয়ালেরএকাংশে জোড়াতালি দেয়া একটা কাঠের দরোজা।
পেছনে একটা দীঘি, দীঘির পশ্চিমপাড়ে গাছপালা ঘেরা ঘরবাড়ি; উত্তর পাড়ে পুরোনো ঘাট, যার সিঁড়িগুলোর ইট কোথাওকোথাও খসে পড়েছে।
আর পূর্বপাশে একটা জীর্ণ দালানের ভগ্নাবশেষ যা জমিদারেরদাতব্য চিকিৎসালয় ছিল বলে কথিত আছে।
এর পাশে, অনতিদূরে খোলা প্রাঙ্গনে একটিপরিত্যক্ত কৃপ।দলটি কথিত ছাত্রাবাসের কাছে এসে পৌঁছালে দলনেতা দেখেন,
দীঘির জলের উপরচাঁদের আলো রূপার কুচির মতো তিরতির করে কাঁপছে। তবে দলের সদস্যদের ওদিকে খেয়ালকরার অবকাশ নেই।
তারা বিলম্ব না করেই মাটির দেয়াল আর টালির চালার লম্বা ঘরটিকেচারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।
একজন ‘সাহসী পদক’-ধারী হাবিলদার, মকবুল হোসেন,বিড়ালের মতো শব্দহীন পদক্ষেপে দরোজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ফোকর দিয়ে দেখতে পায়,
এই মধ্যরাতেও ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছে। আর দলের লক্ষ্যবস্তুটি খোলা জানালা দিয়েবাইরে তাকিয়ে কী নিয়ে যেন ভাবছে।
সে তার ভাবনার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে কমান্ডারেরনির্দেশনার জন্য সংকেত দিলে স্বয়ং কমান্ডারও এগিয়ে আসেন। তিনি স্বচক্ষেই দেখেন,
লোকটার সামনে টেবিলের উপর একটা খোলা ডায়েরি, তার হাতে কলম, যেন সে কোনোলুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসী নয়; যেন এক আত্মমগ্ন কবি,
নিঃস্তব্ধ রাতের নিরালায় একাজেগে কাব্যধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে। যেন একটা নতুন কবিতার জন্মের জন্য সেপ্রতীক্ষারত।
গভীর রাতের কোনো এক প্রহরে তার মনের ভেতরে জন্ম নেয়া একটি কবিতাডিমফোটা বাচ্চার মতো অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে বেরিয়ে আসবে।
আর মা মুরগিরমতো তুলতুলে বাচ্চা দেখার মুগ্ধ সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার জন্য লোকটি বসে আছে!কমান্ডার ভাবছেন,
আসাদ করিমকে স্তব্ধ রাতে জানলার পাশে এমন একাকী ভাবনামগ্নদেখে যে কেউ কবি ভেবে ভুল করবেন।
তার সম্পর্কে না জানলে এমন ভুল করা খুবইস্বাভাবিক আর সঙ্গত। কিন্তু মধ্যরাতের চৌকষ অভিযাত্রী দলের সদস্যদের ভুল করার কারণ ছিলনা।
পূর্ণিমা চাঁদের সঙ্গে কারো চাঁদমুখ কল্পনা করে আসাদ করিম সত্যি সত্যিকাব্যগ্রস্ত হয়ে থাকলেও চৌকষ দলের সদস্যদের
কাব্যজগতে বিচরণের অবকাশ না থাকায় দলেরকেউ সে রকম করে ভাবে নি।
বস্তুতঃ গদ্যময় অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের নিয়ে এই দলেরসদস্যদের কারবার। দলের উপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে,
অন্ধকার জগতের এরকম ধুরন্ধর বাসিন্দাদেরমোকাবেলা করা। দায়িত্বপালন করতে গিয়ে আবেগ-তাড়িত না হওয়ার জন্য
দলের সদস্যদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়ে থাকে। কঠিন প্রশিক্ষণের ফলে চৌকষ দলের সদস্যদেরমস্তিষ্কের কোমল অনুভূতি শুকিয়ে যায়;
তারা ক্ষিপ্র আর চৌকষ হয়ে উঠার সাথেসাথে স্নায়ুবিক অনুভূতির দিক থেকে হয়ে উঠে শিকারী কুকুরের মতো।
কালো পোশাকের ক্ষিপ্রদলটি রাত্রির অভিযানে চৌকষ শিকারীর মতোই লক্ষ্যবস্তুর উপরসঙ্গোপনে আর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
একটা শক্ত এনকাউন্টারের ভাবনা দলনেতারমাথায় ছিল। যে রকম আঁট-ঘাটবাঁধা প্রস্তুতি ছিল,
ঐ সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করতে কিন্তুদলের প্রস্তুতির সামান্যতম কসরতও কাজে লাগে নি।
বরং মধ্যরাতের সাঁড়াশি আক্রমণেরআকস্মিকতায় আসাদ করিম নামের লোকটি হতচকিত,
হতবিহল আর হতভম্ভ হয়ে গিয়েনিরপরাধ ও নির্বোধ লোকের মতো অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল।
কোনো প্রতিরোধেরমুখোমুখি না হওয়ায় দলের সদস্যরাও হতাশ আর বিরক্ত হয়েছিল।
দলের সদস্যরা ফনা তুলেদাঁতের বিষ ঝাড়তে না পেরে ফোঁসফাস করছিল।
আর কমান্ডারও ভেতরে ভেতরে হতাশ হয়েছিলেন এবং আসাদ করিম প্রতিহত না করায় তার উপর বিরক্ত হয়েছিলেন।
তিনি যা ভেবেছিলেন, বাস্তবে সেরকম প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার মতো কিছুই ঘটল না।
একজনফেরারি সন্ত্রাসীকে জলের তলের বেলে মাছের মতো বসে ভাবতে দেখা যাবে।
এমনটা বিশ্বাস করাও কমান্ডারের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে ছিল। বরং এমন অবস্থা হলো যে, পুরো দলআর কমান্ডার নিজেও বিব্রত হলেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ত্রাস আসাদকে গ্রেফতার করার জন্যসবজেলার চৌকষ দলকে নির্দেশ দেয়া আছে।
সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীদের দ্বারা গতএক বছরে বেশ কয়েকটি প্রকাশ্য খুন সংঘটিত হয়েছে। খবর আছে যে,
আসাদের নেতৃত্বেই এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সর্বহারাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীর দৃশ্যমান কোনো সাফল্য ছিল না।
আসাদ করিমকে গ্রেফতারের পর মেজর ভেবেছিলেন, মধ্যরাতের এই অপারেশনের মধ্য দিয়ে সর্বহারাদের বিরুদ্ধে উল্লেখ করার মতো
একটা সাফল্য আসবে এবং সেটা পত্রিকায় ফলাওসে আশায় ছাই পড়ল।
একজন সন্ত্রাসীর ঘর তল্লাশি করে কোনো কিছুই পাওয়া যাবে না এমন কি সে নিজের কাছে কোনো হালকা অস্ত্রও রাখবে না।
সেটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। সঙ্গে কোনো অস্ত্র না রাখার ব্যাপারটা মেজরের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
অবশ্য কয়েকটা অস্ত্রসহ আসাদকে আদালতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে থানার ওসি তাকে আশ্বস্ত করেছে।
তাতেও এলিট বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তার কোনো কৃতিত্ব নেই।
যদি ওসি বলেও যে এলিট বাহিনীর অপারেশনেই এসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তবু নিজেকে কমান্ডার সান্তনা দিতে পারবেন না।
আর যাই হোক তিনি নিজেকে পুলিশের মতো ভাবতে পারবেন না। যে ঘরটায় আসাদকে থাকতে দেয়া হয়েছিল সেখানে তেমন কোনো আসবাব পত্র ওনেই।
একটা পুরোনো টেবিল আর একটা পুরোনো চেয়ার ছিল। একটা তাকিয়া আগে থেকেই ঘরে ছিল। কবুতরের বিষ্ঠায় সেটি নোংরা হয়েছিল।
আসাদ সেটি ঝেড়ে মুছেধুয়ে পরিষ্কার করে বইপত্র রেখেছিল। তাকিয়ায় কয়েকটি রবীন্দ্রনাথের বই রাখা ছিল। কোনো লাল বই ছিল না।
বই ছাড়া টেবিলের উপর বিগত সনের একটা ডায়েরি আরটেবিলের ড্রয়ারে দুটো ব্যক্তিগত চিঠি পাওয়া গেছে।
ডায়েরি আর চিঠি দুটো আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। কমান্ডার আসাদ করিমের সেই ডায়েরিটা দেখছিলেন আর অভিযানের বিষয়ে ভাবছিলেন।
একটা সাদামাটা ডায়েরি মলাটে একটা ট্রেডিং কোম্পানির মনোগ্রাম ছাপানো। তিনি এর পাতা উল্টে দেখলেন, বর্তমান সনের নয়,
ডায়েরিটা পুরোনো না হলেও গত সনের। নাম লেখার জায়গায় সুন্দর হস্তাক্ষরে আসাদ করিম লেখা আছে।
প্রথম কয়েকটি পাতায় সংবাদের খসড়ার মতো কিছু লেখা। কিছু কিছু যেন শব্দের আঁচড় মাত্র। তাড়াহুড়ো করে লেখার চেষ্টা বোঝা যায়।
এসব লেখা বাদ দিয়ে মেজর আরো পাতাউল্টাতে উল্টাতে নিজের কথা ভাবতে শুরু করলেন।
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মেজরের নিজেরই অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর মনে পড়ল, তিনি নিজেও একসময় ডায়েরি লিখতে পছন্দ করতেন।
ছাত্র জীবনে বছরের শুরুতে বাবার নিকট থেকে তিনি শুভেচ্ছাসহ একটা ডায়েরি উপহার পেতেন। তাতে তিনি নিজের ইচ্ছের কথা,
স্কুলের মজার ঘটনাগুলো লিখতেন। সেই ডায়েরিতে কলেজে পড়বার সময় তিনি কবিতাও লিখতেন।
স্কুল আর কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর কয়েকটি কবিতা ছাপাও হয়েছিল। এখনো দু’একটি পঙতি মাঝে মাঝে মনে উঁকি দেয়।
আবার কখনো কখনো নতুনকোনো ভাবনা কবিতার মতো মনে আসে। তিনি আর কবিতাও লিখেন না, ডায়েরিও না।
বিএমএ-এর লংকোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদানের পরও কিছুদিন ডায়েরি লিখেছেন।
রাত জেগে ডায়েরি লেখার অপরাধে একবার ডিটেনশন খেয়ে তিনি ডায়েরি আর কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
তাঁর কমান্ডেন্ট ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, আবেগময় ভাবনা সৈনিকের জন্য নিষিদ্ধ। সৈনিককের আবেগ থাকা চলবে না।
আবেগ থাকলে গুলি চালানো যায় না। তখন ভেবেছিলেন, পাসআউট হবার পর আবার ডায়েরি আর কবিতা লিখবেন।
কিন্তু তারপর আর কখনও ডায়েরি লেখেন নি। তিনি আজো মনে করেন, ডায়েরি হলো যাপিত জীবনের প্রতিলিপি বা অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু যেসব বিরল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তিনি হয়েছেন সেগুলো মূল্যবান হলেও লিখতে তিনি সাহস পান নি।
এখন তিনি আরো বেশী করে অনুধাবন করেন। যেসব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৈনিক জীবন অতিবাহিত হয়
সেগুলো স্মৃতিতে ধারণ করে রাখাও বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিতে পারে। পেশাগত জীবনে তাঁর আর ডায়েরি লেখা হবে না,
তবু তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যক্তিরএকান্ত ভাবনাগুলো তার চিঠিপত্র আর ডায়েরির পাতায় প্রকৃতির মতো স্বতঃস্ফ‚র্ত হয়ে প্রকাশ পায়।
আর সে বিবেচনা থেকেই হয়তো সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলাবিরোধী অভিযোগের তদন্তের জন্য
অভিযুক্তের ডায়েরি বা ব্যক্তিগত নোটবুক তালাশ করা হয়। তিনি শুনেছেন,
কর্নেল তাহেরের লেখা ডায়রিও তাঁর বিপক্ষে মোক্ষম সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ডায়েরিটা হাতে পেয়ে কমান্ডারের মনে হচ্ছে।
নিষিদ্ধ জীবন যাপনকারী এই ব্যক্তিটিকে জানবার জন্য তার এই ডায়েরিটা সহায়ক হতে পারে। কমান্ডার ডায়েরিটা একবার পড়ে দেখার জন্য।
গ্রেফতারের আগে ডায়েরিতে সে কী লিখেছে সেটা পড়েদেখার কৌতূহল বোধ করছেন। সর্বশেষ কী লিখেছে সেটা পড়তে গিয়ে তিনি দেখলেন,
ডায়েরির অর্ধেক পাতা মাত্র শেষ হয়েছে। আসাদ করিম সবশেষে লিখেছে ‘এই গ্রাম, এই মাঠ, এখানকার লোকজন আমার খুব আপন মনে হয়।
মনে হচ্ছে, এখানে থেকেই আমি মানুষের জন্য সত্যিই কিছু করতে পারব। এখানে এসে মনে হচ্ছে। পৃথিবীটা খুব সুন্দর।
এখানকার আলো-বাতাস-জল-স্থলসবকিছু যেন মায়াময়। আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই
‘সমস্ত সভ্য সমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি পৃথিবীর এক কোণে বসে মৌমাছির মতো
আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলে আর কিছু চাই নে।
’একজন ফেরারী সন্ত্রাসীর ডায়েরিতে এরকম রোমান্টিক লেখা কমান্ডার প্রত্যাশা করেননি। আরো কিছু পাতা উল্টিয়ে দেখতে দেখতে,
কিছু কিছু বর্ণনা আর কথোপকথন পড়ে কমান্ডারের মনে হলো এটি ডায়েরি নয়, লেখাটি গল্পের মতো।
তিনি বিভিন্ন পাতার এখানে-ওখানে পড়তে নিয়ে দেখলেন, গল্পটিতে যেন আটককৃত লোকটির নিজের কথাও আছে।
নিজের কথা লিখতে গিয়ে সে যেন তার শৈশবের কথাও লিখেছে। আর শেষে স্কুলেরকথা, শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীদের কথা লিখেছে
যে স্কুলে সে ছদ্মবেশে মাস্টারি করছিল। এমনকি একটি তরুণীও গল্পে আছে, যার সঙ্গে গা ঢাকা দেয়া লোকটার একটা মধুর সম্পর্ক আছে।
সম্পর্কটিকে প্রেম বলা যাবে কিনা কমান্ডার নিশ্চিত হতে পারছেন না। আসাদএমন করে ডায়েরিটা লিখেছে যেন সে নিজেও গল্পের একটা চরিত্র মাত্র।
বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা পড়ে কমান্ডার ডায়েরিটার প্রতি আরো বেশি আকর্ষণ বোধ করছেন।
রাতের নিরালায় শিকার শেষে বিশ্রামরত শিকারীর মতো এলিট বাহিনীর এক কমান্ডার আসাদের ডায়েরিটা পড়তে শুরু করলেন।