উপন্যাসকাব্যশীলন

উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ১১ম পর্ব

অন্তর্দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করার জন্য অনুভূতিই যথেষ্ট কী বল তুমি? হোমার কিংবা মিলটন ওঁরা তো কোনোমতে যদি কবিতাটা ছাপে তাহলেই হলো। নাদিম জিজ্ঞেস করল, আবার কবে দেখা করব? ভদ্রলোক বললেন, মাসখানেক পড়ে আসবেন। নাদিম অনুরোধ করল, আমার বন্ধুটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। আপনি এডিট করে হলেও যদি ছাপিয়ে দেন তাহলে সে উৎসাহ পাবে। আরও লিখতে পারবে। আমরা গোটা পরিবার আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। ভদ্রলোক পান খাওয়া রঙিন দাঁত বের করে হাসলেন। তিনি বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানে অন্ধ। অন্ধ হয়েও কবিতা লিখে! বা! চমৎকার কবি তো উনি। বিরল প্রজাতির কবি।

ভদ্রলোকের কথা নাদিমের শরীরে যেন ভিমরুলের হুল ফুটিয়ে দিল। বিষকাতরে শরীর মুষড়ে যায়। রাগ আর উত্তেজনায় তার মাথাটা ছোলাভাজা কড়াইয়ের মত তপ্ত হয়ে ওঠল। চেয়ার তুলে এই লোকের মাথায় একটা বাড়ি দিতে পারলে শান্তি পাওয়া যেত। একটা টিস্যু পেপারের সাহিত্য সম্পাদকের এই কথা… যদি ভালো পত্রিকার হত তাহলে মেনে নেওয়া যেত। তার উত্তেজনা আস্তে আস্তে থিতু হতে থাকে আসিফের কথা ভেবে। নির্জীব হয়ে বসে রইল। দুর্বল মানুষেরাই ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকা মানুষকে সমীহ করে। নাদিমকে আজ দুর্বলই মনে হচ্ছে। তারপর শিক্ষকতার কাজে লেগে গেলে মনে হয় মহান এক আদর্শের কোলে শরীরের তেজ নেতিয়ে যেতে থাকে। না হয় আজ এই একটা কিছু হয়তো হয়ে যেত। গায়ে হাত বুলিয়ে যদি কাজ হয় অসুবিধার তো কিছু নেই। নাদিম ভাবল, হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে। সময়ে তাকে জবাব দিতে হবে।

বাসায় এসে আসিফকে নাদিম জানায়, লেখাগুলো দিয়ে এসেছি একটা পত্রিকায়। হয়তো ছাপা হবে। আসিফ খুব খুশি হয়। উৎসাহের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে ভাবে, তাহলে আমি লেখালেখিতেই মনোযোগ দিই কি বলিস? উপন্যাসটি লেখা শুরু করে দেব। গদ্যে আমার হাত পদ্যের চেয়ে ভালো। আসিফ জিগ্যেস করল, একটা কবিতার জন্য কত টাকা সম্মানী দেওয়া হয়?

নাদিম বলে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সম্মানী। আমি যেটিতে দিয়ে এসেছি ওরা পঁচিশ টাকা করে দেয়।

অনেক তুখোড় মানুষও পঙ্গুত্বের খাঁচায় অসহায় শিশু। শিশুদের মত বোধশক্তি দেখা যায়। আসিফও অনেক সময় এমন অবোধ হয়ে গেছে। আজকে আসিফ হিসেব করে মনে মনে বলল তাকে আর পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। তিনটি কবিতার জন্য পঁচাত্তর টাকা পাবে। সংসারের বাড়তি আয়ের একটা পথ হলো। এভাবে প্রতিমাসে যদি হাজার তিনেক টাকা পাওয়া যেত তাহলে নিশার আশাটা পূর্ণ করা যেত। নিশার একটা আবদার ছিলো আসিফের কাছে কিন্তু সে আবদার আজও পূর্ণ হয়নি। ‘একটা ফ্রিজ কিনে দেবে ভাইয়া, এটা তোমার কাছে আমার প্রথম এবং শেষ চাওয়া। যেদিন আসিফ চাকরিতে জয়েন করতে যাচ্ছিল সেদিন নিশা তাকে বলেছিল। আসিফ ভাবে এখন যদি পারা যায়।

এভাবে যদি ভাবা যায় যে আসিফের কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়নি কিন্তু নাদিম আসিফকে উৎসাহিত করার জন্য কিংবা পরনির্ভরশীলতার আতঙ্ক থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কিংবা পরনির্ভশীলতার দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য নাদিম আসিফের সঙ্গে প্রতারণা করে বলেছে, তোর কবিতা ছাপা হয়েছে এবং তোর আর কোনো চিন্তা নেই। তুই বিখ্যাত হয়ে যাবি সারা দেশে তোকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে বা যাবে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়?

বস্তুত তাই হয়েছিল। পত্রিকা অফিসে কয়েক মাস ঘুরে ফিরে সেদিন নাদিম দেখল সম্পাদক খামটি খুলেই দেখেননি। আরও উল্টাপাল্টা কথা। তিনি বললেন, কত লেখা দেখা যায় ভাই? দেখেন টেবিলের ওপর লেখার স্তূপ পড়ে আছে। কয়টা দেখব? এত মানুষে কবিতা লেখে কেন? মানুষের কি কোনো কাজ নেই? না কি সবাই রবীন্দ্রনাথ হয়ে মরতে চায়? এর উত্তর নাদিম কী দেবে? তবু আজ সাহসের সঙ্গে বলল, যাদের প্রতিভা আছে তারা লিখবে তাতে আপনার এত আপত্তি কীসের?

সম্পাদক বিরক্ত হয়ে বলেন, এটাকে প্রতিভা বলে না।

নাদিম আরও কঠিন ভাষায় বলল, শুনেন সবাই লিখতে পারে না। বাংলাদেশের এগার কোটি মানুষের মধ্যে কজনকে পাবেন যারা একটা নির্ভুল চিঠি লিখতে পারবে। নাদিম আরও কঠিন ভাষায় বলল, আপনার কোনো লিখা তো কোনো দিন পড়িনি। আপনি কীসের সাহিত্য সম্পাদক হয়েছেন? সাহিত্যের সংজ্ঞা জানেন? এতই যদি সহজ হয় তাহলে লেখেন না কেন? দুএকটা লেখা দেখান দেখি সাহিত্যসম্পাদকগিরি করতে বসছেন যখন। আপনার মত অপদার্থ লোকেরাই শুধু মানুষের ভালোকে ভালো চোখে দেখতে পারে না। ঘুষটুষ দিলে হয়ত লেখা ছাপেন তাই না? নাদিম খামটা নিয়ে বেরিয়ে আসে।

ভদ্রলোক হাঁ করে চেয়ে থাকেন নাদিমের দিকে।

বিকেল বেলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে নাদিম দৈনিক সংবাদ অফিসে এসেছিল। এই অফিসে তার এক বন্ধু চাকরি পেয়েছে মাসখানেক আগে। তাকে নিয়েই সাহিত্য সম্পাদকের কাছে যায় নাদিম। তার বন্ধুটি আশ্বাস দিল লেখা ভালো হলে অবশ্যই ছাপা হবে। সাহিত্য সম্পাদক সঙ্গে সঙ্গে খামটি ছিঁড়ে পড়েলেন এবং বললেন, ভালো লিখেন তো। চমৎকার কবিতা। কবে থেকে লেখেন উনি?

নাদিমের মন ভরে গেল। কৃতজ্ঞতা সপ্রতিভ সলজ্জভাব ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। নাদিম ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইল আরও কোনো কথা শোনার জন্য। তিনি আর কোনো কথা বললেন না। নাদিম মনে মনে ভাবল এখন নামিদামি পত্রিকাগুলোতে আসিফের লেখা পাঠাতে হবে। বড় মানুষের বড় মন। গুণীই জানে গুণীর কদর।

পত্রিকা অফিস থেকে এখন হেঁটে যেতে হবে। রিকশায় চড়ে না নাদিম। যে রোজগার হয় তা দিয়ে রিকশায় চড়লে উপোস করতে হবে।

হাঁটছে নাদিম। রাজপথ, অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরীর আর চলে না। এলিফ্যান্ট রোডে কফি হাউসের কাছে এসে থামে। কফি হাউসটার দিকে তাকায় নাদিম। এখানে কয়েক দিন এসেছে নাবিলাকে সঙ্গে নিয়ে। কফি খেয়েছে। কথা বলেছে। সে-সব দিনগুলো এখন মলিন হয়ে গেছে। বাস্তবতার ধুলোবালির আস্তরণ পড়ে গেছে। নাবিলাকে সেই পরীক্ষার পর আরও একদিন কড়া কথা শোনাতে হয়েছিল নাদিমকে। এই কড়া কথা তার মনের কথা ছিল না। ছিল সাজানো। এসব মনে করে নাদিম কফি হাউসের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাস্তায় পা বাড়াল।

মোড়ের পাশে একটা চায়ের দোকান। সামনে পাতা একটা বেঞ্চ। দুতিনটা বিস্কুটের বয়াম। কয়েকটি বাসি কেকের টুকরোর ওপর দুএকটা মাছি হেঁটে বেড়াচ্ছে। দোকানদার ড্রেনের দু’প্রান্তে চেয়ারের পায়া ফেলে বসে আছে। চেয়ারের নিচ দিয়ে প্রবাহিত নর্দমার পানি। বিচিত্র রঙের পানি। ড্রেনের গায়ে অতি সবুজ রঙের শ্যাওলা। কালো পানির উপর ভেসে যাচ্ছে হলুদ রঙের টুকরো টুকরো মানব বিষ্ঠা। কয়েকজন লোক বসে চা খাচ্ছে। তাদের চোখে মুখে অদ্ভুত পরিতৃপ্তির ছাপ।

একজন রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে। প্রচন্ড ক্ষোভ আর যন্ত্রণা তার বুক থেকে ঠিকরে পড়ছে। রাজনীতিক মানেই জালিম। এরা দুমুখো বিষাক্ত সাপ। অন্য একজন বলে, এত ক্ষেপেন ক্যায়? লোকটি আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ক্ষ্যাপব না তো কী করব? কয়জন পাবেন যাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল আছে? কেন তারা কি পারে না কথায় কাজের মধ্যে মিল রাখতে? আর ভোট কেন দেব? ধনী-গরিবের পার্থক্য তো কমছে না। গরিব শুধু বাড়ছেই। সব মানুষের ভোট দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আর যারা বিতলামি করে তাদের মুগর বসানো উচিত।

অন্যজন বলে, কীভাবে পারবে? সত্য কথা বললে তো আপনিও ভোট দিবেন না। তবে মুগরের কথাটা খারাপ বলেন নি। বেশ ভালো কথা।

লোকটি বলল, দুরমুজ ছাড়া ঠিক করা যাবে না। আরে বেটা এরশাদ হে আবার ‘হাঁ’ ‘না’ ভোট দেয়। জিয়াও দিল ‘হাঁ’ ‘না’ ভোট। কয়জন মানুষ গেল কেন্দ্রে? কে ভোট দিল? সাড়ে তিনটা মানুষ গেল না কেন্দ্রে দেখাইল সাড়ে তিন কোটি মানুষ ভোট দিছে। প্রতি মিনিটে চুয়াল্লিশটা ভোট পড়েছে। নিজে নিজেই রাজা? বিতলামি করার জাগা ফায় না। আমি ‘না’ বাক্সে ভোট দিলাম ফয়ত্রিশটা আর গনা হল দুইডা। ‘হা’ ‘না’ ভোটের বাক্সে আমি মুতি। উত্তেজিতভাবে এ কথা বলার সময় পায়ে নাড়া লাগায় হাতের চায়ের কাপ ছলকে অনেকটা চা পড়ে প্যান্টের ওপর। গরম লাগাতে লোকটি লাফিয়ে ওঠে। পাশের সবাই হেসে ওঠে।

অন্য লোকটিও হাসল। কিছুক্ষণ পর বলল, আপনার মত কজন মানুষ আছে? এই দেশে পাঁচ টাকা দিলে ভোট কিনা যায়। এই দেশে ভোটের সিস্টেমটা উঠায়ে দিলে ক্যামন হয়?
ক্ষ্যাপা লোকটি বলে, ঠিক বলেছেন। যে দেশে টাকা দিয়া ভোট কেনা যায় সে দেশে ভোটের সিস্টেম বাদ দেওয়া উচিত। অন্য সিস্টেম দরকার।

নাদিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। উত্তেজিত লোকটিকে নাম দিল ‘ক্ষ্যাপা মিয়া’ আর অপেক্ষাকৃত শান্ত লোকটিকে নাম দিল ‘সক্রেটিস’। সে সক্রেটিসের মেওটিস পদ্ধতি ব্যবহার করছে। অতি সূক্ষ প্রশ্ন করে লোকটার ভেতরের কথা বের করছে। আলোচনাটা নাদিমের ভালো লাগে। সে মনে মনে বলে, ক্ষ্যাপা মিয়া চালাও দেখি। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা চা খাওয়া যাক আর শোনা যাক লোকটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামে? নাদিম বলল, আঙ্কেল একটা চা দেন। নাদিম রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খায়। দুজনের আলোচনা চলছে। এবার ঢাকার রাজনীতি ছেড়ে ওয়াসিংটনের দিকে এগিয়ে গেল। আমেরিকাকে এক ছুট ধোলাই করল। আসিফ মনে মনে বলল, ক্ষ্যাপা মিয়াকে এখন ধোলাই খালের কাছে নেওয়া উচিত। তবে লোকটা যা বলছে তা খাঁটি কথা। নাদিম বেশিক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুনতে পারেনি। মাথায় রাজ্যের চিন্তা এসে ভিড় করে লোকগুলোর আলোচনার সময়। চা খেতে খেতে নাদিম চিন্তা করে আসিফকে আজ ধোঁকা দেবে। তাতে এমন কী আর হবে? আসিফ তো আর পড়তে পারবে না। নিশাকে একটু বলে দিলেই হলো। নিশা যদি এমন প্রতারণাকে প্রশ্রয় না দেয় তাহলে কী হবে? নিশাকে আগে থেকেই ম্যানেজ করে নিতে হবে। নাদিম মনে মনে ভাবে আসিফ যদি উৎসাহ পায় তবে তার লেখার গতি বেড়ে যাবে এটা ঠিক। একদিন সে নাম করা লেখক হবে-এমন দৃঢ় প্রত্যয়ের একটা চারা গাছ তার বুকের মধ্যে শাখা প্রশাখা গজাতে থাকে।

সামনের মোড়ে এসে নাদিম একটা পত্রিকা কেনে। দাঁড়িয়েই হেড লাইনগুলো দেখে। পত্রিকা পড়ার আগ্রহ খুব একটা নেই। কী আছে পড়ার মতো। সব বাসি খবর। খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ এই সব ছাড়া পত্রিকায় আর কী খবর আছে? কোনো কোনো আর্টিকেলের হেড লাইন দেখলে পিত্তি জ্বলে উঠে। রাজনীতি ছাড়া কোনো ভালো প্রবন্ধ নেই। লিখলেও পত্রিকার মুখ দেখে না। পত্রিকায় প্রবন্ধ থাকে না এটা ভাবতেও অবাক হতে হয়। শিল্প সাহিত্য কিংবা রাজনীতি কৃষ্টি কালচারের উন্নত মানের পত্রিকা; কলমে যা আসে তাই লেখা। মুখে যা আসে তাই বলা। বাচ্চাদের পরীক্ষার পড়া তৈরি করে দেয় পত্রিকাওয়ালারা। তাহলে স্কুল কলেজ কীসের জন্য আছে? পৃথিবীর আর কোনো দেশে কি এভাবে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার পড়া তৈরি নোট ছেপে দেয়? তাহলে নোটবইয়ের বা গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের দোষ কী? তাদের বিরুদ্ধে কেন পত্রিকাগুলো বিষোদাগার করে ছাড়ে? ব্যবসা করলেই কি এত নিচে নামতে হবে? নাদিমের বিরক্তি যেন বাড়তে থাকে। অনুসন্ধানহীন ও বিশ্লেষণহীন সমাজ ও জীবনবোধ উপেক্ষিত কাগজ। স্বগোক্তি আর খেদ কিছুটা থিতু হয়ে এলে পত্রিকাটি ভাঁজ করে প্যান্টের পিছনের পকেটে ঢুকিয়ে বাসার দিকে পা বাড়াল।

নাদিমের বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যার ডাক পড়ে। বড় বেশি তাড়াহুড়ো করে হামাগুড়ি দিয়ে অন্ধকার নেমে আসছে আকাশ ভেঙে। পথবাতির বৈদ্যুতিক বাল্বগুলো পেটে ধারণ করে উজ্জ্বল আলো।
বারান্দায় আসিফ বেতের চেয়ারে বসে আছে ঝিম ধরে। নাদিমের পায়ের শব্দ শুনেই সে হাসে। নাদিম তাকিয়ে দেখে এই হাসি নিষ্পাপ, অকৃত্রিম যে মনে হয় সারাদিন চেয়ে চেয়ে দেখে তার হাসি। কিরে এলি? আসিফ জিগ্যেস করে। নাদিম নিঃসংকোচে বলে ফেলে আজ সুখবর আছে। তোর একটা কবিতা ছাপা হয়েছে।

আসিফ আবেগাপ্লুত হয়ে নাদিমকে জাপটে ধরে। নাদিম কাগজটা বাড়িয়ে দেয়। আসিফ বলে কোথায় কোথায়? পেপারটা খাটের ওপর রেখে আসিফ হাত বুলায়। কোথায় কোথায় দেখি তো। হাতের স্পর্শে মনে হয় আসিফ তার লেখা কবিতাটা পড়ে ফেলছে। সে ভাবাবেগকে সংবরণ করতে না পেরে নিশাকে ডাকে, কইরে নিশা দেখ আমার লেখা ছাপা হয়েছে, আয় এসে দেখ। আসিফের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা আনন্দাশ্র“। নিশা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে।

আসিফ হাসতে হাসতে বলল, নিশা দেখ আমার লেখা ছাপা হয়েছে কাগজে।

নিশাও তার ভাইয়ের লেখাটা দেখার জন্য আগ্রহ দেখায়। কাগজটা আসিফের হাত থেকে টেনে নিল। নাদিম নিশার থুতনি ধরে বিনীত ক্ষমা প্রার্থনা করে শব্দহীন ভাষায়। হাতজোড় করে তার দিকে তাকিয়ে শব্দহীন ভাষায় ক্ষমা চায়। নিশা বুঝতে পারল নিছক বানোয়াট কাহিনী। নাদিম কোনো নাটক তৈরি করছে কে জানে? এতক্ষণে হাস্যোজ্জ্বল নিশার মুখাবয়বে নেমে এল কালো মেঘের ছায়া। জমাট মেঘ যেমন বৃষ্টি বর্ষণ করেÑনিশার কান্না পেল। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। আসিফ জিগ্যেস করে, কাঁদছিস কেন? নিশা বলল, আমার আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না ভাইয়া এই বলেই সে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। সেখানেও তার কান্না থামে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।

নাদিম আসিফকে বলল, এত আবেগপ্রবণ হলে কি চলে? কেবল একটা লেখা ছাপা হল। যখন তোর লেখা মানেই পত্রিকাওয়ালারা পাগল হবে সে দিন তোর সুখ। তুই লিখে যা। আমার বিশ্বাস তুই প্রতিষ্ঠা পাবি। আসিফ আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। এ যেন আপ্তবাক্য। শব্দহীন ভাষায় তার আত্মবিশ্বাসের কথা জানায়—যেন কষ্টের মালভূমিতে স্বপ্নময় ভবিষ্যতের বীজ।

রাত গভীর। কারও চোখে ঘুম নেই। নাদিমের চোখে ঘুম নেই। নিশাও ভাবছে আদিগন্ত নাদিম কেন এমন একটা কাণ্ড করল? কী প্রয়োজন এমন প্রতারণা করার? আসিফকে বোঝা ভেবেই এমন ধোঁকা দেয়া হচ্ছে নাকি, না অন্য কিছু? আসিফই বা আর কত দিন এমন বোঝা হয়ে থাকবে? নাদিম যদি কোনোদিন চলে যায় তাহলে আসিফকে কে দেখবে? এমন হাজারো প্রশ্নের স্রোতে নিশা ভাসতে লাগল।

আসিফও ঘুমুতে পারছিল না। মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল। আরও কত লিখতে হবে তাকে। অনেক চিন্তা মাথায় জমা হচ্ছে। হঠাৎ তার মনে পড়ে চিন্তার ওয়েভ আছে। এগুলো জমাট হলেই ভালো লেখা হয়। ওয়েভগুলো যত বেশি সন্নিবেশিত হবে তত বেশি লেখা সম্ভব। এ জন্যই হয়তো বড় বড় মনীষীরা বলে গেছেন বেশি চিন্তা করো। ভালো কিছু করার জন্য চিন্তাই হলো মূল মন্ত্র। চিন্তাই মূল শক্তি।

নিশার শরীর থেকে মেয়েলি গন্ধ নির্গত হচ্ছে। নিশা পাচ্ছে পুরুষালী গন্ধ। নাদিম ছড়িয়ে দিচ্ছে সে গন্ধ বাতাসে। তার হাত পড়ে নিশার শরীরে। ঘুমঘরের বাতি নেভানো।
ঘুমিয়ে পড়েছো? আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে নাদিম।
নিশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
নাদিম বুঝতে পারে নিশা ঘুমোয়নি।

উষ্ণ আদর ঢেলে দেয় নাদিম। চুলের অরণ্যে আঙুল সঞ্চালন করে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে নাদিম বলে, তুমি দুঃখ পেয়ো না নিশা। ওর বিষণ্ন আনন্দহীন জীবনে একটু আনন্দ দিতে চেয়েছি। আমি জানি এটা প্রতারণা। তারপর ভাবলাম, ওতো খারাপ লেখে না। অন্তত আমি তো বুঝি কোন লেখাটা ভালো কোনটা খারাপ। যদি উৎসাহ পায় তাহলে আরও লিখতে পারবে। ওকে এখন বলছি উপন্যাস লেখা শুরু করতে। যদি ও শুরু করে, তাহলে লেখালেখি নিয়ে থাকতে পারবে। চাকরির চেষ্টা তো করছি, কোথাও কিছু করতে পারছি না। শুধু বসে থাকলেও ও মানসিকভাবেও প্রতিবন্ধী হয়ে যাবে। তুমি দেখো ও একদিন নামী লেখক হবে। ওর মেধা আছে কিন্তু পরিচর্যা নেই। আমি মাত্র একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে যাচ্ছি আর কিছু না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

নিশা কিছু বলল না। নাদিমের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পর ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল, ভাইয়ার তো আর হারাবার কিছু নেই।
নিশার কথা শোনে নাদিমকে আরও বেশি অপরাধী মনে হল। নিশাকে আরও কাছে টেনে এনে বুকের সাথে মিশিয়ে চেপে ধরল নাদিম। ক্ষমা করো নিশা। তুমি আর আমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না। আমরা না হয় লুকিয়ে থাকব কিছুকাল। তারপর দেখা যাক কী হয়?

নিশা নিরুত্তাপ। নাদিমের স্পর্শে শরীরের শীতলতা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে উষ্ণতার আধারে। এক সময় নিশার শরীর বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ঢেউয়ের মত। মনে হল ছোট খাটো অপরাধ করে ক্ষমা চাইলে প্রেম গাঢ় হয়। নাদিম হারাতে থাকে নিশার মধ্যে। নিশাও ডুবে যেতে থাকে নাদিমের মধ্যে।

পরদিন বিকেলে নাদিমের বাবা এলেন নিশাদের বাসায়। নাদিমের বাবা ইদানীং প্রায়ই আসেন। নিশার হাতের এক কাপ চা খেয়ে যান। হাতে করে কিছু নিয়ে আসেন। নিশাকে সেদিন বললেন, মানুষের জীবন বড় বিচিত্র বুঝলি নিশা। একেক বয়সে একেক রকম সঙ্গ চায় মানুষ। সঙ্গ ছাড়া বেঁচে থাকা খুব কষ্ট। বাসায় কেউ নেই। সানাইয়ের মা তো আমার সাথে কথাই বলতে চায় না। অদ্ভুত চিজ। সানাই যখন বাড়িতে ছিল বাড়িটা ভরাট ছিল, এখন মনে হয় একটা গহŸর।

এখানে চলে আসতে তার শ্বশুরকে বলল নিশা। নিশার কথা শুনে তিনি হাসলেন। বললেন, ঘরশ্বশুর হব? শ্বশুরের কথায় নিশাও হাসল।

নাদিমের বাবা আসিফের কাছে গিয়ে বসলেন। তোমার সাথে আলাপ করে বেশ মজা পাই বুঝলে আসিফ, নাদিমের বাবা বললেন। আসিফ ফালতু কথা বলে না। জ্ঞানের কথা বলে। ছাত্র-জীবনে যে পড়াশুনা করেছে তা থেকেই এখন পুষিয়ে নিতে পারে। শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে অগাধ ধারণা। বিশ্লেষণ ক্ষমতাও জোরালো আর ধারালো।

আসিফ আজ হাসতে হাসতে বলল, চাচা আপনি তো অনেক কাগজ পড়েন। আমার কবিতা ছাপা হয়েছে দেখেছেন? আসিফের আজ আর এক প্রকার সুখের বিস্ফোরণ। নাদিমের বাবা প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠেন। তিনি বললেন, না তো, দেখিনি? কোন কাগজে? দেখাও তো পড়ি। আসিফ এখন নিজেকে খুব ছোট মনে করছে। সেদিন সে এতই আপ্লুত হয়ে পড়েছিল কাগজের নামটি পর্যন্ত জিগ্যেস করেনি।

আসিফ নিশাকে ডেকে বলল, কোন কাগজে জানি ছাপা হয়েছে আমার কবিতা? নিশাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল। সে কি বলবে বুঝতে পারেনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, কাগজটা ও কলেজে নিয়ে গেছে। ও এলে বলা যাবে। আসলে কাগজের নাম দেখার দিকে আমাদের মন ছিল না। আসিফ মর্মাহত হয়। আফসোস করে বলল, কবিতাটি দেখাতে পারলাম না?

নিশাও মর্মাহত হয় আজ এমনভাবে বানিয়ে মিথ্যে কথাটা বলল।

নাদিমের বাবা আসিফকে উৎসাহিত করেন লেখার জন্য, লিখে যাও। একদিন তোমাকে দেখতে চাই আন্দ্রেই ভজনেসনাস্কির মতো বিখ্যাত কবি। তিনি স্থাপত্যের ছাত্র ছিলেন। হয়তো তুমি চোখে দেখো না তাতে কি? আসলে মানুষের ইনসাইট যদি ক্ষমতাধর হয় তাহলে চোখে দেখার প্রয়োজন নেই। এই তো দেখো আমরা কোটি কোটি মানুষ ঝিঙে ফুল দেখেছি কবিতা লিখতে পারিনি। নজরুল লিখেছেন। আমরা কোটি কোটি মানুষ সিগারেট টানি Ñ সুকান্ত লিখে গিয়েছেন সিগারেট দিয়ে এক অসাধারণ জ্বলে ওঠার মত বিদ্রোহ কবিতা। কমলালেবু আমরা কত মানুষই খাই আর জীবনানন্দ লিখেছেন কেমন সুন্দর কবিতা− নাদিমের বাবা পাঠ করলেন কবিতাটি…

একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।

কবিতাটি পাঠ শেষ করেই তিনি বললেন, কজনে লিখেছে কমলালেবু হয়ে রোগীর পাশে থাকতে চান। ছোট্ট অথচ অদ্ভুত রকমের সুন্দর কবিতা জীবনানন্দ দাস লিখেছেন। কপালের চোখে দেখে কবিতা লিখতেন না। অন্তরের চোখ দিয়ে দেখতেন। তুমিও অন্তরের চোখ দিয়ে দেখ এবং লেখ। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে লেখার জন্য জাগতিক বিষয়গুলোকে ইনসাইটের সাথে রিলেট করা।

Series Navigation<< উপন্যাস।। ছায়াপথ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। ১০ম পর্বউপন্যাস।। ছায়াপথ ।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। শেষ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *