উপন্যাস

উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব পনেরো

এগারো

সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশ দূতাবাসের এক জুনিয়র কর্মকর্তা অফিসকক্ষে টেবিলের সামনে বসা আমির হামজা আল শামসের দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বললেন, ‘আমার দেশের এক তরুণের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন দেখে ভালো লেগেছে। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী দেশে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। রুস্তমের বাড়ি থেকে ছবি ও প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। নিন। প্যাকেটটি নিন।’

আমির হামজা বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! দেশের মানুষের জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। দ্রুত কাজটা করে দিতে পেরেছেন। এজন্য আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার উদ্দেশে বলছি, বাংলাদেশের বহু ছেলে আমার তত্ত্বাবধানে কাজ করছে। কারও মধ্যে অসততা বা অপরাধপ্রবণতা দেখিনি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক আছে এ দেশে। কেউ কেউ হয়তো অপরাধ করছে, সবাই নয়। ঢালাওভাবে সবাইকে অপরাধী ভাবিনি কখনো। যদিও এখন কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা বেশি অপরাধপ্রবণ।’

‘জি। ঠিক বলেছেন। জাল পাসপোর্ট, পাসপোর্টের ছবি ও তথ্য পরিবর্তন করে ইউএই-তে এসে অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। অনেককে বিমানবন্দর থেকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য কেবল নিরীহ শ্রমিকরা দায়ী নয়, ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সিও দায়ী। এসব প্রতিষ্ঠানের পাল্লায় পড়ে এ দেশে এসে দুই বছরেও সঠিক কাজ না পেয়ে নিয়োগকর্তার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে বহু বাংলাদেশি শ্রমিক। এভাবে অবৈধ হয়ে গেছে প্রায় এক লাখ। তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে যারা এসেছে, অধিকাংশই ভালো আছে এ দেশে।’

‘অবৈধ সবাই তো অপরাধী নয়। পরিস্থিতির শিকার।’

‘জি। সত্য কথা বলেছেন। আপনাকে কিছু তথ্য দিই। পরিস্থিতির বলি হয়ে হত্যা মামলায় জড়িয়েছে প্রায় অর্ধশত; অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে পাঁচজন এবং মাদকসেবন ও কেনাবেচার সঙ্গে জড়িয়েছে পঁচিশজন। বৃহত্তর শ্রমিক সততার সঙ্গে কাজ করে আপনাদের দেশটা গড়ে তুলছে।’

‘যারা গ্রেফতার হয়েছে, মামলায় জড়িয়েছে, সবাই যে প্রকৃত অপরাধী, তা মনে করছি না। অনেক নিরীহ ছেলেও জড়িয়ে গেছে বিপদে। এ দেশের বাসিন্দা হিসেবেও অনুভব করছি। যেমন বলব রুস্তমের কথা। কোনো দোষ না করেও সে আসামি। পড়ে আছে মরুজেলে। তাকে উদ্ধার করেই ছাড়ব—এ বিশ্বাস রাখি।

‘অল্পসংখ্যক অপরাধীর জন্য বিপুলসংখ্যক সৎ শ্রমিকের ভাবমূর্তি যেন নষ্ট না হয়, আরব আমিরাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করার দায়িত্বও আপনাদের। শ্রমিকদের কাছে শুনেছি, সমস্যা নিয়ে দূতাবাসে এসে সহায়তা পায় না। অবহেলা করা হয়, তাড়িয়ে দেওয়া হয়—বিষয়টি সত্যি মনে হলো না আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রমাণ পেয়ে।’

আমির হামজার কথায় অপরাধবোধে আক্রান্ত হলেন জুনিয়র কর্মকর্তা। ত্রুটি নিজে ধরতে পারে না কেউ। চোখে আঙুল দিয়ে অন্য কেউ ধরিয়ে না দিলে নজরে আসে না নিজেদের দোষ, স্খলন। সমালোচনাটা সহজভাবে নিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তা বললেন, ‘এটাও একটা ঢালাও অভিযোগ। তবে বলছি, সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করব সবার দেখভাল করার। এখন দেখুন, পাঠানো তথ্যে রুস্তমের কোনো উপকার হয় কি না।’ প্যাকেটটা খুললেন আমির হামজা। পাশে তন্ময়ও আছে। রুস্তমের বিয়ের ছবি দেখে সোল্লাসে বলল, এই তো রুস্তম! বিয়ের ছবি! ছবিটির উলটো পিঠে দস্তখত করা নাম দেখল, নূরে জান্নাত কলি!

তন্ময় বলল, ‘বলেছিলাম না! ওর বউয়ের ডাকনাম কলি হতে পারে। মিলে গেছে স্যার!’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন আমির হামজা। ছবিটি হাতে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে একবার তাকালেন নবদম্পতির দিকে। তারপর ঘোষণা করলেন, ‘সত্য চেপে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে বেরিয়ে আসবেই সত্য। ভুল বুঝে একজনকে শাস্তি দিলে সেই শাস্তির দায়ভার সংশ্লিষ্ট সবার ওপর পড়বে। আমরাও দায় এড়াতে পারি না।’

‘জি স্যার। আপনি ঠিক বলেছেন। এখন উদ্ধারের কাজে নেমে পড়তে হবে আমাদের।’
‘উদ্ধারের কাজেই আছি আমরা। এখন যাব চিফ অফিসারের কাছে। তাকে নিয়ে যেতে হবে সিকিউরিটি ইনচার্জের সেলে। মহলের আম্মিজানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইব।’
‘আম্মিজান কি স্বীকার করবেন নিজের ভুল, স্যার?’

‘আম্মিজান তো আর নির্দয়া নন। ভুল করেছেন। ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারলে অনুতপ্ত হতে পারেন। অনুতপ্ত হওয়া অপমানকর নয়, সম্মানজনক। এই বোধ কাজ করে আমাদের নারীসমাজের মাঝে। সঠিকভাবে অ্যাপ্রোচ করতে পারলে নিশ্চয়ই সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারব রুস্তমকে।’

‘তাহলে উনার সঙ্গে দেখা করাটাই জরুরি।’
‘হ্যাঁ। জরুরি।’
‘দেখা করার অনুমতি পাব তো?’
‘এটা একটা ঝামেলার কাজ। মহলে যাওয়ার জন্য, দেখা করার জন্য কর্তৃত্ববান পুরুষের অনুমতি লাগবে। সেটা পেয়ে গেলে সব পথ সহজ হয়ে যাবে।’
‘মহলের  আম্মিজানের  হাতে কি এখনো কোনো ক্ষমতা রয়েছে রুস্তমকে মাফ করে দেওয়ার?’

‘হ্যাঁ। আছে। শুরা পরিষদে যায়নি মামলাটি। মহলের ডিসিপ্লিন ভঙ্গ হয়েছে—এই অজুহাতে রুস্তমকে লঘু সাজা দিয়েছে ডিসিপ্লিনারি বোর্ড। তাছাড়া রুস্তমকে মাফ করে দেওয়ার সঙ্গে মহলের ছোটো মেয়ের মুক্তির বিষয়ও জড়িত। শুনেছি, তাকেও নিজ গৃহে অন্তরিন রাখা হয়েছে।’

দুজনের কথোপকথন শুনে দূতাবাসের কর্মকর্তা বললেন, ‘আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, মহলে ঢোকার অনুমতি পাওয়াটাই এখন বড়ো কাজ। বড়ো বাধাও বলতে পারি। কী বলেন হামজা সাহেব?’

‘জি। সেটা বলা যায়।’
‘বাধা টপকানোর জন্য দূতাবাস থেকে কি কোনো উদ্যোগ নিতে পারি?’
‘আগে চেষ্টা করে দেখি আমরা। ফেল করলে আপনাদের সাহায্য নেব। আশা করছি ফেল করব না। কী বলো, তন্ময়?’
‘স্যার! সামনাসামনি প্রশংসা করা ঠিক নয়। দুবাইতে আপনার মতো এমন মহানুভব মানুষের দেখা পাইনি। যেখানে আপনি আছেন, ফেল করার প্রশ্নই ওঠে না।’ জুনিয়র কর্মকর্তা বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, তন্ময়। নিশ্চয়ই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসবে রুস্তম। নিশ্চয়ই আপনাদের উদ্যোগ সফল হবে।’

আমির হামজা উঠে দাঁড়ালেন। হ্যান্ডশেক করলেন কর্মকর্তার সঙ্গে। বললেন, ‘আমাদের জীবনটা খুব ছোটো। কারও আসন কোথাও স্থায়ী নয়। যে চেয়ারে বসেছেন, সেটাও স্বল্পস্থায়ী। স্বপ্ন সময়ে যতটুকু সম্ভব প্রবাসীদের জন্য আন্তরিকভাবে করবেন, এ দাবি রাখছি। পরামর্শ বা উপদেশ দিচ্ছি না। এটা আমার উপলব্ধি। আপনাদের সহযোগিতা পেলে অনেক নিরীহ সৎ শ্রমিকের মূল্যায়ন সঠিক হবে, নিশ্চিত আমি।’

আমির হামজা আল শামসকে বিদায় করে চেয়ারে কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কর্মকর্তা। এই প্রথম দুবাইয়ের একজন মহৎ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে সমৃদ্ধ করলেন নিজের বোধ আর উপলব্ধি। এ ব্যক্তি প্রবাসী শ্রমিকের জন্য ঢেলে দিচ্ছেন মমতা, মানবিকতা! দেশের প্রতিনিধি হিসেবে কী করছি বা করতে পারছি ? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন দূতাবাসের এই কর্মকর্তা।

কোনো উত্তর এলো না মাথায়। বুঝলেন, যা করছেন, তার চেয়ে বড়ো কিছু করতে হবে। যেসব শ্রমিক ঢুকবে এ দেশে, তাদের জন্য একটা পরামর্শসভা করা জরুরি। ঠেকে শেখার চেয়ে আগাম অভিজ্ঞতা নিয়ে মাঠে নামলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।

কাজটা যত কঠিন মনে হয়েছিল, এখন তত কঠিন মনে হলো না। চিফ অফিসারের কারণে সিকিউরিটি ইনচার্জ ভালো ভূমিকা রেখেছেন। অন্দরমহলে ঢোকার অনুমতি পেয়েছেন চিফ অফিসার ও আমির হামজা আল শামস। তন্ময়ের অনুমতি মেলেনি। মহলের বাইরের ওয়েটিং রুমে বসানো হয়েছে দুজনকে। মহলের আম্মিজান সরাসরি এখানেই আসবেন বলে জানানো হয়েছে।

মহলের ভেতর থেকে ওয়েটিং রুমে ঢোকার আলাদা পথ রয়েছে। সেই পথ ধরে এগিয়ে এলেন আম্মিজান। যেখানে বসে সাধারণত দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দেন, সে কক্ষে না ঢুকে ঘরোয়া আরেকটি কক্ষে বসার পর নারীরক্ষীরা দুই অতিথিকে নিয়ে এলেন ওই রুমে। আবায়ায় ঢাকা আম্মিজানের মুখ দেখা না গেলেও, প্রার্থিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসা দুই সাক্ষাৎপ্রার্থীর জন্য অদৃশ্য অনুকম্পা রয়েছে। বোরকার ভেতরের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তা প্রকাশ পাচ্ছে।

গম্ভীরকণ্ঠে আম্মিজান বললেন, ‘বলুন। কী বলতে চাইছেন, খোলামেলা বলুন।’
‘বলার আগে এই ছবিটা দেখাতে চাই আপনাকে।’ বলতে বলতে ছবিটি সামনে বাড়িয়ে দিলেন আমির হামজা আল শামস।

ছবিটা দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন আম্মিজান। একটা ধাক্কা খেয়েছেন বোঝা গেলেও, চট করে প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। কোনো প্রশ্ন না করে হাতে ধরা ছবিটা দেখতে দেখতে আবার বসে পড়লেন চেয়ারে। চারদিক থেকে যেন তীক্ষ্ণ বাণ এসে আঘাত হানল তার বোধে। নিস্প্রাণ পাষাণবেদি নড়ে উঠল মরমি প্রত্যয়ে। দম্ভের কারণে নয়, কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা মহলের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতার কারণে তাৎক্ষণিক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা যে ভুল ছিল তা আঁচ করতে পারলেন। তবু প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁ। বুঝলাম ছেলেটি বিবাহিত। এটা দিয়ে কী প্রমাণ করতে চান?’ ‘প্রমাণ করার বিষয় নয়, আম্মিজান। একটা তথ্য দিতে এসেছি। ছেলেটির স্ত্রীর নামও কলি। অপর পিঠে নববধূ তার সিগনেচার করে দিয়েছে। তার আসল নাম নূরে জান্নাত। ডাকনাম কলি। স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বউয়ের নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি। রুস্তম উত্তরে বলেছিল, কলি। এ মহলের ছোট্ট আম্মিজানের নামও কলি। একই নাম ও ভাষাবিভ্রাটের কারণে ভুল বোঝাবুঝি হলো কি না, ছবিটি পর্যালোচনার জন্য আপনার দরবারে পেশ করলাম।’

‘ছবিটি সংগ্রহ করে ভালো করেছেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন আম্মিজান। এতে শুধু ওই নিরীহ ছেলেটির উপকার হবে না। মহলের ছোটো মেয়ে কলিরও মুক্তি ঘটবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ছেলেটির মুক্তির জন্য। তাকে পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করব। সঠিক তথ্য জানানের জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

অমাবস্যায় হারিয়ে যাওয়া চাঁদ যেন আবার ফুটে উঠল আকাশে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করে উঠলেন আমির হামজা আল শামস। চিফ অফিসার বললেন, ‘আম্মিজান, ছেলেটি সৎ। ভালো ছেলে। হামজা সাহেব, দুবাইবাসী হয়ে তাকে সার্টিফাই করেছেন। এজন্য এতদূর পর্যন্ত আমরা এসেছি। আমাদের প্রচেষ্টাকে সহজভাবে নেবেন, আশা করি।’

তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বিদায় নিলেন।

সাবানের ফেনায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে অবরুদ্ধ মহলের বাথটাবে শরীর এলিয়ে রিল্যাক্স হওয়ার চেষ্টা করছিল দুবাই-কলি। চোখ ছিল আলো-ঝলমলে বাথটাবের সুইচবোর্ডের দিকে। হাতের স্পর্শে বা আঙুলের চাপে সুইচ অন-অফ হলেও এখন আপনাআপনি অন-অফ হচ্ছে মনের সুইচ। সাবানের ফেনায় ডুবে থাকলেও বাথটাবের আলো চুইয়ে নেমে যেতে লাগল ভেতরের ক্লেদ, হতাশা। বেঁচে থাকার প্রেরণা পেল অবিচারের প্রতিশোধ নেওয়ার আশায়। ক্রোধ, ক্ষোভ আর ঘৃণার ত্রিমুখী আক্রমণে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল সে। খসে খসে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল ডানামেলা পাপড়িদল। ক্রমশ নিঃশেষ হতে থাকা দুবাই-কলি তন্দ্রা ও বিস্ময়ের ঘোর থেকে জেগে উঠল। আশ্চর্যজনকভাবে পায়ের পাতায় নিজের ভর টের পেল। অস্তিত্বের গহিনে খুঁজে পেল নিজেকে। নিজের আয়নায় ভেসে উঠল নিরীহ রুস্তমের বিপর্যস্ত প্রতিটি মুহূর্ত। সনাতন সংস্কারে মধ্যযুগীয় বর্বরতার দৃশ্যপট তাড়াতে পারল না মন থেকে। নতজানু হলো রুস্তমের প্রতি। আভিজাত্যের খোলস ছোটো হতে হতে নেমে গেল তার পদযুগলের কাছে।

ধ্যান ভাঙল মহলে কারও আসার সংকেত শুনে। এটি কোনো স্বাভাবিক সংকেত নয়। বিশেষ কেউ এলে এমন সংকেত দেওয়া হয়। বিশেষ জনকে বিশেষ সম্মান জানানোর বিধান রয়েছে মহলে। বিধান মানার তাগিদবোধ করল না কলি। একবারমাত্র নড়ে উঠে ভাবনার চাকা ঘুরিয়ে দিলো আপন বলয়ে।

আবার সংকেত হলো। টের পেল, এটা স্বাভাবিক সংকেত নয়। জরুরি ঘণ্টা বাজছে। স্পেশাল গার্ড এসে যাবে এখন। কী করবে? সংকেতে সাড়া না-দেওয়ায় নিয়ম ভাঙার জন্য আবারও সাজা দেবে? শিকল পরাবে? জরুরি সিগন্যাল পাত্তা না দিয়ে যেমন ছিল, তেমনই চোখ বুজে শুয়েই রইল বাথটাবে। স্মৃতির ধুলোর ঘূর্ণিতে ভেসে উঠল রুস্তমের মুখ। অসহায় ছেলেটির জন্য কি প্রেম জেগেছিল তার মনে? এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে নিজেকেই উত্তর দিলো—না, না। তাহলে কেন ভাবনায় ঠাঁই পায় রুস্তম?

বিশেষ ব্যবস্থায় বাইরে থেকে মহলের মূল দরজা খোলার শব্দ টের পেল। নড়ল না তবু। যেমন ছিল তেমনই রইল। কাছে আসছে পায়ের শব্দ। বাথটাবের সামনে এসে থেমে গেল শব্দ। চোখ বন্ধই আছে কলির। ‘চোখ খুলে দেখো আমি এসেছি। তোমার আব্বাজান এসেছেন। ওঠো।’

আম্মিজানের কণ্ঠ শুনে চকিতে রক্তশূন্য হওয়ার আগেই আব্বাজান আসার খবরে হঠাৎ চারপাশে শুনতে পেল যেন শঙ্খধ্বনি। চাঁদের পূর্ণ জোছনায় প্লাবিত হওয়ার মতো মায়াবী প্লাবন টের পেল শরীরে। মেঘ ফুঁড়ে আলোর ঢল নামল দু-চোখ বেয়ে। চারপাশে আলো আর আলো। ভুবন ভরা আলোর জোয়ারে খুলে গেল চোখের পাতা। একবারমাত্র তাকিয়ে দেখল মায়ের মুখ থেকে ঝরে পড়ছে জ্যোতির্ময় আলো। নির্দয়তার ছায়া নেই সেখানে। চোখ বন্ধ করল আবার। কবরের অন্ধকার নয়, মাতৃজঠরের ঐশ্বরিক আলোয় ধুয়ে গেল দেহমন। বন্ধ চোখের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে এলো লোনাজল। এ জল উৎসর্গ করল রুস্তমকে। বাথটাবের সুইচবোর্ড থেকে বেরোতে লাগল বাসন্তী রঙের ঢেউ। এই ঢেউয়েও নেয়ে উঠে স্বাভাবিক কণ্ঠে কলি বলল, ‘বসার ঘরে বসুন, আমি আসছি।’

সদ্যঃস্নাতা মেয়ের মুখে যেভাবে লাবণ্য ফুটে থাকার কথা, ছিটেফোঁটাও নেই। দীর্ঘ সময় শৃঙ্খলিত থাকার কারণে যে মানসিক যাতনাভোগ করেছে তার প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে আছে মুখে।
কম্পিত কণ্ঠে আব্বাজান বললেন, ‘এই নাও। ছবিটা দেখো।’

বাবার কথা উপেক্ষা না করে ডান হাত বাড়িয়ে ছবিটি নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে বুঝল, রুস্তমের বিয়ের ছবি এটি। নববধূর মিষ্টি মুখটা ক্ষণিকের জন্য ঝিকমিক করে উঠলেও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বলল, ‘কী করব ছবিটা?’

‘দেখালাম তোমাকে। রুস্তম বিবাহিত।’
‘হ্যাঁ। তিনি বলেছিলেন আম্মিজানকে।’
‘ওর বউয়ের নাম কলি।’
‘হ্যাঁ। সেকথাও আম্মিজানকে বলেছিলেন তিনি।’

অপরাধী কণ্ঠে আম্মিজান বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমাকে বউ হিসেবে দাবি করেছে রুস্তম। সে দাবিতে ইন্ধন রয়েছে তোমারও।’
‘ভুল মনে করেছিলেন। ভুল ভাঙানোর কোনো সুযোগই দেননি আপনি।’
‘বাংলাদেশের কোনো মেয়ের নাম কলি হতে পারে, মাথায় আসেনি আমার। এর জন্য অনুতপ্ত আমি।’

‘অনুতপ্ত হওয়ার কথা শোনাচ্ছেন কেন আমাকে? যাকে শোনানো দরকার, তার কাছে গিয়ে অনুতপ্ত হন। দুঃখপ্রকাশ করলেই তো সব ভুল শোধরানোর সুযোগ থাকে না।’
মা-মেয়ের কথায় অংশ নিয়ে আব্বাজান বললেন, ‘সুযোগ আছে। আমাদের মরুজেলেই রাখাল হিসেবে রয়েছে সে। তাকে উদ্ধার করব আমরা।’
‘উদ্ধার করলেই হবে না। এ দেশে পুনর্বাসিত করে দিতে হবে তাকে। এই উদারতা আছে আপনাদের, জানি আমি। ওকে সাজা দিয়েছে কে?  শুরা  পরিষদ,  নাকি মহলের  শৃঙ্খলা রক্ষা বোর্ড?’

‘মহলের শৃঙ্খলা রক্ষা বোর্ড।’

আব্বাজানের জবাব শুনে মনের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল যেন বর্ষার নতুন জলে ভেসে গেল। উধাও হয়ে গেল বিষাক্ত দংশন। ফুরিয়ে যাওয়া চোখের আলো দপ করে জ্বলে উঠল আবার। আশা জেগে উঠল বুকে। আম্মিজান বললেন, ‘তোমার ওপর দিয়ে যে ঝড় গেল, কোনোকিছুর বিনিময়ে শোধ হওয়ার নয় সে ক্ষতি। তবু বলব, মহলের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়ে কঠোর হয়েছিলাম। এই কঠোরতায় মাতৃত্ব কিংবা পিতৃত্বের কোনো হাত নেই। দায় নেই।’

মায়ের নতজানু কণ্ঠস্বর মনের বিদ্রোহের ঢেউয়ে বাধা দিলো। তবু কঠিন কণ্ঠে কলি বলল, ‘আমাকে বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই, আম্মিজান। প্লিজ! নিরীহ শ্রমজীবী মানুষটাকে বোঝান। তার যন্ত্রণাকাতর মনটাকে শান্ত করুন। এতে শান্তি পাবে দেশে তার পরিবারও।’

মেয়ের পরিণত কথাবার্তায় চমকে উঠলেন মহলের কর্তৃত্ববান পুরুষ, আব্বাজান। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ভেবো না, মা। যতটুকু অবিচার হয়েছে, কড়ায় গন্ডায় পুষিয়ে দেবো আমরা।’একবার ইচ্ছা হলো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করেন। ভেতরের এই তাড়নাটি বাধা পেল। খেয়াল করলেন, বয়স কম হলেও দৈহিক গড়নে বেশ বড়ো হয়ে গেছে সে। নারী হয়ে উঠেছে আদরের মেয়েটি। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা হঠাৎ মাথায় এলো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন মেয়ের মহল থেকে।

আম্মিজান নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না নিজেকে। ঝাঁপিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। মেয়ের মাথায় আদর বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলেন স্বামীর সঙ্গে। এই আদরে একাত্ম হতে না পারলেও দুই নক্ষত্রের আগমনে বন্দিদশা থেকে মুক্তি টের পেয়ে স্বস্তি পেল কলি।

করিডর ধরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জিনাত মহল স্বামীর উদ্দেশে বললেন, ‘কী ভুলটাই না হয়ে গেল? অপরাধের বোঝা থেকে দ্রুত মুক্তি দেন আমাকে। ছেলেটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসুন।’
নিজের স্ত্রী হলেও, মহলের সবার শ্রদ্ধেয় আম্মিজান হিসেবে পরিচিত জিনাত মহল। তাঁর কাতর আবেদন শুনে বললেন, ‘আবেগতাড়িত হয়ে চট করে ছোটো-বড়ো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। টের পেলেন তো, বেগম?’

‘নিজের মেয়ের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দিয়ে টের পেয়েছি। সাজা পাচ্ছি নিজেও। দিশেহারা লাগছে। আমার চাপমুক্ত করুন। পাপমোচন করুন ভুল সিদ্ধান্তের। দ্রুত করুন, জনাব।’
‘ভুল ধরতে পেরেছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে আমাদের হাতে। আর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। মাথা ঠান্ডা রেখে এখন নিতে হবে সামনের সিদ্ধান্তগুলো। নইলে আরেক ঝড়ে উড়ে যেতে পারে আমাদের পার্থিব মহল।’

‘সেটা কী?’ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন জিনাত মহল।

‘ছোটো আম্মিজান কলি ছোটো নেই মনে হলো। পূর্ণাঙ্গ ফোটা ফুলের মতো আলো ছড়াল। এই আলোর নতুন আবেগে বাঁধা পড়ে যেতে পারে অবিচারের শিকার ছেলেটির প্রতি। এমনটিই এ বয়সে ঘটে থাকে। যেমন করেছে ওর কাজিন, ওর খেলার সাথি!’
‘ছেলেটির ক্ষতি পুষিয়ে দিলে নিশ্চয়ই আমাদের মেয়ে মুক্ত হবে দায়ভার থেকে। আবেগ, স্পর্শ, টান থেকে দূরে থাকতে পারবে।’লজ্জা ও শঙ্কা ঝেড়ে বললেন জিনাত মহল। প্রসঙ্গ পালটে মহলের প্রবল কর্তৃত্ববান পুরুষপ্রধান আবদুল্লাহ আল কাফি এবার অকৃত্রিম কণ্ঠে জবাবদিহিতার স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘বেগম! মেয়ে যে বড়ো হয়েছে, বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে, লুকিয়ে রেখেছেন কেন?’ স্বামীর প্রশাসনিক কণ্ঠস্বর শুনে কেঁপে উঠে জিনাত মহল বললেন, ‘না তো! এখনো বড়ো হয়নি সে। আলামত পাইনি। এখনো মিনস শুরু হয়নি মেয়ের। এই আনন্দসংবাদ তো নিশ্চয়ই জানিয়ে দিত ওর কেয়ারটেকার নারী গভর্নেসরা।’

‘খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমার মনে হয় বিষয়টি কৌশলে লুকোনো হয়েছে। চোখ-কান খোলা রাখুন। নইলে মহলের শৃঙ্খলা বারবার ভঙ্গ হতে থাকবে। এখন মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে হবে, বেগম।’
‘এই মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্ত কি ঠিক হবে, জনাব?’
‘না। ঠিক হবে না। মেয়ের মনের ক্ষত শুকোতে থাকুক, আমরাও গোপনে খোঁজখবর নিই। যোগ্য পাত্র পেলে সময় নেওয়া যাবে।’
‘আপনি যা ভালো মনে করেন, তাই হবে। তবে ছোটো আম্মিজান স্বাভাবিক হয়ে নিক আগে। এটাই চাই আমি। তাড়াহুড়ো করে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।’
‘তাড়াহুড়োর ব্যাপার নয়। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিলাম আপনাকে। আশা করি, মাথায় রাখবেন কথাটা।’

মূল মহলের প্রশাসনিক সেলে এসে রুস্তমকে সসম্মানে ফেরত আনার নির্দেশ জারি করলেন আবদুল্লাহ আল কাফি। পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে ফরমানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিটি পদক্ষেপে রুস্তমের মতামতের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। পুনরায় যেন কোনো ধরনের অপমানের শিকার না হয়, খেয়াল রাখতে হবে। তাকে শ্রমিক হিসেবে না দেখে মেহমান হিসেবে দেখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। আপাতত তাকে বিদেশি পুরুষ অতিথিশালায় রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দউপন্যাস।। মরুঝর।। মোহিত কামাল।। পর্ব ষোল >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *