উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// এক
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// পর্ব দুই
- উপন্যাস ।। মরুঝড় ।। মোহিত কামাল ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব চার॥
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব নয়
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। মরুঝর।। মোহিত কামাল।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আঠারো
॥ সাত ॥
রাতে ভালো ঘুম হয়নি রুশনা বেগমের। ঘুম ভেঙে গেছে দুঃস্বপ্নে। ফজরের আজান শোনা যায়নি এখনো। এত রাতে ঘুম ভাঙে না কখনো তাঁর। কীসব আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছেন। পুরোপুরি মনে করতে পারছেন না। এটুকু মনে আছে, কালো একটা পাহাড় উড়ে এসে দড়াম করে পড়েছে ঘরের ওপর। তখনই ঘুম ভেঙে গেছে। কালো পাহাড় উড়ে এলো কেন? ‘কালো’ মানে কী? অশুভ কোনো সংকেত? পাহাড় তো উড়তে পারে না। উড়ানপাহাড় দেখলেন কেন? স্বপ্নের অর্থ নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। অর্থ খুঁজে পেলেন না। বুক হালকা লাগছে না। চাপবোধ হচ্ছে বুকে। শুয়ে আছেন বিছানায়। চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকার উড়ানপাহাড়ের মতোই চেপে ধরেছে তাঁকে। অন্ধকারে কি মুক্ত বাতাস নেই? দূষিত বাতাসে কি ভরে গেছে পুরো বাড়ির চারপাশ? প্রশ্ন নিয়ে বালিশের পাশে রাখা টর্চলাইটের দিকে হাত বাড়ালেন। হাতে টর্চের স্পর্শ লাগায় শীতল ও কোমল অনুভূতি শিরশির করে ছুটে এলো মস্তিষ্কের দিকে। ঘরের চালের দিকে টর্চ জ্বালানোমাত্রই আলোয় ভরে গেল পুরো ঘর। এবার সহজভাবে শ্বাস নিতে পারলেন রুশনা বেগম। ঘরের আঁধার দূর করে আলোয় ভরে ওঠামাত্রই হালকা হয়ে গেল বুকের চাপ। বুকের চাপ কমলেও দুশ্চিন্তা কমছে না। ছেলে কল করছে না অনেক দিন। বউমার ওপর অভিমান করেই কি কল করছে না? নাকি কোনো বিপদ হয়েছে ? মায়ের মন স্বস্তি পাচ্ছে না। এরই মধ্যে মোবাইল ফোন রিচার্জ করে আনিয়েছেন। শৌর্যই রিচার্জ করে দিয়েছে। কল করছেন বারবার। ফোনসেট বন্ধ পাচ্ছেন! কেন বন্ধ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে রোষ গিয়ে পড়ল বউমার ওপর। কেন সে সখ্য গড়ে তুলছে শৌর্যের সঙ্গে? এই ঘটনাই তো ছেলেকে কষ্ট দিয়েছে। হয়তো এ কারণেই অভিমানে ছেলে ফোনসেট বন্ধ রেখেছে। এসব ভাবতে ভাবতে বিছানা ছাড়তে গিয়েও ছাড়লেন না। শুয়ে থাকলেন। মাথার পাশ থেকে ফোন বের করে ছেলের নম্বরে কল করলেন। এত রাতে কল করা উচিত নয়। জানেন তিনি। তবু সামলাতে পারলেন না নিজেকে। কল সংযোগ হচ্ছে না। হতাশায় জড়সড়ো হয়ে গেলেন রুশনা বেগম। নিজের অজান্তেই ঘরের চালের দিকে টর্চের আলো ছুড়তে থাকলেন। প্রতিফলিত আলোর ঝলক পাশের রুমে কলিকেও জাগিয়ে তুলল। আকস্মিক ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রথমে ভীত হলেও নিজেকে সামলে নিল সে। চট করে শোয়া থেকে বসে পড়ল কলি। বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা। বুঝল, এটা শাশুড়িরই কাণ্ড। প্রায়ই এমনটি করেন তিনি। ঘুম ভেঙে গেলে টর্চের আলো ছুড়তে থাকেন উপরের দিকে। সে-আলো ছড়িয়ে যায় তার রুমেও। আবার মনে হলো, শরীর খারাপ করল না তো শাশুড়ির? দিনে দিনে শাশুড়ির ওপর অবচেতনে জমতে থাকা খেদ, ক্লেদ মুহূর্তেই উড়ে গেল। তড়িঘড়ি ছুটে গেল শাশুড়ির রুমে। রুমের ইলেকট্রিক সুইচ অন করে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মাজান, ঘুম ভেঙে গেছে?’
‘হ্যাঁ। দুঃস্বপ্ন দেখলাম একটা। ঘুম ভেঙে গেল।’
‘শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না। শরীর ঠিক আছে। মনে শান্তি পাচ্ছি না। ভয় লাগছে। ছেলের কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না, এসব ভেবে ভয় লাগছে।’
‘দুর্ঘটনা ঘটবে কেন? খারাপ চিন্তা করবেন কেন ? ভালোটা ভাবুন। নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছে। সময় পাচ্ছে না কল করতে। এভাবে ভাবুন।’
বউমার কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রুশনা বেগম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘তোমার ওপর রাগ করে কল করা বন্ধ করল না তো?’
‘কোনো অন্যায় তো করিনি আমি। আমার ওপর রাগ করলে, কী করব আমি? ভুল বুঝে তিনি কষ্ট পেলে শোধরাব কীভাবে? কল করছেন না, এটা তার ব্যাপার। মোবাইল বন্ধ রেখেছেন, এটাও তার সিদ্ধান্ত। আমি কি বলে দিয়েছি ফোনসেট বন্ধ রাখতে?’ একরাশ অভিমানও ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে। শুধু সরলরেখার অভিমানই বয়ে যাচ্ছে না মনের সাগরে। অভিমানের আকাশছোঁয়া ঢেউও উঠছে। চোখের পলকে সে অভিমান রূপ নিল ক্ষোভে। ক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ল শাশুড়ির মাথায়। ভাঙা ঢেউয়ের বিশৃঙ্খল তোড়ে কলি বলে বসল, ‘সব দোষ আপনার। অযথা ছেলের কানে বিষ ঢেলে দিয়েছেন। কচিদেবরকে ঘিরে ছেলের বউকে জড়িয়ে কূটকথা বলেছেন। কী দরকার ছিল এমন অবিশ্বাস্য কথা ছেলের কানে দেওয়ার?’
বউমার পালটা আক্রমণ দেখে দমে গেলেন রুশনা বেগম। অন্য সময় হলে ফুঁসে উঠতেন, শব্দবাণে আক্রান্ত করতেন। এই মুহূর্তে বিষহীন পলায়নরত সাপের মতো গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। এমনিতে তাঁর মন ভালো নেই। বউয়ের কথায় মন যে খারাপ হয়েছে, তা নয়। তবে রাগ হয়েছিল। বাঁচোয়া যে রাগটা তেতে ওঠেনি। মনের ভেতর রাগ নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
পালটা জবাব না পেয়ে দমে গেল কলি। বুঝতে পারল, মনের ঝাল ঝাড়ার সময় নয় এখন। ছেলেকে মোবাইল ফোনে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন মা। স্ত্রী হিসেবে নিজেও ভেঙে ফেলছে ধৈর্যের বাঁধ। স্বামীর জন্য শিরায় শিরায় বহমান ভালোবাসার স্রোত। কতকাল আর নীরবে বয়ে বেড়াবে একাকিত্ব। তার সঙ্গে কি কথা বলবে না রুস্তম? অভিমান কি কেবল স্বামীরই হবে স্ত্রীর মনে কি জাগতে পারে না অভিমান?
নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠল ফজরের আজানের মধুর সুর। কুক্কুরু… মোরগের ডাক ভেসে আসছে। বিছানায় যেতে ইচ্ছা হলো না আর। নিজের রুমে এসে জানালা খুলে দিয়েছে কলি। ভোরের আলো না ফুটলে জানালা খোলায় নিষেধ আছে শাশুড়ির। নিষেধের কথা ভুলে গেছে, তা নয়। বরং নিষেধ ভাঙার অভিমানী ক্ষোভে জানালা খুলেছে। ভোরের শীতল বাতাসের পরশ মুছে দিলো তার ক্ষোভ, যাতনা। অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকলেও, তার চোখ উড়াল দিয়েছে মরুরাজ্যে। কাতর মন চষে বেড়াচ্ছে অজানা-অচেনা বালুসমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ। রুস্তম কি বসে আছে বালুর ঢেউয়ের চূড়ায়?
কতক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে, টের পায়নি কলি। হঠাৎ টের পেল হাঁস-ঘরের কপাট খুলে দেওয়ার শব্দ—কোঁ কোঁ শব্দ করে ঘর থেকে বেরোচ্ছে হাঁসের দল। ছোটোখাটো একটা হাঁসের খামার পরিচর্যা করেন শাশুড়ি। ফজরের নামাজের পর শাশুড়ির দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় হাঁস পরিচর্যার মধ্য দিয়ে। আজও জীবনযাত্রার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ভোরের কচিসূর্য পুবাকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে লালিমা। নতুন ভোর শুরু হয়েছে। নতুন দিনে ঢুকে যাচ্ছে পুরোনো রাতের আঁধার। জীবন এমনই।
শাশুড়ির সঙ্গে সংসারের কাজে যোগ দিলো কলিও। হাঁসের ঘরের পুরোনো তুষ ও কাঠের গুঁড়ো সরিয়ে নতুন তুষ ও গুঁড়ো বিছিয়ে দিতে লাগল।
শীত আসছে গুটিগুটি পায়ে। শীতের আক্রমণ থেকে হাঁসদের রক্ষা করতে হয়। আবার ঘর ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করতে হয় গরমের দিনে। বউ-শাশুড়ি মিলে কাজগুলো করে আনন্দের সঙ্গে। ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখাও জরুরি। অপরিষ্কার জায়গা থেকে রোগজীবাণু ছড়িয়ে হাঁসের ক্ষতি করতে পারে। ক্ষতি যাতে না হয়, সেদিকে নজর রাখেন রুশনা বেগম। হাঁসের ঘর থেকে জলাশয় পর্যন্ত পথটুকু থাকে ঝকঝকে। হাঁস পালনে তেমন সময় দিতে হয় না। হাঁসের দল বাইরে চষে বেড়ায়, খাবার সংগ্রহ করে খায়। হেলেদুলে চলতে থাকা হাঁসের দলকে অনুসরণ করে রুশনা বেগম এগিয়ে গেলেন ঘরের পেছনে জলাশয়ের দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখলেন বউমাকে।
হঠাৎ বউমার উচ্ছ্বসিত ডাক শুনে ফিরে তাকালেন রুশনা বেগম। চিৎকার করে কলি বলল, ‘আম্মাজান পুরোনো তুষের মধ্যে চারটা ডিম পেলাম!’
বউমার কণ্ঠের আনন্দ সঞ্চারিত হলো শাশুড়ির বুকেও। উপচানো খুশিতে নেচে উঠল চোখের পাতা। বউমার কাছে ফিরে এসে চকচকে চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘কই, দেখি!’ বলেই শাড়ির আঁচলের একটা অংশ বিছিয়ে ধরলেন রুশনা বেগম।
শাশুড়ির পেতে ধরা আঁচলে ডিমগুলো তুলে দিয়ে বিজয়িনীর বেশে কলি বলল, ‘আম্মাজান! ডিম কি ঘরে তুলবেন, নাকি বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা করবেন?’
রুশনা বেগম বললেন, ‘মন্দ বলোনি! বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্তত পঞ্চাশটি হাঁস বাড়িময় ঘুরে বেড়াক, চাই আমি।’
চট করে শাশুড়ি রাজি হয়ে গেলেন কলির কথায়! স্বতঃস্ফূর্ততার মাঝেও আলাদা করে কলি অনুভব করল, হাঁসমুরগি পালনে দুজনের মতের অমিল নেই, কেবল অমিল রুস্তমের ব্যাপারে। রুস্তমের ব্যাপারে কলি যা বলবে, শাশুড়ি তার উলটোটা বলবেনই। এই মুহূর্তে বলতে ইচ্ছা করল, কেবল হাঁসমুরগিতে বাড়ির আঙিনা ভরে তুললে হবে? নাতি-নাতনির প্রয়োজন নেই, আম্মাজান? মনে নড়ে ওঠা ইচ্ছাটা দমিয়ে ফেলল কলি। দুজনার এই মুহূর্তের আনন্দটুকু নষ্ট করতে চাইল না সে।
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কলি বলল, ‘কচুখেতটা দেখে আসি। তারপর দুজনে একসঙ্গে সকালের খাবার খেয়ে নেব।’
রুশনা বেগমও খুশিমনে বললেন, ‘শিম বাগানটাও দেখে এসো। পোকামাকড় লাগল কি না, খেয়াল রাখতে হবে তো।’
কলি বলল, ‘আচ্ছা।’
পুকুরের বাঁ পাশের ঢালে ছোট্ট একটুকরো জমিতে লতিরাজ কচু চাষ করেছেন রুশনা বেগম। বউ-শাশুড়ি মিলেই পরিচর্যা করেন খেতের। কচুখেতটি বাড়ির আঙিনার ভেতর হওয়ায় অবাধে চলাচলের বাধা নেই এখানে। কচুখেতের সামনে এসে আনন্দে নেচে উঠল কলির মন। প্রকৃতির বিপুল ঐশ্বর্যের সঙ্গে নিজেদের ঐশ্বর্যের মিল খুঁজে পেল না সে। কচুগাছে ফুল ফুটেছে, জালের মতো বিস্তৃত হয়েছে মাটি কামড়ানো মোটা সাইজের কচুর লতি। লতির গোড়ার দিক মোটা হলেও সরু বর্ধনশীল অগ্রভাগ থেকে সবুজ ভাঁজ খুলে এগিয়ে যাচ্ছে কচুর লতি। এক গাছের লতি জড়িয়ে ফেলেছে অন্য গাছ। নিবিড় বন্ধনের লীলাময় প্রকৃতির খেলা দেখে মুগ্ধ কলির মনে পড়ে গেল রুস্তমের কথা। ইচ্ছা করছে লতির মতো জড়িয়ে রাখতে রুস্তমকে। রুস্তমের উদ্দেশে মনে মনে বলল, কী লাভ মরুর বুকে পড়ে থেকে? ফিরে আসুন দেশে। এসে দেখুন কচুগাছের গোড়া থেকে কীভাবে বের হচ্ছে চারাগাছ! চারাগাছের প্রয়োজন কি নেই আপনার? ফিরে আসুন দেশে। বুকে জড়িয়ে রাখুন নিজের বউকে।
মনের কথা শূন্যে মিলিয়ে গেলেও পাশের আমগাছের ডালে বসা একটি পাখি উড়ে গিয়ে বসল সবুজ পাতায় ঘেরা অন্য ডালে। উড়াল দেওয়ার সময় ঝরে গেল কয়েকটি হলুদ পাতা। পাতাগুলো উড়ে গিয়ে পড়ল কচুগাছের ওপর। খেত থেকে পাতা কুড়াতে গিয়ে কলি দেখল পাখিটাকে। চেনা লাগছে। হ্যাঁ, চিনতে পেরেছে। এটা একটা কাঠ-শালিক। শালিকটির থুতনি-গলা সাদা। ঠোঁটের গোড়া নীল। ডানার প্রান্ত কালো। পায়ের রং হলদে, মাথা-ঘাড় ধূসর-রুপালি হলেও গায়ের বর্ণ তুলনামূলকভাবে উজ্জ্বল নয়। তবু দেখে ভালো লাগল। সাধারণত কাঠ-শালিকরা চলে দল বেঁধে কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। একাকী চলে কম। জানে কলি। এই পাখিটা একাকী কেন বসে আছে ডালে? হলুদ পাতা উড়িয়ে কী জানান দিলো?
পাখির উদ্দেশে মনে মনে বলতে লাগল, একাকী পাখি, তুমি কি নিজের শূন্যতা পূর্ণ করতে এসেছ আমার কাছে? আমার রুস্তমই কি পাঠিয়েছে তোমাকে? সুসংবাদ না দুঃসংবাদ বয়ে এনেছ, হে পাখি?
কলি আরও ভাবল, রুস্তমের কাছে চিঠি লিখবে। মোবাইল ফোনের যুগ হলেও চিঠির যুগ শেষ হয়নি। চিঠি লিখে বলবে, প্রিয় রুস্তম, একাকী মরুর দেশে হলুদ পাতার মতো নিঃশেষ হয়ে ঝরে যেয়ো না। ফিরে এসো দেশে। দেখে যাও, এই গ্রামের নুরুল হকের কাণ্ড। শুনেছি, তিনি ১৫ বিঘা জমিতে কচু চাষ করে বিক্রি করেছেন ১০০ মণ লতি। আয় করেছেন ২ লাখ টাকা। লাগানো কচুগাছের গোড়া থেকে যে চারাগাছ বের হয়েছে, তা বিক্রি করে পেয়েছেন আরও ২ লাখ। এছাড়া কচুগাছের মূল ও কাণ্ড বিক্রি করে পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা। কচু চাষে তার বিঘাপ্রতি খরচ মাত্র ৮─১০ হাজার টাকা। টাকার জন্য কেন মরুতে পুড়বে? ফিরে এসো রুস্তম। মরুর দেশের চেয়ে কম শ্রমে আরও বেশি রোজগার করতে পারবে তুমি দেশে। বেশি টাকার প্রয়োজন নেই। অল্পতেই তুষ্ট থাকব আমরা। তুমি জেনে খুশি হবে, চারটি ডিম পেড়েছে পোষা হাঁস। ডিম দেখে আম্মাজান যেভাবে খুশি হয়েছেন, এর চেয়ে বেশি খুশি দরকার নেই আমাদের।
কাঠ-শালিকটি আচমকা ঠোকর বসিয়েছে পাতার ওপর ছুটে আসা এক পোকার ওপর। ঠোঁটে খাবার পুরে ঢুকে গেছে গাছের কোটরে নরম লতাপাতা দিয়ে বানানো আপন নীড়ে। পাখিও ফেরে আপন নীড়ে। রুস্তম, তুমি কি ফিরবে না? কবে ফিরবে?
পাখির নীড়ে ফেরা দেখে মন আরও বেশি আনচান করে উঠল রুস্তমের জন্য।
আমগাছের একটা ডাল নিচু হয়ে নেমে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে কচুখেতের দিকে। নিচু ডাল হাতে ধরা যায়। ডাল থেকে একটা তাজা আমপাতা ছিঁড়ে পাতার মাঝখানের সরু ডাঁটিটি খুলে ফেলল। তারপর পাতার দুটি অংশ ভাঁজ করে মুড়িয়ে মিসওয়াকের মতো তৈরি করে দাঁত ঘষতে ঘষতে কচুখেত থেকে বেরিয়ে পুকুরের দিকে এগোতে লাগল কলি। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এভাবে ব্রাশ করলেও কলি ব্যবহার করে টুথপেস্ট ও ব্রাশ। আজ আমপাতার ব্রাশে দাঁত ঘষতে ভালোই লাগছে। কচিপাতার রসে কী আছে, কে জানে। রসে বিস্বাদ লাগলেও তেতো লাগছে না। বিস্বাদটাও উপভোগ করা যাচ্ছে ব্যতিক্রমী স্বাদ হিসেবে। পুকুরের পাড়ে উঠে ঘাটের দিকে নামতে গিয়েও নামল না সে। চোখ গেল পুকুরের ডান পাশের বিস্তৃত ধানখেতের দিকে। খেতে এরই মধ্যেই কাজ শুরু করেছেন আতর আলি মুনশি—শৌর্যের বাবা। সঙ্গে শৌর্য। এত সকালে মাঠে নামে সবাই! আতর আলি মুনশি চাচাশ্বশুর হলেও শ্বশুরের মতোই আদর করেন কলিকে। মুনশির সামনে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে না পারলেও দেখা হলে কথাবার্তায় জড়তা থাকে না। দাঁত ব্রাশ করতে করতে তাই জড়তাহীন এগিয়ে গেল পুকুরের ঢাল পেরিয়ে আইলের দিকে। ধানখেতটিও বাড়ির আঙিনাসংলগ্ন। তাই চলাফেরায় কোনো ধরনের সংকোচ রইল না। শাশুড়িও তেমন বাধা দেন না। কলিকে দূর থেকে দেখে, লুঙ্গি মালকোঁচা দেওয়া উদোম গায়ে শৌর্য এসে দাঁড়াল সামনে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাবি! এত ভোরে তুমি এখানে?’
‘পুকুরের ওই পাশে আমাদের কচুখেতটা দেখতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, পুকুরে মুখ ধুয়ে কচুর লতি তুলে ফিরব ঘরে। তোমাদের দেখে নেমে এলাম।’
‘ভালো করেছ! শৌর্যের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। চোখেমুখেও আনন্দের ঢেউ। ওর আনন্দ উপভোগ করতে করতে আনমনে কলির চোখ গেল শৌর্যের চকচকে বাড়ন্ত শরীরের দিকে। শৌর্যের সঙ্গে মিশলে শাশুড়ি কেন সন্দেহের চোখে দেখেন, এবার বুঝতে পারল কলি। নিজেকে সংযত করে বলল, ‘শৌর্য, ওই যে সবুজ খেতে তোমার আব্বাজান বাঁশের কঞ্চি পুঁতে রাখছেন। তোমার হাতেও অনেক কঞ্চি রয়েছে। এগুলো দিয়ে কী হয়?’
‘ওঃ! ভাবি! তুমি জানো না? কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে খেতে কীটপতঙ্গভুক পাখি বসাতে আসন পেতে দিচ্ছি আমরা। দেখো, ওই যে দূরে ‘ভি’ আকারের কঞ্চিতে বসা দুটো পাখি? দেখেছ? ওরা ধানের কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলে, সবুজ খেত বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের কাজ শেষ হলে ধানখেতে এসে দেখবে অসংখ্য পাখি বসেছে কঞ্চিতে। সবুজ ধানের মধ্যে কোথাও পতঙ্গ দেখলে টুপ করে ঠোঁটে পুরে নেবে। এটা একটা দেখার মতো দৃশ্য! পরিবেশ রক্ষায় আমাদের এলাকায় এ পদ্ধতি চালু হয়েছে।’
চোখে দেখার প্রয়োজন হলো না। শৌর্যের বর্ণনার ধরন দেখে কীটপতঙ্গভুক পাখিদের আক্রমণের কৌশলটা কল্পনা করে হেসে উঠল কলি।
‘হাসলে কেন, ভাবি?’
‘তোমার বর্ণনা শুনে হাসি এলো, তাই হাসলাম।’
‘আমি কি খারাপ বর্ণনা দিয়েছি?’
‘না। খারাপ না। মজাদার বর্ণনা। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, তুমিই আক্রমণ করছ কীটপতঙ্গের ওপর।’
‘শোনো, আমি কি আর পোকামাকড়ের ওপর আক্রমণ করব!’
‘তো, কার ওপর আক্রমণ করবে?’
‘বলব না তোমাকে। তুমি আবার হাসবে।’
‘আচ্ছা, কথা দিলাম। হাসব না। বলো।’
‘না। বলব না। যখন আক্রমণ করব। তখন টের পাবে।’
‘বাঁশের কঞ্চিতে বসে, নাকি গাছের ডাল থেকে আক্রমণ করবে তুমি?’
‘ফসলের রোগবালাই দমনে বাঁশের কঞ্চি ব্যবহারকে বলে পার্চিং পদ্ধতি। আমার পদ্ধতি ভিন্ন। সরাসরি।’
কথা বাড়ানোর সুযোগ পেল না কলি। দেখল, চাচাশ্বশুর এগিয়ে আসছেন তার দিকে। কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে শৌর্য বলল, ‘কচুর লতি রাঁধবে কী দিয়ে?’
‘জানি না।’
‘পাশের খালে চিংড়িমাছ ধরব আমি একটু পর। মাছ পাঠিয়ে দেবো। আমার জন্য রান্না করা লতি পাঠিয়ে দিয়ো।’
‘দেবো।’ ছোটো করে জবাব দিলো কলি।
শৌর্য চলে যায় কাজে। কিছুক্ষণ পর পাশে এসে দাঁড়ালেন আতর আলি মুনশি। মুনশিকে দেখে কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হলো। তবু হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলল, ‘সবুজ ধানখেত দেখতে ভালো লাগছে, চাচাজান!’
‘হ্যাঁ। বউমা, আশা করছি এবার বাম্পার ফলন হবে। কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে পার্চিং পদ্ধতি ভালো কাজ দিচ্ছে। তাছাড়া নিমের পাতা বেটে এবং গুলিয়ে এবার জমিতে দিয়েছি দুটো পদ্ধতিই বেশ কাজের। পরিবেশ রক্ষা পায়, আবার মানুষেরও উপকার হয়।’
চাচাজানের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ চোখ গেল খেতের দিকে। এরই মধ্যে অসংখ্য পাখি বসেছে ডালে, ধানখেতে পাহারা দেওয়ার নব-উদ্ভাবিত প্রাকৃতিক কৌশল দেখে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইল কলি।
হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে আতর আলি মুনশি বললেন, ‘গতকাল রাতে হাটে দেখা হয়েছিল আমাদের ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন আজ দুপুরের দিকে সমাজসেবা অফিস থেকে একজন অফিসার আসবেন আমাদের বাড়িতে। ভাবির সঙ্গে কথা বলবেন।’
‘সমাজসেবা অফিসার? কেন চাচাজান?’ বুকটা ধড়াস করে উঠল কলির।
‘তা তো জানি না। কমিশনার সাহেব বলে দিয়েছেন ওই সময় আমিও যেন পুরুষ সদস্য হিসেবে বাড়িতেই থাকি। টিএনও স্যার নাকি আমাদের বাড়ি ভিজিট করার নির্দেশ দিয়েছেন সমাজসেবা অফিসারকে।’
অজানা শঙ্কায় ছেয়ে গেল কলির মুখ। উদ্বেগের ছায়া পড়ল আতর আলি মুনশির মুখেও। উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন, ‘ভাবিকে বিষয়টি এখনো জানাইনি। ভাবছিলাম, খেত থেকে উঠে সকালের খাওয়াদাওয়া সেরে যাব তোমাদের ঘরে।’
কলি বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি বিষয়টা আম্মাজানকে জানান।’
‘ঠিক আছে। আমি জানাব। ভালো নাশতা-পানির কথা ভেবে রেখো।’
‘আগে আম্মাজানকে বলুন। পরে ব্যবস্থা করব আমি।’
‘আচ্ছা বউমা। তাহলে এখন যাও। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আশা করি ভালো খবরই পাব।’
‘জি। ভালো খবর হলেই ভালো।’ কথা শেষ করে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল কলি।
মুখ ধুতে গিয়ে পুকুরের টলটলে পানিতে দেখল নিজের প্রতিকৃতি। পানিতে ঝলমলে এই বধূ তো রুস্তমের! প্রতিকৃতি নিজে দেখে কী লাভ? যার দেখার কথা, সে যদি-না আসে, না কথা বলে! শূন্যই থেকে যাবে সব।
সকালের সতেজ মন মরে গেছে প্রায়। মুখ ধুয়ে মলিনমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল ঘরের দিকে। হঠাৎ খেয়াল হলো শৌর্যের কথা। কচুর লতির তরকারি পাঠাতে হবে তার জন্য। ভেবে ফিরে গেল কচুখেতে। ভেজা ভেজা কচুর লতি তোলার সময় হঠাৎ মনে হলো রাতে কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশামাখা সতেজ ভোরে বুকের ভেতর কেবলই বাজছে বিষাদের ঘণ্টা। ঘণ্টাধ্বনি বাইরেও কি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে?
কলির মুখের দিকে তাকিয়ে রুশনা বেগম বললেন, ‘কী হয়েছে, বউমা? এত মন খারাপ লাগছে কেন তোমাকে? একটু আগেও তো কেমন হাসিখুশি ছিলে?’
‘না। তেমন কিছু হয়নি।’
‘তো, মুখ এত মলিন কেন?’
কলির মনে হলো এই প্রথম শাশুড়ি খেয়াল করে দেখেছেন ছেলের বউকে। বিষয়টা অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু দুশ্চিন্তার বড়শিতে গাঁথা মনে আনন্দ আসছে না। কথা বলার ক্ষমতাও কেউ যেন বেঁধে ফেলেছে অদৃশ্য সুতোয়।
কচির লতি রসুইঘরের মাটিতে রাখতে গিয়ে জড়তাহীন কণ্ঠে কলি বলল, ‘খালে চিংড়িমাছ ধরবে শৌর্য। লতি রান্না করার জন্য মাছ দিয়ে যাবে বলেছে। আসুন, খাওয়াদাওয়া করে নিই আমরা। খেয়ে লতি কুটতে বসব।’
কলির কথা থেকে কেবল ‘শৌর্য’শব্দটি লুফে নিলেন শাশুড়ি। মুহূর্তে পালটে গেল তার কণ্ঠস্বর। নিজের অস্তিত্বের ভেতর প্রহরীসত্তার ঢোলের বাড়ি খেয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘সুযোগ পেয়ে শৌর্যের সঙ্গে দেখা করে এলে?’
রুশনা বেগম নিজের পৃথিবীটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ছোটো করে যেন স্থির করেছেন শৌর্যতে এসে। প্রশ্নের মধ্য দিয়ে যেন সেকথাই জানান দিলেন। ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের বিষের দহন পুরোটাই ভরে নিলেন নিজের বুকে। সেই জ্বালার অংশবিশেষও স্পর্শ করল না কলিকে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আতর আলি মুনশি চাচাও আসবেন বাসায়। আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ কথা শেষ করে সামনে থেকে সরে গেল কলি।
আতর আলির কথা শুনে বিষের উদ্গিরণ থেমে গেল। অবাক হয়ে দেখল বউমার প্রতিক্রিয়াহীন নিস্পন্দিত চলার গতি। মনে হলো নিজের কালিমা জলে ধুয়ে জ্যোতির্ময় আলো নিয়ে ঘরে ঢুকেছে বউমা। বৈধব্যের আকাশে অদৃশ্য তারা হয়ে কেবলই ভাসে বউমা আর রুস্তম। তারা দুটো ঘিরেই তার সুখ। সুখ কেড়ে নিচ্ছে শৌর্যের সঙ্গে বউমার নিরপরাধ মেলামেশা, কথাবার্তা! কেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেননি কখনো। এখন উত্তর খুঁজতে গিয়ে ব্যাপক ও বিধ্বংসী শূন্যতা টের পেলেন চারপাশে। এই শূন্যতার কঠিন ঘেরাটোপ ভাঙবেন কীভাবে জানা নেই তার। শূন্যতার সঙ্গে এরই মধ্যে যোগ হয়েছে রুস্তমের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা। কল করে না, ফোনও বন্ধ রেখেছে রুস্তম! কেন? প্রশ্নটি কাঁপিয়ে দিলো বুক। উত্তর খোঁজার চেষ্টা কিংবা সাহস দুটোই হারিয়ে গেছে মন থেকে।
মাটিতে মাদুর বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করেছে কলি। পান্তাভাত, কাঁচা মরিচ, ডিম ভাজা আর ডাল ভর্তা সাজিয়ে শাশুড়ি বলল, ‘খেতে আসুন।’
পাশের রুম থেকে রুশনা বেগম বললেন, ‘তুমি খেয়ে নাও। পরে খাব আমি।’
উচ্চৈঃস্বরে কলি জবাব দিলো, ‘আপনি না খেলে আমিও খাব না।’
কলির স্বরে কী ছিল টের পেলেন না রুশনা বেগম। তবে ভীত হয়ে দ্রুত এলেন খাবার ঘরে। মাদুরে বসে তাকালেন ডাল ভর্তার দিকে। এটি তার প্রিয় পদ। মনোমালিন্যের মধ্যেও বউমা প্রিয় পদটি তৈরি করেছে দেখে তৃপ্ত হয়ে গেলেন।
কলি বলল, ‘শুরু করুন। কিছুক্ষণ পর মাছ নিয়ে আসবে শৌর্য। মাছ কুটতে হবে। লতি রান্না করতে হবে। আতর আলি চাচাজানও আসবেন ঘরে। হাতে সময় পাব না। নিন, হাত লাগান।’
কথার মধ্যে সরলতা লুকিয়ে আছে, বুঝলেন শাশুড়ি। তবু কলির কথায় শৌর্যের প্রতি আস্থা দেখে নিভে গেলেন। হাত না লাগিয়ে ভাতের প্লেট ধরে বসে রইলেন।
কলি আবার বলল, ‘উপজেলা অফিস থেকে সমাজসেবা অফিসারও আসবেন। পরে খাওয়ার সময় পাব না। নিন, শুরু করুন। আপনি না খেলে আমিও ছোঁব না ভাতের থালা।’
সমাজসেবা অফিসার আসবেন শুনে মস্তিষ্ক থেকে সঞ্চারিত বাধার সংকেত উড়ে গেল। আচমকা খেতে শুরু করলেন তিনি।
কাঁচা মরিচে কামড় বসিয়ে মরিচের ঝাল অনুভব করল কলি। জীবনযাপনে প্রতিদিন যে ঝালের উদ্গিরণ ঘটে, তার চেয়ে তুচ্ছ এ ঝাল! খেতে শুরু করল সে।
এক পর্যায়ে মুখে ভাত রেখেই রুশনা বেগম বললেন, ‘সমাজসেবা অফিসার আসবেন কেন? আতর আলি কিছু বলেছে তোমাকে?’
‘বলেননি। তিনিও জানেন না কী কারণ। ওয়ার্ড কমিশনার সাহেবই তাঁকে জানিয়েছেন বিষয়টি।’
‘কে জানিয়েছেন?’
‘বললাম তো ওয়ার্ড কমিশনার।’
‘ওয়ার্ড কমিশনার মানে কি মুনির উদ্দিন? রুস্তমের ফুপাতো ভাই?’
‘ওয়ার্ড কমিশনার তো একজনই এই ওয়ার্ডে। তাঁর নাম কি মুনির উদ্দিন? রুস্তমের ফুপাতো ভাই হন তিনি?’
‘হ্যাঁ। রুস্তমের একমাত্র ফুপির বড়ো ছেলে।’
‘তাহলে আর ভাবনা কী। নিজেদের লোক আছে সঙ্গে। ভাবনার কিছু নেই।’
‘মুনির আসবে সঙ্গে?’
‘জানি না।’
‘সে আমাদের বাসায় আসে না। এ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঝামেলা আছে জায়গাজমি নিয়ে।’
‘ওঃ! স্বজন হয়েও তাহলে কমিশনার সাহেব আপন নয়। নিজেদের লোক নয়?’
‘নিজেদের লোকই। তবে বিরোধ থাকার কারণে আর আপনজন ভাবা যায় না তাকে।’
‘বিরোধ থাকলেই কেউ পর হয় না, আম্মাজান। বিরোধ মিটে গেলে আবার আপন হয়ে যাবেন তিনি। এই আমার-আপনার মধ্যে প্রায়ই বিরোধ বাঁধছে, তাই বলে কি আমি আপনার পর? আমি ছাড়া কি আর কেউ আছে আপনার আপন?’
কলি ভেবে বলেনি কোনো কথা। স্বগতস্বরে মন উজাড় করে বলে ফেলেছে কথাগুলো। ভালোকথা বলতে পেরে নিজেকেই বাহবা দিলো সে। ভাবল, যাক, ঘায়েল করা গেছে শাশুড়িকে।
নীরবতা ভেঙে রুশনা বেগম জবাব দিলেন, ‘ছেলেই আমার আপনজন।’
কলি বলল, ‘আম্মাজান, বাচ্চা মেয়ের মতো কথা বলছেন কেন? আমি হচ্ছি আপনার ছেলের বউ। আমার স্বামী হচ্ছে রুস্তম। রুস্তম আপন মানে আমিও আপনার আপন। আমি তো আপনার ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না।’
‘ছিনিয়ে নিয়ে যাবে না, তার প্রমাণ কী? ছিনিয়ে নিতেও পারো। ছিনিয়ে না নিলেও তোমার কারণে আমার ছেলে দূরে সরে গেছে।’
শাশুড়ির অমূলক দৃঢ় ধারণা আবিষ্কার করে হতভম্ব হয়ে গেল কলি। শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার সময় বিস্ময়কর সুখ ছুঁয়ে যাচ্ছিল কলির পিপাসার্ত মনে। হঠাৎ মনের তারে বেজে উঠল বিষাদের সুর। অন্ধকারে ঢেকে গেল মনের আকাশ।
আকস্মিক আঁধার আকাশে জ্বলে উঠল জোনাক-আলো। শৌর্য এসে বলল, ‘ভাবি! প্রায় আধা খালুই চিংড়িমাছ পেয়েছি! জো চলছে এখন। ধানিজমি থেকে বাড়তি পানি পেয়ে চিংড়ি নেমে যাচ্ছে খাল বেয়ে। খালে ঠ্যালাজাল বসিয়ে থেকেছি কেবল। পাঁচ-দশ মিনিট পরপর জাল তুলেছি আর জালের খালুইতে প্রতিবারই উঠেছে অনেক লোল্লা চিংড়ি। দেখো, কেমন লাফাচ্ছে চিংড়িগুলো।’বলতে বলতে খালুই উপুড় করে ঢেলে দিলো প্রায় অর্ধেক মাছ। জ্যান্ত মাছ ছড়িয়ে গেল চারপাশে।
‘কী করলে শৌর্য! কী করলে! ওঠাও। চিংড়িগুলো তুলে ওই ডেকচিতে ভরে দাও। বলতে বলতে কলি বাঁহাতে বাড়িয়ে দিলো শূন্য ডেকচিটি।’
কলির কথায় অবাধ্য হলো না শৌর্য। ভেজা কাপড়ে যে এসেছে সে। ভুলে গেল সেকথা। প্রতিটি চিংড়ি কুড়িয়ে নিয়ে পাতিলে রেখে দিলো।
বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে রুশনা বেগম একবার দেখছেন গা গতরে বড়ো হয়ে ওঠা শৌর্যকে। দেখছেন শৌর্যের চিকচিক করা আনন্দিত চোখজোড়া। আবার দেখছেন বউমার আনন্দধ্বনি। দুই আনন্দের অবাধ্য স্রোতে নেমে এলো বিষাদের চোরাস্রোত। স্রোতে ভাসতে ভাসতে আবার চলে গেলেন তিনি সন্দেহের চরে।
ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকলেন রুশনা বেগম। শূন্য ও শুষ্ক চোখও ভরে উঠল উষ্ণ জলে। শেষ আশ্রয়ের আশায় হাত নাড়াতে লাগলেন ভাতের প্লেটে। কাঁচা লংকা, ডিম ভাজা আর ডাল ভর্তা মেখে মুখে পুরে দিচ্ছেন এক একটা নলা। মনে হলো, ভাতের থালাটাই সবচেয়ে বড়ো অবলম্বন। বেঁচে থাকার জন্যই আঁকড়ে থাকতে হবে ভাতের থালা। এই মুহূর্তে ভাতের থালাটাই প্রাধান্য পেল রুশনা বেগমের চোখে।
সমাজসেবা কর্মকর্তা আসার কথা থাকলেও আসেননি। তিনি পাঠিয়েছেন সদ্য চাকরিতে জয়েন করা এক জুনিয়র কর্মকর্তাকে। সুদর্শন এই কর্মকর্তা বসেছেন বেতের মোড়ায়। আতর আলি মুনশি বসেছেন আরেকটি মোড়ায়, পাশে। ওয়ার্ড কমিশনার মুনির উদ্দিন এখনো এসে পৌঁছাননি। আসবেন বলে জানিয়েছেন। শোয়ার ঘরের জানালা দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাকে দেখে ভীতি কমে গেল কলির। দেখে সজ্জন মনে হলো। ভদ্র ও পরোপকারী মনে হলো।
খানিকটা দূরত্বে বসেছিলেন রুশনা বেগম। কিছুটা সরে এসে আলোয় বসে জিজ্ঞাসুচোখে জুনিয়র কর্মকর্তার দিকে তাকালেন।’
‘আমার নাম জাফর আহমেদ। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে উপজেলা পরিষদ অফিস থেকে এসেছি কয়েকটি তথ্য জানার জন্য।’
‘কী তথ্য?’
‘খুব সাধারণ তথ্য: যেমন রুস্তম সাহেবের বাবার নাম। মায়ের নাম। স্ত্রীর নাম। বাড়ি বা গ্রামের নাম ইত্যাদি।’
রুশনা বেগম বললেন, ‘লিখুন, রুস্তমের বাবার নাম মনসুর আলি। তিনি গত হয়েছেন চার বছর। মায়ের নাম রুশনা বেগম। স্ত্রীর নাম কলি।’
‘কলি কি আসল নাম?’ প্রশ্ন করলেন জাফর আহমেদ।
প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন রুশনা বেগম।
ভেতর থেকে কলিই বলে উঠল, ‘আসল নাম নূরে জান্নাত, ডাকনাম কলি।’
ভেতর থেকে ভেসে আসা অদৃশ্য আওয়াজ শুনে জাফর আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনিই কি নূরে জান্নাত কলি?’
‘জি। আমার স্বামীর পাসপোর্টে নূরে জান্নাত লেখা আছে। কলি লেখা নেই।’
‘হ্যাঁ। ডাকনাম লেখা থাকবে না। এটাই স্বাভাবিক।’
অদৃশ্য কথোপকথনের দিকে চোখ তুলে জাফর আহমেদ বললেন, ‘আপনাকে আমার সামনে আসতে হবে। আপনার পর্দানশিনতাকে সম্মান করে বলছি, আপনার আর আপনার শাশুড়ির ছবি তুলতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্য থাকলে তার ছবিও তুলতে হবে। ছবি-সহ তথ্যগুলো জমা দিতে হবে টিএনও অফিসে। ক্যামেরা নিয়ে এসেছি আমি। আপনাদের দস্তখত ও টিপসইও নিতে হবে।’
ভেতর থেকে কলি প্রশ্ন করল, ‘আমাদের টিপসই বা দস্তখতের প্রয়োজন কী? তথ্যগুলো কী কাজে লাগবে আপনাদের?’
‘ধন্যবাদ প্রশ্নের জন্য। সম্ভবত আপনার স্বামীর আকামা বা লেবার কার্ড রিনিউ করতে তথ্যগুলো কাজে লাগাবে বাংলাদেশ দূতাবাস। বাংলাদেশ এম্বাসি থেকে তথ্যগুলো যাবে সৌদি দূতাবাসে।’
উত্তর সন্তোষজনক হলেও সন্তুষ্ট হতে পারল না কলি। অসন্তুষ্টি নিয়ে বলল, ‘উনার লেবার কার্ড রিনিউ করতে মা আর স্ত্রীর দস্তখত নেওয়ার কোনো প্রচলিত নিয়ম নেই। নতুন ধারা কি তৈরি হয়েছে ওই দেশে? কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেন?’
প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে জাফর আহমেদ বললেন, ‘প্রমাণ তো হাতে নেই। অফিস যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে সেভাবেই বলছি আমি।’
টিপসই আর দস্তখতের কথা শুনে ভীত হয়েছেন রুশনা বেগম। মনে মনে ভাবলেন, ওয়ার্ড কমিশনার মুনিরের কোনো ষড়যন্ত্র নেই তো টিপসই নেওয়ার পেছনে? ভাবনাটি গোপন রেখে আতর আলি মুনশির উদ্দেশে বললেন, ‘মুনির আসবে না?’
‘আসার কথা তো। হয়তো এখনই এসে পড়বেন।’ বললেন জাফর আহমেদ।
রুশনা বেগমের মাথায় নতুন ভাবনার উদয় হলো, এই লোক কি মুনিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছে? মুখ ফুটে বললেন, ‘টিপসই আর দস্তখত প্রয়োজন হলে পরে দেবো। এখন আমার আর বউমার ছবি নিতে পারেন। তাছাড়া আমার একমাত্র মেয়ে, রুস্তমের বড়ো বোনও আছে শ্বশুরবাড়িতে। তার কি ছবি লাগবে?’
‘না। যিনি শ্বশুরবাড়ি আছেন, তার ছবির প্রয়োজন নেই।’
কোথায় সত্য কোথায় ভুল জানে না কলি। তবু জীবনখাতায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ভুলের। নতুন সত্যের ছাপও বসে যাচ্ছে জীবনে। সত্য-মিথ্যার অনুসন্ধানের জন্য নয়, বরং অফিসিয়াল নিয়মকানুন যথাযথ মানা হয়েছে কি না বোঝার জন্য কলি বলল, ‘আপনি কি টিএনও স্যারের অফিস অর্ডার দেখাতে পারবেন?’
‘শিয়োর।’ বলেই হাতের ক্যামেরাটি পাশে রেখে, ফাইল খুলে টিএনও-এর অফিস অর্ডারটি বের করে দিলেন জাফর আহমেদ।’
স্বল্পশিক্ষিত কলির মনে কাজ করছে দুরন্ত সাহস। অফিস অর্ডার পড়ে কী বুঝল, নিজেও জানে না। তবু দৃপ্ত গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। ছবি তুলে নিন। সাদা কাগজে টিপসই কিংবা দস্তখত দিতে চাই না আমরা। বিষয়টি টিএনও স্যারকে জানিয়ে দেবেন।’
জাফর আহমেদ জবাব দিলেন, ‘আচ্ছা। তাহলে আপনারা রেডি হয়ে উঠোনে আসুন। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।’
আতর আলিকে নিয়ে বাইরে এলেন জাফর আহমেদ। বাইরে এসে বললেন, ‘আপনাদের বউমা বেশ সাহসী। বুদ্ধিমতী।’
বউমার প্রশংসা শুনে বিগলিত হলেও ভাতিজার জন্য উদ্বেগবোধ করে আতর আলি বললেন, ‘ঠিক করে বলুন তো রুস্তমের কী হয়েছে? গ্রামের অনেক ছেলেই সৌদিতে থাকে। কেউ আছে ওমানে। কেউ আছে দুবাইতে। কারও জন্য এমন তদন্ত হয়নি। রুস্তমের জন্য হচ্ছে কেন?’
জাফর আহমেদ বললেন, ‘মূল ঘটনা জানি না। আমার দৌড় আর দায়িত্ব হচ্ছে আপনাদের বাড়ি পর্যন্ত।’
উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলেন না আতর আলি। কিন্তু প্রকাশ করলেন না।
এখনো বের হননি রুশনা বেগম। ছবি তোলার জন্য নতুন শাড়ি পরছেন তিনি। কলিও পরেছে বিয়ের সময় পরা দ্বিতীয় শাড়িটি। এই শাড়ি পরনে অনেক ছবি আছে বাসায়। একবার বলার ইচ্ছা হয়েছিল, আমার একার ছবি নেবেন কেন? নিলে রুস্তম-সহ ছবি নিয়ে যান এক কপি। মনের কথা প্রকাশ না করে উঠানে এসে জাফর আহমেদের মুখোমুখি হয়ে মনের ঈশানকোণে আশার আলো জ্বেলে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কি দুবাই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি? ছবি তোলার প্রয়োজন হলো কেন?’
স্মার্ট মেয়েটিকে দেখে কিছুটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন জাফর আহমেদ। সংকোচের খোলস ঝেড়ে শালীন ভাষায় বললেন, ‘এত সুন্দর বউকে কে এই পাড়াগাঁয়ে ফেলে রাখতে চায়, বলুন? নিশ্চয়ই সেরকম একটা কিছু চেষ্টা করছেন আপনার স্বামী। সে কারণে হয়তো বিয়েসংক্রান্ত বিষয়ে দুবাই দূতাবাস থেকে সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।’
বউমার সঙ্গে জাফর আহমেদের কথাবার্তার অর্থ পরিষ্কার না হলেও এত কথা বলা পছন্দ করলেন না আতর আলি মুনশি। এ সময় ঘর থেকে রুশনা বেগম বেরিয়ে এসে বললেন, ‘নিন। ছবি তুলুন।’
ছবি তোলার পর রুশনা বেগম ভেতরে গেলেন। একটু সরে এসে জাফর আহমেদকে কলি বলল, ‘আমার মনে হয়, শাশুড়ির সঙ্গে ছবি দেওয়ার চেয়ে, রুস্তমের সঙ্গে আমার বিয়ের ছবি দিলে সেটা আরও বেশি ফল দেবে। কী বলেন?’
‘গুড আইডিয়া,’ জাফর আহমেদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, বিয়ের ছবি দেন। উলটো পিঠে আপনার দস্তখত করে দিতে পারেন। সেটা সত্যায়িত করে টিএনও সাহেবকে জমা দেবো।’
প্রস্তাবটা পছন্দ হলো কলিরও। ঘরে ঢুকে নিজের সুটকেস বের করে ছবির অ্যালবাম থেকে বিয়ের দিনের দুটো ছবি নিল হাতে। একটাতে আছে সে আর রুস্তম। অন্যটি হচ্ছে ওদের পরিবারের ছবি। ছবিতে বড়ো আপাও রয়েছে। শাশুড়ি আর রুস্তম তো আছেই।
রুশনা বেগমের উৎকণ্ঠা আর কুসংস্কারের ফাঁক গলে বারবার কল্পচোখে ভেসে উঠছে রুস্তমের মুখ। এরকম জরুরি সময়েও একবার কল করলেন রুস্তমকে। না। কল সংযোগ হচ্ছে না এখনো। মনের আকাশে দুশ্চিন্তার নিম্নচাপ তৈরি হলো। উদ্বেগের চাকায় সেঁটে গেলেন আবার। এ সময় ছবিদুটো নিয়ে কলি এসে বলল, ‘আম্মাজান, আমার মনে হয় এই ছবিদুটো দেওয়া ভালো হবে।’
ছবিজোড়া হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে রুশনা বেগম প্রশ্ন করলেন, ‘এই চিন্তা এতক্ষণ মাথায় আসেনি কেন?’
কলি বলল, ‘এতক্ষণ না এলেও এখন তো এসেছে। যেহেতু ছবিতে আপনার ছেলের ছবি আছে, অকাট্য প্রমাণ পাবে কর্তৃপক্ষ। নিশ্চয়ই এতে আপনার ছেলের উপকার হবে।’
ছেলের উপকার হবে ভেবে নরম হলেন রুশনা বেগম। বললেন, ‘তাহলে দিতে পারো।’
শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে বাইরে এলো কলি। একবার তাকাল চাচাশ্বশুরের দিকে। তাকে এমন মলিন লাগছে কেন? প্রশ্নটি আচমকা বুকে কামড় বসালেও সহজভাবে জাফর আহমেদের দিকে ছবি এগিয়ে বললেন, ‘নিন। এ দুটো ছবি নিন।’
ছবি হাতে পেয়ে খুশি হলেন জাফর আহমেদ। হাসিমুখে বললেন, ‘এই তো, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে আপনার বুদ্ধিমত্তার কারণে!’
নিজের প্রশংসা শুনে গদগদ হয়ে বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করি টিএনও সাহেবও খুশি হবেন।’
‘অবশ্যই খুশি হবেন। ভালোকথা, ছবির উলটো পিঠে আপনার পুরো নাম ও ডাকনামটি লিখে দস্তখত করে দেন।’
দিয়েছি। কলি বলল, ‘আমার কাজ করেছি আমি। এখন আপনার পালা। আশা করি আমাদের উপকারের জন্য যা প্রয়োজন হয়, করবেন।’
‘নিশ্চিত থাকুন। তবে প্রয়োজনে হয়তো আসতে পারব না। আপনার মোবাইল নম্বরটি কি দেবেন?’
কলি বলল, ‘আমাদের বাসায় একটাই মোবাইল ফোন। সেই নম্বরটিও ছবির উলটো পিঠে লিখে দিচ্ছি।’
হাতেই ছিল কলম। ছবি দস্তখত করার সময় সেটি নিয়েছিল হাতে, এখনো আছে হাতে। টুকটুক করে নম্বরটি লিখে দিলো কলি।
জাফর আহমেদ বিদায় নেওয়ার সময় কলির মুখে ফুটে উঠল অনাবিল হাসি। দুঃখের ফুটন্ত কড়াই থেকে যেন সে উঠে বসেছে সুখের গোলাপ বাগানে।
এই মুহূর্তে রুশনা বেগম দেবরের উদ্দেশে বললেন, ‘মুনির এলো না কেন, আতর আলি?’
‘ঠিক বলতে পারছি না। তবে তিনি আসবেনই এমন কথা বলেননি আমাকে।’
উত্তর শুনে শুভকাজের পরও ঈশানকোণে ঘন মেঘের ছায়া দেখলেন রুশনা বেগম।
কচুখেত ও শিম চাষের মাচাটি দেখে আসতে বলেছিলেন শাশুড়ি। কচুখেত দেখলেও শিমের মাচা দেখা হয়নি ভেবে আবার কলি এগোল বাড়ির উত্তর দিকে। বেশ কিছুদিন শিমের পরিচর্যা করা হয়নি। এখন মাচার সামনে এসে হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুদিন আগে দেখেছিল শিমগাছে ফুল ফুটেছে, এখন শিম দেখার আশায় এসে দেখল সব ফুল ঝরে গেছে। শিম ধরেনি একটিও। কোনো গাছে কেবল ফুলই ঝরেনি, শিমগাছের মাথাও শুকিয়ে যাচ্ছে। কপালে ভাঁজ নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। কাউকে দেখল না। ফুল ঝরে যাওয়ার সঙ্গে জীবনপ্রকৃতির আনন্দ ঝরে যাওয়ার মিলও খুঁজে পেল। রুস্তম নিয়ে যাবে তাকে, নেওয়ার চেষ্টা করছে। বালিময় দেয়াল গেঁথে এরকম আশার চাষ করা উচিত নয়। বালির বাঁধ ভেঙে গেলেও, ফুল ঝরে যাওয়ার মতো কলি ঝরে গেলেও, ভেঙে পড়বে না, নিরাশ হবে না। তবে ভাবলেও নৈরাশ্য হানা দিলো মনে। নৈরাশ্যের চাপা উদ্গিরণ ঠ্যাকাতে না পারলেও বাড়ির শেষপ্রান্তে জলজ এলাকায় এসে আবারও অবাক হলো কলি। সামনে রয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচু জলাবদ্ধ পতিত জমি। জলাবদ্ধ জমিতে ভেড়ি বা নালা পদ্ধতিতে চাষ করা হয়েছে শিম। পানিতে মাছ, পানির ওপর মাচায় চাষ করা হয়েছে শিম। প্রতিটি গাছে ফুল ফুটেছে। শিমও ধরেছে কোনো কোনো গাছে। একই এলাকায় দুই দৃশ্য কেন ? কোথাও ফুল আছে, কোথাও নেই! জীবনও এরকম? কারও জীবন ফুলে ভরা, কারও জীবনের ফুল ঝরে যায়!
একটু বাঁক নিয়ে সামনে এগিয়ে কলি দেখল শৌর্যকে—পরিচর্যা করছে তাদের শিম বাগানের! দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখল দৃশ্যটি। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই দেখা হয়ে যাচ্ছে শৌর্যের সঙ্গে! বিষয়টা কী? কেন ঘটছে অনিচ্ছাকৃত এই সংযোগ? শৌর্যের সঙ্গে প্রকৃতি কিংবা জীবন-পরিচর্যার কোনো যোগাযোগ রয়েছে কি? মনে মনে ভাবল, পরিচর্যা ছাড়া জীবন বৃথা, প্রকৃতির মতোই বৃথা। জীবন-পরিচর্যার জন্য রুস্তমকে বড়োই প্রয়োজন। কবে আসবে রুস্তম, কবে নিয়ে যাবে─ ভাবল কলি। রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে দেখল, রোদ্দুরের সীমা নেই, পরিসীমা নেই। বিস্তীর্ণ ঠা ঠা রোদ্দুর আলো ছড়ায় না, অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে মনের পর্দা। এ কেমন রোদ্দুর?