উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব চার॥
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// এক
- উপন্যাস// মরুঝড়// মোহিত কামাল// পর্ব দুই
- উপন্যাস ।। মরুঝড় ।। মোহিত কামাল ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব চার॥
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব নয়
- উপন্যাস ।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। মরুঝর।। মোহিত কামাল।। পর্ব ষোল
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। পর্ব আঠারো
দুই ॥
স্বামী বিদেশে থাকে। অথচ নতুন বউকে থাকতে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। মন মানে না কলির। শাশুড়িকে বোঝা ভার।
নতুন বউকে তিনি পছন্দ করছেন কি করছেন না, স্পষ্ট নয় এখনো।
তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না, শাশুড়ি তার ব্যাপারে মোটেও চোখ বুজে থাকেন না।
নতুন বউয়ের চলাফেরা, ওঠাবসা তার চোখ এড়িয়ে যায় না মোটেও।
ঘরের বাইরে পা বাড়ালে তার সেই সতর্ক প্রহরার মাত্রা বেড়ে যায়। ছেলের বউকে চোখে চোখে রাখেন কেন,
ব্যাপারটা বুঝতে পারে না কলি। এখনো কোনো অশোভন আচরণ করেনি সে।
শাশুড়ির অসুস্থতার সময় প্রাণ ঢেলে সেবা করেছে। যথাসম্ভব চেষ্টা করছে সবার মন জুগিয়ে চলতে।
তারপরও কখনো কখনো হোঁচট খেতে হচ্ছে তাকে। এসবের পরও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মতো কিছু সৃষ্টি হয়নি।
কিন্তু শাশুড়ির গোয়েন্দাগিরি আচরণ তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। একটা ভয়ানক অস্বস্তিকর চাপে পিষ্ট হচ্ছে সে।
ঘরে বসে জানালা খুলে গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে কলি দেখছে ঝলমলে নীল আকাশ।
কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টির পর নেমেছে রোদের প্লাবন।
বাড়ির পেছনের ঘন ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে চিকচিকে রোদের ঢেউ।
এখনো লতায়-পাতায় জমে আছে বিন্দুবিন্দু জল।
ভেজা পাতা আর জলের ফোঁটায় রোদের ঝলকানিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারপাশ।
বড়ো বড়ো গাছগুলোর ফাঁকফোকর দিয়েও মাটিতে আছড়ে পড়ছে রোদের চকচকে ছুরির ফলা।
কিন্তু জানালা দিয়ে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে তৃষ্ণা মিটল না তার। একবার উঁকি দিলো শাশুড়ির ঘরে।
আসরের নামাজ পড়ার জন্য জায়নামাজে বসে আছেন তিনি।
এই সুযোগে ঘর থেকে বেরোনোর ইচ্ছা প্রবল হলো তার। বাইরের দরজা খুলে বেরিয়েও এলো।
বাড়ির আঙিনা ঘুরে চলে এলো পেছনের ঝোপঝাড়ে। ভেজা পাতা, ভেজা মাটি আর পড়ন্ত বিকেলের
রোদের খেলা দেখতে দেখতে ঝোপের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ দেখল চালতাগাছের ঘন সবুজ
পাতার বুক ফুঁড়ে ফুটে আছে একটা চালতাফুল। সবুজ পাতারা মায়াবী আদর দিয়ে ঘিরে রেখেছে সদ্য ফোটা ফুলটিকে।
কেউ যেন দেখতে না পায়, ছুঁতে না পারে, ছিঁড়তে না পারে- এতসব ভেবেই কি সবুজ প্রকৃতি এভাবে ঢেকে রাখার চেষ্টা
করছে ফুলটিকে? চালতাফুলের কদর না থাকলেও কম নয় তার সৌন্দর্য।
সবার অলক্ষে সেই সৌন্দর্য যেন রাঙিয়ে তুলেছে ছোট্ট স্বল্প সবুজ বনটাকে। বুক ভরে গেল এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে।
হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল তার বুক। কোথা থেকে ফুর্তিবাজ এক চঞ্চল পাখি উড়ে এসে বসল তার ডালে।
চালতাফুলের খুব কাছ ঘেঁষে। পাখিটি তাকিয়ে আছে তারার মতো সাজানো গুচ্ছ পরাগকেশরের দিকে।
কেমন বিস্ময়ভরা তার দৃষ্টি। তবে কলি পাখিটার নাম মনে করতে পারছে না।
এ এলাকায় এমন পাখি আরও দেখেছে। একমুহূর্তের জন্যও স্থির থাকছে না পাখিটি।
একবার তাকাচ্ছে পরাগকেশরের দিকে, একবার মাটির দিকে। তাকাচ্ছে রোদের দিকেও।
তার চোখ ঘুরছে চক্রাকারে। দেখতে চড়ুই পাখির মতো হলেও এটি চড়ুই নয়। মাথা কুচকুচে কালো।
চোখের নিচ থেকে গালের দুপাশে ত্রিভুজ আকারের সাদা ছোপ।
চোখের উপরিভাগ থেকে ঘাড় পর্যন্ত বিস্তৃত কালো রঙের পাখিটির গোটানো ডানার উপরিতল ধূসর সুরমা রঙা।
হঠাৎ চিঁচিঁ করে ডাকতে শুরু করল পাখিটি। কলি গভীর চোখে দেখতে থাকে পাখি আর ফুলের পাশাপাশি অবস্থান।
পাখিটির কাছে কি ফুলটি নিরাপদ? মাথায় প্রশ্নটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে,
কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে, চিঁচিঁ হুইহুই শব্দ শুনে একইরকম আরেকটি পাখি উড়ে বসেছে পাশাপাশি।
দুটো পাখিই তাকিয়ে আছে রঙিন গর্ভকেশরের দিকে।
এবার কলির বুকে একের পর এক তির বেঁধার পালা। দুটি পাখিই তাদের তিনকোনা চঞ্চু দিয়ে ঠুকরে খেতে শুরু করেছে
সেই গর্ভকেশর গুচ্ছ। ফুটন্ত পরাগকেশরের মতো কলির বয়সি একটি কিশোরীবধূও কি একইরকম অনিরাপদ?
অরক্ষিত থাকলে কি এভাবেই হামলে পড়বে কেউ? ভাবতে গিয়ে অজানা ভয় ভর করল তার মনের গহনে।
ভয়-পাওয়া চোখেই তাকিয়ে দেখতে লাগল ফুলের রেণু খাচ্ছে যে পাখিটা, তার উল্লাস।
ব্যাপারটাকে তার নিষ্ঠুর খেলার মতো মনে হয়। হঠাৎ গা ছমছম করে উঠল তার।
ডান পাশের আমগাছের আড়াল থেকে এগিয়ে আসতে থাকা একটা অদৃশ্য পায়ের আওয়াজ পেল কলি।
ডানে তাকিয়ে দেখল পাশের ঘরের রুস্তমের চাচাতো ভাই শৌর্য এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
সমবয়সি শৌর্যের সঙ্গে কথা হয়েছে আগে।
খালি গায়ে সুঠামদেহী কৃষ্ণকায় শৌর্যকে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন করল,
‘দেখছ, পাখিরা কীভাবে পরাগরেণু খেয়ে ফেলে?’
‘বাঃ! পাখিদের খাবারই তো ওটা। নিজের খাবার খাবে না পাখি?’
খাবারের কথা এমনভাবে বলল, শুনে লজ্জায় কলি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও আবার প্রশ্ন করল,
‘পাখিটার নাম জানো ?’
‘জানব না কেন ? আমাদের এলাকায় ওর নাম রামগাংরা।’
‘অন্য একটা কী নাম আছে যেন। এ নাম শুনিনি তো কখনো!’
‘হ্যাঁ, অন্য নামও আছে। বাংলা বইতে পাখিটির নাম রামগাঙর, ইংরেজিতে বলে গ্রে-টিটা।’
‘এতকিছু তুমি জানলে কীভাবে?’
‘একবার আলম শাইন নামের একজন পাখিবিশেষজ্ঞ এসেছিলেন আমাদের গ্রামে। এখানে তো অনেক পাখি।
ছবি তুলেছিলেন। তার কাছ থেকেই জেনে নিয়েছিলাম পাখিটার নাম।’
ওদের কথার মাঝখানে ‘নতুন বউ! কোথায় তুমি?’ বলে ডাকতে ডাকতে ঘরের পেছনের দিকে এগিয়ে এলেন শাশুড়ি।
তাঁর ডাক শুনে দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলি বলল,
‘পাখি দেখছিলাম।’
বাগানের ভেতরে একা ঢুকেছিলে? ’ শাশুড়ির প্রশ্ন।‘একাই ঢুকেছিলাম। গিয়ে দেখলাম শৌর্যকে। পাখিগুলো চিনিয়ে দিচ্ছিল ও।’
কলির সরল উত্তর শুনেও তার দিকে সরল চোখে তাকালেন না শাশুড়ি। কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকলেন তার মুখের দিকে।
শাশুড়ি রুশনা বেগমের তাকানোর ধরন দেখে হকচকিয়ে গেলেও সহজ হয়ে কলি বলল, ‘চালতাগাছে ফুল ফুটেছে।
ফুলের পরাগরেণুগুলো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল রামগাংরা পাখি। কী সুন্দর দৃশ্য! পাশাপাশি নির্মমও!
‘এমন দৃশ্য আপনি দেখেছেন কখনো, আম্মাজান?’
কথার সহজ জবাব না দিয়ে রুশনা বেগম এবার কলিকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ঘরে যাও।
বাগানে একা এভাবে ঢুকবে না। কলি, তুমিও পরাগরেণুর মতো নতুন, ভুলে যেয়ো না কথাটা।’
শাশুড়ির ভয়ংকর কথা শুনে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেল কলি। এরকমের একটা ঘটনার এমন ব্যাখ্যা হতে পারে,
চিন্তাও করতে পারেনি। শাশুড়ির কথা শুনে তাই স্বাভাবিকভাবেই আহত হলো সে। সে অবস্থায় ঘরে ঢুকে গেল।
বউয়ের প্রতি শাশুড়ির বিশ্বাস থাকবে না? এ কেমন শাশুড়ি! কী ইঙ্গিত করলেন তিনি!
শৌর্যের মতো অমন ভালো একটা ছেলেকে নিয়ে এমন বাজে ধারণা পোষণ করতে পারলেন তিনি?
কোনো অশোভন কথা বলেনি শৌর্য বাজে আচরণও করেনি। অথচ ওকে ঘিরে এমন ইঙ্গিত করতে পারলেন শাশুড়ি!
বিস্ময়ের ঘোরে ডুবতে ডুবতে বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল মন। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রুস্তমের চিন্তায় ডুবে গেল কলি।
তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হলো। অথচ মোবাইল ফোনটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। ঘরে একটিমাত্র ফোন।
সেটাও শাশুড়ির নিয়ন্ত্রণে। যখন-তখন ব্যবহারের সুযোগ পায় না।
রুস্তমের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হলেও সে ইচ্ছাকে দমন করতে হলো।
ফোনের জন্য শাশুড়ির কাছে হাত পাততে ইচ্ছা করল না। নিজের ঘরে বসে আবার তাকাল বাইরের দিকে।
রোদমাখা ভেজা সবুজ গাছগাছালি, লতাপাতার সমুদ্রে হারিয়ে গেল কলি।আচমকা কলি ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
জানালার নিচ থেকে ভোঁস করে মাথা তুলে শৌর্য বলল,
‘তোমার শাশুড়ি হলো কুটনিবুড়ি। তার কথায় মন খারাপ কোরো না।’
শৌর্যকে আবার দেখে কেবল ভয়-ই পায়নি, ওর কথা শুনে রীতিমতো থরথর করে কাঁপতে লাগল।
মুহূর্তে ভয় বেড়ে গেল হাজারগুণ। বুক ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল ভেবে যে,
শাশুড়ি শৌর্যকে আবারও দেখলে আর রক্ষা নেই! অশ্রাব্য কটুকথা শোনাতে জিভ আটকাবে না শাশুড়ির।
মনের এরকম যখন অবস্থা, তখন ভেতরের দিকে তাকিয়ে দেখল দরজার মুখে দাঁড়িয়ে শকুনের মতো চোখ
পাকিয়ে আছেন শাশুড়ি। জানালার সামনে থেকে তিনি চট করে শৌর্যের সরে যাওয়ার দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছেন
প্রখর দৃষ্টি মেলে। জানালা থেকে শৌর্যকে সরে যেতে দেখে দরজা থেকে সরে গেলেন তিনিও।
কিছুদূর এগিয়ে আবার ফিরে এসে বেশ ঠান্ডা গলায় কলিকে প্রশ্ন করলেন,
‘এই ছেলের সঙ্গে কবে থেকে ঘনিষ্ঠতা হলো তোমার? এভাবে গোপনে কবে থেকে মেলামেশা করছ?’
প্রশ্ন শুনে আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। বাক্-রুদ্ধ হয়ে গেল কলি। মুখে কথা জোগাল না।
যেন জীবনের ভাঁজ খুলতে শুরু করেছে ধাপে ধাপে। প্রতিটি ভাঁজ থেকে বেরোচ্ছে কেউটের মতো বিষাক্ত সাপ।
সাপের ছোবল খেয়েই তাহলে তাকে এগিয়ে যেতে হবে? শাশুড়ির প্রশ্ন মুহূর্তেই খুলে দিলো তার মুখের জড়তা।
সে বলে বসল, ‘এসব কী বলছেন, আম্মাজান? ঘনিষ্ঠতা হবে কেন? গোপনে মেলামেশার প্রশ্নই বা তুলছেন কেন?
একই বাড়ির পাশের ঘরের দেবরের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হতেই তো পারে। এমন হওয়াটা কি দোষের?’
রুশনা বেগম রূঢ় ভাষায় জবাব দিলেন, ‘গলা উঁচিয়ে কথা বোলো না, বউমা। আমি তোমার শাশুড়ি।
শাশুড়ির সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, শিখে আসোনি?’
চিরাচরিত বাঙালি শাশুড়ির স্বরূপ যেন প্রকাশ হতে শুরু করেছে। আজকে একটু আগে যা ঘটে গেল,
সেটা কি তার প্রথম ধাপ? সবকিছু বুঝে চুপ হয়ে গেল কলি। বউমাকে চুপ হতে দেখে রুশনা বেগম চুপ হয়ে গেলেন না।
বরং গলা আরও খুলে বলতে লাগলেন,
‘পরপুরুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলছ, দেখাসাক্ষাৎ করছ—এ কথা শুনলে যে রুস্তমের ভয়ানক কষ্ট হবে, একবারও কি তা ভেবে দেখেছ?
ছেলে আমার মরুভূমিতে পড়ে আছে। আর তুমি কি না পরপুরুষের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াবে! আর এসবই মেনে নিতে হবে আমাকে?’
শাশুড়ির কথা মুহূর্তে আগুন ধরিয়ে দিলো তার সারাশরীরে। কঠোর জবাব দিতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল।
নিজেকে সংযত করল অনেক কষ্টে। জানালা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়।
রুশনা বেগম ততক্ষণে চলে গেছেন দরজার সামনে থেকে। কিছুক্ষণ পর উঠে দরজায় খিল দিলো কলি।
শাশুড়ির বলা তিক্ত কথাগুলো মন থেকে হাজার চেষ্টা করেও তাড়াতে পারছে না।
যিনি ছেলের নতুন বউকে এমন কথা শোনাতে পারেন, রংচং মিশিয়ে ছেলেকেও যে বলতে পারেন অনেক কথা,
তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া ‘রুস্তম এসব শুনলে কষ্ট পাবে’ কথাটার অর্থ কী?
কে এসব কথা শোনাতে যাবে রুস্তমকে? নিশ্চয় শাশুড়িই বলবেন, বউকে শাসন করত গিয়ে, শিকলে বাঁধতে গিয়ে,
ছেলের বুকে যে কোপ বসিয়ে দেবেন না, কে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারে! ভাবনার চাকা আরও বেশি ঘুরতে লাগল।
ফোনটাও চাওয়া যাবে না। যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। রুস্তমের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হলো।
যা-কিছু ঘটে গেল, তা নিয়ে বলার কিছু নেই। কারণ সজ্ঞানে সে কোনো অপরাধ করেনি।
কেবল কৌতূহলের বশেই গিয়েছিল বাগানে। এই এখন,
ঘটে যাওয়া সবকিছু ভাবতে গিয়ে নিজেকে আর তেমন অসহায় মনে হয় না।
কিন্তু কথাগুলো একটু শেয়ার করতে পারলে ভালো হতো। এখন একমাত্র নিজের মাকেই সব খুলে বলা যেতে পারে।
সেই সুযোগও শাশুড়ি দেবেন না। নিজেদের বাড়িতে যেতে হলেও অনুমতি লাগবে রুস্তমের।
অবশ্য তার কল না এলে বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানানোরও সুযোগ পাবে না।
স্বামী কখন কল করবে কলি নিজেও জানে না। ফলে তার কলের আশায় আশায় প্রহর গোনে সে।
গত সপ্তাহে একবারও কল করেনি। নাকি কল এসেছিল, তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি?
এরকম ভাবনা ভাবতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। আরও অস্থির হয়ে ওঠে মন। শোয়া থেকে উঠে বসে।
মনে হচ্ছে দম আটকে যাবে। এ সময় একটা টিকটিকি টুপ করে জানালা থেকে বিছানার দিকে এগিয়ে এলো।
ব্যাপার কী? টিকটিকি মানুষ দেখলে ভয় পায়। ত্বরিতগতিতে ছুটে পালায়।
সেই টিকটিকির বিছানায় পা রাখার উদ্দেশ্যটা কী। পালাচ্ছে না কেন? পিটপিট করে তাকাচ্ছেই বা কেন?
টিকটিকিটার আগমন কি শুভ কোনোকিছুর জানান দিয়ে গেল?
মাথায় নতুন চিন্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে রুস্তমের কলের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।
কিন্তু সেই ব্যাকুলতা কমানোর কোনো উদ্যোগ নিতে পারল না। বুকের ভেতরটা এবার কেঁদে উঠল।ভেতরের কান্না বাইরে এলো,
চোখের জলে ভেসে গেল বুক। বুকের তলে বালিশ রেখে ঘুমিয়ে গেল কখন, টেরই পেল না কলি।
এক সময় হঠাৎ করেই বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল কলি। শাশুড়ি ডেকে ডেকে বলছেন,
‘সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনো শুয়ে আছো? শুয়ে থাকলে চলবে? দুপুরের বাসি খাবার দিয়েই কি সারতে হবে রাতের খাবার?’
কথার সুর কেমন কর্কশ। কোনো সৌন্দর্য নেই। প্রতিটি শব্দ থেকে ঝরে পড়ছে চরম বিরক্তি। ক্ষোভ।
কোনোমতেই মানুষকে আপন করার সুরে কথা বলতে পারেন না। এ কেমন শাশুড়ি!
ক্রমেই টলে যাচ্ছে তার শ্রদ্ধার আসন। এ বাড়িতে কথাবার্তা সাবধানে বলতে হবে ভেবে কলি বলল,
‘উঠছি, আম্মাজান।’
গ্রাম জনপদ হলেও উপজেলা সদরে তাদের বাড়ি। বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে। তবে বাল্বের পাওয়ার কম।
ষাট ওয়াটের বাল্বের আলো দূর করতে পারে না ঘরের পুরো অন্ধকার। টেবিলঘড়িতে এখন সন্ধ্যা সাতটা দশ মিনিট।
হিসাব করে বুঝল দুবাইতে এখন বিকাল পাঁচটা দশ মিনিট। কাজের সময় শেষ হয়েছে।
রুস্তম নিশ্চয় নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাসায় ফিরে গোসল করে খেয়ে মাঝে মাঝে কল করে।
আজ কি কল করবে ? এরকম ভাবনায় দুলতে দুলতে উঠে দাঁড়াল কলি। নিত্যদিনের কাজে মনোযোগ দিলো।
রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।শাশুড়ি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন মোবাইল ফোন নিজের হাতে রেখেছিল কলি।
কাজের সময় কল না দিলেও মনের ভেতরে কল দেওয়ার ইচ্ছাটা ডানা ঝাপটাত। মাঝেমধ্যে ঝট করে মিসকল দিত।
মনে হতো সঙ্গেই আছে রুস্তম। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার পর প্রথমেই মুঠোফোন তার দখলে নিয়েছিলেন শাশুড়ি।
সঙ্গে সঙ্গে কলির মনে হয়েছিল, পুরো রুস্তমকেই দখল করে নিয়েছেন তিনি।
রুস্তম কি কেবলই শাশুড়ির সন্তান? সন্তানকে দখলে রাখুন তিনি, আপত্তি নেই। কিন্তু একইসঙ্গে রুস্তম যে তার স্বামী।
তার স্বামীকে আড়াল করার এই প্রবণতা কেন, বুঝতে পারে না কলি। এখন তো ভালোই আছে রুস্তম।
ভালো জায়গায় কাজ করছে। বেতনও পাচ্ছে ভালো। দেশেও টাকা পাঠাচ্ছে। তাদের অবস্থা ফিরছে দিনে দিনে।
একবার কথার ফাঁকে রুস্তমকে বলেছিল,
‘আমার আলাদা একটা ফোন থাকলে ভালো হতো। আপনার সঙ্গে যখন-তখন কথা বলতে পারতাম।’
শুনে রুস্তম বলেছিল, ‘মাকে বোলো। মাই কিনে দেবেন।
পারিবারিক কাজগুলো মায়ের সম্মতিতে করলে ঘরে শান্তি থাকবে।
’ঘরের শান্তি বজায় থাকার কথাটা সহজভাবে নিয়েছিল কলি। তাই একবার খুশির তোড়ে শাশুড়িকে বলেছিল,
‘আম্মাজান, আমার জন্য আরেকটা মোবাইল কিনলে হয় না?’কথাটা শুনে প্রায় চমকে উঠেছিলেন রুশনা বেগম,
‘সে কি! আমরা এক ঘরে থাকি। দুটো ফোনের দরকার কেন? তোমার বয়সি মেয়েদের হাতে ফোন থাকতে নেই। ফোন হাতে থাকলে
আশেপাশের ছেলেরা জ্বালাতন করবে। বরং একটাই ভালো। যখন রুস্তম কল করবে, তুমিও কথা বলবে। অসুবিধা কোথায়?’
শাশুড়ির কথায় মাথায় যেন দুম করে বাজ পড়েছিল। কথার পিঠে কথা না বলে চুপ হয়ে গিয়েছিল কলি।
এরপর মুখ ফুটে আর আলাদা সেটের কথা বলেনি। অভিমানে সারারাত শাশুড়ির নির্দেশ অমান্য করে নির্ঘুম কাটিয়েছিল।
জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে দু-চোখ মেলে দেখেছিল ধবল পূর্ণিমার আলো। সেই আলোয় স্নান করে পেয়েছিল নতুন শক্তি।
থেমে গিয়েছিল বুকের নিভৃত চাপা কান্না।অভিমান বুকে পুষে চুলায় ভাতের হাঁড়ি চাপাল কলি। জ্বলন্ত চুলার দিকে তাকাতে গিয়ে তার মনে হলো,
নিজের বুকের ভেতরেও জ্বলছে তুষের আগুন। খানিক পর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলেও এপাশটা বেশ অন্ধকার। ঘরের লাইটের কারণে আলো-আঁধারের
রহস্যময়তা ঘিরে রেখেছে চারপাশ। এখানে দাঁড়িয়ে ঝোপঝাড়ের অন্ধকারের নির্জনতা অনুভব করা যায়।
কোথাও কোনো শব্দ নেই। নৈঃশব্দ্য ভেদ করে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে এলো।
জোনাকি পোকার পিটপিটে আলো জ্বলছে আর নিভছে।
ঝিঁঝির শব্দ মনে আর জোনাকির আলো চোখে ধারণ করে ভেতরের আগুনশিখাটা নিভিয়ে ফেলল কলি।
শাশুড়ির রুমে হঠাৎ ফোনের শব্দ শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনের ঘরেও ঘণ্টা ভেজে উঠল। ছুটে গেল কলি।
রসুইঘরের ভেতর দিয়েই এগিয়ে গেল। গিয়ে শাশুড়ির রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়াল চুপিচুপি।
একবার মাত্র রিংটোনের শব্দ পেয়েছিল সে। দ্বিতীয় দফায় বেজে ওঠার আগেই কল ধরেছেন রুশনা বেগম।
ফিসফিস করে কথা বলছেন এখন।মা-ছেলের কী এত গোপন কথা? এত কী লুকোছাপা? ভাবল কলি। রুস্তম কি তাহলে কথা বলতে চাইবে না
তার সঙ্গে? গোপন এই প্রশ্নে মন ভরে উঠল প্রগাঢ় এক অভিমানে।
দরজার আড়াল থেকে সরে এলো সে রসুইঘরে।অভিমানে সরে এলেও গোপন একটা আকাক্সক্ষা ভর করেছিল কলির মনে।
ভেবেছিল শাশুড়ি কথা শেষ করে কলিকে নিশ্চয়ই ডাকবেন। সেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবেন,
‘নাও কথা বলো, রুস্তম কথা বলবে তোমার সঙ্গে।’
কিন্তু আকাক্সক্ষার সেই পাপড়িগুলো ঝরে যেতে লাগল। মিনিট বিশেক পেরিয়ে গেলেও শাশুড়ির তরফ থেকে তার ডাক নেই।
আবার সপ্রশ্ন হয়ে উঠল কলি,মা ও ছেলে কী কথা বলছেন এতক্ষণ? বুকে চিন্তার তুমুল তোলপাড়। সেই অবস্থায় পা টিপেটিপে
এগিয়ে গেল শাশুড়ির ঘরের দিকে। ঘর নিস্তব্ধ। শোনা যাচ্ছে না শাশুড়ির ফিসফাস তবে কি তিনি এখনো কানে সেট ধরে বসে আছেন?
ছেলেই কেবল কথা বলে যাচ্ছে? দরজার আড়াল থেকে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলো কলি।
ভেতরের যে দৃশ্য চোখে পড়ল তার, তা যেন তার দুই গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে দিলো।
পানের বাটা নিয়ে বসেছেন শাশুড়ি। ফোনে আর কথা বলছেন না। খাটের ওপর পড়ে আছে সেট।
লাইন কেটে দিয়েছে রুস্তম। বউয়ের সঙ্গে স্বামীকে কথা বলতে না দিয়ে লাইন কেটে দিতে পারলেন শাশুড়ি!
বোঝা যাচ্ছে বেশ খোশমেজাজে আছেন। খোশমেজাজে থাকলে অসময়েও পানের বাটা নিয়ে বসার অভ্যাস তার।
ছেলের সঙ্গে মা কথা বলে তৃপ্ত হলেও বউ কলির মন আবার জ্বলে উঠল। একটা অব্যক্ত ইচ্ছার আগুন জ্বলে উঠেই হঠাৎ দপ করে নিভে গেল।
রুস্তমের প্রতি অভিমানের বরফ গলে পানি হয়ে গেল। মুঠোফোনে কথা না বলতে পারায় বুকজুড়ে শুরু হলো তুমুল তোলপাড়।