কিশোর উপন্যাস

কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। সাত

সাত:

স্কুল ড্রেস পরা সিপসিপে গড়নের ছেলেটির চোখে-মুখে বিস্ময়। শরীর আর মনজুড়ে চলছে আনন্দ-বিষাদের লড়াই। তানজিল কোন পথে স্টেজে উঠবে ভেবে পাচ্ছিলো না। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসএসএফের কর্মীরা তাকে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি যেতে সাহায্য করলেন। তানজিল প্রধানমন্ত্রীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এতো কাছাকাছি বাংলাদেশের রাজকন্যা! বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা! একি স্বপ্ন? না-কি সত্যি? তানজিলের মনে হলো-এখনই রাজকন্যার পা ছুঁয়ে সালাম করা উচিত। এই ভেবে সে সালাম করতে গেল। হঠাৎ তীরবেগে ছুটে এলেন এসএসএফের কর্মীরা। সালামে বাধা দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ছেড়ে দাও।

এসএসএফের কর্মীরা সরে দাঁড়ালো। তানজিল ভয়ে ভয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করলো। তিনি তানজিলকে আদর করে মাথায় হাত রাখলেন। তানজিলের মনে হলো সে আকাশে ভেসে যাচ্ছে। ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে স্বর্গে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। নানান রঙের ফুল, পাখি আর প্রজাপতির মেলা। স্বচ্ছ জলের প্রবাহ। সবমিলিয়ে বইয়ে পড়া বর্ণনার মতো সাজানো-গোছানো।  যেখানে শুধু আনন্দ, সুখ আর স্বাচ্ছন্দ। জল প্রবাহের কথা মনে হতেই তানজিল সরে দাঁড়লো স্টেজের রোস্ট্রামের পাশে। রোস্ট্রামটি বাহারি সব রঙিন ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো। তার ওপরে একটি টার্চ ল্যাম্প। তিনপাশ দিয়ে তিনটি ছোট মাইক্রোফোন, ফাইল আর কিছু কাগজপত্র রাখা। তানজিল চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো প্রায় সবার নজর তার দিকে। সে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকলো। কী করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মুখ তুললো। বিভিন্ন টেলিভিশন, রেডিও, পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের চোখ এবং ক্যামেরার ফোকাস এখন তানজিলের দিকে। ফটাফট উঠতে থাকলো ছবির পরে ছবি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠলো মঞ্চমূল।    

প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্কুল পড়–য়া ছোট্ট একটি ছেলে। এই ছেলেকে সবাই সেতুবালক বলে ডাকে। পদ্মা সেতু নিয়ে তার কতো স্বপ্ন। কতো ভাবনা। পত্রপত্রিকায় পড়ে, ইন্টারনেট ঘেটে সেতু সম্পর্কে সে অনেক কিছু জেনেছে। সেতু নিয়ে ভিডিওচিত্র বানিয়েছে। স্কুলে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে। একটি বাচ্চা ছেলের পদ্মা সেতু নিয়ে কতো ভাবনা। এটা আমাদের জন্য বড়ো প্রাপ্তি। কিন্তু একটি দল সবসময় এসবের বিরোধিতা করে গেছে। কারণ তারা উন্নয়ন চায় না। অথচ সেতুবালকের কাজ, তার ভাবনা-চিন্তা দেখেই বোঝা যায় দেশের মানুষ আধুনিক হয়ে উঠছে। দেশের সকল জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি চাই এই ছেলের মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী দেশ নিয়ে চিন্তা করবে। দেশের মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাববে। দেশের কল্যাণে কাজ করবে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করবে। নতুন নতুন আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবে। আমাদের নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাবে। আমার বিশ্বাস এই ছেলে একদিন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিম্বা অন্য কিছু হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। পরিবার-পরিজন এবং শিক্ষকদের মুখে হাসি ফোটাবে। সরকার তার পড়াশোনার সকল দায়িত্ব নিচ্ছে। আমাদের ইচ্ছে আছে আগামীতে পাটুরিয়া গোয়ালন্দ এলাকায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা। এই ছেলে হয়তো একদিন দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে।

এই কথা শুনে তানজিলের চোখ জলে ভেসে যায়। জামার হাতা দিয়ে বারবার চোখ মুছতে থাকে। এসএসএফের কর্মীরা তাকে স্টেজ থেকে নামিয়ে সিটে বসিয়ে দেয়।

একটু পরে অনুষ্ঠান শেষ হলো। যে যার মতো বেরিয়ে যেতে লাগলো প্যান্ডেল থেকে। তানজিল বাইরে বেরিয়ে দেখে গেটের মুখে তার বাবা ও প্রিয় দুই শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছেন। শুকুর আলী তানজিলকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরেন। শিক্ষকরা গায়ে মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে থাকেন। আশপাশের লোকজন তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। শুকুর আলী বলেন,

                -বাপজান আইজ আমি খুব খুশি হইছি। প্রধানমন্ত্রী তুমার কতা কইছে। তুমার পড়ালেখার দায়িত্ব নিছে। বাপ হয়ে আমার এ যে কতো বড়ো পাওয়া বুঝতে পারবা না। সার, আইজ থেইকা আমার ছেলেরে আপনাগো হাতে পুরাপুরি তুইলা দিলাম। ওর পড়ালেখার সব দায়িত্ব আপনাগো।

                -ঠিক আছে চাচা। আমরা তো আছি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

চারদিকে হাজার হাজার মানুষের ঢল। সবাই ভীষণ উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত। মনে হচ্ছে এখনই হেঁটে কিংবা দৌড়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে যাবে। বারবার মাইকে বলা হচ্ছে আগামী কাল পদ্মা সেতু সকলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনো এই এলাকায় আছেন। আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করছেন। আপনারা শান্ত থাকুন। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না।

সমাবেশ স্থল থেকে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর মাওয়া প্রান্তের সেতু ফলকের দিকে এগোতে থাকে। প্রথম যাত্রী হিসেবে বেলা পৌনে বারোটার দিকে টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দেন প্রধানমন্ত্রী। বারোটার দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি সুইচ টিপে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন। এর পাশাপাশি ফলকের স্থানে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ম্যুরাল উদ্বোধন করেন। এ সময় আকাশ হেসে ওঠে। বাতাস হেসে ওঠে। পাখিরা গান গাইতে শুরু করে। নদীতে স্রোত বইতে শুরু করে। শুরু হলো পদ্মা সেতুর আনন্দযাত্রা। এ আনন্দযাত্রায় কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে যাত্রী হলো আকাশে ছিটানো আবিরের রং। রঙিন আকাশে উড়লো বিমান বাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাবেশস্থ ছাড়ার পরপরই পুলিশের বাধা অতিক্রম করে সেতুতে উঠতে শুরু করে উৎসবমুখর হাজার হাজার জনতা। তারা উল্লাস করতে থাকে। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকে। জাতীয় পতাকা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। তানজিলেরও খুব ইচ্ছে হয় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে পদ্মা সেতুতে উঠতে। হৈ হুল্লোড় করতে। যে পদ্মার বুকে এখন বাংলাদেশ হাঁটবে সেই পথে হাঁটতে। কিন্তু স্যারেরা তাকে বাধা দেন। এতো ভিড়ের মধ্যে যেতে নিষেধ করেন। জাকির স্যার বলেন,

                -আমরা তো খুব কাছেই থাকি। অন্য একদিন আসব। মজা করে সেতুটি ঘুরে দেখব। চলো আমরা রওয়ানা দেই। 

                তানজিলের মন খারাপ হলো। কিন্তু কী আর করার! তার বাবা ও দুই শিক্ষকের সঙ্গে ভিড় ঠেলে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়।

                -জাকির সাহেব, আমরা একদিন আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের এখানে নিয়ে আসতে পারি। পদ্মা সেতু এলাকাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে পারলে তাদের ভালো লাগবে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে তাদের মনেও স্বপ্ন জাগতে পারে। বললেন, হাসান স্যার।

                -স্যার আমিও তাই ভাবছিলাম। এতে ছাত্রছাত্রীরা খুব আনন্দ পাবে। তানজিল তুমি কী বলো?

                -অবশ্যই স্যার। আমরা সবাই মিলে একদিন এখানে আসব। খুব আনন্দ হবে।

তানজিলের হাতে ব্যাগ দেখে শুকুর আলী জানতে চান হাতে ওটা কীসের ব্যাগ? কে দিয়েছে? তানজিল বলল,

                -অনুষ্ঠানে ঢোকার সময় দিয়েছে। ব্যাগের ভিতরে কী আছে জানি না। বাড়ি গিয়ে দেখবো।

দুপুরের দিকে তারা বাড়িতে পৌঁছায়। বাড়িতে পৌঁছাতে তাদের একটু বেশি দেরি হয়। কারণ রাস্তায় প্রচ- ভিড়। সেইসঙ্গে এলাকার মানুষ তানজিলের সঙ্গে কথা বলে। প্রধানমন্ত্রীকে সামনা সামনি দেখে কেমন লাগলো তা জানতে চায়। উনি তাকে কী বললেন সেসব কথা জানতে চায়। অল্প সময়ের ব্যাবধানে তানজিল যেনো তারকা বনে যায়। যেতে যেতে জাকির স্যার বললেন,

                -এ হলো খ্যাতির বিড়ম্বনা। কিন্তু তোমাকে ভুলে গেলে চলবে না তুমি একজন ছাত্র। লেখাপড়া তোমার মূল কাজ। আজ যে সুযোগ তোমার জন্য তৈরি হলো তা কোনোদিন হাতছাড়া করো না। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। তোমার স্বপ্ন পূরণ হবেই। আমরা আছি তোমার পাশে। যাই হোক, ব্যাগে কী দিয়েছে আমারও কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। ছয়কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *