কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। ছয়

ছয়:

আর মাত্র কয়েক দিন। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে। সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নদ্বার। তাই সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরেই সবার ব্যস্ততা। প্রায় প্রতিদিনই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেতু এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে কার কী দায়িত্ব, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা, উৎসুক মানুষের ঢল নামলে কীভাবে তা সামাল দেওয়া হবে- এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের সুধী সমাবেশের স্থান চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। উদ্বোধনী ফলক, ম্যুরাল তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় তিন হাজার অতিথির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। চলছে দাওয়াতপত্র ছাপার কাজ।

বাইরে আষাঢ়ের খটখটে রোদ। ভ্যাপসা গরম। তানজিলদের স্কুলে হন্তদন্ত হয়ে একজন ব্যক্তি ঢুকলো। হাতে একগাদা চিঠিপত্র। তানজিল হুদাকে খুঁজতে লাগলো। হেড স্যার তানজিলকে খোঁজার কারণ জানতে চাইলেন। পত্রবাহক বলল,
-তানজিল হুদার নামে একটি চিঠি আছে। চিঠিতে এই স্কুলের ঠিকানা দেওয়া। তাকে একটু দ্রুত ডেকে দিন। আমাকে   এখনো অনেক জায়গায় যেতে হবে।
-হেড স্যার দপ্তরি পাঠিয়ে তানজিলকে ক্লাস থেকে ডেকে আনলেন।
-ও আপনে তানজিল হুদা। আমি তো ভাবছি স্কুলের কোনো স্যার হইবো। নেন, আপনার একটা চিডি আছে। স্বাক্ষর  দেন।

তানজিল স্বাক্ষর করে চিঠিটি হাতে নেয়। দেখে খামের উপরে লেখা- তানজিল হুদা, বিস্ময়কর সেতুবালক, যশলদিয়া পদ্মা সেতু স্কুল, জাজিরা, শরীয়তপুর। খামের নিচে লেখা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তানজিল খামটি হেড স্যারের হাতে দিলেন। স্যার বললেন,

                -তোমার নামে চিঠি। তুমিই খোলো।

তানজিল কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটি খুললো। দেখলো পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ভাবতেই তার বুকটা আনন্দে ভরে উঠলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পদ্মা সেতু শুরু এবং বর্তমান সময়ের চিত্র। দেখতে দেখতে চোখের সামনে বদলে গেলো সবকিছু। মনে পড়লো সেতু তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় তার মা-বাবার আহাজারির কথা। আত্মীয় স্বজনের বিলাপের কথা। মনে মনে বলল, তাঁরা কষ্ট পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু পদ্মা সেতু হয়েছে বলেই আজ আমাকে এলাকার মানুষ সেতুবালক হিসেবে চেনে। এই এলাকায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। দেশের মানুষ আনন্দের সাগরে ভাসছে। হাজার হাজার মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যাওয়ার দাওয়াত পেয়েছি। হঠাৎ হাসান স্যারের কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেলো তানজিল। স্যার বললেন,

                -তানজিল তুমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। পড়ালেখার পাশাপাশি পদ্মা সেতু বিষয়ে তোমার জানার চেষ্টা, একাগ্রতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ভালোবাসার পুরস্কার এই চিঠি। ভবিষ্যতে কখনো এই সম্মানের অমর্যাদা হতে দিও না। খবরটি তোমার মা-  বাবাকে জানাবে। এখন ক্লাসে যাও।

                -স্যার এজন্য আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনাকে ও জাকির স্যারকে সঙ্গে নিয়ে ওই দিন আমি সেখানে যেতে চাই। আমার বাবাকেও নিয়ে যেতে চাই।

                -আমরা অবশ্যই যাব। তোমার বাবাকেও নিয়ে যাবে। তুমি আগে থেকে তোমার বাবাকে বলে রাখবে। কিছু বললে  আমাদের কথা বলবে যে, স্যারেরা যেতে বলেছেন। কিন্তু তানজিল আমার কী মনে হয় জানো- টিএনও স্যার ডিসির মাধ্যমে কাজটি করিয়েছেন। তিনি হয়তো তোমার বিষয়ে সেতু উদ্বোধনের দিন যাঁরা অতিথিদের দাওয়াত দেওয়ার কাজ করছে তাদের বলে দিয়েছেন।

                -স্যার আমারও তাই মনে হয়।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো তানজিলের। আজ সেই বিশেষ দিন। ২৫ জুন ২০২২, শনিবার। পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সকাল ১০টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। তানজিল তার বাবা ও দুই স্যারের সঙ্গে অনুষ্ঠান স্থলে যাবেন। একটু পরেই স্যার আসবেন। তানজিল স্কুল ড্রেস পরলো। বাবাকে বললো, ভালো একটি জামা পরতে। কিন্তু শুকুর আলী তখনো গড়িমসি করছে। যেতে চাচ্ছে না সেতু এলাকায়। এমন সময় জাকির স্যার তানজিলদের বাড়িতে এলেন।

                -চাচা এখনো রেডি হননি। তাড়াতাড়ি রেডি হন। এখনই বের হতে হবে।

                -না বাবা আমি যেতে চাইতেছি না। আমারে মাপ কইরা দাও।

                -আজ আর মাপ করা যাবে না, চাচা। চলেন।

জাকির স্যার তানজিল ও তার বাবাকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন জাজিরা পয়েন্টের দিকে। তাদের সঙ্গে পথে যোগ দিলেন হেড স্যার। শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় সাজ সাজ রব। নতুন নতুন রাস্তাঘাট। রাস্তার দুপাশে ফুলের বাগান। বড়ো বড়ো গেট তৈরি করা হয়েছে। রং বেরঙের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠানস্থল। পদ্মা সেতুর আদলে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চের সামনে টলটলা পানি। স্টেজ সাজানো হয়েছে রং বেরঙের ফুল দিয়ে। অনুষ্ঠানস্থলের গেট থেকে স্টেজ পর্যন্ত বিছানো হয়েছে লাল গালিচা। স্টেজের সামনের চেয়ারগুলো রঙিন কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাতে ঢোল, বাঁশি। ব্যানার, ফেস্টুন। গায়ে পদ্মা সেতুর ছাপ দেওয়া বিভিন্ন রঙের টি শার্ট। হাতে প্লাকার্ড। প্লাকাডে লেখা- পদ্মা সেতু দৃশ্যমান, শেখ হাসিনার অবদান। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, জনগণের স্বপ্নের উন্মোচন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, দেশবাসীর স্বপ্নপূরণ প্রভৃতি। মুখে গান। নাচ। মিছিল। মিছিলে জয় বাংলা স্লোগান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে, ট্রেনে, নৌকায়, মোটরসাইকেল, অটোরিক্সায় করে তারা এসেছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে। অনেকেই মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে এসেছেন ঐতিহাসিক এই ঘটনার সাক্ষী হতে। আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে। যাঁর অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল আর অদম্য বিশ্বাসে তৈরি হয়েছে এই সেতু তাঁর কথা শুনতে। সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ। পদ্মা সেতু হয়েছে সেই আনন্দ। সেতু দিয়ে পার হবে সেই আনন্দ। উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ে পা দেওয়ার আনন্দ। একটু পরে সেতু খুলে দেওয়া হবে- তখন স্বপ্নের সেই সেতু ছুঁয়ে দেখার আনন্দ। সবমিলিয়ে উৎসব উৎসব পরিবেশ। এসব দেখে শুকুর আলীর পা যেনো আর চলতে চায় না। চোখের পলক পড়তে চায় না। বিস্ময় চোখে তাকিয়ে থাকে। কেবলই তাকিয়ে থাকে। মানুষের আনন্দযাপন দেখতে থাকে। মানুষের উল্লাস দেখতে থাকে। মনে মনে বলল, এ যেনো যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। বড়ো কিছু প্রাপ্তির আনন্দ। কী দেখছিলাম আর কী হইলো। সত্যিই বিশ্বাস হইতাছে না আমার। ছেলে তো ঠিকই কইছিল। আমি শুধু শুধু ছেলেডারে বকছি। সেতুর কথা উডলেই রাগারাগি করছি।

আর ঘণ্টখানেক বাকি। অনুষ্ঠানের মূল প্যান্ডেলে ঢুকতে হবে। ওই প্যান্ডেলের মধ্যে শুধু তারাই ঢুকতে পারছে যাদের হাতে দাওয়াতপত্র রয়েছে। তানজিলের সঙ্গে তার বাবাও ঢুকতে চাইলেন। কিন্তু পুলিশ ঢুকতে দিলো না। ঢুকলো শুধু তানজিল। শুকুর আলী, হাসান স্যার ও জাকির স্যার থেকে গেলেন মূল অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে। তাদের বাইরে রেখে যেতে তানজিলের ভীষণ খারাপ লাগলো। মনে মনে বলল, অন্তত আব্বাকে যদি নিয়ে যেতে পারতাম! প্রধানমন্ত্রীকে সামনা সামনি দেখতে পারতো।

পুলিশের এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে গেল শুকুর আলী। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন পুলিশের দিকে। আবার তাকালেন দুই স্যারের দিকে। হেড স্যার বললেন,
-চাচা এখানে এটাই নিয়ম। আপনার ছেলে ওখানে ঢোকার দাওয়াত পেয়েছে। আমরা কিন্তু পাইনি। কারণ এই সেতু নিয়ে আপনার ছেলে অনেক কিছু করেছে। স্কুলে আমাদের ভিডিও দেখিয়েছে। বক্তৃতা দিয়েছে। থানার টিএনও, ওসি, শিক্ষা অফিসারসহ অনেক বড়ো বড়ো অফিসাররা তানজিলকে চেনে। সবাই তাকে সেতুবালক বলে ডাকে। আমি জানি না আপনি সেটি জানেন কি-না।

শুকুর আলী এই কথার কোনো জবাব দেয় না। কান খাড়া করে মাইকে কী বলছে তা শোনার চেষ্টা করে। 

প্রধানমন্ত্রী স্টেজে ওঠার পরপরই জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। ঘোষক জানালেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সারাদেশে একযোগে রেডিও, টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে। জেলায় জেলায় উৎসব করে উদ্যাপন করা হচ্ছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ঢাকার হাতিরঝিলে আয়োজন করা হয়েছে চোখ ধাঁধানো লেজার শো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমন্ত্রিত অতিথিরা একের পর এক বক্তব্য দিলেন। এবার প্রধান অতিথির পালা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরু করলেন। শোনালেন পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর ইতিহাস। সেতু তৈরি করতে গিয়ে কতো ধরনের বাধা-বিপত্তি এসেছে, দেশ-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে সেসব কথা। এই এলাকার সাধারণ মানুষের ত্যাগ স্বীকারের কথা। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বস্তির যাত্রার কথা। ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের কথা। এই সেতু কীভাবে দেশের অর্থনীতিতে বড়ো ভূমিকা রাখবে। হাজার হাজার মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ এবং গতিশীল হবে। দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হবে। তারা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে সেসব কথা। তিনি বললেন, পদ্মা সেতু সকল ষড়যন্ত্রের জবাব। অপমানের প্রতিশোধ। আমরা আমাদের টাকায় এই সেতু তৈরি করেছি। এই সেতু শুধু সেতু নয়। শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের কাঠামো নয়। এই সেতু আমাদের অহংকার। আমাদের গর্ব। সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে শুনতে শুকুর আলীর চোখে পানি চলে আসে। মনে মনে বলে, এতোদিন আমি সবাইকে ভুল বুঝেছি। না বুঝে সেতু নিয়ে গালমন্দ করেছি। মুরুখখ্ মানুষের এই এক জ্বালা। ভালো-মন্দের কিছু বুঝতে পারে না।  

প্রধানমন্ত্রী বললেন, এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি। আপনাদের এই এলাকার একটি ছেলের কথা এখন বলব। তাঁর এই কথা শুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই যেনো একটু নড়েচড়ে বসলো। প্রধানমন্ত্রী কী বলেন সেটি শোনার জন্য মুখিয়ে থাকলো। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি এখানে আসার আগে শুনেছি এই এলাকার স্কুলপড়–য়া একটি ছেলে আছে। ছোটোবেলা থেকেই যার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান এই পদ্মা সেতু নিয়ে। এজন্য তাকে নাকি সবাই সেতুবালক বলে ডাকে। আমি তার গল্প শুনেছি। এখন আমি তাকে সামনা সামনি দেখতে চাই। তাকে মঞ্চে আসার জন্য বলছি।

প্রধানমন্ত্রীর এই কথা শুনে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা ভীষণ অবাক হন। সবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছেলেটিকে খুঁজতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে তানজিল হুদার অবস্থা তখন আরও শোচনীয়। যেনো সে নিঃসাড় হয়ে গেছে। চলার শক্তি হারিয়েছে। তারপরও মনে সাহস নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। সবাই বিস্ময় চোখে তাকিয়ে থাকলো ছেলেটির দিকে।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। ৫মকিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। সাত >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *