টোকন ঠাকুরের কবিতা

উত্তরের হাওয়া

কার কথা কীভাবে বলব আমি?

বন থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঝরাপাতা─
কারা তাতে লেখে আর কারাই বা পাঠক-পাঠিকা?
কার কাছে বলা যায়−
উত্তরের হাওয়া আসে গুপ্তচর হয়ে?
সন্ধে থেকেই ওঁৎ পেতে বসে আছে আততায়ী ঘ্রাণ,
চন্দ্রমল্লিকার!
মনে হয়,
ভাবনা স্রপ্রচার কেন্দ্রের আজ রজতজয়ন্তী,
তুমুল ভাবনা কর্মসূচি…
ভাবনাকে দেখতে আসে বুদ্বুদ−
দোস্তে দোস্তে জুয়া খেলে কয়েক সেকেন্ড;
এরই মধ্যে ঝাঁপ দেয় গনগনে কবিতা খসড়া,
এর মধ্যেই উঁকি দিয়ে যায় এক স্বর্ণমৃগয়া,
নড়ে ওঠে ঝোপঝাড়, যেহেতু সতর্ক…
পদবুলি বাইপাস করে ছুটতে থাকি
ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে
বনবনানির নির্জনতায় যেখানে এলাম−
ওহ্ কি দুরবস্থা,
নিজেই রচনা করেছি সুনিপুণ আত্মঘাতী ব্যাকরণ−
আমি এই জঙ্গলের গাছে গাছে ফেরার
কোনো চিহ্ন এঁকে রেখে আসিনি,
কীভাবে ফিরব? আমি কি আজ অরণ্যমন্ত্রী? না,
আমি এই বনবাস উদ্যাপন করছি না।
হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রায় এই মর্মর
কম্পোজিশন আমার ভালো লাগছে না।
আমি জানি,
এক দিগ্বালিকা বড় হচ্ছে ঘরের মধ্যে,
রাতে; বাইরে বসন্তপূর্ণিমা,
বাইরে অঙ্গার বৈরাগীর গান−
পাতা-টাতা নাই বনে, ভালোবাসি তোমারে,
হরিণেরা কি জানে,
ভালোবাসি তোমারে? ঘরের মধ্যে বড় হচ্ছে বালিকা,
বালিকারা বড় হচ্ছে কার জন্যে−
এই প্রশ্ন কোনো প্রশ্নই হয়ে উঠতো না,
যদি, আমাদের কবিতার চেয়ে করে আসা লোকচার,
ধর্মাচার, তদীয় গ্রন্থাচার বড় না হতো!
আমি জানি এক দিগ্বালিকা বড় হচ্ছে ঘোরের মধ্যে,
ঘরের মধ্যে, জনপদে।
সে বালিকা জানে তার ভালোবাসা সেই ডালিম,
ধীরে ধীরে বড় হয়, লুব্ধক প্রেমিকের হাতে পড়লেই
পাকা ডালিমটা ফেটে যায়,
পাকা ডালিম ফাটা ডালিম ভেতরটা দেখিয়ে দেয়…
আমি সেই ফলের রসময়ী দানাগুচ্ছ থেকে বহুদূরে
এক স্বর্ণমৃগয়ার খপ্পরে পড়ে এই বনভূমির মধ্যে−
আজ আর এই গ্রিন অভিবাস পছন্দ করছি না।
যদিও কোকিল ডাকছে,
এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে,
স্বাভাবিকতার পতন ঘটছে।
এ সময় কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে,
এ সময় উত্তরের হাওয়া আসে গুপ্তচর হয়ে,
দক্ষিণের বারান্দায় ওঁৎ পেতে বসে থাকে
আততায়ী ঘ্রাণ, চন্দ্রমল্লিকার।
মনে হয়, শিহরণ শব্দের অর্থ বুঝতেই
দিগ্বালিকা আজ আর স্কুলে যাবে না,
কিন্তু স্কুলে যাবার নাম করে সে
ঠিকই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বে…

শিহরণ, তোর কথা কীভাবে লিখব আমি?

২।

ভাষা-সমস্যা

ভাষার সমস্যা আছে। সব কথা সে প্রকাশে সমর্থ নয়।
যতই পণ্ডিতি করি, সান্ধ্যসুর ধরি, ঠিক যেন হলো না−
আমার কি বলার ছিল?
কী বলার মধ্যে আমি কী ভাব বোঝাতে চেয়েও,
শেষ পর্যন্ত বাক্য যেন বাগে আসল না,
বরং বিরাট বিট্রে করে বসল।
কুয়োর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া চৈত্রমাসের মহাজোসনা যেন
আমি আর তুলে আনতে পারলাম না।
আর এদিকে পরিস্থিতি প্রতিদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে
ঝুপঝাপ আঁতাত শুরু করে দিল।
এর ফলে, মাথার উপর দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক গুলি উড়ে গেল।
কারণ, এই কালপর্বের নাম যুদ্ধক্ষেত্র।
আমাকে ক্রলিং করে,
মাটিতে বুক বাঁধিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
মাঝেমধ্যে ভ্রম হচ্ছে,
তবে কি আমার বুকপকেটে সেরকম কোনো চিঠি আছে−
যার প্রেরক এই শহরেই থাকে, প্রহেলিকা চৌধুরী?

কিন্তু ঐ যে বললাম, ভাষার সমস্যা!
ভাষায় আমি জোসনা দেখাতে পারছি না,
সূর্যাস্ত দেখাতে পারছি না, যুদ্ধ দেখাতে পারছি না,
রক্ত কতটা লাল দেখাতে পারছি না,
বাতাসের বেআদপ আচরণ দেখাতে পারছি না!
এমনকি আমার মন কতখানি অবাধ্য এখন যে,
সে আমার ঘরেই থাকে না,
প্রত্যেকদিন একই রাস্তায় একই দিকেউধুর−
মনোগমনের এ বর্ণনা লিখে বোঝানো অসম্ভব!
অ্যাবসার্ড!!
কারণ, ভাষা শিল্পকে যতটা সমর্থন করে বা
শিল্পীকেও উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করতে পারে
কিন্তু শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে যেটুকু প্রচ্ছন্ন দূরত্ব,
যতোটা লৌহবেদনা−
ভাষা তা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।

কতটা নির্মম, দুর্ভাগ্যপীড়িত, যদি বলো,
এই ভাষাতেই আমাকে লিখে জানাতে হবে
সেই প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প,
লৌহবেদনার ইতিকথা?
মন-আনমনা, বাক্য যেন ভাব বুঝল না,
বাক্য বিরাট বিট্রে করে বসল।
অথচ,
কুয়োর মধ্যে চৈত্রমাসের মহাজোসনা গড়াগড়ি যায়..

৩।.

ভিক্ষাবৃত্তির কবিতা

ফিরিয়ে দেবার আগে,
একবার ভিক্ষুকের চোখ দেখবে না?

একবার সত্যি সত্যি জানবে না,
ভিক্ষার আড়ালে ভিক্ষুক আসলে কি চায়?
গোত্রের মানুষকে কখনো ভিক্ষুকের বন্ধু হতে দেখিনি।
ডাইনিং টেবিলে,
তোমার মুখোমুখি কোনোদিন কোনো ভিক্ষুককে বসিয়েছ?
এমন কি ফুটপাতের চায়ের দোকানে স্বচ্ছন্দে তোমার পাশে
কোনোদিন বসেছে ভিক্ষুক? তুমি বসেছ, তার পাশে?

প্রত্যেকটি ভিক্ষুকের চোখের মধ্যে লেখা আছে
ভিক্ষাবৃত্তির যথাযুক্ত কারণ: অবশ্যই বঞ্চিত-লাঞ্ছিত,
অপমানিত ইতিহাস এবং একথাও সত্য যে,
ডোর-টু-ডোর প্রত্যাখ্যাত হতে হতে ভিক্ষুক
একদিন বুঝতে পারে−
প্রত্যাখানই তার স্বাভাবিক পাওনা।
তবু তাকে ভিক্ষা করতে হয়,
কারণ সে তো ফিরে পেতে চায়।
হারানোকে ফিরে চাওয়া,
ফিরে পাওয়া হারানো মাত্রই অধিকার হয়ে পড়ে।
এই চাওয়া-পাওয়ার নামই ভিক্ষাবৃত্তি।
হতে পারে এর কোনো অন্য নাম ভালোবাসা

নদীভাঙা মানুষেরা আসে।
নদীতে বিলীন বাড়িঘর-জমি-গরু-স্ত্রী-বাচ্চার
সন্ধানে তারা শহরে চলে আসে।
নদীহীন মানুষও কি নদীভিক্ষা চায়নি কখনো,
মেঘের দিকে তাকিয়ে?
একজন মুক্তিযোদ্ধার মা চিরকাল ভিক্ষা চান
তার হারানো ছেলেকে।

ফলে, সেই মাকেও আজ ভিক্ষুক বলতে হবে তোমাকে।
অ সবসময় ভিক্ষা চাচ্ছে শ এর মন।
ফাঁসির আসামী ভিক্ষা চাচ্ছে জীবন।
দেখলাম তো,
প্রেমভিক্ষা চেয়ে কত মোমিন স্রেফ মজনু হয়ে গেল!
ভিক্ষুকদের বাড়িয়ে দেওয়া সকাতর হাত
ট্রেনে বাসে দোকানের সামনে,
গোপনে-প্রকাশ্যে কে না দেখেছে,
বাংলা-বিহার উড়িষ্যায়, বলো?

প্রসঙ্গত, ভিক্ষা দাও বা না দাও,
তোমাকে বলি, আমিও একটা ভিক্ষুক।
একদিন তোমার খুব কাছাকাছি চোখ রেখে,
তোমার বুকের ওপর আমার বুকটি রেখে,
তোমার নিঃশ্বাসের ওঠানামার ফাঁকে তাকিয়ে দেখেছি−
আমার হারানো কবিতাগুলো আছে
এবং তাদের ফিরে পাওয়া সম্ভব।
দেখেছি চোখের মধ্যে, তোমার বুকের মধ্যে,
নিঃশ্বাসের মধ্যে আমার হারানো কবিতাগুলো
ভাঁজ করা আছে, অপ্রকাশিত, পাঠকবঞ্চিত।

‘পান্ডুলিপি গুছিয়ে দিচ্ছি’_
প্রকাশককে দেওয়া আমার এই কথার কি হবে?
হারানো কবিতা আমি কিভাবে ফিরে পাব?

৪।
জঙ্গলের মধ্যে জাদুঘর



জঙ্গল দেখলেই মনে হয়,
ঐ জঙ্গলের একদম ভেতরে একটা জাদুঘর আছে।
অসংখ্য গাছে গাছে ভরা অবিরাম পাতায় পাতায়
হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রা আর অগণন পাখিতে পাখিতে
নরম পালকে পালকে ডিসপ্লে করা গ্রিনমিউজিয়াম।
এই পৃথিবীতে যতগুলো জঙ্গল আছে,
প্রায় প্রত্যেকটা জঙ্গলের মধ্যেই একটা করে জাদুঘর আছে

জাদুঘরে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে
মরচেধরা অনেকদিন আগের একটা বাইসাইকেল।
সেই সাইকেলটা কার গো, কার?
যথা অপরিণামদর্শী কৌতূহলে,
জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া যে বালক আর
কোনওদিনও ফিরে আসিল না, তার?
জংলিপনায় স্নাতকোত্তর আমি,
জঙ্গল দেখলেই বুঝতে পারি−
এই জঙ্গলের ভেতরে একটা জাদুঘর আছে।
বাইসাইকেল আছে।
বালক-পুরুষ ফিরতে না-পারার জনশ্রুতি আছে।

জনশ্রুতির অধিক রহস্য, সেটাই ধরিত্রী,
সেটাই অবলীলা চৌধুরীর লাবণ্য;
লাবণ্যের ভেতরে মিশিমিশি আফ্রিকা,
ঘনান্ধকার আমাজান− সাহস করে একবার ঢুকে পড়লেই
জাদুঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবার প্রেরণা পাওয়া যাবে।
ক্লান্ত সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে
এবং সম্ভবত আমার আর কোনওদিনও ফিরে আসা হবে না…
হবে না

এ অঞ্চলে এটাই সত্য,
জঙ্গলে হারানো পুরুষ শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে যায়

বসন্তদিন

রহস্যপুর গল্পটা পড়া শেষ হয়নি

আমি সিরিয়াস পাঠক।
পড়তে পড়তে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা এগিয়ে যাই,
তাকিয়ে দেখি গল্পের মধ্যে সোনার ঢেঁকিঃ
পাড়ের শব্দও শুনি।
ঠিক তক্ষুণি, পর্দাজুড়ে দৃশ্যমান,
হাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে দইঅলা বলে একটা চরিত্র,
আমি তার পিছু পিছু এগিয়ে যাই কয়েক পৃষ্ঠা,
হঠাৎ সামনে পড়ে পোড়ো রাজবাড়ি,
রাজবাড়িটা ভাঙা ভাঙা এবং ভৌতিক…
ভীতিলুব্ধ সিঁড়িতে একটা প্রজাপতি,
আমি প্রজাপতিকে লক্ষ করে উপরে উঠতে থাকি।
প্রত্নকোঠার ছাদের কিনারে গিয়ে বলি, ‘প্রজাপতি,
তোমার আত্মজীবনী আমি মুখস্থ করতে চাই’,
শুনেই ডানাঅলা এই প্রায়পাখিটি উড়ে যায়।
এবার আমিও উড়তে থাকি প্রায়পাখিটির সঙ্গে,
পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা, বাক্যের পর বাক্য, শব্দের পর শব্দ,
প্রয়োজনীয় নৈঃশব্দ…
প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
তুমি কি কোনো বংশীবাদক,
সুরের ফাঁদে ষড়যন্ত্র করছ?
ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ?

রহস্যপুর গল্পের তেইশতম পৃষ্ঠায়
সেই হাইডআউট লোকেশন,
পাঠক যেখানে অসহায়,
দুরু দুরু-সন্ত্রস্ত কিন্তু এগিয়ে যেতে উৎসাহী।
প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে মুখোমুখি এক মায়াবী অধ্যায় :
আলো হয়ে প্রকাশিত নারী।
নারীর সর্বাঙ্গে সদম্ভ আগুন,
অহোরাত্র নারীকে পড়তে গিয়েই আগুনে পুড়তে হয়−
এই নিয়তি নির্ধারিত বলে, মন পুড়ে যায়।
পোড়া মন চিকিৎসাধীন−
নার্সও দেখতে প্রায়নারী, বেতন-ভাতায়।

আমি রহস্যপুর হাসপাতালে শুয়ে আছি,
গল্পের মাঝামাঝি কোনো পৃষ্ঠায়।
খুবই জানি, সুস্থ হলেই আবারও সেই ষড়যন্ত্র,
প্রজাপতির। হয়তো আমারও খুব ইচ্ছে করবে,
তার ডানার খোপের অন্ধকারে রঙ মেখে ঘুমিয়ে থাকি,
জাগি। বোঝাই তো যাচ্ছে,
এরপর গল্পে একটা খুন এসে যাবে।
টিকটিকিরাও জানাচ্ছে, চিরকালই খুনের প্রেরণা নারী।
সিরিয়াস পাঠক আমি, হিটলিস্টে আছি,
সুতরাং খুন হয়ে যাব– এই ভয়ে অসুস্থ থাকি।
হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে (জন্মদোষে)
নার্স ও নারীর আন্তঃপার্থক্যটুকু ধরার চেষ্টা করছি,
পড়ার চেষ্টা করছি… আমার পোড়ামন চিকিৎসাধীন

এদিকে বসন্তদিন…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *