বিশ মনীষীর সাহিত্য সংবেদ: এক উজ্জ্বল উল্কাপিন্ড।। সৈয়দ নূরুল আলম

বিশ মনীষীর সাহিত্য সংবেদ বইটিকে একটি সাম্প্রতিক, বিশদভাবে তথ্যভিত্তি এবং নিয়মনিষ্ঠ গবেষণাধর্মী কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বইটির লেখক বাবুল আনোয়ার। যিনি কবি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। বইটির শিরোনাম থেকেই বুঝা যায় এটা বাংলা সাহিত্যে যাঁরা পুরোধা, যাঁরা স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যকে একটা শক্ত জায়গায় এনে দাড় করিয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে শীর্ষ বিশজনকে এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ছোট করে হলেও তাঁদের জন্মবিত্তান্ত, তাঁদের সাহিত্য জীবন, প্রকাশিত বই, পুরস্কার প্রাপ্তি ইত্যাদি তথ্য তুলে ধরেছেন। ছোট করে বলছি এ জন্য, এই সব মনীষীদের জীবন আলেখ্য লিখতে, এক একজনকে নিয়েই একটা পুরো বই লেখা যায়, তবে বাবুল আনোয়ার দক্ষতার সাথে, সুনিপুন ভাবে চার-পাঁচ পৃষ্ঠার মধ্যে পুরো জীবনের নির্যাস তুলে এনেছেন। যা গবেষক ও কৌতুহলী পাঠকের প্রয়োজন মেটাবে। এই সেলুলয়েডের জগতের মধ্যে আলোকদীপ্ত হয়ে উঠেছে অজস্র মানুষ। নানা রকমের, নানা মনের, নানা মাত্রার। এঁদের মধ্য থেকে বিশজনকে বাছাই করে বইটি পদ্ধতি সম্মত গবেষণা গ্রন্থের মতো করে লেখা হয়েছে। লেখকদের ব্যক্তি জীবনের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করে, সাহিত্য বিষয়ক মূল আলোচনায় প্রবেশ করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্ষেত্রে, সহজ ভাষায়, পান্ডিত্যের মিথ্যা ঝাঁকুনি না দিয়ে। এঁরা হলেন, আবুল ফজল, আহসান হাবীব, মহাশ্বেতা দেরী, আহমদ রফিক, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, হাসান আজিজুল হক, রশীদ হায়দার, রফিক আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, সেলিনা হোসেন, আবুল হাসান, বুলবুল চৌধুরী, হুমায়ুন আহমেদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহম্মদ নূরুল হুদা ও দিলারা মেসবা। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এঁদের বাইরে, সমমর্যাদার অন্য কোনো লেখক নেই? সে বিষয়ে প্রবন্ধকার কোনো তথ্য দেননি, তবে তালিকা দেখে পাঠক নিশ্চয় সন্তুষ্ট হবেন।

আবুল ফজলের কথা বলতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘মানুষের জীবনাচারে ধর্মের কল্যাণকর দিকগুলো মেনে চলার পথে কোনো বাধা তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। তার দৃষ্টিতে মানুষই ছিল সবার উপরে। আর মানবকল্যাণের জন্য অনুকূল কর্মকান্ড, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলই ছিল তার সারাজীবনের আরাধ্য বিষয়।’

এভাবে সহজ, সরল শব্দের বিন্যাস, একজন লেখকের জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় মেলে, যেটা বাবুল আনোয়ার সহজে আয়ত্ত করেছেন। একারণে গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলো পড়তে বিরক্ত লাগে না, বরং চমৎকার গল্পের স্বাদ পাওয়া যায়। তথ্য, মন্তব্য, উদ্ধৃতি, এর বিপুল সমাহার পাঠককে ভারাক্রান্ত করে না। কারণ এর মাঝেই ঝলক দিয়ে ওঠে অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণ, লেখকের এই নিভৃত কণ্ঠ ইতিহাসের সাথে মিলে গিয়ে অন্য আরেকটি আবহাওয়ার সৃষ্টি করে, যেখানে ব্যক্তির বৃত্ত আর সমাজের বৃত্ত পরস্পর নির্ভর হয়ে অভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি হয় দায়বদ্ধ।

এ বইটির আরেকটি ভালোলাগার দিক হচ্ছে, প্রতি লেখককে শ্রেনিবিন্যাসিত করেছেন আলাদ একটি শিরোনাম দিয়ে, যেমন, সৈয়দ শামসুল হক- কবিতার বিস্তারে পরানের ভিতরে, রফিক আজাদ- সশস্ত্র সুন্দরের কবি, আহসান হাবীব- অন্তর্লীন সৌন্দর্য ও শিল্পের কবি, নির্মলেন্দু গুণ- তিমির হননের কবি, হুমায়ূন আহমেদ- জোছনায় ফেরা নন্দিত মুখ। এভাবে প্রত্যেক লেখককে আলাদা ভাবে বিশেষায়িত করেছেন, যা নতুনত্বতো বটেই, পাঠকের কাছে আলাদা একটা ভালোলাগা তৈরি হবে। হুমায়ুন আহমেদকে মূল্যায়ন করতে যেয়ে প্রবন্ধকার বলেছেন, ‘চরিত্র সৃষ্টিতে তার দক্ষতা ও চমৎকারিত্ব পাঠককে সহজে মুগ্ধ করে। তাই তার সৃষ্টি পাঠকের হ্রদয় সরব অনুভূতিতে সব সময় বিচরণ করে। আমাদের জীবন ও সংসার ঘিরে চেনাজানা মানুষগুলোই তার কথাসাহিত্যের চরিত্র।’ লেখক এভাবে গ্রন্থভূক্ত কুড়িজন লেখককেই তাত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন, অর্থাৎ তত্ত্বের ‘কচকচি’ কিছুটা উহ্য রেখেই এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো অনেক বেশি তথ্যমূলক ও গবেষণানিষ্ঠ।আরও একটি বিচারে বইটি ব্যতিক্রমী। কাউকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বর্তমান পন্ডিতিচর্চার যে ঝোঁক দেখা যায় এবং যে চর্চায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সংস্কারচিন্তা ও তথাকথিত পুনর্নির্মান বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে থাকে, এই বইটি কিন্তু বিষয়টিকে অগ্রাহ্য না করলেও অতিরিক্ত প্রাধান্য দেয়নি। সাহিত্য সংশ্লিষ্ট একই গুরুত্বে সহকারে আলোচিত হয়েছেন কুড়িজন লেখক। সময়ক্রমে অনুসারে এই বইয়ের প্রবন্ধগুলি কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস তৈরি করে না, প্রত্যেক লেখকের বিশেষ কয়েকটি দিকই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অনেক পরিচিত বিষয় বাদ পড়লেও, একজন ব্যক্তি লেখককে চেনার-জানার জন্য যথেষ্ট তথ্য রয়েছে।

বইটি ২০২২ বইমেলায় প্রকাশ করেছে দেশ পাবলিকেশন্স । প্রচ্ছদ করেছেন মিনতি রায়।

অভিনন্দন প্রিয় লেখক বাবুল আনোয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *