কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। ৫ম

পাঁচ:

স্কুলের চারপাশ খুব সুন্দর করে পরিষ্কার করা হয়েছে। মূল গেটে, দরজার ওপরে, মঞ্চের পিছনের দেওয়ালে ব্যাকড্রপ, রঙিন কাগজ ও বেলুন দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। সবমিলিয়ে চারদিকে সাজসাজ রব। আজ তানজিলদের যশলদিয়া পদ্মা সেতু স্কুলের দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একটু পরে অনুষ্ঠান শুরু হবে। স্যারেরা এখন ভীষণ ব্যস্ত। বিশেষ করে হেড স্যার ও জাকির স্যার। কারণ অনুষ্ঠানটি স্কুলের ফেইসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হবে। জাকির স্যার দুই তিনদিন আগেই তানজিলের প্রেজেন্টেশনটা দেখেছেন। যেসব জায়গায় সমস্যা ছিল ঠিক করে দিয়েছেন। ওই দিন অতিথিদের সঙ্গে কী বলবে সেগুলো দেখে দিয়েছেন। হেড স্যার কান থেকে ফোন সরিয়ে জানালেন, একটু পরেই প্রধান অতিথি চলে আসবেন। বিশেষ অতিথি খুব কাছাকাছি আছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের হট্টোগোল না করে চুপচাপ সিটে বসে থাকার নির্দেশ দিলেন।

স্কুলের উদ্বোধনী সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হলো। প্রধান শিক্ষক হাসান স্যার স্কুল, স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য দিলেন। ছাত্রছাত্রীরা আবৃত্তি, গান করলো। হেড স্যার হাতে মাইক্রোফোন নিলেন। বললেন,

    -মাননীয় প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিসহ এখানে উপস্থিত সবাই জানেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। পদ্মা নদীর উপর তৈরি হচ্ছে সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে     উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটেছে। এতে দক্ষিণবঙ্গের একুশটি জেলার মানুষ বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ। এবং নিচের স্তরে থাকবে একটি রেলপথ। থাকবে গ্যাসের লাইন। বিদ্যুতের লাইন ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এই সেতু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের টাকায় নির্মাণ করেছেন এই সেতু। পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে। অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয়েছে। আমাদের স্কুল পদ্মা সেতু নির্মাণ এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় নানান ধরনের ঘটনা এবং রটনা কানে আসে। কিছু দিন আগে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের কাটা মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়। আমি বিষয়টি উপলব্ধি করে আমাদের স্কুলে সচেতনতামূলক একটি প্রোগ্রাম করি। সবাইকে সচেতন থাকার কথা বলি। আজ আমাদের স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র  তানজিল হুদা পদ্মা সেতুর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছে। এখন সেটি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হবে। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন আমাদের কম্পিউটার শিক্ষক জাকির সাহেব।

তানজিল উপস্থিত সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে তার প্রেজেন্টেশন শুরু করলো। বললো,

    -আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ হতে দেখেছি। আমাদের বাড়ি সেতু নির্মাণ এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় রাতভর হ্যামার, ক্রেন, বড়ো বড়ো কার্গো, জাহাজ প্রভৃতি জিনিসের শব্দ পেতাম। চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পর আমি প্রায়ই সেতু এলাকায় যেতাম। নির্মাণ শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলতাম। তখন থেকেই আমার মধ্যে এই সেতু সম্পর্কে জানার ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। আমার কেবলই মনে হতো- আমি যদি ইঞ্জিনিয়ার হতাম! এই সেতু নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পরতাম! যাইহোক ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে স্কুলে প্রথম কম্পিউটার পাই। জাকির স্যার আমাকে কম্পিউটারের অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রথমেই আমি স্বপ্নের এই সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের কাটা মাথা লাগবে- ইন্টানেটের মাধ্যমে যে গুজব ছড়ানো হয়েছিল সে বিষয়টি দেখাতে চাই। আমি প্রমাণ করে দিব যে, ফটোশপে এডিট করে মানুষের মাথাগুলো পানিতে ভাসানো হয়েছে। আমি পদ্মা সেতু নির্মাণ বিষয়ে সকল তথ্য নিয়েছি ইন্টারনেট এবং পত্রপত্রিকা থেকে। এজন্য আমি তাঁদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি যাঁরা পদ্মা সেতুর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ছবি তুলেছেন। ভিডিও করেছেন। আমি শুধু ধারাবাহিকভাবে এই সেতু কীভাবে তৈরি হলো সে বিষয়গুলো একের পর এক সাজিয়েছি। বোঝাতে চেয়েছি খরস্রোতা পদ্মার বুকে এই সেতু তৈরি সরকার, ইঞ্জিনিয়ার, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য কতোটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তানজিল ভিডিওচিত্র দেখাতে দেখাতে কথা বলতে থাকে।       

   স্যার, আপনারা কি জানেন পদ্মা নদীর গভীরতা কত? পানির প্রায় চল্লিশ মিটার মানে প্রায় ১৩১ ফিট গভীর এই নদীর তলদেশ। মাটি থেকে এই স্কুলের উচ্চতা দশ ফিট। সেই হিসেবে পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে পানির উপরের স্তর পর্যন্ত উচ্চতা ১৩ তলা বিল্ডিঙের সমান। তাহলে ব্রিজের কলামগুলো কমপক্ষে ১৩ তলা বিল্ডিঙের সমান হতে হবে। কিন্তু কলাম   যদি মাটিতে গাঁথা না থাকে তাহলে তো কলাম স্রোতে ভেসে যাবে তাই না? এজন্য কলামগুলো মাটিতে গেঁথে দিতে হবে।   তা কতটুকু গাঁথতে হবে? পদ্মার তলদেশের মাটি নরম কাদা, বালি টাইপের।

    বর্ষার সময়ে যখন অতিরিক্ত স্রোত থাকে তখন পদ্মার তলদেশের মাটি ধুয়ে চলে যায়। এটাকে বলে স্কাওয়ার হওয়া। পদ্মা নদীর স্কাওয়ার হওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড প্রায় ৬৫ মিটার বা ২১৩ ফিট। মানে ২১ তলা বিল্ডিঙের সমান উচ্চতার মাটি বিভিন্ন   সময়ে ধুয়ে চলে গেছে। এমন অবস্থায় পানির নিচে মাটি পেতে হলে ১৩+২১=৩৪ তলা নিচে নামতে হবে! তাহলে ব্রিজের যে কলামগুলো দিতে হবে, সেগুলোকে ৪০+৬৫=১০৫ মিটারের বেশি লম্বা হতে হবে! অর্থাৎ ৩৪ তলা বিল্ডিঙের চেয়ে লম্বা কলাম!

    আমরা জানি পুকুর কিংবা নদীর সব স্থানের গভীরতা এক রকম নয়। কোনো জায়গায় গভীরতা বেশি। আবার কোনো জায়গায় কম। এজন্য এই ব্রিজে গড়ে ১২০ মিটার পাইল দেওয়া হয়েছে। ১২০ মিটার মানে প্রায় ৪০ তলা বিল্ডিং। একেকটি পাইল বসানো হয়েছে ৪০ তলা বিল্ডিঙের সমান লম্বা। এটা গেল পাইলের গভীরতা। এবার দেখা যাক পাইলগুলোর সাইজ বা আকার কেমন। পাইলগুলো গোল। একেকটি ৪০ তলা বিল্ডিঙের সমান লম্বা সিলিন্ডার। সিলিন্ডারের ব্যাস ৩ মিটার। মানে এই রুমের ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত। পাইলগুলো বানানো হয় স্টিলের পাত দিয়ে। বেশ পুরু এই পাতগুলোকে মুড়িয়ে সিলিন্ডার বানানো হয়।

    সিলিন্ডারগুলো জ্যামিতিক হারে অ্যাটাচ বা আটকানো হয়। মানে এক মিটার লম্বা সিলিন্ডারের সঙ্গে এক মিটার লম্বা আরেকটি পার্ট। এবার এই দুই মিটার লম্বা সিলিন্ডারটির সঙ্গে আর এক একটা দুই মিটার লম্বা সিলিন্ডার যোগ করা হয়। এভাবে ২০ তলা বিল্ডিঙের সমান লম্বা একটির সঙ্গে আরেকটি ২০ তলা বিল্ডিঙের সমান লম্বা পাইল জোড়া দিয়ে বানানো হয় একটি পাইল! বিশাল বিশাল এই পাইলগুলো কি কোনো সুপারম্যান পানির মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে? না, পাইলগুলোর জন্য জার্মানি থেকে আনা হয়েছে স্পেশাল হ্যামার বা হাতুড়ি। আনা হয়েছে স্পেশাল ক্রেন। পাইলগুলোর ভিতর ফাঁপা। মাটিতে বসানোর পর এগুলোর মাঝে বালি দিয়ে ভরাট করা হয়। এই পাইলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে পদ্মা ব্রিজের কলাম।   যাকে আমরা বলি পিয়ার। যদি কোনো কারণে পাইলের নিচের মাটি সরে যায়? এ জন্য প্রতি কলামের নিচে ৬টি করে পাইল আছে। মাকড়শার যেমন ৮টি পা ৮ দিকে থাকে। এই কলামের পাইলগুলো তেমনি ৬ দিকে ছড়ানো।

    পাইলগুলো কিন্তু খাড়াভাবে মাটিতে বসানো হয় না। বাঁকা করে অর্থাৎ ইনক্লাইন্ডভাবে বসানো হয়। ১২০ মিটার লম্বা পাইল বাঁকা করে ঢোকালে মাটির নিচে এদের ৬টি পা ৬ দিকে অনেক দূরে থাকবে। এই ৬ দিকের মাটি তো আর    একসঙ্গে ধুয়ে যাবে না। দুই পা একসঙ্গে লাগিয়ে যতটা সহজে দাঁড়ানো যায়, দুইপা দুই দিকে দিয়ে দাঁড়াতে বেশি সুবিধা হয়। লোড সহ্য করা যায় বেশি। এজন্য ৬টি পাইল বাঁকা থাকার কারণে পিয়ার লোড নেবে বেশি।

     আবার শুধু বাঁকা হওয়ার কারণেই ১২০ মিটার দৈর্ঘ্যরে পাইল মাটির নিচে যাবে ১১৮.৩ মিটার। কারণ যখন কোনো লাঠি বাঁকিয়ে  ফেলি, তখন তার দৈর্ঘ্য একই থাকলেও তার উচ্চতা কমে যায়। যেমন মই যদি খাঁড়া দেওয়ালে লাগিয়ে রাখি তাহলে যত উঁচুতে মইয়ের মাথা থাকবে- মই হেলিয়ে দিলে মইয়ের মাথা আরও নিচে নেমে যাবে। পাইলের ব্যাপারটাও তেমন। ইঞ্জিনিয়াররা গবেষণা করে দেখেছেন ৬টি ইনক্লাইন্ড স্টিল পাইলের ফাউন্ডেশন বেশি কার্যকর। এই ৬টি পাইলের মাথায় থাকে পাইল ক্যাপ। একেকটি পাইল ক্যাপ ৯০০ স্কয়ার ফিটের চেয়ে বড়ো। এই পাইল ক্যাপ পুরোটাই পাথরের। ব্যাপারটি আপনারা একবার ভাবুন।

    দুইটি পিয়ারের নিচের পাইল একটু অন্য রকম। যেগুলো ঢুকে গিয়েছে ৮০ মিটার গভীরে। মানে এই পাইলগুলো বাঁকা না। সোজা পানির নিচে। এগুলো কংক্রিটের পাইল। আমাদের বাসাবাড়ির সাধারণ কলামের মতো। সবচেয়ে মজার বিষয়  হলো- এই পাইলগুলো পানিতে কাস্ট করা হয়! মানে পানির মাঝে কংক্রিট ঢেলে দেওয়া হয়। কিন্তু কংক্রিট ভেসে না গিয়ে কলাম হয়ে যায়। এই ধরনের পাইলের ক্ষেত্রে একটা পিয়ারের নিচে সর্বমোট ১২টি পাইল দেওয়া হয়। এই পাইল ক্যাপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে পিয়ার বা ব্রিজের কলাম। ৪২টি পিয়ারের পুরোটাই কংক্রিটের তৈরি। এই পিয়ারের মাথায়   বসে স্প্যান। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। পদ্মা সেতুতে ৪২টি পিয়ারের ওপর বসেছে ৪১টি স্প্যান। তাহলে সব স্প্যান মিলে হয় ৬,১৫০ মিটার। অর্থাৎ সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। আর প্রস্থ ১৮.১০ মিটার বা ৫৯.৪ ফুট। আর দুইপাশের সংযোগ সড়ক মিলিয়ে প্রায় দশ কিলোমিটার লম্বা এই সেতু।

    আপনারা জানেন বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। তবে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়। বন্যা হয়। এজন্য বর্ষাকালে নদীতে প্রচুর স্রোত হয়। পদ্মাও তার ব্যতিক্রম নয়। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান নদীর পরে পৃথিবীর সবচেয়ে খরস্রোতা নদী পদ্মা। প্রবল স্রোতে এর তলদেশে ‘স্কাউর’ বা ঘর্ষণজনিত তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তার ওপরে আছে অতি মাত্রার ঘূর্ণি ও মৌসুমি বায়ুচাপ। সব সিজেনে এই সেতুর নিচ দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধা রাখা হয়েছে। এজন্য সেতুটির দুটি    পিলারের মধ্যখানে স্প্যানের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এবং পানির উপরিভাগ থেকে সেতুর তলা পর্যন্ত ‘ক্লিয়ারেন্স’ রাখতে হয়েছে ১৮ মিটার।

   তিনটি মডেলের একস্ট্রা ডোজ কংক্রিট ট্রাস, কংক্রিট গার্ডার ও স্টিল ট্রাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পদ্মাসেতু। এর মধ্য দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন, হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎলাইন ও টেলিসংযোগের তার পরিবহন করার সুবিধা রাখা হয়েছে। সেতু কাঠামোর সার্বিক ওজন কম রাখতে সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে মিহি দানার বিশেষ সিমেন্ট এবং অতি উচ্চ ক্ষমতার স্টিল। সেতুটির লাইফ টাইম ১০০ বছর হলেও সম্পূর্ণ মডুলার স্ট্রাকচারে তৈরি হওয়ায় যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করে এ সেতু আরও কয়েক গুণ বেশি সময় ব্যবহার করা যাবে।

   এই সেতু প্রায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পও সহজে মোকাবিলা করতে পারবে। পিলারের মাথা ও ট্রাসের মাঝখানে স্থাপন করতে  হয়েছে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টিকারী ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজন বহনে সক্ষম পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এই প্রযুক্তির নাম সাইজমিক আইসোলেশন। পদ্মা সেতুর নির্মাণে নদীশাসন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দুরন্ত পদ্মাকে বশ মানাতে এর তলদেশে ফেলা হয়েছে ১ টন পর্যন্ত ওজনের ৩৮ লাখ টন পাথর। চৌদ্দ কিলোমিটার পাড় রক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টন কংক্রিট ব্লক এবং ২ কোটি জিও ব্যাগ। তবে সব ক্ষেত্রেই ইলিশ মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে দিকেও বিশেষ নজর রাখা হয়েছে।

    সার্বিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। স্বীকৃতি লাভ করেছে প্রকৌশল অত্যাশ্চর্য স্থাপনা হিসেবে। শুধু তাই নয়। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, এই সেতুতে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকৌশল প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হওয়ায় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে পদ্মা সেতুর নাম স্থান করে নিয়েছে। এজন্য বলা  হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পর পদ্মা সেতু আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এভাবে ধাপে ধাপে তৈরি হয়েছে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

এমন সময় জাকির স্যার বললেন,

  -তানজিল তুমি পদ্মা সেতুর টুকিটাকি বিষয়ের স্লাডটি দেখাতে ভুলে গেছ। বিশেষ করে কবে থেকে মূল সেতুর কাজ শুরু হলো। বাজেট কতো ছিল। কোন প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করছে। এর ডিজাইনারকে এ বিষয়গুলি।

   -দুঃখিত স্যার ক্ষমা করবেন। এখন পদ্মা সেতুর টুকিটাকি বিষয়ের স্লাইডটি দেখাব। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। বাদ যাওয়া বিষয়টি দেখানোর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য জাকির স্যারকে ধন্যবাদ।

    আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত হয় ২০১২ সালের ৯ জুলাই। সেতুর মূল কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। প্রথম স্প্যান বসে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। শেষ স্প্যান বসে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর সর্বশেষ এই স্প্যানটি বসানোর পর ওইদিন সম্পূর্ণ সেতুর কাঠামো মানুষের সামনে দৃশ্যমান হয়। এই সেতু তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সেতুটি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। সেতুটির মূল ডিজাইনার ব্রিটিশ নাগরিক ড. রবিন শ্যাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশ-বিদেশের আরও বারো জন বরেণ্য প্রকৌশলী। এই সেতু নির্মাণ কাজে প্রায় সাতশ প্রকৌশলী এবং প্রায় চৌদ্দ হাজার শ্রমিক সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দৈর্ঘ্যরে এবং একমাত্র দুইতলা সেতু। যার নিচতলা দিয়ে চলবে ট্রেন। উপর দিয়ে চলবে গাড়ি। শুধু তাই নয়। পদ্মা সেতুর   ঝুলিতে জমা হয়েছে পাঁচ পাঁচটি বিশ্ব রেকর্ড। এতেই আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি এই সেতু মোটেও সহজে তৈরি করা যায়নি। যাইহোক, এখন জেনে নেই কী কী বিষয়ে বিশ্ব রেকর্ড করলো এই সেতু। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম ১২৭ মিটার পাইল, রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পরোধক পেন্ডুলাম বিয়ারিঙের ব্যবহার, ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন, সবচেয়ে বড়ো ক্রেনের ব্যবহার এবং কংক্রিট ও স্টিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই সেতু। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে, হাজার হাজার মানুষের শ্রম আর ঘামে তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু। কোনো ধরনের গুজবে কিন্তু সেতুর কাজ বন্ধ হয়নি। এমন কি মহামারি করোনার সময়ও পদ্মা সেতুর কাজ চলেছে। তাই আমরা বলতে পারি-

                সত্য-মিথ্যা যাচাই আগে

               ইন্টারনেটে শেয়ার পরে

                সত্য-মিথ্যা যাচাই করি

                গুজব থেকে দূরে থাকি।

  আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু সম্পর্কে কিছু কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমাদের হেড স্যার এবং জাকির স্যারকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এতোক্ষণ সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তানজিলের কথা শুনছিল। ভিডিওচিত্র দেখছিল। প্রোজেস্টরে একের পর এক স্লাইড দেখছিল। তানজিলের কথা শুনতে শুনতে সবাই যেনো হাততালি দিতেও ভুলে গেছে। হঠাৎ হাতে তালি দিতে দিতে মঞ্চের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন টিএনও সাহেব। তাঁর দেখাদেখি থানা শিক্ষা অফিসার এবং অন্যান্যরাও দাঁড়িয়ে করতালি দিতে শুরু করলো। টিএনও সাহেব তাঁর বক্তব্যে বললেন,

   -পদ্মা সেতু নিয়ে তানজিলের প্রেজেন্টেশন এবং বক্তব্য শুনে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। অবাক হয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে তানজিল বিস্ময়কর এক সেতুবালক। কারণ তার ধ্যান-জ্ঞান সব আমাদের এই সেতু নিয়ে। সেতু সম্পর্কে এই ছেলেটির জানার আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি। এবং স্কুলের শিক্ষকদের জানিয়ে রাখছি    তানজিলের লেখাপড়ার বিষয়ে যে কোনো সাহায্য সহযোগিতা আমি প্রশাসনের পক্ষ থেকে করবো। ওকে যেনো আরও ভালোভাবে গাইড করা হয়। আমার এই মেসেজটি যেনো তানজিলের বাবা-মাকেও জানানো হয়। আমার বিশ্বাস এই ছেলে একদিন দেশের নামকরা মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

সেই থেকে তানজিলের আরেক নাম হয়ে গেল ‘সেতুবালক’। প্রসঙ্গ উঠলে স্কুলের অনেকেই তাকে সেতুবালক বলতো। প্রথম প্রথম কথাটি শুনতে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগতো। লজ্জা লজ্জা লাগতো। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতো না। এখন অবশ্য অনেকটাই সয়ে গেছে। কিন্তু ওই সময় তানজিল জানতো না তার সামনে আরও কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। চারকিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। ছয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *