কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব নয়

নয়

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পেরিয়ে গেছে বেশ কিছু দিন। তানজিলের ওদিকে আর যাওয়া হয়নি। এলাকাটা ভালোভাবে ঘুরে দেখা হয়নি। এজন্য সে একদিন সকালে জাকির স্যারকে নিয়ে বের হলো সেতু এলাকাটি দেখতে। এর আগে যতটুকু দেখেছে গাড়িতে বসে। যতটুকু ঘুরেছে গাড়িতে চেপে। এজন্য তারা আজ একটি অটোরিক্সা নিয়ে বের হয়েছে। কিছুটা পথ তারা অটোতে যেতে পারল। কিছুটা পথ গেল হেঁটে। এভাবেই চলছে সেতু এলাকায় তাদের ঘুরে বেড়ানো। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই যেন সবকিছু বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার আর্থ সামাজিক অবস্থা বদলেছে। মানুষ বদলেছে। মানুষের জীবনযাত্রা বদলেছে। পেশা বদলেছে। এলাকার চেহারা বদলেছে। পদ্মা সেতু বদলে দিয়েছে সবকিছু। এই সেতু যেন জাদুর কাঠি। যার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কতো কিছু যে হয়েছে জাজিরা এলাকায়! দেখছে আর অবাক হচ্ছে তানজিল ও জাকির স্যার। 

তারা ঘুরতে ঘুরতে জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে নামলো। দেখলো সেখানে তৈরি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ম্যুরাল। তার পাশে তৈরি করা হয়েছে ইলিশের ভাস্কর্য ও ফোয়ারা। মানুষ বিস্ময় চোখে সেসব দেখছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। আনন্দ করছে। ছবি তুলছে। পাশেই বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষর সার্ভিস এরিয়া-২। শেখ রাসেল সেনানিবাস। পদ্মা সেতু থেকে শিবচরের পাচ্চর পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। লাগানো হয়েছে বাহারি ফুলের গাছ। এই রাস্তা ধরে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা মোড়ে যেতে সময় লাগছে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। এসব এলাকায় চলাচল করা মানুষের কাছে যা সত্যিই বিস্ময়ের। স্বস্তির এবং আনন্দের।

তানজিল ও জাকির স্যার হাঁটতে হাঁটতে সার্ভিস এরিয়া-২ এ ঢুকে পড়ল। দেখলো সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে- বড়ো অফিস। মসজিদ। মোটেল। মেস। রিসোর্ট। ডুপ্লেক্স বাড়ি। ল্যাবরেটরি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন। ফায়ার ডিটেকশন ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। তারা  সালাম দিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের অফিসের একটি রুমে ঢুকলো। দেখলো এক ভদ্রলোক কম্পিউটারে বসে নীরবে কাজ করছেন। বললেন,

                -বলুন কী চান। আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?

                -আমরা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। বললেন জাকির স্যার।

                -কী বিষয়ে?

                -পদ্মা সেতু বিষয়ে।

                -ও আচ্ছা। একটু বসুন। আমি হাতের কাজ শেষ করে কথা বলছি।

ভদ্রলোকের কণ্ঠটা তানজিলের বেশ চেনা চেনা মনে হলো। মনে হলো ইঞ্জিনিয়ার অজিহার স্যার কথা বলছেন। তাছাড়া পিছন থেকে ফিগার দেখেও অজিহার স্যারের মতো মনে হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের শুরুর দিকে অজিহার স্যারের সঙ্গে তানজিলের অনেক স্মৃতি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়–য়া তানজিলের তখন সেতুর বিভিন্ন বিষয়-আশয় নিয়ে জানার অনেক আগ্রহ। তানজিলের সব প্রশ্নের জবাব দিতেন সাইট ইঞ্জিনিয়ার অজিহার সাহেব। একসময় অজিহার স্যার বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার কারণে আর যোগাযোগ হয়নি। দেখা যাক, তানজিলের আইডিয়া ঠিক আছে কি-না। তারা কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। রুমের মধ্যে এটাসেটা দেখতে থাকলো। হঠাৎ কম্পিউটারের কি-বোর্ড থেকে হাত সরিয়ে পিছনে ফিরলেন তিনি। বললেন,

                -এবার বলুন আমার কাছে কী জন্য এসেছেন?

হ্যাঁ। অজিহার স্যারই তো। তানজিলের ধারণা ঠিক হলো। অজিহার স্যার তানজিলকে ঠিকই চিনতে পারলেন। বললেন,

                -আরে কী সৌভাগ্য আমার। এ কাকে দেখছি। এ তো দেখি সেই বিস্ময়কর সেতুবালক। কী যেনো নাম তোমার? হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে- তানজিল। অনেক বড়ো হয়ে গেছো তুমি। এখন কোন ক্লাসে পড়ছো?

                -এবার এসএসসি পরীক্ষা দিব স্যার।

                -ও আচ্ছা। গুড। খুব ভালো খবর। সেতু উদ্বোধনের দিন অনুষ্ঠান শেষে আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি। আমার খুব ভালো লেগেছে এটা ভেবে যে, আমাদের সেই ছোট্ট তানজিলকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্টেজে ডেকেছেন। তোমাকে নিয়ে কথা বলেছেন। আমি জানতাম তুমি একদিন অনেক বড়ো হবে। কারণ তোমার মধ্যে জানার আগ্রহ আছে। শেখার চেষ্টা আছে। তার ফলও পেতে শুরু করেছো। এখন চেষ্টা করবে সেটি ধরে রাখার। যাইহোক, এবার বলো এখানে কেন এসেছো?

                -স্যার আমরা ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। বাইরে থেকে জায়গাটা দেখে ভালো লাগলো। তাই ঢুকে পড়লাম। আমরা জানতাম না আপনি এখানে আছেন। স্যার পরিচয় করিয়ে দিই। উনি আমাদের স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক জাকির স্যার। ওনার কাছেই আমি কম্পিউটার শিখেছি। তাঁর সহযোগিতায় পদ্মা সেতু নিয়ে স্কুলে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়েছি। 

                -ও আচ্ছা।

দুজন উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। কুশল বিনিময় করলেন।

জাকির স্যার বললেন, আমরা জানতে চাচ্ছিলাম আগামীতে পদ্মা সেতু এলাকায় আমরা আর কী কী দেখতে পাবো? কিংবা কী ধরনের পরিবর্তন আসবে এই এলাকায়?

                -সে অনেক লম্বা ইতিহাস।

                -আপনি সংক্ষেপে বলুন। আমরা শুনছি।

                -ঠিক আছে বলছি। শুনুন তাহলে। আপনারা নিশ্চয় জানেন, সেতুটি চালু হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর এলাকায় ইতোমধ্যেই উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এবংমাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকার প্রায় ১২০ একর জমিতে তৈরি হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁত পল্লি। এই প্রকল্পের পাশেই তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর শরীয়তপুর প্রান্তের রেলস্টেশন। এই স্টেশনের কারণে এখানকার তাঁতিরা কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য সহজে আনা-নেওয়া করতে পারবেন।

                এখানে তৈরি করা হচ্ছে মোট ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড। এই তাঁতপল্লি থেকে বছরে উৎপাদিত হবে ৪ দশমিক ৩১ কোটি মিটার কাপড়। তাঁতিদের জন্য তৈরি হচ্ছে আবাসিক ভবন। তাঁত শেড। ডরমেটরি। রেস্টহাউস। সাইবার ক্যাফে ও বিদ্যুত উপকেন্দ্র। সপ্তাহে এক বা দুই দিন বসবে তাঁতপণ্যের হাট। যে হাটে সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল বিক্রি ও প্রদর্শনী  হবে। দেখতে দেখতে এই এলাকা শহরের মতো হয়ে যাবে। আলো ঝলমল করবে। দেশি-বিদেশি মানুষ আসবে।

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় গড়ে তোলা হবে আইটি পার্ক। এজন্য ৭০ দশমিক ৩৪ একর জায়গা নির্ধারণ করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। প্রযুক্তি নিয়ে এখানে গবেষণা হবে। বিকেএসপি যেমন খেলোয়াড় তৈরি করে, তেমনি এখানে আগামী দিনের আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে। এখানে কর্মসংস্থান হবে প্রায় ২০ হাজার মানুষের। কিন্তু এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এখান থেকে অসংখ্য আইটি বিশেষজ্ঞ বের হবে। তারা সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর কারণে পদ্মায় ধরা মাছ যেমন খুব সহজেই কারওয়ান বাজারে যাবে। তেমনি যেকোনো কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা যাবে। ফলে কৃষক, জেলেসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ সরাসরি লাভবান হবেন।

শুধু তাই নয়। পদ্মা সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ হবে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নতুন উদ্যমে চালু হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ, নতুন নতুন অনেক রিসোর্ট তৈরি হবে। যেগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। এতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।

                -স্যার এছাড়া এই এলাকায় আর কী কী হবে?

                -আমার তো অত সব মনে করে বলতে পারছি না। তোমাদের কিছু কাগজপত্র দিচ্ছি। ওগুলো পড়লে জানতে পারবে সেতু এলাকায় আগামীতে আর কী কী হতে যাচ্ছে।

অজিহার স্যার চেয়ার থেকে উঠে একটি বক্স থেকে কিছু কাগজপত্র বের করলেন। তারপর তানজিলের হাতে দিলেন। তানজিল কাগজপত্রগুলো অনেক সময় ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। সে দেখলো- পদ্মা সেতু এলাকায় আগামীতে তৈরি হতে যাচ্ছে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। শেখ রাসেল শিশুপার্ক। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট অ্যান্ড কলেজ। আইএইচটি ভবন। ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। শিল্পকলা একাডেমি ভবন। মুক্তমঞ্চ ও অলিম্পিক ভিলেজ। এছড়া এই এলাকায় আগামীতে সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তোলা হবে বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও আইকন টাওয়ার।

এছাড়া এই এলাকায় তৈরি হতে যাচ্ছে- রেজাউল করিম তালুকদার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি এবং সার্কেল এএসপি অফিস-কাম-বাসভবন। বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলসহ ট্রেনিং সেন্টার ও ডে-কেয়ার সেন্টার। শিবচর পৌর বাস টার্মিনাল। ট্রমা সেন্টার। শিবচর হাইওয়ে থানা। হাজি আবুল কাসেম উকিল ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। চৌধুরী ফাতেমা বেগম ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

তানজিল অবাক হয়ে পড়ছিল আর ভাবছিল। এত্তো কিছু হবে এই এলাকায়? মনে মনে বলল, কেবল তো শুরু হলো। না জানি আরও কতো প্ল্যান আছে সরকারের। এমন সময় অজিহার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

-তানজিল কাগজগুলো পড়ে কী বুঝলে? দিনে দিনে এর বাইরেও অনেক কাজ হবে এসব এলাকায়। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়। সারা দেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতুতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া এই সেতু ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কন্টেইনার নিয়ে বুলেটের মতো ছুটে চলবে একেকটি ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। এভাবে অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন নতুন সোনালি স্বপ্ন। এখন আর কথা না বলি। দুপুরের খাবরের সময় হয়েছে। চলো আমরা খাওয়া-দাওয়া করি। তোমাদের আবার কবে পাবো তা তো জানি না। আর আমাকেও সরকার কয়দিন এখানে রাখবে তাও জানি না। তবে যোগাযোগ রেখো। এই আমার কার্ড।

এই কথা বলে অজিহার সাহেব তানজিল ও জাকির স্যারের হাতে তাঁর ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন। বললেন,

-চলো আমাদের ডরমেটরি থেকে খেয়ে আসি। তারপর গল্প করা যাবে।

-না স্যার। আজ থাক। আমরা বরং যাই। এখনো আমাদের অনেক জায়গা ঘোরার বাকি। আরেক দিন আসব। বললেন জাকির স্যার।

-তা হয় না। এই দুপুরে না খেয়ে যাওয়া যাবে না। যা বলছি শোনেন।

তারা তিনজন ডরমেটরির দিকে পা বাড়ালো।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। পর্ব।। আটকিশোর উপন্যাস।। বিস্ময়কর সেতুবালক।। ইমরুল ইউসুফ।। শেষ পর্ব ।। >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *