উপন্যাস

উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব উন্নিশ

১৯.

দীর্ঘদিনের অদর্শনে প্রেমও ফিকে হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ফারিয়ার মনে শফিকের যে জায়গা ছিল সেটা এখনো অক্ষত রয়েছে। ফারিয়া নিজে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে কারণে তারও অনেক ব্যস্ততা। কিন্তু শফিকের কথা খুব মনে পড়ে আজকাল। ফারিয়া ঢাকাতেই থাকছে। তার মা-বাবা তাকে এলাকায় নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে রাজি হয়নি। এলাকায় থাকা মানেই মা-বাবার ইচ্ছায় চলা। ফারিয়া জানে, এলাকায় গেলে সারা দিন সারা রাত বিয়ের কথা শুনতে হবে তাকে। কিন্তু সে যদিও শফিকের সঙ্গে রাগ করে, তাকে আঘাত দিয়ে চলে এসেছে, তবু তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা সে ভাবতে পারে না। এ জন্যই সে ঢাকা ছাড়েনি। বান্ধবীদের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে। সবাই মিলে পড়ালেখাটা ভালোই এগোচ্ছে এখানে। বাড়িতে গেলে তার লেখাপড়াটাও হতো না।

সেদিনের পর শফিক তাকে একটা কল পর্যন্ত করেনি। অবশ্য দোষটা তারই, সে-ই রাগ করে, বাজে কথা বলে চলে এসেছিল। কিন্তু তবু তার মনে একটা আশা ছিল, শফিক তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ও পক্ষের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। শফিক কি পারত না, তাকে একটা ফোন করে সরি বলতে। ও রকম অজপড়াগাঁয়ে না থেকে এখানকার চাকরিটা করলে তারা এত দিনে সংসার শুরু করে দিতে পারত। বুকের মধ্যে একটা অভিমান দানা বেঁধে উঠল ফারিয়ার। আগে শফিকের সঙ্গে যতবারই রাগারাগি হয়েছে, ফারিয়া নিজে উদ্যোগ নিয়ে সেটা মিটমাট করেছে। কিন্তু এবার আর না। যে ছেলে তার এত ইমোশনের দাম না দিয়ে একটা দুর্গম চরের মধ্যে গিয়ে খামোখাই পড়ে আছে, যার জীবনে ফারিয়ার কোনো মূল্য নেই, তার কাছে নিজে থেকে ফারিয়া আর যাবে না। সে হয়তো একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে, কিন্তু শফিক কি পারত না তাকে একটা ফোন দিতে?

এদিকে শফিক ভাবছে ফারিয়া তাকে বুঝতে না চেয়ে হঠাৎ করেই রিলেশন শেষ করে দিতে পারে না। কিন্তু সে তাই করেছে। অতএব, তাকেই শফিককে সরি বলতে হবে। প্রথম প্রথম ফারিয়ার ওপর খুব রাগ ছিল শফিকের। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সেই রাগ কমে গেছে। তবে তারও অভিমান হয়। অনেকবার ভেবেছে ফারিয়াকে ফোন করবে। কিন্তু করা হয়নি। প্রতিটি দিনই যেন শফিকের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিনই নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে তাকে। নিজের আয়ের জন্য যেটুকু কাজ না করলেই নয়, তা-ই করছে শফিক। সেদিন একটা পত্রিকায় তার নিউজ ছেপেছে। তারপর থেকে অন্য পত্রিকাগুলো তার সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। শফিকের এসব ভালো লাগে না। তবু সাংবাদিকদের সঙ্গে তাকে কথা বলতেই হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তার মতো অন্যরাও এ রকম কাজে উত্সাহী হয়ে উঠতে পারে। সবাই যদি ঢাকায়ই থাকে, তাহলে প্রান্তের মানুষগুলোর কী হবে? তারা কি সারা জীবন দুঃখকষ্ট সহ্য করেই যাবে? ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা বদলাতে না পারলে দেশের উন্নতি হবে না। যেসব পত্রিকা তাকে নিয়ে নিউজ করতে আসে, সবাইকে শফিক এ কথা বলে। দেশের শিক্ষিত যুবকেরা যেন ঢাকা থেকে নিজেদের এলাকায় ফিরে এলাকার উন্নয়নে কাজ করে, এটাই শফিকের চাওয়া। দেশকে ডিজিটাল করতে হলে, এখন এর চেয়ে আর ভালো বুদ্ধি নেই।

২০.

ফারিয়া জেনারেল ম্যাথটা দেখছিল। এই অঙ্কগুলো তার মাথায় থাকতেই চায় না। সেই কবে অঙ্ক সাবজেক্ট ছিল। তারপর বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের পুরোটাই তো সে অঙ্ক না করে কাটিয়েছে। এখন হাইস্কুল লেভেলের অঙ্ক দেখলেও তার কঠিন মনে হয়। আফরিন তাকে ইদানীং অল্পস্বল্প হেল্প করে। আফরিন ফিজিকসের স্টুডেন্ট। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে প্রচুর অঙ্ক করতে হয়েছে। তবে আফরিন আজ অঙ্ক করানোর মুডে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারিয়া আর শফিকের প্রেমের কথা সবাই জানত। শফিক ওদেরও বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। ফারিয়ার যারা বন্ধু, তারা শফিকেরও বন্ধু। তারপর ফারিয়ার সঙ্গে এক রুমে থাকতে থাকতে আফরিন তাদের সব ব্যাপার জানত। শফিকের বাড়ির ঘটনাও ফারিয়া তাকে বলেছে। আফরিন বলল, ‘একটা দারুণ সুখবর আছে ফারিয়া।’ ফারিয়া জটিল একটা অঙ্কের মধ্যে ডুবেছিল। সে বলল, ‘কী খবর?’

‘তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’

‘কিসের সারপ্রাইজ?’

‘তার আগে বল কী খাওয়াবি?’

‘আহা! তুই বল না কী বিষয়? কোনো জব ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট দিয়েছে?’

‘ধুর, এসব কিছু না। তার চেয়েও ভালো খবর।’

‘আহা, বলবি তো কী খবর?’

পত্রিকার যে পাতায় শফিকের ‍নিউজ বের হয়েছে, সেটা বের করে দিল আফরিন। নিউজের শিরোনাম ‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’। ইয়া বড় একটা ছবি শফিকের। সঙ্গে একটা টিনের স্কুলঘরের ছবি। ফারিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে দ্রুত খবরটা পড়তে লাগল। আফরিন অবশ্য আগেই পড়েছে। শফিকের সঙ্গে ফারিয়ার যে এটা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল, তা তো সে জানেই। কিন্তু খবরটা পড়ে শফিক সম্পর্কে তার ধারণাই বদলে গেল।

খবরটা পড়ে ফারিয়ার চোখ জলে ভরে গেল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। শফিককে সে ভুল বুঝে এত কষ্ট দিয়েছে ভেবে তার খুব দুঃখ হলো। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে গিয়ে শফিককে জড়িয়ে ধরতে। সেদিন শফিক ও রকম জেদ না করলে আজ তাকে নিয়ে এই খবর ছাপা হতো না। চাকরি তো সবাই করে। এ রকম কাজ কজন মানুষ করতে পারে? নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে যারা মানুষের কথা ভাবে, দেশের কথা ভাবে, মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তারাই তো প্রকৃত মানুষ। নিজের জন্য তো সবাই বাঁচে। মানুষের জন্য বাঁচে কজন? আফরিন ফারিয়ার পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। ফারিয়া কান্না সামলে আফরিনকে বলল, ‘এখন আমি শফিককে মুখ দেখাব কীভাবে? তার সামনে আমি কেমন করে যাব?’

আফরিন বলল, ‘ধুর পাগল। দেখ, শফিককে আমি যতটা চিনি, তাতে তাকে খুব বড় মনের মানুষ বলেই মনে হয়েছে। তুই একবার গিয়ে দেখা করলেই সব রাগ জল হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু সে যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়? আমি তাকে অপমান করে এসেছি।’

‘ফিরিয়ে দেবে না। এর আগেও তো তোদের গণ্ডগোল হয়েছে। আবার মিটমাটও হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া এত দিনের একটা রিলেশন, এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না।’

‘তাহলে আমি এখন কী করব আফরিন? আমি ওর সঙ্গে অন্যায় করেছি।’

‘তুই গিয়ে একবার শুধু তার সামনে দাঁড়া। আর কিছু তোকে করতে হবে না। তুই যেমন কষ্ট পাচ্ছিস, আমি জানি শফিকও খুব কষ্ট পাচ্ছে।’

ফারিয়া আর কোনো কথা না বলে তক্ষুনি তার ব্যাগ গোছাতে লেগে গেল। রাতের বাসেই সে বগুড়া যাবে। একটুও সময় নষ্ট করতে চায় না সে। এরই মধ্যে ফারিয়ার বন্ধুমহলে শফিকের খবরটা চাউর হয়ে গেছে। খড়ের ঘরটাই এখন শফিকের ঠিকানা। এটাকে সে যথেষ্ট আরামদায়ক বানিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। দক্ষিণ দিকের জানালাটা বড় করেছে। বাঁশ দিয়ে একটা খাটের মতোও বানিয়ে নিয়েছে সে। একটা টেবিল আছে, যেটাকে সে স্টাডি টেবিল হিসেবে ব্যবহার করে। এসবের কিছুই তাকে নিজ হাতে বানাতে হয়নি। এই স্কুলের এক ছাত্রের বাবা শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। শফিক তাকে ডিজাইন বুঝিয়ে দিয়েছিল শুধু। তারপর অবসরমতো সব কাজ তিনিই করে দিয়েছেন। একটা টাকাও নেননি। শফিক অনেক চেষ্টা করেছিল লোকটাকে কিছু টাকা দিতে। কিন্তু পরে যখন সে দেখল, টাকার কথা বললে লোকটা অপমানিত বোধ করছেন, আহত হচ্ছেন, তখন সেই চেষ্টা সে বাদ দিয়েছে। তা ছাড়া শফিকের মতো এ রকম একজন শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নিলে চরের অন্য লোকেরাই বা কী বলবে! স্কুলে ছাত্রছাত্রী এলে তারা কেউ একজন এসে শফিককে খবর দেয়। তারপর শফিক রেডি হয়ে তাদের ক্লাস নিতে যায়। ততক্ষণে অবশ্য আলিমুল স্যারের ক্লাস চলতে থাকে।

লোকের মুখে শুনে শুনে ফারিয়া চরের দিকে আসতে লাগল। এদিকে রহিম মিয়া আর রওশন আরাও রওনা দিয়েছেন। তাদের সঙ্গী মতিন। ফারিয়া যে আসবে সেটা ফারিয়ার মা-বাবাও জানেন না। ফারিয়া যে খেয়াটা পার হলো, কেবলই তার পরের খেয়ায় শফিকের মা-বাবা আসছেন। ওনারা শফিকের মা-বাবা, এটা শুনে চরের ছোট থেকে বড় সবাই তাদের সাহায্য করতে লেগে গেল। কে কার আগে তাদের খেদমত করবে, সেটারই যেন একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছে।

ফারিয়া যখন স্কুলঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, শফিক চক দিয়ে বোর্ডে লিখছে। ছাত্রদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সে যখন তাকাল, দেখতে পেল হলুদ শাড়ি পরা ফারিয়া দাঁড়ানো। ফারিয়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেও ফারিয়ার চোখে চোখ রাখল। তাদের দুজনার চোখই তখন জলে চিকচিক করছে।

Series Navigation<< <strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব সতেরো</strong>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *