উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব  তিন

৩.

বাড়ি এসেই ফারিয়ার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে। মা ভয়ে খুব একটা কাছে আসছে না। ছোট বোন নিশা শুধু ঘুরঘুর করছে আশপাশে। সে ক্লাস নাইনে গেল এবার। ফারিয়ারা দুই বোন, ফারিয়া আর নিশা। কোনো ভাই নেই। ফারিয়ার বাবা মজিদ মিয়া। তিনিও বেশ সম্পদশালী মানুষ। বগুড়া শহরের বড় কাপড়ের দোকানগুলোর একটি তার। অত বড় ব্যবসা সামলাতে তাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয় দিনের অনেকটা সময়। ফারিয়ার ছোট বোন নিশা পড়ালেখায় খুব একটা ভালো না। তার কোনো আগ্রহও নেই পড়ালেখা নিয়ে। বরং সাজগোজ নিয়ে থাকতে সে বেশি পছন্দ করে। নিশা শুধু শুনেছে বড় বোনকে দেখতে আসবে। তারপর থেকে রূপচর্চা শুরু হয়ে গেছে। প্রায় সব ধরনের সবজি দিয়ে এক্সপেরিমন্ট করা হয়েছে। শুধু কাঁচা মরিচটাই লাগাতে পারছে না সে। এতে তার মুখের ফরসা রং বদলে গিয়ে অনেকটা লাল রং ধারণ করেছে। ফারিয়ার আশপাশে ঘুরে সে তাকে সবজি লাগাতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। ফারিয়া তার ওপর খুবই বিরক্ত। নিশা বলল, ‘আপু, এক ঘণ্টা লাগিয়ে রাখো প্যাকটা ছেলেপক্ষ এসে চোখই সরাতে পারবে না।’

ফারিয়া বলল, ‘চোখ না সরাতে পারলে তো খুবই বিপদ ঘটে যাবে রে নিশা। ওরা তো কিছু খেতেই পারবে না। কারও সঙ্গে আলাপ করতে পারবে না। কী একটা বিশ্রী অবস্থা হবে তুই ভেবে দেখেছিস?’
‘আপু, ইয়ার্কি না, সত্যি।’
‘সত্যি? তাহলে তুই লাগিয়ে রাখ।’
‘আমি তো লাগিয়েছিলাম কাল। আজ আবার লাগাব।’
‘ওহ, তাই বল। এ জন্যই তোর মুখটা লালমুখো বান্দরের মতো হয়ে গেছে। যা গিয়ে একবার আয়নায় দেখে আয়।’
‘কী বলছ আপু! আমার স্কিন সুন্দর হয়নি?’
‘না, বান্দর হইছে। এখন সামনে থেকে যা আমার। তোর প্যাক তুই লাগিয়ে বসে থাক।’

মন খারাপ করে নিশা চলে গেল। তাকে কেউ রূপবিষয়ক খোঁটা দিলে সে সেটা সহজে হজম করতে পারে না। বাবার সঙ্গে বেশি কথা হয়নি ফারিয়ার। বাবা ব্যস্ত মানুষ। সকালে বেরিয়ে গেছেন। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে যেতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে। সপ্তাহে একটা ছুটির দিন বাদে সারা বছরই তাকে শহরে যেতে হয়। কর্মচারীদের হাতে অত বড় ব্যবসা ছেড়ে আসা যায় না। বিশ্বস্ত লোক অবশ্য একজন আছে, কিন্তু তারও বয়স হয়েছে, সব সময় দোকানে থাকতে পারে না। রজব আলী যদি দোকানে থাকে, তাহলে নিশ্চিন্তে দোকানটা তার হাতে ছেড়ে আসা যায়। রজব আলীর জন্যই এলাকার জমিজমা দেখভাল করতে পারেন মজিদ মিয়া। নয়তো দুদিক সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হতো। মজিদ মিয়া অনেকবার ভেবেছেন গ্রামের পাট চুকিয়ে শহরে স্থায়ীভাবে চলে যাবেন। কিন্তু ওই ভাবাভাবিই সার। যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া বাপ-দাদার ভিটের প্রতি মানুষের একটা টান থাকে বোধ হয়। ভিটে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। গ্রাম ছেড়ে যাওয়া মানে তো শুধু সেখানকার ভিটেমাটি ছাড়া নয়। সেখানকার মানুষজন আত্মীয়-পরিজন সব ছেড়ে আসা। কেমন একটা শিকড়ছেঁড়া অনুভূতি হয় ভাবলেই। যাতায়াতের জন্য মজিদ মিয়া একটা অটোরিকশা কিনে দিয়েছেন বাড়ির পাশের একজনকে। মজিদ মিয়াকে সে-ই আনা-নেওয়া করে। আর বাকি সময় অটোরিকশাটা ভাড়ায় চালিয়ে যে আয় হয়, সেটা তার। মজিদ মিয়া সেখান থেকে কিছু নেন না। উপরন্তু কখনো মেকানিকের কাছে নিতে হলে বা কোনো পার্টস কিনতে হলে খরচটা মজিদ মিয়াই দেন। এই গ্রামের একটা গ্রাম পরেই শফিকদের গ্রাম। ফারিয়াদের গ্রামে এখন সব আধুনিক ব্যবস্থা এসেছে। বিদ্যুতের লাইন এসেছে গত বছর। তারপর থেকে গ্রামের চেহারা পুরোই পাল্টে গেছে। কিন্তু শফিকদের গ্রাম সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে। বিদ্যুৎ নেই, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো নয়। বর্ষা এলে পথঘাট প্রায় চলার অনুপযোগী হয়ে যায়। ফারিয়া ছোটবেলায় একবার ওই গ্রামে গিয়েছিল। তখন সব অন্য রকম ছিল অবশ্য। বিস্তর মটরশুঁটির খেতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল সেটুকু মনে আছে। ফারিয়া শফিকের মুখে শুনেছে, ওই গ্রাম এখনো আগের মতো আছে। আগে সোলার প্যানেল ছিল না, এখন এক-দুটি বাড়ির লোকেরা সৌরবিদ্যুৎ চালায়। এই যা পার্থক্য। আর ছোটবেলায় সে শফিককে চিনত না, এখন চেনে।

মা জানে, ফারিয়ার মেজাজ একবার বিগড়ে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে। সে জন্য তিনি একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন। ফারিয়া তাদের আদরের মেয়ে। তাদের কথাও শোনে। কিন্তু সমস্যা হলো, সে মুখের ওপর যা খুশি বলে দেয়। এই যে হুট করে তাকে ঢাকা থেকে চলে আসতে বলা হলো, সে কিন্তু না এলেও পারত। বলতে পারত তার কাজ আছে। কিন্তু মা-বাবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে বলাতে সে না এসে পারেনি। মা-বাবা তাকে বলেনি যে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। খবরটা সে নিজেই বের করেছে। বিদ্যুৎ আসার পর থেকে এ গ্রামের অনেকের কাছেই মোবাইল ফোন আছে। ফলে খবর বের করে ফেলা তেমন কোনো ব্যাপার নয় এখন। আর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কতজন আছে ফারিয়ার স্পাই, সেটা তার মা-বাবা জানে না! দুপুরে তার মা যখন রান্নাঘরে কাটাকুটি করছিলেন, ফারিয়া গিয়ে পাশে বসল। বলল, ‘কী মা? তোমাদের পাত্রপক্ষ কখন আসবে?’ মা একটু অবাক হলেও সামলে নিলেন। তিনি বুঝলেন মেয়ে খবর পেয়ে গেছে। তা ছাড়া নিশাও সব জানে। মা বললেন, ‘আসরের নামাজের পর আসার কথা।’

ফারিয়া বলল, ‘তুমি শফিক আর আমার ব্যাপারটা জানো না?’
‘জানি তো।’
‘তাহলে এসবের মানে কী?’
‘দেখ মা, কেউ দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। তুইও দেখবি। তোর অমতে তো আর আমরা কিছু করব না।’
‘শোনো মা, আমার কাউকে দেখার খায়েশ নাই। বিয়ে দিতে হলে তোমাদের ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও। আমি শফিককেই বিয়ে করব।’
‘কী আবোলতাবোল বলছিস! ও তো বাচ্চা মেয়ে।’
‘ওহ, ও বাচ্চা মেয়ে আর আমি বুঝি বুড়ি হয়ে গেছি?’
‘বুড়ি হোসনি। কিন্তু বিয়ের বয়স তো হয়েছে?’
‘শোনো, এবার এভাবে ডেকেছ আর কখনো আমাকে এ ধরনের ব্যাপারে ডাকবে না। শফিককেই আমি বিয়ে করব। এই ছেলেকে দেখিয়ে বিদায় করে দেবে। খবরদার, আমার কাছে এসব ব্যাপারে ওকালতি করতে আসবে না।’
‘ঠিক আছে, কেউ তোর কাছে ওকালতি করতে যাচ্ছে না। তুই একবার ছেলেটাকে দেখ। কথা বল। পছন্দ না হলে না করে দিবি।’
‘কেন? ছেলে কি প্রিন্স হ্যারি?’
‘ওটা আবার কে?’
‘ও তুমি বুঝবে না। রাজকুমার একজন। যাহোক, এসব ঝামেলার এটাই শেষবার। আমি যদি দেখি আবার এমন করেছ, তাহলে তোমাদের খবর আছে। ঢাকায়ই একটা চাকরি করে থেকে যাব। কোনো দিন গ্রামে আসব না, বিয়েও করব না।’

Series Navigation<< উপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দুই<strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব চার</strong> >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *