উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব এগারো

১১

ফারিয়ার পরীক্ষা শেষ। শফিক এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না। চাকরির নিয়োগপত্রটা সে হাতে পেয়েছে গত সপ্তাহের প্রথমে। কথাটা কাউকে বলতে পারেনি সে। কথা চেপে রাখা কী যে কষ্টকর কাজ! সে ফারিয়াকে প্রথমে জানাবে বলে বাড়িতেও জানায়নি। আর বাড়িতে জানালে মা প্রথমেই তাকে চলে আসতে বলবে। মায়ের অনুরোধ সে ফেরাতেও পারবে না। এ জন্য বাড়িতে জানানো হয়নি। তবে তার পরিবারের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে চাকরি না করলেও চলে শফিকের। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করলেই হয়। কিন্তু শফিক নিজে কিছু করতে চেয়েছে আজীবন। বাসা থেকে এমনকি টাকা নিতেও তার ভালো লাগত না। এখন সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। বাসার টাকা আর নিতে হবে না। নিজে রোজগার করবে, বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারবে। নিজে এটা-ওটা কিনে দিতে পারবে সবাইকে।

কফিশপটাতে শফিক অপেক্ষা করছে সতেরো মিনিট। অথচ তার কাছে অনন্তকাল মনে হচ্ছে। ফারিয়া এখনো আসছে না। চাকরির খবরটা শুনে ফারিয়ার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা দেখার জন্য সে উন্মুখ হয়ে আছে। কফির অর্ডার দিয়ে সে বসেছে মাত্র, এর মধ্যে দেখল কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে ফারিয়া। দারুণ লাগছে তাকে। হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছে সে। যেন একটা হলুদ পরি হেঁটে আসছে। শফিকের মনটাই ভালো হয়ে গেল। ফারিয়ার গঠন খুব ভালো, আকর্ষণীয় ফিগার। একটা গজ দাঁতের কারণে সে যখন হাসে বা কথা বলে তখন তাকে আরও ভালো দেখায়। পরীক্ষা শেষ করে সোজা এখানে চলে এসেছে ফারিয়া। তবু তার মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। এসেই সে এমন একটা হাসি দিল যে শফিকের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।

শফিক বলল, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’

ফারিয়া বসতে বসতে বলল, ‘বলছি, কফি দিতে বলো আগে।’

শফিক ওয়েটারকে ডেকে আরেকটা কফির কথা বলল।

‘পরীক্ষা ভালো হয়েছে। সব কমন পড়েছে। পরীক্ষা দিয়েই সোজা তোমার কাছে চলে এসেছি। এখন তোমার খবর বলো।’

শফিক রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ‘আমার খবর দেওয়ার জন্যই তো ডেকেছি তোমাকে। একটা ভালো খবর আছে।’

‘কী খবর?’

‘আন্দাজ করো তো।’

‘উফফ্, আন্দাজ করতে পারছি না। তুমি বলো।’

শফিক নাটকীয় ভঙ্গিতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা খামসহ ফারিয়ার হাতে দিল। ফারিয়া বলল, ‘কী এটা?’

‘আহা, খুলেই দেখো না।’

ফারিয়া খাম খুলে লেটারটা পড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটা চিত্কার দিল। কফিশপের অন্যান্য লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সে সরি বলে বসে পড়ল। সে বলল, ‘দারুণ! কংগ্রাচুলেশনস শফিক। এই খবরটা তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন?’

‘আগে জানালে তোমার পরীক্ষায় এর প্রভাব পড়ত। এ জন্যই পরীক্ষা শেষে জানালাম।’

‘আমি কত টেনশনে ছিলাম জানো? আজকে পরীক্ষার টেনশন আর এই টেনশন দুটোই দূর হলো।’

‘তুমি খুশি হয়েছ?’

‘খুশি মানে? দারুণ খুশি হয়েছি। আমি খুব প্রাউড ফিল করছি তোমাকে নিয়ে। তোমার তো রেজাল্টই বের হয়নি। এর আগেই এত ভালো একটা চাকরি! ভাবা যায় না।’

‘হ্যাঁ, রেজাল্টের আগেই এমন একটা চাকরি পাব ভাবিনি।’

‘এখন দ্রুত বাসায় বলে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে। মা-বাবা এখন আর অমত করতে পারবে না।’

‘তুমি তো খুব বেহায়া হয়ে যাচ্ছ দিন দিন। নিজের মুখে নিজের বিয়ের কথা বলে নাকি মেয়েরা?’

শফিকের কথায় ফারিয়া একটু লজ্জা পেলেও দ্রুতই সামলে নিল। সে বলল, ‘এখন যুগ পাল্টেছে। তা ছাড়া ছেলেরা যখন বিয়ের কথা বলে না, তখন তো মেয়েদেরই বলতে হবে।’

‘হা হা হা, তাই বুঝি?’

‘হুম, তাই। আজ সারা দিন আমরা ঘুরে বেড়াব। তোমাকে শপিং করে দেব। তোমার চাকরি পাওয়া আমি সেলিব্রেট করব। আজ সব বিল আমি দেব।’

‘বিয়ে হয়ে গেলে সেগুলো কড়ায়গণ্ডায় উসুল করে নেবে?’

‘অব্যশ্যই কড়ায়গণ্ডায় উসুল করে নেব। বিয়ের আগে পর্যন্ত আমি তোমাকে চালাব। আর বিয়ের পরও তোমাকে আমিই চালাব।’

‘বিয়ের পরও তুমি চালাবে? সেটা কেমন?’

‘এই ধরো তোমার স্যালারির সব টাকা আমার কাছে থাকবে। সেখান থেকে সংসার তো আমাকেই চালাতে হবে।’

‘ওহ। এভাবে চালাবে?’

‘হ্যাঁ। শোনো, টাকা আয় করার চেয়ে সেটা সঠিকভাবে খরচ করাটা বেশি কঠিন। তোমার জন্য না হয় আমি সেই কঠিন কাজটাই করলাম।’

‘আহা! আমার জন্য কত ভাবনা তোমার।’

‘ভাবনাই তো। তোমার সব দায়িত্ব এখন থেকে আমার। তুমি রোজগার করবে, আমি সংসার সামলাব।’

‘তুমি চাকরি করবে না?’

‘অবশ্যই চাকরি করব। কিন্তু সেটা সরকারি চাকরি। তুমি তো জানোই সরকারি চাকরি পেতে কত সময় লেগে যাবে। এই সময়টা আমি পড়ব আর সংসার করব। এর মধ্যে অন্য কাজ করতে গেলে বিসিএস বা ফার্স্ট ক্লাস জব আমি পাব না।’

‘সেটা অবশ্য ঠিক। চাকরি করে বিসিএসের পড়াশোনা করা কঠিন। আচ্ছা, তোমাকে চাকরি করতে হবে না। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার সংসারের চাকরিটা সামলাও।’

‘ওকে ডিয়ার। তাই হবে। বাসায় জানিয়েছ খবরটা?’

‘নাহ, তুমি খুব টেনশন করছিলে বলে তোমাকেই আগে জানালাম। আর বাড়িতে জানালে বাবা এসে আমাকে নিয়ে যেত। মাঝখানের দিনগুলো ঢাকায় থাকতে পারতাম না। আজই বাবাকে ফোন করে জানাব।’

‘আমাকেও বাসায় ফোন করতে হবে। তোমার চাকরির কথাটা বলতে হবে। তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠাতে হবে।’

‘আমাদের বাড়িতে লোক পাঠাতে হবে কেন?’

‘বাহ রে, বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে না?’

‘হা হা হা। মেয়ের বাড়ি থেকে আগে লোক পাঠায় নাকি? তুমি তো দেখি বিয়ের জন্য একেবারে পাগল হয়ে গেছ!’

‘ওহ, তা অবশ্য ঠিক। তাহলে তোমাদের বাড়ি থেকেই প্রস্তাবটা পাঠাতে হবে।’

‘হুম। আগে চাকরির খবরটা সবাইকে জানাই, তারপর প্রস্তাব পাঠাতে বলব।’

‘তোমার বাসায় রাজি হবে?’

‘হবে না মানে? এক শ বার রাজি হবে। ফারিয়ার মতো মেয়ে লাখে একটা।’

‘আহা। এত পাম দিয়ো না তো।’

‘আজব! পাম কেন হবে। আর তা ছাড়া পাম দিতে হয় সম্পর্ক হওয়ার আগে। এখন তো আর পাম দেওয়ার কিছু নেই।’

‘সেটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। যে মেয়ে নিজেই এতটা পটে আছে, তাকে আর পটানোর দরকার কী; বরং এই প্রতিভাটা অন্যত্র খরচ করলে লাভ আছে।’

‘হা হা হা। ভালো বলেছ তো। দেখব নাকি ট্রাই করে?’

‘খবরদার! ওই কাজ ভুলেও করতে যেয়ো না। একদম জানে মেরে ফেলব।’

‘ওরে বাবা। তুমি তো দেখি বিয়ের আগেই দজ্জালপনা শুরু করেছ। বিয়ের পর তো অন্য কারও দিকে তাকাতেই দেবে না দেখছি!’

‘তাকানোর ইচ্ছে আছে নাকি?’

‘এখন তো নেই। যদি কখনো ইচ্ছে হয়?’

‘ওসব ইচ্ছে না করাই ভালো। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পত্রিকায় তো প্রায়ই আসে এসব নিউজ, দেখো না?’

‘কী রকম নিউজ?’

‘ওই যে, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, বিশেষ অঙ্গ কর্তন, এ রকম শিরোনাম দেখো না?’

‘তুমি তো দেখি খুবই ডেঞ্জারাস মেয়ে!’

‘হুম, অন্য কোনো মেয়ের দিকে ভুলেও তাকাবা না। খবর করে ছেড়ে দেব একদম।’

‘অবশ্যই। জানের মায়া কার না আছে।’

‘হা হা হা। গুড বয়। তাহলে বাড়িতে যাচ্ছ কবে?’

শফিক কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘কালই যাব ভাবছি। তুমি কী বলো?’

‘যাও। দেরি না করাই ভালো। এত বড় একটা খুশির সংবাদ। আর আমাদের বাড়িতে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করো। তুমি তো জানোই কত টেনশন করছে আমার বাড়িতে।’

‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছি। দ্রুতই লোক পাঠাতে বলব। এ রকম সংবাদ শুনে তারাও অমত করবে না।’

‘চলো তাহলে এখন আমরা কফিটা খেয়ে বের হই। আজ সারা সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াব।’

‘ঠিক আছে। বিয়ের আগে থেকেই তাহলে তোমার কথা মান্য করা শুরু হোক।’

ফারিয়া ও শফিক কফিশপ থেকে বের হয়ে রিকশা নিল। ফারিয়ার পছন্দের জায়গা তার বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়া। রমনা, টিএসসি, চারুকলা এসব জায়গাতেই সে ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কেমন নিজের জায়গা যেন এসব। শফিকের অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স করে নেওয়ার ইচ্ছা আছে। সেটা সে করবে বলেই ভেবে রেখেছে। যদিও ফারিয়াকে সে এ বিষয়ে কিছু বলেনি এখনো। রেগুলার কোর্স না হোক, অন্তত সন্ধ্যাকালীন কোনো একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামে সে পড়তে চায়। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠে একবার ছাত্র হতে চায় সে। ফারিয়া এই এলাকায় যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সে সেটা করতে পারে না। যেন অন্যদের জায়গায় ঢুকে পড়েছে, এই বোধ তার ভেতরে সব সময় কাজ করে। যদিও সে সেটা কখনো ফারিয়াকে বুঝতে দেয়নি। তবু অন্তত এই বোধটা কাটানোর জন্য হলেও সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তার পছন্দের সাবজেক্টে পড়ার আগ্রহের কারণে অনার্সে এখানে ভর্তি হওয়া হলো না। এখন সেই পড়াশোনা শেষ, ইচ্ছা করলেই শফিক এখানে অন্য একটা কোর্স করে নিতে পারবে। দেখা যাক, চাকরিতে জয়েন করার পর সে একটা ব্যবস্থা করে নেবে এখানে পড়ার। অবশ্য নতুন চাকরি, মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়ও লাগবে।

ফারিয়া খুব হিসেবি মেয়ে। সে মনে মনে শফিকের স্যালারি থেকে ব্যয়ের একটা হিসাব বের করে ফেলল। বাসাভাড়া ২০ হাজার, শফিকের বাড়িতে পাঠানো হবে ১০ হাজার, আর আপাতত সেভিংস ৫ হাজার। এই মোট ৩৫ হাজার। বাকি থাকে ২০ হাজারের কিছু বেশি। এই টাকায় সংসার খরচ, যাতায়াত এসব হয়ে যাবে। আর সে যখন চাকরি করবে তখন তার টাকার পুরোটাই প্রায় জমাতে পারবে। ফারিয়ার বাড়িতে অত টাকাপয়সার দরকার নেই। তবু সে একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক পাঠাবে। রমনার লেকপাড়ের বেঞ্চে বসে ফারিয়া এসব টুকটাক সাংসারিক হিসাব করছিল আনমনে। শফিক বলল, ‘কী ভাবছ?’ ফারিয়া বলল, ‘জিনিসপত্রের লিস্ট করছি।’

‘কী জিনিসপত্র?’

‘বাহ রে! সংসার শুরু করতে কেনাকাটা করতে হবে না?’

‘হা হা হা। সবে চাকরিটা হলো, বিয়ে হবে, এরপর না সংসার!’

‘তো? আগেভাগে হিসাব করে রাখলে তোমার অসুবিধা আছে?’

‘না না। আমার অসুবিধা কী? আমার তো বরং সুবিধাই হবে।’

‘হ্যাঁ, তাই তো। তোমরা ছেলেরা তো কোনো কাজ করো না। সংসার সামলানোটা এত সোজা নয়। এখন থেকে এসব হিসাব করে না রাখলে পরে পস্তাতে হবে।’

‘তো, কী হিসাব করলেন ম্যাডাম?’

‘সেটা এখন তোমাকে বলা যাবে না। তোমার যে স্যালারি, তাতে দুজন মানুষের ঢাকা শহরে মোটামুটি চলে যাবে। তবে প্রাথমিক কেনাকাটার জন্য বেশ বড় অঙ্কের টাকা লাগবে।’

‘তা ঠিক। ঘর সাজাতেই অনেক টাকা লাগবে। আচ্ছা, ওই টাকাটা পাব কোথায়?’

‘ওটা আমি ভেবেছি। ফার্নিচার আর টিভি, ফ্রিজ এসব কেনার জন্য যা লাগবে, সেটা আমি বাবার কাছ থেকে ম্যানেজ করব।’

‘ওরে বাবা! তুমি তো দেখি পাকা প্ল্যান করে ফেলেছ। কিন্তু আমি তো শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক নেব না।’

‘ওটা যৌতুক নয়। বিয়ের সময় এগুলো এমনিতেই দেয়। যাদের সামর্থ্য নেই তাদের কাছ থেকে যদি এগুলো বাধ্যতামূলক আদায় করা হয়, তাহলে সেটাকে যৌতুক বলা যেতে পারে। আর যাদের টাকার টানাটানি নেই সেসব ফ্যামিলিতে এগুলো এমনিই দেয়।’

‘তুমি তো বললে ম্যানেজ করবে। তাহলে সেটা যৌতুক হয়ে যাবে না?’

‘আরে গাধা, ম্যানেজ করব সেটা কথার কথা বলেছি। বাবা এমনিতেই এগুলো দেবে।’

‘ওহ, ঠিক আছে তাহলে। তবে তুমি কিন্তু কিছু চাইতে পারবে না। প্রয়োজনে আমরা ব্যাংক থেকে লোন নেব। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু চেয়ে নেব না।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে যৌতুক নিতে হবে না। এত টেনশন করার দরকার নেই। আগে তুমি বাড়িতে গিয়ে আমাদের বাড়ি লোক পাঠাও।’

Series Navigation<< <strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দশ</strong><strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব বারো</strong> >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *