উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দশ

১০.
সকাল সকাল ই-মেইলটা খুলেই শফিক খুশি হয়ে গেল। শেষ পরীক্ষার দিনে সে যে ইন্টারভিউটা দিয়েছিল, সেটার রেজাল্ট জানিয়েছে। চাকরিটা তার হয়েছে। স্যালারি সে যা চেয়েছিল প্রায় তাই-ই। একদম ফ্রেশার হিসেবে সে ৬০ হাজার টাকা বলেছিল এক্সপেক্টেড স্যালারি। ওরা জানিয়েছে ৫৫ হাজার ৭০০। প্রথম চাকরি হিসেবে এটা অনেক বেশি বলেই মনে হলো শফিকের। দুই-তিন বছর কাজ করার পর এই অঙ্ক দুই-তিন গুণ হয়ে যেতে পারে। শফিককে দেখে ওদের খুব পেশাদার আর ক্রিয়েটিভ ছেলে মনে হয়েছিল। তাই নতুন হিসেবে একটু বেশি স্যালারি হয়ে গেলেও ওরা শফিকের ডিমান্ড মেনে নিয়েছে। মেইলে লিখেছে অফিসে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিয়ে আসতে। আর সেটা যদি সম্ভব না হয় বা শফিক কোনো কারণে বিজি থাকলে ওরা লেটারটা কুরিয়ারে পাঠাবে। শফিক মেইলের রিপ্লাইয়ে জানিয়ে দিল, পাঠানোর দরকার নেই। সে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে। মা-বাবার কথা মনে পড়ে গেল শফিকের। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট পর্যন্ত বেরোয়নি, এর আগেই এমন চাকরি! এ তো সোনায় সোহাগা। মা-বাবা খুব খুশি হবে। শফিক খবর পেয়েছে তার পরীক্ষার আগে বাবা এলাকার এতিম ছেলেদের খাইয়েছে। চাকরির খবর পেলে তো পুরো গ্রাম খাওয়াবে খুশিতে।

ফারিয়ার কথা মনে হলো তার। আচ্ছা, ফারিয়াকে চমকে দিলে কেমন হয়? বেচারির ফাইনাল শেষ হবে কয়েক দিন পরে। এরপর আর মা-বাবাকে সে আটকে রাখতে পারবে না। এখন চাকরি না পেলে শফিকের অবস্থা দেবদাসের মতো হতে পারত। ফারিয়া সেই কবে থেকে তার অপেক্ষা করে বসে আছে। সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্নে সে বিভোর। আবশ্য সেই স্বপ্ন শফিকেরও আছে। কিন্তু সে একটু ইন্ট্রোভার্ট বলে সেটা শিগগির প্রকাশ করে না। কিন্তু ফারিয়ার সঙ্গে দেখা হলেই ফারিয়া তার সংসার কী কী দিয়ে সাজাবে সেসব প্ল্যানের কথা শফিককে শোনাতে থাকে। শফিক অবশ্য খেয়াল করে দেখেছে, ফারিয়ার জিনিসপত্রের লিস্ট প্রায়শই চেঞ্জ হয়ে যায়। আগেরবার যেটা বলে, পরেরবার আবার সেটা বলে না। সম্পূর্ণ নতুন কোনো  প্ল্যান শোনায়। তবে সংসার নিয়ে মেয়েটার যে এক্সাইটমেন্ট, তার কিন্তু কোনো তুলনা নেই। সেটি একদম নিখাদ। ঢাকা শহরে কোন এলাকায় থাকবে, কত দিন পরে ফ্ল্যাট কিনবে, এসব প্ল্যান সে এখনই করে রেখেছে। ফারিয়া খুব সংসারী মেয়ে। অন্তত শফিকের কাছে তাই মনে হয়। একই এলাকার মেয়ে বলে সহজেই বাড়ির সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে।

ফারিয়ার পরীক্ষাও ভালো হচ্ছে। তবে সে ভাবছে বিসিএস ট্রাই করবে। স্বামী–স্ত্রী দুজনের একজন সরকারি চাকরিজীবী হলে ভালো হয়। তবে শফিকের চাকরি হলে সে আর দেরি করতে চায় না। সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের কাজটা সেরে নেবে। শফিক ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে সংসার করার কথা সে ভাবতে পারে না। তার চেয়ে সে আইবুড়ো হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে। ওর বান্ধবীরা ওকে এখন বিয়েপাগলি বলে খেপায়। সে বিয়ে বিয়ে করে হয়রান হয়ে গেছে। তার যাবতীয় টেনশন যেন বিয়েকে ঘিরে। পরীক্ষা দিতে হয় বলেই দেওয়া। ফারিয়া হলো সেসব মেয়ের একজন, যারা সারা বছরই অল্প অল্প করে পড়াশোনা এগিয়ে নেয়। তাহলে পরীক্ষার আগে আর চাপটা পড়ে না। আরামে থাকা যায়। রোকেয়া হলের রুমটায় এখন ফারিয়ারা তিনজন থাকে। সৌভাগ্যক্রমে তিনজনই একই ইয়ারের। এদের মধ্যে দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই সিটের রুমে ওদের তিনজনকে থাকতে হয়। সে জন্য দুটো খাট জোড়া দিয়ে নিয়েছে। বিবাহিত দুজনের যেকোনো একজন দেখা যায় বেশির ভাগ দিন অনুপস্থিত থাকে। আজ এ আছে তো কাল ও নেই। এ রকম করে ওদের হলের দিনগুলো এখন শেষের পথে। তবে পরীক্ষা শেষে সবারই হল ছেড়ে দিতে হবে বলে ইদানীং ওদের বন্ডিংটা যেন বেড়েছে। যার পরীক্ষা শেষ হবে, সে-ই হল ছেড়ে দেবে। এত দিনের একসঙ্গে থাকা, এত দিনের পথচলার পর আলাদা হয়ে যাওয়াটা ওদের সবাইকে দুঃখ দেবে। আর ফারিয়ার সামনে তো একপ্রকার অনিশ্চয়তা। সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না এখনো। তার নিজের জীবন জড়িয়ে আছে শফিকের সঙ্গে। শফিকের চাকরি পাওয়া না-পাওয়াতে তার অনেক কিছু নির্ভর করছে। শফিকের সাবজেক্ট বেশ ডিমান্ডিং হলেও মাঝে মাঝে চাকরি পেতে অনেক সময় লেগে যায়। তারপর দেখা যায় ব্যাটেবলে মিলছে না। সে যে ধরনের চাকরি খুঁজছে, সেটা হয়তো পাবে না সহজে। ফারিয়ার মাথা এলোমেলো হয়ে যায় এসব ভাবতে গেলে। বাসা থেকে বিয়ের চাপটা না থাকলে তার এত সমস্যা মনে হতো না। ওই চাপটাই যত সব সমস্যার গোড়া। মা-বাবাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না এখন। সেদিনও ফোন করেছিল তারা। অথচ তারাই শফিকের ব্যাপারে প্রথম থেকে পজিটিভ ছিল। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন তাদের মনোভাব নেগেটিভ হচ্ছে। সমবয়সী বলেই তারা এখন বেঁকে বসেছে। আসলে মেয়ের মা-বাবার কাছে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাটা অনেক বড় ব্যাপার। অনিশ্চিত জীবনের দিকে কেই-বা যেতে দিতে চায় তাদের সন্তানকে। ফারিয়া তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, দুজনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে, একটা না একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মা-বাবার একই কথা, সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্র ছাড়া মেয়েকে কারও হাতে তুলে দেবেন না তারা। আর তাদের মতে, শফিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করছে, কবে চাকরি পাবে তার কোনো ঠিক নেই। তার চেয়ে এখনই প্রতিষ্ঠিত এমন ছেলে যখন পাওয়াই যাচ্ছে, তাকে আর হাতছাড়া করা কেন? ফারিয়া তার এক জেনারেশন আগের মা-বাবাকে বোঝাতে অক্ষম।

Series Navigation<< <strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব নয়</strong><strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব এগারো</strong> >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *