উপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দুই

 

২.

বাড়ির সামনের রাস্তাটা সোজা অনেক দূর চলে গেছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে একদম আধা মাইল পর্যন্ত মাঠ অবধি। তারপর কিছুটা সরু হয়ে বাঁয়ে। ওই মাঠেই বেশ কিছু জমিজমা রহিম মিয়ার। শহরে ঠিকাদারি করে বেশ জমি কিনেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে তার বাবার সম্পত্তিও ছিল কিছু। সব মিলিয়ে এখন অনেক জমিজমা রহিম মিয়ার। মেঠোপথটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, ওখান থেকেই তার জমির সীমানা শুরু। রহিম মিয়া এখন আগের মতো ঠিকাদারি করেন না। কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। বয়স হয়ে যাচ্ছে আর এত জমিজমাও দেখে রাখার জন্য অনেক সময় দিতে হয়। সে জন্য টুকটাক দু-চারটা কাজ করেন বছরে। আসলে এখন আর তার ঠিকাদারি না করলেও চলে। এত দিনে যে সম্পত্তি করেছেন, তা দিয়েই ভালোভাবে চলে গিয়েও বেশ উদ্বৃত্ত থাকে। এখন হেমন্তের শেষ দিক। ধান কাটা শেষ পর্যায়ে। নিজে তদারকি করে রহিম মিয়া যেসব জমিতে ধান ফলান, সেগুলোই দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। আর যেগুলো বর্গা দেওয়া, সেসব জমিরও খোঁজখবর করতে হয় তাকে।

কিছু কিছু বর্গাদার না হলে ঠিকমতো ফসল দেয় না। বেশির ভাগই অবশ্য হিসাবে ঠিকঠাক। দু-একজনের জন্যই তদারকিটা করা লাগে। বেলা পড়ে এসেছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে তেরছা হয়ে রোদ আসছে। রহিম মিয়া বাড়ির দিকে ফিরছিলেন, তার সঙ্গে বাট্টু মতিন। মতিনের উচ্চতা স্বাভাবিক। গড় উচ্চতার চেয়ে কম না। তবু কেন যে তার নাম বাট্টু মতিন হয়ে গেল সেটা এক রহস্য। মতিন রহিম মিয়ার বাড়ির ছোটখাটো কাজগুলো করে। গরু-ছাগলের দেখাশোনা করে। টুকটাক বাজার-সদাইও প্রায় তাকেই করতে হয়। আর কাজ না থাকলে রহিম মিয়ার আশপাশে থাকে। আজ যখন রহিম মিয়া মাঠের দিকে যাচ্ছিল, মতিন নিজ থেকেই তার সঙ্গে জুটে গেছে।

রহিম মিয়াকে মতিন বলে খালুজান। মতিনের বয়স যখন ছয়-সাত বছর, তখন থেকেই এই পরিবারের সঙ্গে আছে সে। হয়তো দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয়তা আছে রহিম মিয়ার স্ত্রী রওশন আরার সঙ্গে। প্রায় আট বছর সে এখানে আছে। যমুনার এক চরে ছিল মতিনদের বাড়ি। একসময় হয়তো কিছু জায়গা-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু যমুনার পাড়ে অনেক মানুষের মতো তাদের জীবনে একদিন দুর্ভাগ্য নেমে আসে। এক রাতেই বসতবাড়িসহ সব জমি চলে যায় নদীর ভেতর। মতিনের মা তার অন্য সন্তানদের নিয়ে চলে যায় শহরের দিকে। যদি কোথাও কাজটাজ পাওয়া যায়, সেই আশায়। মতিনকে রেখে যায় তার দূরসম্পর্কের বোন রওশন আরার কাছে। এতগুলো মানুষের খাবার সে একা কীভাবে জোগাড় করবে, এই ছিল তার প্রধান ভাবনা। বাবার কোনো স্মৃতি নেই মতিনের মনে। শুনেছিল, খুব ছোটবেলায় তার মাকে রেখে সে দূরের কোনো শহরে চলে গেছে বিয়ে করে। খালুজানকে সে বাবার দৃষ্টিতে দেখে। খালুজানও মতিনের দিকে বেশ খেয়াল রাখে। সব মিলিয়ে এই সংসারে সে বেশ ভালোই আছে। মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ে না তার। সে কোথাও যেতেও চায় না।

রহিম মিয়ার মন আজ বেশ ফুরফুরে। এ বছর সামান্য বন্যা হয়েছিল। জমিতে প্রচুর পলি পড়ায় ধান এবার বেশ ভালো হয়েছে। ধানের দামও এবার ভালো পাওয়া যাবে। বর্গাদারেরা বেশির ভাগ জমির ধান দিয়ে গেছে। ওরাও খুশি। আসলে ফসল ভালো হলে সবারই ভালো লাগে। রহিম মিয়া খুশি খুশি মনে জমি থেকে বাড়ির দিকে আসছিলেন। তার সঙ্গে মতিন। পথে দেখা হলো ইউসুফ শেখের সঙ্গে। রহিম মিয়ার মতো অত জমি না থাকলেও ইউসুফ শেখের অনেকটা জমি এই ডাঙ্গায়। তবে ইউসুফ শেখের অন্য ব্যবসাও আছে। সিজনে কাঁচামাল কিনে মজুত করে, যখন বেশি দাম পাওয়া যায়, সেই সময়টায় সে বাজারে ছাড়ে। তাতে লাভ কম নয়। তবে সে শুধু টাকা বানানোর ধান্ধায়ই থাকে। ছেলেমেয়েগুলোকেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছে অল্প বয়সেই। তার কথা, লেখাপড়া করে আর কয় টাকা বেতন পাবে। তার চেয়ে অল্প বয়সেই ব্যবসাটা শিখে নিতে পারলে বেশি ধনসম্পদের মালিক হওয়া যায়। রহিম মিয়াকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল ইউসুফ। বলল, ‘কী মিয়ার বেটা, কেমন আছেন?’ রহিম মিয়া বললেন, ‘ভালো আছি শেখের পো। আপনার খবর কী? ধানের ফলন কেমন?’
‘আর বইলেন না, ধান তো ভালোই। তবে বর্গাদাররা চুরি করতে চায়। এই অজুহাত, সেই অজুহাত।’
রহিম মিয়া হাসলেন। বললেন, ‘সবাই তো আর সমান নয়। সব বর্গাদারও এক নয়। একটু হেরফের তো হবেই।’
‘হ, সেইটা আপনি ঠিকই বলছেন। একটু তদারকি করতে যাইতেছি। কাছে না থাকলে ঠিকঠাক ফসল পাওয়া যায় না।’
‘হ, উত্তরের জমিটায় যে কালিজিরা ধান লাগাইছিলেন ওইটার ফলন কেমন?’
‘মাশাল্লাহ, ভালো ধান হইছে। ওইটাও দেইখা আসব এখন।’
‘শেখের পো, তাইলে ওই জমির কয়েক মণ ধান আমারে দিয়েন। আমার পোলাটা খুব পছন্দ করে ওই জমির ধানের চাল।’
ইউসুফ শেখ বলল, ‘শফিক বাবাজির কথা বলতেছেন? ওর জন্য তো আমি এমনিই আপনারে মণখানেক ধান দেব। এত বিদ্বান পোলা এই গ্রামে আর কটা আছে।’
ইউসুফ শেখ জানে গ্রামের কৃষক মানুষ সে লেখাপড়ার সূক্ষ্ম বিষয়গুলো জানে না। শুধু জানে, শফিক এলাকার স্কুল-কলেজ থেকে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা ছাত্র। এ রকম ছাত্রদের ভর্তি করার জন্য শহরের প্রতিষ্ঠানগুলো মুখিয়ে থাকে। শহরের তেমনই এক ভার্সিটিতে শফিক পড়ে। সেখানেও তার রেজাল্ট বেজায় ভালো। পড়ালেখা শেষ করে সে বড় বিজ্ঞানী হবে, এমনটাই বলে এলাকার মানুষ। নিজের এলাকার ছেলের এই কীর্তিতে যেন ইউসুফ শেখের বুক ভরে যায়।
ছেলের কথায় রহিম মিয়ার বেশ গর্ব হয়। তিনি হাসেন। বলেন, ‘না না। দুই মণে হইব না আমার। বেশি লাগব। আমি আপনারে দাম দিয়া দেব। তিন-চার মণ ধান লাগব আমার।’
‘আচ্ছা, সে দেওয়া যাবে। ছেলেটা আছে কেমন? পড়ালেখা কদ্দূর?’
‘আপনাগো দোয়ায় ছেলে খুব ভালো আছে। আর ছয়-সাত মাসের মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে একবার আইসা বেড়ায় যাইতে কইছি।’
‘হ, মেলা দিন আসে না সে। মেলা দিন সাক্ষাৎ নাই। দেখা হইলে খুব সম্মান করে আমারে। আপনার পোলাডা খুব ভালো, মিয়ার বেটা।’

ছেলেটা যে তার খুব ভালো এটা রহিম মিয়া জানেন। একটা বাড়তি টাকা নেয় না। শহরে গিয়ে আদব-কায়দা ভোলেনি। মুরব্বিদের দেখলে খুব সম্মান করে। গ্রামে কারও সঙ্গে কোনো দিন বেয়াদবি করেনি। তার ছেলের সুনাম সব জায়গায়। স্কুলের শিক্ষকেরাও শফিক বলতে অজ্ঞান।

যমুনাপারের এই এলাকাটা একদম গ্রাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে শুধু একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুল। এক গ্রাম পরে আছে একটা হাইস্কুল। আর কলেজ সেই একেবারে বগুড়া শহরে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবু সব বাড়িতে এখনো বিদ্যুৎ লাইন লাগেনি। ঝড়বৃষ্টি-বন্যায় এখানকার মানুষ খুব অসুবিধায় পড়ে। নিচু জমিতে যাদের বাড়ি, দিনমজুর ধরনের মানুষ যারা, এসব দুর্যোগে তারা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু রাস্তাটায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নয়তো, বন্যার দুই মাস উঁচুতে বাড়ি এমন আত্মীয়ের আশ্রয়ে গিয়ে ওঠে। এখানে কলেজ পাস করা ছেলেই হাতে গোনা। এক গ্রাম পরে চেয়ারম্যানবাড়ির দুটো ছেলে আর সেই গ্রামেরই অন্য বাড়ির একটা মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এ ছাড়া এখানকার শিক্ষার চিত্র খুব একটা ভালো নয়।

প্রকৃতি আর দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতেই মানুষ জীবন কাটিয়ে দেয়। তবে আগের তুলনায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার বেশ ভালো। স্কুলের বয়সী বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই স্কুলে পড়তে যায়। সরকার বৃত্তির ব্যবস্থা করায় আশানুরূপ সাড়াও পাওয়া গেছে। তবে যমুনার ভেতরের চরগুলোতে মানুষের জীবন খুব মানবেতর। সেখানেও অনেক মানুষ থাকে। এই মানুষগুলো একেবারে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। নৌকা ছাড়া চরগুলোতে যাতায়াতের অন্য কোনো পথ নেই। সপ্তাহে এক বা দুদিন এরা বাইরে বের হয়। বাইরের মানুষের সঙ্গে দেখা হয় প্রায় এক দেড় ঘণ্টা নদীপথে যাওয়ার পর স্থানীয় কোনো বাজারে। এ ছাড়া প্রায় বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলো। তাই যমুনাপারের মানুষের সঙ্গে এই চরের মানুষগুলোর জীবনের পার্থক্যও অনেক। এরা নিতান্তই বেঁচে থাকার অন্য উপায় না থাকায় এই চরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

Series Navigation<< উপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব এক<strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব  তিন</strong> >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *