উপন্যাস

উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব সতেরো

১৭.

প্রথম দুই-এক রাত ঘুমানোর সমস্যা হলেও এরপর শফিকের নিয়মিত ঘুম হতে লাগল। ধীরে ধীরে এই নির্জন প্রকৃতিকে তার খুব আপন লাগতে শুরু করে। যেন এই জলহাওয়ারই সন্তান সে। যেন এই চরের জীবনে সে একেবারেই অভ্যস্ত। এই পরিবেশের সঙ্গে এত অল্প দিনেই যে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবে, সেটা সে ভাবেনি। অবশ্য শুধু ঘুম নয় অন্যান্য দৈনন্দিন কাজকর্মেও এখানে অ্যাডজাস্ট করাটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আন্তরিকতা, দৃঢ় ইচ্ছা আর একাগ্র সাধনা থাকলে সব হয়। 

প্রান্তের মানুষদের বড় সমস্যা হলো যোগাযোগ। সবকিছু থাকার পরও যোগাযোগহীনতার কারণে এরা অনেক দিক দিয়ে ঠকে যায়। যে জিনিসটা ভোক্তা পর্যায়ে দাম ১০০ টাকা, উত্পাদক সেটা বিক্রি করে ১০ টাকায়। ভয়াবহ এই বৈষম্যের একমাত্র কারণ যোগাযোগহীনতা। ক্রেতার সঙ্গে উত্পাদকের যোগাযোগ যদি সরাসরি আর তাত্ক্ষণিক হতো তাহলে উত্পাদকও বেশি দাম পেত এবং ক্রেতাও কম দামে জিনিস কিনতে পারত। শফিকের মনে ভাবনাটা এল এই চরের মানুষ প্রতিটি ফসলের দাম কম পাচ্ছে সেটা জানতে পেরে। সোলার প্যানেল লাগানোর প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। এখানে নেটওয়ার্ক মোটামুটি ভালো। শফিক তার আউটসোর্সিংয়ের কাজগুলো শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে তার নিজের খরচ চালানোর জন্য তেমন বেশি বেগ পেতে হবে না।

রহমত আলীর দুই ছেলে এই স্কুলে পড়ে। ছেলেগুলো বেশ চটপটে। শহরের স্কুলে পড়লে এত দিন তাদের মেধা নিয়ে হয়তো পত্রিকায় খবর হতো। নেহাত এই অজপাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে বলে ওদের কেউ চেনে না। শুধু রহমত আলীর ছেলে নয়, এখানকার অনেক ছেলেই মেধাবী। এদের মধ্যে জানার আগ্রহ অনেক। এটাকেই যদি কাজে লাগানো যায় এই স্কুলকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। স্কুলে প্রথম দিন ক্লাস নেওয়ার পর থেকেই শফিকের উত্সাহ বেড়ে যায়। এই চরকে সে নিজের মতো করে সাজাবে বলে মনস্থির করে। আর এই ছেলেদের শিক্ষিত করার জন্য হলেও এদের পরিবারের জন্য কার্যকর কিছু একটা করতে হবে। শফিক বিষয়টা নিয়ে একদিন আলিমুল স্যারের সঙ্গে আলাপ করে। আলিমুল স্যার জানান, এই চরের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ফসলের বিক্রি নির্ভর করে কয়েকজন লোকের হাতে। তারা বগুড়া শহর থেকে আসে ও নিজেরা নিজেরা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে এখানকার কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কিনে নেয় এবং বলাই বাহুল্য এটা স্থানীয় বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম। আর ঢাকার বাজারের চেয়ে অনেক অনেক কম। দেখা যায়, রাজধানীর কাছাকাছি যে কৃষকেরা থাকেন, তারা এদের চেয়ে কম ফসল ফলিয়ে আয় করেন এদের প্রায় তিন গুণ। শফিক ও আলিমুল স্যার হিসাব করে দেখেছেন, এই চরের ফসল প্রায় সাত-আট হাত ঘুরে তারপর একজন ভোক্তার কাছে যায়। এ কারণেই ভোক্তাপর্যায়ে দাম আকাশছোঁয়া হলেও কৃষকপর্যায়ে উত্পাদন খরচই মাঝে মাঝে ওঠে না। শফিক স্থানীয় কৃষকদের একদিন ডাকল। তাদের সমস্যার কথা শুনল। এখানকার যারা চাষি, তাদের অনেকেই স্থানীয় ক্রেতাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়। ঋণের সময় শর্ত থাকে ফসল ঘরে উঠলে তাদের কাছেই এগুলো বিক্রি করতে হবে। আর ওরা এমন চড়া সুদে ঋণ দেয় যে, তা মেটাতে এখানকার কৃষকেরা হিমশিম খায়। এই প্রায় নিরক্ষর কৃষকেরা ব্যাংকের সঙ্গে কারবার করার মতো সাহসী হয়ে ওঠেনি। শফিক এদের ফসল সরাসরি কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করে দিল। পুরো প্রক্রিয়া হবে অনলাইনে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এখানকার ফসল দেখে পছন্দ করবে ওখানকার ব্যবসায়ীরা। তারপর তারা দামদস্তুর করে বিক্রি নিশ্চিত করবে। চরের যে কটি মোবাইল ফোন ছিল, সেগুলোর মাধ্যমেই এসব প্রযুক্তিগত যোগাযোগ শুরু হলো। যার ফোন নেই অন্যেরা তাকে ফোন ধার দিচ্ছে।

শফিকের ফোন থেকেও এসব মানুষ ঢাকার কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আপাতত যেটুকু প্রযুক্তি তাদের আছে, তাই নিয়েই কাজ শুরু হলো। এরপর আরও স্মার্টফোন কেনা হবে, চরের মানুষেরা অল্প দিনেই এর ব্যবহার শিখে গেছে। শফিক যতটা ভেবেছিল, তার চেয়েও দ্রুতগতিতে এই মানুষগুলো প্রযুক্তির ছোটখাটো দিকগুলো শিখে ফেলল। এই প্রক্রিয়ায় ফসলের প্রায় তিন গুণ দাম বাড়াতে সক্ষম হলো কৃষকেরা। তারা যাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল, সেগুলো শোধ করে দিতে লাগল দ্রুতই। আর নতুন করে কেউ ঋণ নিল না। কারও ইমার্জেন্সি টাকার দরকার হলে শফিক বগুড়া সদরের ব্যাংক থেকে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দিত। অথবা স্থানীয় কেউ বিনা সুদে টাকা ধার দিত। মহাজনদের সুদের বেড়াজাল থেকে অনেক দিন পর মুক্তি পেল তারা। আগে যেখানে তাদের দুই বেলা খাওয়াই হতো না, এখন শফিক আসার পর এই চরের মানুষ সচ্ছলতার মুখ দেখছে।

সেদিন আলিমুল স্যার আর শফিক কথা বলছিল, আলিমুল স্যার খুব খুশি তার এই প্রাক্তন ছাত্রের কর্মকাণ্ডে। স্যার শফিককে বললেন, ‘এত অল্প দিনে তুমি এই চরের মানুষদের আপন করে নিতে পারবে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি শফিক।’

শফিক মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার দোয়া থাকলে আমরা আরও অনেক দূর যেতে পারব স্যার।’

‘দোয়া তো বাবা সব সময়ই করি। আমি যে কাজ কখনোই করতে পারতাম না, তুমি সেটা এই কয় মাসেই করে দেখিয়েছ। ছাত্রছাত্রীরাও এখন আমার চেয়ে তোমাকে বেশি পছন্দ করে।’

‘কী যে বলেন স্যার! এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ আপনাকে দেবতার মতো দেখে। এসব তো আপনার জন্য হয়েছে। আপনি যদি আমাকে আপনার সঙ্গে থাকার সুযোগ না দিতেন, আমি কি এগুলো করতে পারতাম?’

‘না বাবা। আমি জানি, তোমাদের মতো তরুণেরা যা এক বছরে করতে পারো, আমরা বুড়োরা সেটা এক যুগেও করে উঠতে পারি না। আর তুমি তো আমার ছাত্র। তুমি আমাকে ছাড়িয়ে গেলে আমিই সবচেয়ে খুশি হব। ছাত্র আর পুত্রের কাছে পরাজয় বড় মধুর।’

‘আপনার স্বপ্নকে যেন অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারি, সেই চেষ্টাই থাকবে স্যার। আর আপনি তো আমার মাথার ওপরে আছেনই। আপনি থাকলে আমি কোনো কিছু নিয়েই আর চিন্তা করি না।’

‘এই গ্রামের মানুষ তোমাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। এত তাড়াতাড়ি তুমি যে তাদের ভাগ্য বদলে দেবে, সেটা আমিও ভাবতে পারিনি।’

‘স্যার, আপনিই তো আমাকে সঙ্গে নিতে চাইছিলেন না।’

আলিমুল স্যার হেসে উঠলেন তার প্রিয় ছাত্রের কথায়। ‘হা হা হা, আমি ভেবেছিলাম তোমার ভবিষ্যতের জন্য এটা ভালো হবে না। কিন্তু সেই ভাবনা যে ভুল ছিল, সেটা তুমি প্রমাণ করে দিয়েছ। এই ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন যেকোনো জায়গা থেকেই কাজ করা সম্ভব, সেটা তুমি দেখিয়েছ।’

আসলেই এই দুর্গম চরে বসে অনেকেই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছে এবং সেটা কাজে লাগাচ্ছে। চরের মানুষ ইউটিউবে ভিডিও দেখে নতুন নতুন আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে। তাতে তাদের ফসল আগের চেয়ে বেশি ফলছে। ফসলের রোগবালাইয়ে তারা নিজেরাই চিকিত্সা করতে পারছে। যে জমিতে একটি ফসল হতো, সেখানে দুটি বা তিনটি ফসল ফলানো যাচ্ছে। যারা গরু-ছাগল; হাঁস-মুরগি পালন করছে তারাও বেশ লাভ করছে। যেকোনো কিছু সমস্যায় পড়লে তারা শফিকের কাছে ছুটে আসছে। শফিকও হাসিমুখে সবার সব অভিযোগ, সমস্যা শুনছে। নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল হলে সেটার সমাধানও করে দিচ্ছে দুই শিক্ষক। একজন প্রবীণ আরেকজন নবীন। চরের মানুষের মুখে এখন হাসি ফুটেছে। স্কুলের বাচ্চারা এখন চক-ডাস্টারের পাশাপাশি শফিকের ল্যাপটপের মাধ্যমেও ক্লাস করছে। স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনেক সমস্যার সমাধান তারা নিজেরাই খুঁজে বের করছে। শফিক শুধু তাদের নির্দেশনা দেয়। এরপর তারা নিজেরাই সব করতে পারে। যেসব বাড়িতে মা-বাবা এখনো ফোন ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি, সেসব ক্ষেত্রে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, সহায়তা করছে। সব মিলিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই চরে একটা বিরাট পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এই চরকে আর ছয় মাস আগের চর বলে চেনা যাচ্ছে না।

মতিন একদিন চুপি চুপি এসে শফিকের সঙ্গে দেখা করে গেছে। আসলে শফিকের মা রওশন আরাই তাকে পাঠিয়েছিলেন ছেলের খোঁজখবর নিতে। ছেলেকে দীর্ঘদিন না দেখে রওশন আরার মন ভীষণ ছটফট করছিল। ছেলের প্রিয় কিছু খাবার আর পিঠা দিয়ে তাই মতিনকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। শফিক চলে যাওয়ার পর থেকে রওশন আরা খুব মনমরা হয়ে থাকেন। কারও সঙ্গে তেমন একটা কথা বলেন না। শফিকের বাবা বিষয়টা বুঝতে পারলেও তার ধারণা ছিল ওই দুর্গম চরের মধ্যে শফিক টিকতে না পেরে একসময় নিজেই চলে আসবে অথবা ঢাকায় চলে যাবে। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন এর কোনোটাই হয়নি, তখন তিনিও বিপদে পড়ে গেলেন। এখন না পারছেন ছেলেকে নিয়ে আসতে, না পারছেন ছেলের মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। মতিনের খুব পছন্দ হয়েছে এই বদলে যাওয়া চরের পরিবেশ। তার খুব ইচ্ছে করছিল শফিকের কাছে থেকে যেতে। কিন্তু বাড়িতে তো ফিরতেই হবে। এই গণ্ডগোল না থাকলে সে এখানে দুই-চার দিন বেড়াতে পারত। এখানকার মানুষগুলোকে কেমন আলাদা লাগে মতিনের। শফিক মাস্টারের বাড়ির লোক বলে দোকানদার থেকে শুরু করে খেয়ার মাঝি পর্যন্ত তাকে খুব সমাদর করল। মাঝি এমনকি তার কাছ থেকে পারাপারের টাকাটা পর্যন্ত নিল না। তার ভাইজানকে এখানে এত সম্মান করে দেখে গর্বে তার বুক ভরে গেল। ভাইজান তাকে অনেক আদর করল। আসার সময় অনেকগুলো টাকাও সে গুঁজে দিল মতিনের হাতে। সে যে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছে, সেটা তার কথায় বোঝাই গেল না। যেন এমনিই এখানে আছে সে। শফিকের অবশ্য তেমন কোনো ক্ষোভ নেই কারও প্রতি। আসলে তার মা-বাবার জায়গায় সে হলেও হয়তো এমনটাই করত। প্রথম প্রথম কয়েক দিন সবার ব্যবহারে তার খারাপ লাগলেও পরে শফিক যখন চিন্তা করে দেখেছে, তার অতটা খারাপ লাগেনি। এ রকম একটা প্রত্যন্ত চরে পড়ে থাকা কেউ মেনে নিতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর মা-বাবা তো সন্তানের ভালো চাইবেনই। শফিকের মা-বাবার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সে বিরাট কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবে। সারা দেশের লোক তাকে চিনবে। এলাকায় তাদের অনেক সুনাম হবে। কিন্তু সেটা না হয়ে শফিক যখন প্রত্যন্ত চরের একটা স্কুলে শিক্ষকতার জীবন বেছে নিল, সেটা তারা কেউ ভাবতেও পারেনি। এলাকার মানুষও এসব নিয়ে আজেবাজে কথা বলে।

১৮.

এই চরের স্কুলের সুনাম এখন আশপাশের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। যমুনার অন্য চরগুলো থেকে ইদানীং শফিকের কাছে মানুষজন নানা পরামর্শের জন্য আসছে। এ রকম একটা প্রত্যন্ত চরও যে বদলে দেওয়া যায়, ডিজিটাল করে ফেলা যায়, সেটাই এখানকার মানুষজনকে খুব নাড়া দিয়েছে। আশপাশের চরগুলোও এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এই চরের মানুষদের এখন বগুড়া সদরের লোকেরা পর্যন্ত সমীহ করে, সম্মান করে। শফিকের বাবা রহিম মিয়াকে আগেও লোকে মান্যগণ্য করত। কিন্তু এখন হঠাৎ করে তিনি টের পেলেন সম্মানের পরিমাণটা যেন অনেক বেড়ে গেছে। আশপাশের লোকজন যেন সালামটা বেশি দিচ্ছে ইদানীং। রহিম মিয়া কারণটা বুঝতে পারেননি অনেক দিন। প্রায় দিনের মতো আজ সকালেও তিনি জলিলের চায়ের দোকানে গিয়েছিলেন। জলিলের দোকানটা বড়, একচালা ধরনের চায়ের দোকানগুলোর মতো নয়। এখানেই তারা কয়েকজন সমবয়সী লোকজন আড্ডা দেন। মুরব্বি-অধ্যুষিত এই দোকানে সন্ধ্যার পর ছেলে-ছোঁকরারা বসার সুযোগ পায় না। এলাকার যুবকেরা যদি দেখে রহিম মিয়াদের কেউ দোকানে এসেছেন, তারা জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশের অন্য কোনো দোকানে চলে যায়। তো, জলিলের দোকানে বসার পর একে একে সবাই এল। সবশেষে এল মহিউদ্দিন শেখ। মহিউদ্দিন শেখ খুব ঠোঁটকাটা লোক। সচরাচর লোকের প্রশংসা তার মুখে শোনা যায় না; বরং মুখের ওপর মানুষের নিন্দামন্দ করাই তার বৈশিষ্ট্য। এ জন্য মহিউদ্দিন শেখকে তার বন্ধুস্থানীয় লোকেরা পর্যন্ত সমঝে চলে। আড্ডা কেবল জমে উঠেছে এ সময় মহিউদ্দিন শেখ ঘোষণা দিল, ‘আজকের আড্ডার সব খরচ রহিম মিয়ার।’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবাই তার দিকে আর রহিম মিয়ার দিকে তাকাল। রহিম মিয়া বললেন, ‘সে না হয় খাওয়ালাম, সেটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু কারণটা কী?’

মহিউদ্দিন বলেলেন, ‘কারণ আছে। পত্রপত্রিকা তো পড়েন না। পড়লে আর কারণ জিজ্ঞেস করতেন না।’

এবার সবাই নড়েচড়ে বসল, কিবরিয়া বললেন, ‘মানে কী! এর মধ্যে আবার পত্রপত্রিকা এল কোথা থেকে!’

তখনই হাতের পত্রিকাটায় শফিকের ছবি আর তাকে নিয়ে ছাপা হওয়া একটা ফিচার রহিম মিয়াকে দেখিয়ে মহিউদ্দিন বললেন, ‘দেখেন মিয়া, আপনের ছেলে কী করছে! ওই রকম একটা চরের মইধ্যে গিয়া মানুষের পাশে দাঁড়াইছে, তাদের ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নিছে, আর আপনে বাপ হইয়া তার খবর জানেন না?’

দ্রুত পত্রিকাটা নিয়ে রহিম মিয়া ফিচারটা পড়তে শুরু করলেন। তার জীবনে এত খুশি তিনি বোধ হয় আগে কখনো হননি। এই পত্রিকায় ছবি আর খবর ছাপা হয়েছে, সেটা তিনি এতক্ষণ পরে জানলেন! অথচ ছেলেটাকে তিনি এক রকম বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। সেই ছেলে যে এ রকমভাবে তার মুখ উজ্জ্বল করবে, সেটা তিনি ভাবতেও পারেননি।

‘কী ভাবেন?’ রহিম মিয়াকে চমকে দিয়ে মহিউদ্দিন বললেন।

আনন্দে প্রায় চোখে জল এসে গিয়েছিল রহিম মিয়ার। সামলে উঠে বললেন, ‘ছেলেটা যে এত ভালো একটা কাজ করতেছে, সেইটা বুঝতে পারি নাই। কত বকাঝকা করছি।’

‘ঠিকই বলছেন। এই সময়ের ছেলেরা কিছু করতে গেলে আমরা হায় হায় করে উঠি। ছেলেদের কথা শুনতে চাই না। আমরা ভাবি ওরা কিছু বোঝে না। কিন্তু ওরাই আমাদের চেয়ে ভালো বোঝে অনেক বিষয়।’

‘হু, তাই তো দেখতেছি। শফিক আমারে ভুল প্রমাণ করে দিছে।’

এরই মধ্যে সবাই রহিম মিয়ার কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে খবরটা পড়তে শুরু করল। এমন ছেলের প্রশংসা করল উপস্থিত সবাই। রহিম মিয়া খুশিমনে সবাইকে চা খাওয়ালেন, পাশের বাজার থেকে মিষ্টি এনে খাওয়ালেন। তার আনন্দ আর ধরে না। তিনি ভেবেছিলেন, ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। আর ভাববেন নাই-বা কেন? এলাকার লোকজন, তার পরিচিতরা এত দিন তাকে নানা কটুকথা বলে এসেছে। ছেলে শহরে কী এমন পড়ালেখা করল যে চাকরি পায় না? গ্রামে এসে বসে আছে কেন? সে কি একেবারে চলে এসেছে নাকি আবার শহরে যাবে? পাস করতে পারেনি পরীক্ষায়? এ রকম হাজারটা কথা প্রতিনিয়ত হজম করতে হয়েছে রহিম মিয়াকে। যত শুনেছেন, ছেলের প্রতি তার রাগ ততই বেড়েছে। তা ছাড়া তিনি নিজে অত পড়ালেখা করেননি যে শফিকের বিষয়টা বুঝবেন। তার কেবলই মনে হয়েছিল, ভার্সিটি পাস করে ছেলের পাখা গজিয়েছে। কিন্তু আবার মনে মনে একটা বিশ্বাস রহিম মিয়ার ছিলই। তিনি জানতেন তার ছেলে খারাপ কিছু করতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হতো ছেলে বুঝি ওখানে টিকতে না পেরে ফেরত চলে আসবে। কিন্তু আজকের পত্রিকার খবর যেন এলাকার সব মানুষের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। যাদের কাছে শফিক এত দিন জিরো ছিল, আজ হঠাৎ করেই সেই তারা শফিককে হিরো বানিয়ে মাথায় তুলে নাচছে। রহিম মিয়া বুঝলেন দুনিয়াটাই এমন, যে সফল তার পাশেই সবাই। ব্যর্থদের পাশে কেউ নেই।

ভেবেছিলেন শহরের দিকের কাজ সেরে রহিম মিয়া বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু এই আনন্দের সংবাদে সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। রহিম মিয়া বাজার থেকে অনেক মিষ্টি কিনলেন। যে পত্রিকায় শফিকের ছবি ছাপা হয়েছে তার অনেকগুলো কপি কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। পত্রিকার কপি দেখিয়ে রহিম মিয়া রওশন আরাকে সব খুলে বললেন। রওশন আরা খুশিতে কেঁদে ফেললেন। বারবার বলতে লাগলেন, আর দেরি নয়, ছেলেকে তিনি যত দ্রুত সম্ভব দেখতে চান। মতিন এই খুশির সংবাদে লাফাতে লাগল। ছোট বোন আদর মায়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। রওশন আরা দীর্ঘদিন ছেলের অদর্শনের কারণ হিসেবে রহিম মিয়াকে দোষ দিচ্ছেন আর বলছেন ‘আমি জানি না, আমার ছেলেকে তুমি আমার কাছে এনে দাও।’ স্ত্রীর আবেগটা রহিম মিয়া বুঝতে পারেন। ছেলের জন্য তারও কী খারাপ লাগে না। তিনিও তো বাবা। কিন্তু বাবাদের কাঁদতে নেই। বুকে পাথর চেপে সব কষ্ট আর আবেগ লুকিয়ে রাখতে হয় তাদের।

Series Navigation<< <strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব পনেরো</strong><strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব উন্নিশ</strong> >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *