সাক্ষাৎকার।। শিল্প তৈরি হয় জীবন বোধের অবগাহন শেষে।। স্বরলিপি

স্বরলিপি। যার সাহিত্যকর্মে রাজনীতি, জীবনবোধ, মৃত্যু, দর্শনের একটি মিছিল দাবি আদায়ের সংকল্প নিয়ে চলছে। কালো পিচের ব্যস্ত রাজপথ জুড়ে অলংকারের দৃঢ় মসৃণতা মুগ্ধ করছে সকল শ্রেণীর পিয়াসুদের। ‘নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল’ এসে ২০১৬ সালে যখন পিঁড়ি পেতে কবিতা উঠানে আঁচল বিছায়, তখন থেকে নৃত্যের দোল খাচ্ছে অম্রফুল। সেই দোলেই আড্ডা দিতে শব্দনীল বসে গেলো তার সঙ্গে। সাহিত্যকর্মের নানা কলার নানা রূপ নিয়ে ঝড়ঝড়ে কথায় জানা গেলো ঘাত-প্রতিঘাত এবং ভবিষ্যত।  অকপটেই মুখ খুললেন তিনি কাব্যশীলন-এর প্রশ্নে।

কাব্যশীলন: গল্পগ্রন্থ ‘নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল’ প্রকাশের আগে স্বরলিপিকে তৈরি করার একটি পথ অতিক্রম করেছেন। এই পথযাত্রার অভিজ্ঞতা বলুন-

স্বরলিপি: লেখক হচ্ছে বিচিত্র অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু লেখার চেষ্টা করেন। এটা কখনো দেখা, বোঝা-পড়া বা দর্শন। লেখার রসদ আশেপাশের মানুষ সমাজ ও বাস্তবতা থেকে আসে। আমার মনে হয়, সমাজ-বাস্তবতার একজন মুখপাত্রের মতো কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করেন লেখক। যদিও সফলতা আর ব্যর্থতার বিচার করে সময় এবং বেঁচে থাকার আনুসঙ্গিক উপাদান। নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল লিখতে গিয়ে দ্বারস্থ হয়েছি সমাজের মানুষের কাছে-তাদের ভাবনার কাছে এবং নিজের হৃদয়ের কাছে।

লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছি অচেনা ঢাকায়। মাত্র এইচএসসি পাস করে ঢাকায় আসা, অনার্স-মাস্টার্স ঢাকাতেই। প্রথমে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিযেছিলাম, চান্স পাইনি। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা। মূল সময়টা যাপন করেছি- লেখক হওয়ার চেষ্টায়। এই চেষ্টার বড় একটা অংশ ‘অর্বাক’। গল্পে অনেকের জীবন একা যাপন  করার সুযোগ আছে। সবগুলো চরিত্রে ডুব দেওয়া যায়। তাদের হয়ে কথা বলা যায়, নিরবতা যাপন করা যায়। গ্রাম থেকে চলে আসার পর, দূর থেকে ফেলে আমার সমাজ, সেই সমাজের জীবনাচারণ, মানুষ এবং তাদের দর্শন যেন বেশি দেখা গেল। তার সঙ্গে শহুরে সমাজ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা আর আচরণের প্রভাব নিয়ে লিখলাম ‘নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল’। যদিও বেশি কবিতা লেখা হতো। কিন্তু অর্বাকে কবিতার থেকে বেশি সমাদৃত হলো গল্প। প্রথম বই গল্পের।

এই শহর ছেড়ে যাওয়ার মতো উপলক্ষ জীবনে কয়েকবার এসেছে কিন্তু যাইনি। প্রথমে বাবা যখন জানতে পারেন আমি ঢাকায় আমাকে কিছু বলেননি। কিন্তু মাকে বলেছেন, মামাকে বলেছেন।

আমি ঢাকায় আসার পর আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত মা অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পাড় করেছেন। তাকে বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হয়েছে। ২০০৭ সালের শেষের দিকে ঢাকা আসি, ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে বিয়ে হয়। এই মধ্যবর্তী সময়ে আমি আমার পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজনদের কাছে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা একরকম হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধুমাত্র আমার ছোট কাকু সেই সময়টাতে নিয়মিত খোঁজ রাখতেন, আর্থিক সহায়তা দিতেন। বাবা কথা বলতেন কম, সময়মতো টাকা পাঠাতেন। নিজে টিউশনি করতাম। হীনমন্যতা গ্রাস করে ফেলেছিল, একটু একটু করে টেনে তুলতে হয়েছে। নিজেস্বতা বিচারের শক্তি সেখান থেকেই পাই। এর প্রতিচ্ছবি নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিলে পাবেন। সমাজের বিভিন্ন স্তর আছে, কেন্দ্র আর প্রান্ত আছে। প্রান্ত বলে যাকে চিহ্নিত করা হয় তাকে কেন্দ্রে ফেলে দেখেছি-অসাধারণ শক্তি তার আছে। কেন্দ্রকে প্রান্তে ফেলে দেখেছি তার শক্তিহীনতার শক্তি। তখন আমার গল্পগুলো তার কেন্দ্রিয় চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তারা প্রত্যেকে এক একটি স্বাধীন দ্বীপ। আমার নায়িকারা তথাকথিত সুন্দরী নন। কিন্তু তারা সুন্দর। আগেই বলেছি আমি মানুষের দ্বারস্থ হয়েছি। ‘লঞ্চডুবির পর’ গল্পটি লেখা শেষ করে অঝোরে কেঁদেছিলাম। ঐ যে ভেসে থাকা লাশ যে বলেছিল, পদ্মায় প্রকাণ্ড ব্রিজ হবে, আমার আর বাড়ি ফেরা হবে না।-এই চরিত্রটি মাঝে মাঝেই ফিরে আসে কথা বলে-চলে যায়। গল্পরা ধ্যানের ফসল-মাঠভর্তি বিশুদ্ধ বাতাসে দোল খায় তার সবুজ ডগা।

নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল অর্বাক থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এটি সম্পাদনার করেছেন কবি মহিম সন্ন্যাসী এবং কবি সূর্য্যমুখী। এর প্রকাশক সিলভিয়া নাজনীন। এর প্রচ্ছদ করেছেন কবি ও চিত্রশিল্পী দ্রাবিড় সৈকত। মোটকথা অর্বাকে যারা আসতেন তারা কোনো  না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত।

কাব্যশীলন: সাহিত্যের পথ চলতে কোনো লেখক, ব্যক্তি বা সংগঠনের প্রভাব আপনার উপর আছে কি?

স্বরলিপি: এই সময়ের বিশিষ্ট লেখক স্বকৃত নোমান ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেই সময়টাতে খুব কাছ থেকে একজন লেখকের জীবনযাপন দেখার সুযোগ তৈরি হয় হয়। তিনি কীভাবে গল্পের প্লট খুঁজে ফেরেন, গল্পের বিষয় নিয়ে কাছের মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করেন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীভাবে পড়েন এসব দেখি। নাসরিন আক্তার নাজু আপা, স্বকৃত নোমানের সহধর্মীনি শুরুতেই বোনের মতো গ্রহণ করেছিলেন। তার স্নেহ পেয়েছি। অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছিলাম নোমান-নাজু দম্পতির সন্তান সাকির কাছ থেকে। সে তখন খুব ছোট্ট। তার সঙ্গে সব থেকে ভালো সময় কাটিয়েছি।- থাকতাম রেডিও কলোনি, সাভারে। সেখান থেকে ধানমণ্ডি এসে ক্লাস করতাম, তারপর ফিরে গিয়ে তিনটি টিউশনি করতে হতো। অনেক সময় ধকল কাটিয়ে উঠতে না পেরে- না খেয়েও ঘুমিয়ে গেছি কোনো কোনো রাতে। ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি বহুবার তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য মা যে সংগ্রাম করছেন গ্রামে তাকে তো আমি ফিরে গিয়ে অপমান করতে পারি না! এখানে মা এবং সময়ের প্রভাবে প্রভাবিত।

‘সমকাল’-এর কাছে আমি ঋণী। এই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক মাহবুব আজীজ ভাই গদ্য ও গল্প লেখার ‘বিষয়’ দিয়েছেন। সেগুলো সমকালে প্রকাশ হয়েছে। সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যখন একজন লেখকের লেখা প্রকাশ করেন তিনি খুব সহজে অনেকের কাছে পৌঁছতে পারেন। অন্যদিকে  আমাকে সহযোগিতা করেছেন রাইজিংবিডির নির্বাহী সম্পাদক, কথা-সাহিত্যিক তাপস রায়।-আর আমার বন্ধুরা। অর্বাকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ফরিদ মাঝি। নিজে নিজেকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায় সে বিষয়ে বিভিন্নরকম বই-পত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। এরপর কখনো পাবলিক লাইব্রেরি, কখনো আর সি মজুমদার হলের কোনো বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুনতে হাজির হয়েছি। অনেক দিন পর্যন্ত সংবিধান নিয়ে আলোচনা করা হয় এমন একটি সংগঠন ‘আ-কথা’য় যুক্ত ছিলাম। আরেকটি সংগঠন এমএমওয়াইসি’-সে সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিয়ে আলোচনা আয়োজন করতো-এগুলোতে যেতাম। সব কিছু মিলিয়েই তো চিন্তার গতি-পথ তৈরি হয়।

কাব্যশীলন: আপনি একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ হয়ে ‘লেখক-লেখিকা’-এই বিভাজনকে কীভাবে দেখছেন?

স্বরলিপি: একবাক্যে বলবো- শব্দের মাধুর্য হিসেবে দেখি। লেখিকা বললে আমার খারাপ লাগে না। নারী হিসেবে পৃথিবীটা দেখার আলাদা অভিজ্ঞতা আছে আমার। নারীর জীবন যন্ত্রণা ভোগ করি, নারীর জীবন মাধুর্য উপভোগ করি। প্রেমে অপেক্ষা-উপেক্ষা যা পেয়েছি তা নারী হিসেবে পেয়েছি। নারী হওয়ার কারণেই পরিবারে শরণার্থী হতে হয়। নিজের চেনা পরিবার, সমাজ, সংসার, উঠান, খাদ্যাভাস সব ছেঁড়ে ছুড়ে আরেক সংসারে যেতে হয়। বাঙালি সমাজের এর ব্যতিক্রম হয় খুব কম। এটা রীতি, একে অস্বীকার করি না। রীতি ক্ষয়প্রাপ্ত হলে এর ভেতর আরেক রীতি মাথাচারা দেয়-এইখানেই দ্বন্দ্বটা। লেখিকা শব্দটি যখন তাচ্ছিল্যপূর্ণ উচ্চারণ হয় তখন ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাঠখড় পুড়িয়ে যিনি লেখেন তিনি তো চাইবেনই বিভাজন ভেঙে পড়ুক। এই তাচ্ছিল্য আরেকটা ক্ষতি করছে নিজের অস্তিত্বকে ছুঁড়ে ফেলার প্রবণতা তৈরি করেছে। তাচ্ছিল্য কে চায়! বিষয়টি হয়ে গেছে এক অপরাধের অন্য শাস্তির মতো। যারা শব্দ বিভাজন ভেঙে ফেলার পক্ষে তারা মূলত চেতনা ও বোধের সাম্য চায়। আবার যারা মেনে নেয় তারা অস্তিত্বের সঙ্গে আপোষ করে।

কাব্যশীলন: কবির সৃষ্টি কবিতা মূলত এক কাল থেকে আরেক কালে ফুলের ঘ্রাণের মতো সৌন্দর্য ছড়ায়। সেক্ষেত্রে ‘উত্তরাধুনিক’ কবিতার ফর্মটি কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারবে বলে মনে করেন?

স্বরলিপি: ফর্ম তৈরি হয় জীবনাচারণ থেকে। মানুষ তার কথায়, বলায়, চলায় দ্রুত পরিবর্তন আনছে। কারণ সে ভেতর এবং বাইরে  থেকে প্রভাবিত। ধরা যাক, একজন মানুষের একটা অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা প্রতিস্থাপন করা হলো। এরপর চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরো উন্নতি হওয়ায় শরীরে যেখানে যে সমস্যা তৈরি হলো প্রতিস্থাপন করা হলো। একসময় মানুষের কাঠামো বা ফর্মটিই বদলে গেলো।- হতে পারে এমনটা! সেটা যদি ভালো নাও হয় এতোদিনে যেসব পরিবর্তনের প্রভাবক তৈরি হয়েছে, সেগুলোকে সরাতে পারবেন? না। এগুলো ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। প্রয়োজনীয়তা আছে বলে টিকে গেছে। পরিবর্তনতো অবশ্যম্ভাবী। উত্তরাধুনিক জীবন যাপন যতোটুকু প্রভাব রাখতে পারবে ততটুকুই প্রভাব রাখবে উত্তরাধুনিক কবিতাও।

কাব্যশীলন: জীবনবোধ, মৃত্যু, এবং  রাজনীতি। এই তিনটি বিষয়কে এক সুতায় আনার চেষ্টা আপনার কবিতার ভেতর দেখা যায়। বিষয়গুলো নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন, নাকি ঘটনার প্রবাহ থেকে নেওয়া-

স্বরলিপি: আমার কাছে মনে হয় শিল্প তৈরি হয় জীবন বোধের অবগাহন শেষে। মৃত্যুর ধারনা আমাদের জীবনের জন্য একটি প্রস্তুতি এনে দেয়। রাষ্ট্রীয় জীব হিসেবে রাজনীতিকে অগ্রাহ্য করি না। অগ্রাহ্য না করার পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে আমার বন্ধু সার্কেল বা বৃত্ত। শিল্পে নিজের জীবন থেকে লেখার বাধ্য বাধকতা নেই-তবু ছাপ তো থাকেই। অন্য অনেক জীবন মনে প্রাণে যাপনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় গল্পের এক একটি বিশ্বস্ত চরিত্র বা কবিতা।

কাব্যশীলন: ‘মৃত্যুর পরাগায়ন’ কাব্যগ্রন্থ পাঠকদের হাতে যাওয়ার আগে পাণ্ডুলিপি ছিলো। একটা একটা করে কবিতা জমে পাণ্ডুলিপি হয়ে ওঠার গল্পটি জানতে চাই-

স্বরলিপি: শুরুতে কবিতা কিছুতেই হচ্ছিল না। তখন হৃদয়ের কথা শোনার চেষ্টা করেছি। এ হলো খুব আলগোছে কেউ পাশে এসে দাঁড়ানোর মতো।

 হৃদয় যা বলেছে সেই সব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। কিছু ধরে রাখা যায় না বলে মেনে নিয়েছি। কিছু ধরে না রাখার মানসিকতা নিয়ে এই জার্নিটাকে জাস্ট ভ্রমণ হিসেবে নিয়ে লিখেছি। একদিন অর্বাকে একসঙ্গে ত্রিশটির বেশি কবিতা নিয়ে হাজির হলাম। সেই দিন বলা হলো -কবিতা হয়েছে বা হচ্ছে। আমার কাছেও মনে হতে লাগলো যা বলতে চাই- কিছুটা লিখতে পারছি। সমকালে একাধিক কবিতা প্রকাশ হতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের পড়া বই সম্পর্কে যেমন ছোট আকারে নিয়মিত লিখতাম একই সঙ্গে মাঝে মধ্যেই নিজের লেখা কবিতা দিতাম। আমার কাছে মনে হলো কবিতা এক ধরণের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারছে।

কাব্যশীলন: ‘কবি’ শব্দটিকে সমাজের কাছে একটি তাচ্ছিল্যের ডাক। এই ডাককে উপভোগ করেন?

স্বরলিপি: শব্দ সম্মানের নাকি তাচ্ছিল্যের তা নির্ভর করে প্রয়োগকারীর ওপর। অনেক সময় গল্পকে নাকচ করার জন্য কেউ কেউ বলেন আপনিতো কবি, আবার কবিতাকে নাকচ করার জন্য বলে থাকেন আপনার গল্প বলার স্বকীয়তা আছে কিন্তু কবিতা-টবিতা কিছু হয় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে ‘তাচ্ছিল্য’ আসলে তা নয়। যার যার মূল্যায়ন। সবাইযে ভালোভাবে বলেন তাতো নয়। আবার কেউই যে ভালোভাবে বলেন না তাও নয়। অনলাইন পোর্টাল ‘রাইজিংবিডি’তে আমার নামের পাশে কবি শব্দটি লিখেছিলেন তাপস রায়। সেই লিখিত সম্বোধন তার স্বপ্রণোদিত। সেটা আমার কাছে  দারুণ কিছু পাওয়ার আনন্দের মতো। অনেকে বলার জন্য বলেন-হয়তো বন্ধুত্বের জায়গা থেকে নয়তো তাচ্ছিল্যের জায়গা থেকে। কষ্টটা হয় তখন-দেখা যায় যে একটি কাজ ভুল হয়ে গেছে। সেই ভুলের জন্য বলা হচ্ছে,‘ এই কবিদের এই এক সমস্যা সব ভুলে যায়’। এমন অভিজ্ঞতাও আছে, উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলছেন, কবিতাটা ছেড়ে দাও, নাহলে ক্যারিয়ার দাঁড়াবে না। কাজের জায়গায় কবিতা লেখার জন্য ভুল মূল্যায়ন হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। তবু কবিতা হৃদয়ের দায় মেটায়- উপভোগ না করে উপায় নেই।

কাব্যশীলন: আপনার কবিতায় পরাবাস্তবতার সঙ্গে দর্শনের মিল পাওয়া যায়। স্বকিয়তার এই বিনুনি কীভাবে গেঁথেছেন?

স্বরলিপি: বাস্তবতা অনেক সময় সরাসরি উপস্থাপন করা কঠিন, সেটা প্রচলিত সমাজ বা আইন ব্যবস্থার জন্য। আবার সরাসরি বলাটা শিল্পের জন্য বেশিরভাগ সময় ক্ষতিকর। পরাবাস্তবতা ভাবনা প্রকাশের দারুণ ক্যানভাস। পরাবাস্তবতা দর্শন দাবি করে। নাহলে বিষয়টি শিল্পের সমার্থক হয় বলে মনে করি না।

কাব্যশীলন: আপনাকে বলা হয় দ্বিতীয় দশকের একজন কবি। ‘দশক’ বিষয়টি কি একটি সিন্ডিকেট?

স্বরলিপি: এতে ক্ষতির কিছু দেখি না। সবকিছুর একটা শরীরি বা বৈষয়িক উপস্থাপন আছে। এটা অনেকটা সেরকম। বলতে গেলে এটা থাকা ভালো। এখন যদি বলা হয় আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কবিতা- এর যে শরীরি নির্দেশক তা হলো ভাবনাটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যা আধুনিক। আগের অনেক কবিতা পাবেন যা এখনও সমান আবেদন বহন করে। সুতরাং সেগুলো আধুনিক। আবার কবিতা যে সময়েই লেখা হোক তা যদি আধুনিকতা ছাপিয়ে ‘ভবিষৎ নিয়ে’ বর্তমান থাকে সেগুলো উত্তরাধুনিক কাঠামোর। এই সময়ে বসেও অনেক পেছনে পড়া কবিতা  লেখা হচ্ছে। আবার অনেক আগেই উত্তরাধুনিক কবিতা রচনা হয়েছে। যার আবেদন ভবিষৎয়েও থাকবে। এই বিচারে কবিতার দশক হয় না। কবির দশক থাকতেই পারে।

কাব্যশীলন: সাহিত্যপাড়ায় একটি কথার প্রচলন আছে ‘মেয়ে বলে সুযোগ বেশি পাচ্ছে’। আসলেই কি তাই?

স্বরলিপি: এই কথা যারা বলেন, তারা একটি দিক উল্লেখ করে বলেন। কথাটা পুরোপুরি অসত্য নয়। যেমন-সংবিধানে বলা আছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে সংরক্ষিত অনেক সুযোগের কথা। প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অলিখিত-অঘোষিতভাবে কিছু সুযোগ আছে। সামগ্রিকভাবে, এই হলো পুরুষ সমাজের অবদমন মনের কথা। যারা মেধাকে ভয় পায়, যারা নারীর এগিয়ে যাওয়াকে অস্বীকার করতে না পেরে তা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়।

কাব্যশীলন: আপনার ঝুলিতে ‘ব্রাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরুস্কার’ আছে। যার অর্থ আপনি ‘স্বীকৃত’।  ‘স্বীকৃত’ শব্দটি কতটুকু দায়বদ্ধতার?

স্বরলিপি: পুরস্কার পাওয়ার পর তিরস্কার পাওয়ার এক মসৃন পথ তৈরি হয়। এতে করে নিজের বন্ধুও চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে ফেলতে পারেন, এটা ঠিক কীভাবে পেলি? মর্মান্তিক কোন সুর যেন বেজে ওঠে কাছেই-নিঃশব্দে। দায়বদ্ধতার আগে যে কথাটি থাকা দরকার তাহলো, অনুভব, পর্যবেক্ষণ, বলার মানসিকতা, সাহস। পরিবারে, সমাজে মেয়েরা কথা বলতে গেলে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। আর শ্বশুরবাড়ি হলেতো কথাই নেই, মনে হয় যে জিহ্বা কেটে বাড়িতে গিয়েছেন। আপনার কিছু বলার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই। সবাই আপনার থেকে বেশি বোঝে, বাড়ির যে ছোট ছেলেটা তাকেও আপনার সঙ্গে দিয়ে রাস্তা দিয়ে চলার অনুমতি দেওয়া হয়। এই সব রীতি-নীতিতো চাইলেই ভেঙে দেওয়া যায় না

কাব্যশীলন: শেষ প্রশ্ন, কেনো লেখেন?

স্বরলিপি: শিল্পী যেখানে শেষ হয়ে যান, যতোটুকু শেষ হতে পারেন ততটুকু শিল্পের জন্ম হয়। লিখতে চাই সেইসব কথা- যা হৃদয় আমাকে নিভৃতে- নিরবে শোনায়। যা আমি-তাই লিখতে চাই। আসলে শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য লিখি। যেখানে অন্য শুরু অপেক্ষা করে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *