ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব এক
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// দশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব বার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তের
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব -পনেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব সাত
॥ তিন ॥
পতঙ্গ-মানবদের বংশবৃদ্ধি ঘটছে ফড়ফড়িয়ে। চাই শস্যভূমি। নতুন ভূমি। যেখানে শস্যভূমি নেই অথচ খাদ্যের স্তূপ পাহাড় তৈরি করে আছে সেই নগরে ওরা যেতে চায় না। নগর ভীতি ওদের রক্তে মিশে আছে। সেই যে অনাগত কালে ওরা গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবে, আর ফিরবে না শস্য ভূমিতে, সেই কালের হিসেব ওরা জানে না। রেলগাড়ি আর স্টিমারের গল্প ওরা শুনেছে, রূপকথারই মতো। তাই নগর এখন তাদের রূপনগর। এখনও শুনেছে সেই নগর আসলে দৈত্য-দানবের দেশ।
নতুন শস্যভূমির উদ্ধারপর্ব স্বপ্নে ভাসে। তাই তারা সমবেত হয় তেপান্তরের মাঠের শেষে মজে যাওয়া জলা-জঙ্গল, সাপ-খোপের জায়গাটায়। ওরা শুনে আসছে বংশ-পরম্পরায়, এই জলা-জঙ্গল আসলে একটি সরা নদী। কেমন করে মরল নদী? ধরিত্রী দাসের জ্ঞাতি ভাই চণ্ডরব সেই কাহিনিই শোনায় ভূমি উদ্ধারকারীদের। কেননা সে প্রচণ্ড উচ্চস্বরে কথা বলে তাই তার নাম চণ্ডরব। সিপাহি বিদ্রোহের সময় দিল্লির সম্রারাটের একদল অনুগত সৈন্য যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বঙ্গে পলায়ন করে। নতুন সৈন্য সংগ্রহ করে নতুন করে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য। নৌপথে সৈন্য সংগ্রহ করতে করতে উত্তরের পাহাড়ের উদ্দেশ্যে নতুন যুদ্ধ ঘাঁটিতে ফিরছিল তারা। সম্রাট বন্দি ইংরেজের হাতে। তার বীর যোদ্ধা দুই পুত্রের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় দিল্লিনগর ফটকের লৌহদণ্ডে ফাঁসি দিয়ে।
তাই উত্তর-পূর্ব পার্বত্য সীমান্তে চলছে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি।
কিন্তু হায় দুর্ভাগ্য, হায় নিয়তি! ইংরেজ সৈন্যরা তাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। যুদ্ধে পরাজিত হয় বিদ্রোহী সিপাহিগণ। শত শত, হাজার হাজার সিপাহিকে হত্যা করে এই নদীতে ফেলে দেয়া হয় লাশের স্তূপ, লাশের পাহাড়। নদীর স্রোতে যায় বন্ধ হয়ে। কংকালের স্তূপে বালি ঢাকা পড়ে নদী যায় ভরাট হয়ে। এই সেই স্থান। সিপাহিদহ।
চণ্ডরব উচ্চস্বরে গ্রামবাসীদের জানায়, এই জলা-জঙ্গলের তলায় চাপা পড়ে আছে সিপাইদের কংকাল। কোন কোন গভীর অন্ধকার রাতে নির্বাসনে মৃত সম্রাট বাহাদুর শাহের নামে কংকালেরা জয়ধ্বনি দেয়। তারা ইংরেজ সৈন্যদের মাথার খুলি দিয়ে গেন্ডুয়া খেলে। সারারাত এ খেলা চলে। ভোর হবার পূর্বে তারা বাতাসে মিলিয়ে যায়।
তবে কি এমন মৃত্যুপুরীতে কেউ শস্যভূমি উদ্ধারের প্রত্যাশা রাখে। কৌতূহলী আর ভয়ার্তগণ দ্রুত গ্রামে ফিরে আসে। অন্ধকার রাতের কাল কৃষ্ণপত্র এলেই রাত জেগে ওরা সেই সিপাইদহের দিকে কান পেতে থাকে। কেউ কেউ সিপাইদহ থেকে ভেসে আসা ফিসফিস কথাও শুনতে পায়। কি কথা হয় বিদ্রোহী প্রেত সিপাইদের মধ্যে? নিশ্চয়ই বর্তমান নিয়ে নয়। কেননা প্রেতের দুনিয়ায় তো মাত্র একটি কাল আছে। অতীত। অতীতকাল। সিপাইদহের প্রাচীন অন্ধকারের দুনিয়া থেকে জেগে উঠে তারা তো প্রাচীন পৃথিবীর রূপকথাই বলে। তাদের মধ্যে মাত্র একজনই আছে যে ঢাকা শহরের বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে মাঝে মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদতীরবর্তী গ্রামের সিপাইদহে আনোগোনা করে।
এবার চণ্ডরব থামে। সিপাইদহের জলা-জঙ্গলের দিকে চোখ ফেলে খানিক নীরবতা পালন করে। দমনকের দিকে তাকিয়ে পুনরায় তার বয়ান করে। সে শস্যদেবতার নামে সাক্ষ্য দিয়ে জানায়, পদ্মা-নদীর নৌযুদ্ধে আহত হয়ে বিদ্রোহী যেসব সেপাই বুড়িগঙ্গা বেরিয়ে নবাব খাজাদের ঢাকা শহরে অন্য অনেকের মতো আত্মগোপন করেছিল, তাদের শেষরক্ষা হয়নি। ইংরেজের পোষা ঢাকার নবাবের পাইক-বরকদন্দাজেরা তাদের ধরে ফেলে। ঢাকার নবাব ধৃত বিদ্রোহীদের ইংরেজের হাতে তুলে দেন। ইংরেজ সৈন্যরা তাদের বাহাদুর শাহ পার্কের পামগাছে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে এবার চণ্ডরব ফিসফিসিয়ে বলে, ‘যে সব পথশিশুরা গভীর রাতে পার্কে ঘুমোতে যায় তাদের সেই সব প্রেত সেপাই মশারি খাটিয়ে দেয়। ভোরে ঘুম ভাঙার পূর্বেই সেই মশারি অদৃশ্য হয়ে যায়। সে এক যাদুর খেলা।’
‘তাই নাকি, এ তো ভূতের গপ্পো?’ দমনকের স্বরে উত্তেজনা।
চণ্ডরব হেসে ওঠে, ‘জান কি, এক প্রেত সেপাইতো একদিন ইঁচড় পাকা গাঁজাখোর এক ছোকড়ার হাতে ধরা পড়ে যায়, মশারি খাটানোর সময়। কিন্তু বুঝতে দেয়নি সে যে প্রেত।’
‘তারপর? তারপর কি হলো? জলদি বল।’
তারপর প্রেত সেপাই সারারাত সিপাহী বিদ্রোহের কথা, তার নিজের কথা বলে আর অনতিদূরের প্রাচীন পাম গাছটি দেখিয়ে বলে, এ-গাছেই বেঁধে ইংরেজ সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। আর ছেলেটি তখন বুঝতে পারে তার পাশের মানুষটি ভূত, তাই সে চিৎকার করে ওঠে এবং চোখের পলকে প্রেত সেপাইয়ের শরীর বাতাসে মিশে যায়। ভয়ার্ত ছেলেটি ছুটতে থাকে পার্ক পেরিয়ে সদরঘাটের দিকে।
চণ্ডরব জোনাক রাতের অপেক্ষায় থাকে। তিন দিন তিন রাত পেরিয়ে তবেই জোনাক নামে। বাড়ি থেকে বের হয়ে চণ্ডরব তেপান্তরের মাঠের দিকে হাঁটতে থাকে একাকী। ভয় ভয় করলেও ফকফকা জোনাক তার সাহস যোগায়। তেপান্তরের মাঠের বাঁকা তালগাছের পাশে এলেই তার পা থেমে যায়। পেছনে সে কি কারও পায়ের শব্দ শুনলো? ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখতে পায় সাদা কাপড়পরা এক যুবতী বৌ তাকে পাশ কেটে সিপাইদহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই গভীর রাতে এ কোন নারী বিধবার পেশাকে জলা-জঙ্গলের ভয়ংকর সিপাইদহের দিকে যাচ্ছে? এই অবস্থায় সে যেন ঘোরে পতিত হয়।
‘কে তুমি? কোন গাঁয়ের কি? যাচ্ছ কোথায়?’ বলতে বলতে লম্বা পা ফেলে চণ্ডরব। সে তার স্বভাবসিদ্ধ উচ্চস্বরে জানতে চায়, ‘ওই প্রেতের দহে কেন যাচ্ছ? বড় ভয়ংকর স্থান।’
কিন্তু নিরুত্তর বৌটির পাশে পৌঁছাতে পারে না চণ্ডরব দ্রুত হেঁটেও। তার ইচ্ছে হয় জোর করে ঘোমটা টেনে বৌটির মুখ দেখে। হঠাৎ সিপাইদহ থেকে গুলির শব্দ হয়। বাতাসের শো শো শব্দ হয় ক্ষণমুহূর্ত। মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ায় চণ্ডরব। চণ্ডরব বুঝতে পারে মেয়েটি গর্ভবতী, উঁচু উদর। ঘোমটার আড়াল থেকে ফিসফিস্ শব্দে কথা কয় মেয়েটি, ‘ফিরিঙ্গি সেপাইদের ব্যারাক থেকে আমার সেপাই স্বামী ছুটিতে বাড়ি এলে আমি গর্ভবতী হই। ব্যারাকে ফিরে যাবার পূর্বে আমার স্বামী দিল্লির সম্রাটের নামে প্রতিজ্ঞা করে বলে যায় ফিরে গিয়ে বিদ্রোহ করবে। সম্রাটের বিজয় শেষেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরলেই যেন আমি সন্তান প্রসব করি। একজন পিতার এই প্রতীক্ষা বড় দীর্ঘ।’
‘তোমার স্বামী কি বাড়ি ফিরেছিল’?
‘না, ফেরেনি। বিদ্রোহ আর যুদ্ধের ভেতর তাকে ফিরিঙ্গি সৈন্যরা এখানে হত্যা করে ওই সিপাইদহে লাশ ফেলে দেয়। জোনাক রাতে আমি আমার স্বামীর সাক্ষাতে এই মৃত্যুপুরীতে বারবার আসি।’
‘মৃত স্বামীর সঙ্গে কি তোমার সাক্ষাৎ হয়?’
‘নিশ্চয়ই, আমার কথা ভোলেনি সে। আমরা পুরাতন দুনিয়ার গল্প করি। যেহেতু আমার স্বামী যুদ্ধ জয়ের শেষে ঘরে ফিরে আসতে পারেনি, তাই আমার গর্ভের সন্তানও ভূমিষ্ঠ হতে পারেনি। এ যেন এক অভিশাপ।’
‘শত বৎসর পেরিয়ে গেছে, আজও কি তোমার সন্তান প্রসবের প্রহর আসেনি? আর কতকাল ওকে গর্ভে বয়ে বেড়াবে? আর কত প্রতীক্ষা?’
‘আমার স্বামী বলেছে এমন দিন আসছে যেদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যা তীরের মানুষ অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেদিনই আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। কেননা অনাগত সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমার মৃত স্বামীও ছায়ামূর্তি ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে যাবে, কিন্তু কেউ তাকে চিনবে না।’
‘কোন যুদ্ধের কথা বলছ তুমি?’ চণ্ডরবের এমন প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আকাশে একখ- মেঘ চাঁদকে ঢেকে ফেলে। চরাচরে নেমে আসে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে একাকার হয়ে যায় অজাগতিক নারী।
চণ্ডরব এবার উচ্চস্বরে কাকেশ্বরের নাম করে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে। গ্রামটা তখন ঘুমকাতরতা ভেঙে জেগে ওঠে। যে নারী রাতের তৃতীয় প্রহরে সন্তান প্রসব করেছিল, রক্তভেজা বিছানায়, সে-ই কেবল অচেতন হয়ে থাকে। ঘুম তাড়–য়ারা বুঝতে পারে চণ্ডরব জাতিস্মর হয়ে গেছে। অবশিষ্ট রাত তারা তাকে ঘিরে থাকে।
চণ্ডরব তার গল্প বলতে থাকে। আমি পলাশির যুদ্ধের শেষাবধি মিরজাফরের ঘোড়ার সেবক ছিলাম। সেই ঘোড়া সঙ্গে করে নবাব সিরাজের হারানো ঘোড়ার সন্ধান করতে থাকি। কেননা নতুন নবাব মিরজাফরের এই ছিল নির্দেশ। কিন্তু পাইনি। ভাগীরথী নদীর জেলেরা বলেছে নবাবের ঘোড়া নাকি ভাগীরথীর তীরে এসে পঙ্খিরাজ ঘোড়া হয়ে যায়। সেই ঘোড়া ভাগীরথীর স্রোতের চিহ্ন ধরে বেগম মহলের নারীদের সন্ধানে আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেননা কেউ জানে না ভাগ্যহতাবন্দি নারীদের কোথায় নৌপথে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। এই, নদী-খালের দেশ ওটা। দিগন্তবিস্তৃত শস্যভূমির দেশ।
এবার থামে চণ্ডরব। তার দুচোখে ঘুমকাতরতা নেমে আসছিল। বিড়বিড় করে কথা বলছিল সে। গ্রামবাসীর বিশ্বাস নিশিরাতের প্রেতাত্মা চণ্ডরবের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। প্রেতাত্মাই তাকে কথা বলাচ্ছে। মাত্র একবারই চোখ খোলে চণ্ডরব। চোখ বিস্ফারিত। তারপর আবার বুঁজে আসে। এবার কান্নার মতো ইনিয়েবিনিয়ে চণ্ডরব তার কথা বলে। ‘সিপাইদহের প্রেতাত্মারা আমাকে ডেকেছিল। বিদ্রোহী নিহত সেপাইর বিধবা গর্ভবতী স্ত্রীর পেছনে হেঁটেছি আমি। সেও অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি যুদ্ধের বাজনা শুনেছি। ইংরেজ সৈন্যদের নরমু- ছেদন দৃশ্য দেখেছি। স্তূপ জমে ওঠে সিপাইদহে বিদ্রোহীদের কাটা মুণ্ডে। তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। মেঘের গর্জন। আমি রক্তের স্রোতে সাঁতার কাটছি। কূল নেই। কিনারাও অদৃশ্য। আমি ডুবতে থাকি। ডুবছি…ডুবছি…ডুবছি।’ চ-রবের শরীর ভেঙে পড়ে ঘুম কাতরতায়। হয়ত প্রেতাত্মা তাকে মুক্তি দিচ্ছে।