ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব বার

সেই কবেকার কথা। পূর্ণচরণ সবে কৈশোর অতিক্রম করছে। সাত মাইল হেঁটে গাঁয়ের বন্ধুদের সঙ্গে নদী পেরিয়ে খ্রিস্টান পাড়ায় গিয়েছিল ‘যিশু লীলা’ দেখতে। ‘কৃষ্ণলীলার’ মতোই যাত্রাপালা। যিশুর জন্ম থেকে ক্রমে মৃত্যু পর্যন্ত তার বিস্তার। কৃষ্ণলীলার সুরে গানের মধ্যে সব ঘটনার বর্ণনা। চোখে জল নামে যীশুর দুঃখভোগে।

‘যিশু খ্রিস্টের জন্ম এইরূপে হইয়াছিল। তাঁহার মাতা মরিয়ম যাকোবের পুত্র যোসেফের প্রতি বাকদত্তা হইলে তাহাদের সহবাসের পূর্বে জানা গেল তাহার গর্ভ হইয়াছে পবিত্র আত্মা হইতে। আর যোসেফ তাহাকে গোপনে ত্যাগ করিবার মানস করিলেন। এমন সময় ‘ঈশ্বরের এক দূত স্বপ্নে তাহাকে দর্শন দিয়া কহিলেন, ‘দায়ুদ বংশধর যোসেফ, মরিয়মকে গ্রহণ করিতে ভয় করিওনা, কেননা তাহার গর্ভে যাহা জšি§য়াছেন, তাহা পবিত্র আত্মা হইতে হইয়াছেন, তুমি তাহার নাম যিশু রাখিবে, তিনি ঈশ্বরের পুত্র।’ [বাইবেল-নিউটেস্টমেন্ট]

কিন্তু পূর্ণচরণকে ‘ঈশ্বরের দূত এসে জানায়নি যে,তার কন্যার গর্ভে পবিত্র আত্মা হতে একটি শিশুর আগমন ঘটেছে? তবে কে সে? এই অনধিকার, অবৈধ অনুপ্রবেশ? নিশ্চয়ই এই শিশু পবিত্র আত্মা নয়, বরং অপবিত্র আত্মা থেকে এসেছে। শয়তান, ডেবিল।

‘মালতি, তোর মা আমাকে কোনো সুপুত্র দান করার পূর্বেই মারা গিয়েছে, আমি তাকে ক্ষমা করেছি, কিন্তু তোর গর্ভে যে এসেছে সে অপবিত্র প্রেতাত্মা, আমি তাকে ক্ষমা করিনি, পঞ্চপিতা পরমেশ্বরও ক্ষমা করেননি, পঞ্চপিতার এই পবিত্র ভূমিতে ভূমিষ্ঠ হবার অধিকার তার নেই, আমার নিষ্ঠুরতার জন্য ক্ষমা কর মা’, বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পূর্ণচরণ।

উদাস চোখে মালতি বিড়বিড় করে। যেন সে পিতার কথা শুনতেই পায়নি। অথচ পিতা পূর্ণচরণের মনেহয় সে ভগবানের ইচ্ছায়ই এতটা নিষ্ঠুর হয়েছে। কেননা সমস্ত দেব-দেবী তার মেয়েকে পরিত্যাগ করেছে।

এবার মালতির চোখ বিস্ফোরিত হয়। নরমু- হাতে দণ্ডায়মান দেবী কালী হয়ে যায় সে। পিতাকে শুনিয়ে সে তার মৃত মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুমি জানতেও চাইলে না কে কখন কেমন করে আমার কুমারী পেটের জবর দখল নিয়েছে। সূর্য সাক্ষী রেখে বলছি, যে আমার পেটে এসেছে তাকে আমি ঘৃণা করি, নিজেকেও। কেননা এটি কুক্ষণের জন্মপাপ।’

তারপর পিতা কন্যার মধ্যে দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা হয় না। এক সময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর চোখ। কণ্ঠে যেনো কোনো দৈববাণী, ‘বাবা, যে আমাকে গর্ভবতী করছে তার চেয়েও আমি নিষ্ঠুর, কেউ যেন আমার সঙ্গে ছলনা করছে, বলছে আমি যেন করুণাময়ী মা হই, কিন্তু সেই ছলনাময়ীকে আমি ঘৃণা করি, কেননা আমি নিষ্ঠুর তার চেয়েও, যে আমাকে ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেছে।’

যে সব অসুস্থ অশক্ত বৃদ্ধ উপারান্তর না দেখে গাঁয়ে পড়েছিল কিংবা প্রিয়জন যাদের যুদ্ধের বলি হিসেবে ভিটে বাড়িতে পরিত্যাগ করে গ্রামান্তর হয়েছিল, তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তারা স্বচক্ষে দেখেছে নরহত্যা এবং ধর্ষণ শেষে নারী হত্যা। তারা বিশ্বাস করে নিহত নারীরা পিশাচিনী হয়ে গেছে। ওরাই ভয় করেছে পূর্ণচরণের মেয়ে মালতির উপর। তাই সে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। নিজের ইচ্ছায় নয়, পিশাচিনীদের নির্দেশে।

এক ত্রিসন্ধ্যায় পূর্ণচরণ দেখতে পায় বাড়ির পাশে খেজুর তলায় তার মেয়ে অন্য এক অচেনা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। পূর্ণচরণ তাকে চিনতে পারে না। কে জানে কার বাড়ির ঝি-বউ! দু’জনের মধ্যে যে কথাবার্তা চলছে তা ছিল প্রায় শব্দশূন্য কিংবা ফিসফাস। পূর্ণচরণ এগিয়ে গেলে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় মেয়েটি। সেদিনই রাতে হঠাৎ পূর্ণচরণ দেখতে পায় জোনাকপড়া বারান্দায় মালতির চুল বেঁধে দিচ্ছে একটি অচেনা বৌ। কে? পূর্ণচরণ জানতে চেয়েছিল। কিন্তু জোছনার পর্দার আড়ালে পলকে আত্মগোপন করে মেয়েটি। পূর্ণচরণের দৃষ্টির ভেতর জ্যোৎস্নার কুয়াশা।

তারও তিন চারদিন বাদে। পোড়া ভিটায় আশ্চর্য প্রদীপের যে দৈত্য রিলিফের টিনের চালা তুলে দিয়ে যায়, তাতে মেয়েকে নিয়ে শুয়েছিল পিতা। মাঝরাতে কিছু একটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে পূর্ণচরণ দেখতে পায় মালতি তার ভরাট পেটে হাত রেখে খোলা দুয়ার ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণচরণ খুব সাবধানে মেয়েকে অনুসরণ করে। রাতের কত প্রহর, পূর্ণচরণের অজানা। হয়তো মালতিরও।

কাঁই আন্ধারে মালতি ছায়ামূর্তি হয়ে যায়। পূর্ণচরণের ইচ্ছে থাকলেও মেয়ের পাশাপাশি হতে পারে না। এই স্তব্ধ নির্জন রাত তাকে শাসন করে। ভয় দেখায়। ধীরে ধীরে একটা ঘোর তাকে ঘিরে ধরে। রোদে পড়া কাদামাটি যেমনি বিভিন্ন আকার নিয়ে ফাঁটল ধরে, ঠিক তেমনি অখ- এই রাত জমাট বেঁধে এক একটা মূর্তিতে রূপান্তর ঘটে। সেই সব চলমান মূর্তি মালতিকে ঘিরে ধরে। ওরা ফিসফিস করে কথা বললেও পূর্ণচরণ তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পায়। আশ্চর্য এই, মালতিও তাদের সঙ্গে কথা বলছে। ওদের কথাবার্তায় পূর্ণচরণ বুঝতে পারে ওরা সেসব নারীর প্রেত্মা, যারা যুদ্ধকালে ধর্ষণ শেষে নিহত হয়েছিল। ওরা কি বলছে?

‘মালতি, তুই আমাদের কাছে ফিরে আয়, এই স্বাধীন দেশে তোকে আর তোর গর্ভের সন্তানকে কেউ কখনো স্বীকৃতি দেবে ন, দেশটাকে দুনিয়ার মানুষ স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দিলেও তোকে নয়।’

‘কেনো দেবে না, কেনো?’

‘কেননা, আদম-হাওয়ার গন্ধম ফল খাওয়ার পাপ তোর শরীর বহন করছে। বরং নরক যন্ত্রণার চেয়ে আমাদের মউতের দুনিয়াই তোর জন্য শান্তি। দেখ কত শান্তি আমদের, লোভ হয় না?’

আর তখন পাথুরে এক কঠিন আচ্ছন্নতার ভেতর হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে পূর্ণচরণ এসে তার বুকে মৃত্যু শীতল অশরীরী একটি হাতের স্পর্শ পায়। জ্ঞান হারায় সে। জ্ঞান ফিরলে দেখতে পায় মেয়ে তার মাথায় হাত রেখে স্তব্ধ বসে আছে ঘরের ভেতর। পিতা এবং মেয়ের মধ্যে তখন যে দৃষ্টির বিনিময় ঘটে তা আজানা কোনো দুনিয়ার মতো দুর্বোধ্য। জটিল এবং ভয়ংকর। মালতি নয়, বরং পূর্ণচরণ ভয় পায়। প্রতিবেশি ভবদেব তখন হাতের হারিকেনটা মাটিতে নামিয়ে বসে পড়ে। কেননা, সে-ই রাত গভীরের আর্তনাদ শুনে মাঠ থেকে উদ্ধার করে মালতি আর পূর্ণচরণকে। ভবদেব না থাকলে হয়তো ভয়কর কিছু ঘটতো।

খানিক নীরবতার পর পূর্ণচরণকে আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তির জন্য ধান শূন্য গোলাঘর আর বিরান ফসলের মাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ভবদেব। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং ফসল ক্ষেতে শষ্যদেবীর ডাকের কথা বারবার বলতে থাকে ভবদেব। পূর্ণ কি সে ডাক শুনতে পার না?

এবার শেষরাতে হ্যারিকেনের আলোর বাইরে হ্যারিকেনেরই পড়ে থাকা ছায়ার ভেতর চোখ ফেলে পূর্ণচরণ বিড়বিড় করে, ‘ফসল শূন্য ক্ষেতে শস্যদেবী নয়, প্রেমের ডাক শোনা যায়।’

‘ওসব কিছু না পূর্ণচরণ, একদিন কেউ আর নিশিডাক শুনতে পাবে না,’ পূর্ণচরণকে অভয় দিয়ে মালতির দিকে তাকিয়ে ভবদেব বুঝতে পারে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে, হযতো তার পেটের শিশুটিও।

‘প্রেতের কান্না কোনোদিন থামবে না ভবদেব, কেন জানিস? যারা যুদ্ধে মরে গিয়ে শ্মশান পায়নি, প্রেত তর্পণ পায়নি, গোর পায়নি, জানাজা পায়নি, তাদের আবার শান্তি নাই, তারাই প্রেতমূর্তি ঘুরে বেড়ায়, হাসে, কাঁদে,’ পূর্ণচরণ বিড়বিড় করতে করতে পুনরায় চোখ বন্ধ করে। তার একটি হাত পাশেই ঘুমন্ত মেয়ের ভারিপেটে নেতিয়ে পড়ে। কি প্রশান্তি। মাতা মরিয়মের পবিত্র গর্ভভূমি। ঘুমন্ত ঈশ্বরপুত্র।

মালতি মনুষ্যপ্রেতিনীতে পরিণত হয়। দিনের আলো তার অসহ্য। শীতের সাপের মতো দিনের আলো তাকে অন্ধকার ঘরের গুহার মতো কোনো শীতঘুমে আচ্ছন্ন করে রাখে। রাত নামলেই ওঠে দাঁড়ায় সে। পড়শিরা ওকে পরিত্যাগ করেছে। ঘৃণায় নয়, বরং ভয়ে। মালতি যেন হঠাৎ কালনাগিনী হয়ে যায় সবার চোখে। তার দেখা পাওয়া মানে মৃত্যু ছোবল।

তাড়িয়ে দিতে পারেনি, বরং পিতা পূর্ণচরণ মেয়েকে মাত্র একবারই গরা টিপে খুন করতে চেয়েছিল। পারেনি। আচমকা ঘরে ঢুকে পড়েছিল নিত্যানন্দ। কন্যা হত্যার এই ব্যর্থতা পূর্ণচরণকে গাছ-পালা, লতা-পাতার মতো চেতনাশূন্য প্রাণে পরিণত করে। তার ব্যর্থ হত্যার মাত্র চার দিন পর এক সন্ধ্যায় মালতি পরিণত করে। তার ব্যর্থ হত্যার মাত্র চার দিন পর এক সন্ধ্যায় মালতি কুয়াশায় ডুব দিয়ে পিতার সামনে দিয়েই রশি হাতে আত্মহত্যার জন্য ঘর থেকে বের হয়। আত্মবিস্মৃত পিতাও দেখে, সবই বুঝতেও পারে, কিন্তু বাধা দিতে পারে না। সে অন্য দুনিয়ায়। নির্বিকার। বোবা। নি:সাড়। জবেহ করা মু- বিচ্ছিন্ন পশুর নিষ্প্রভ চোখের মতো তার চোখের মতো তার চোখ জোড়া কেবর দেখে। প্রতিক্রিয়া শূন্য।

চেতনাবিচ্ছিন্ন পিতা মেয়েকে অনুসরণ করে সেই আম গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়, যে গাছে ওঠে মেয়ে ডালে রশি বাঁধার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার ছায়ার মতো আঁধারে পিতা ও কন্যার চোখাচুখি হয়। ডাল এবং গলায় রশিটা বেঁধে মাত্র একবার পিতার দিকে তাকায় মালতি। সে কি পিতাকে কিছু বলতে চায়? এমন কি প্রত্যাশা করে, পিতাও কিছু বলুক? অথচ এই সত্যচিরকাল অজানাই থাকবে। কেননা জš§দাতা স্তব্ধ-নির্বিকার নির্বাক।

এক সময় সারাটা আগমাছ কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যার আবছায়া আঁধার ফালাফালা হয়ে যায়। ঝুলে পড়েছে মালতি। তার শরীর দোলখায়। জলে সাঁতার দেয়ার মতো মাত্র একবার হাত-পা নড়ে ওঠে। অপলক দৃষ্টিতে, নির্বিকার শরীরে একজন পিতা কেবল দেখছে ঝুলন্ত কন্যার উদর কতটা স্ফীত। পিতা কি নিঃশব্দ অদৃশ্য অজাগতিক কোনো বজ্রপাতের দ্বারা প্রাণ শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?

তারপর সন্ধ্যার আঁধার যখন আরো জমাট বাঁধে এবং মালতির ঝুলন্ত শরীর দুলতে দুলতে স্থির হয়ে আসে, তখনই পূর্ণচরণের সারাটা শরীর হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। সে আর্তনাদ করতে চায়, কিন্তু পারে না। সে এক দৌড়ে মালতির শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। পারে না। শরীর তো এক অজ্ঞাতনামা দেবতার প্রাচীন ক্ষতবিক্ষত পাথরের দণ্ডায়মান মূর্তি। একটা রক্তচোষা বাদুড় অন্ধকার আকাশ ভেঙে ওড়ে যায় কোথাও। নিশি শিকারি ক্ষুধার্ত সাপের গন্ধ বতাসে ছড়িয়ে পড়লেও দীর্ঘ চলমান শরীর আঁধারে একাকার হয়ে থাকে। আকাশে উল্কপাত। থৈ থৈ করে রক্ত জন্মে বিছানায়।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগারধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তের >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *