ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দ

উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত

॥ চৌদ্দ ॥

পূর্ণচরণ এখন মৃত কন্যার প্রতি দয়া-মায়া-করুণা দেখাতে চায় না। সে বুঝতে পারে মালতি কন্যা থেকে প্রেতিনী হয়ে গেছে। সন্তান থেকে ঘাতক। বাৎসল্য থেকে ভয়ঙ্কর। পিতা আর সন্তানের মধ্যে বহমান ভাবরসেরস্রোতে শুকিয়ে নিঃসাড় বালির পাহাড় হয়ে গেছে। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে দাউ দাউ। জাগতিক পিতা অজাগতিক কন্যার সঙ্গে বৈরিতায় জিততে চায়। পিতা মুক্তি চায় ভয়ঙ্করের হাত থেকে। অথচ আত্মঘাতিনী কন্যাও চায় প্রেত জীবন থেকে মুক্তি। পিতা আর কন্যার এই জটিল লীলা বড়ই দুর্ভেদ্য। কেউ জানে না মুক্তির ঠিকানা।

আসে কৃষ্ণপক্ষ। আসে অমানিশি। চন্দ্রকলা অদৃশ্য। ঘোর অন্ধকার। যেন অথৈজলের নদীর নিশ্চিদ্র-নিশ্চেতন তল। অন্ধকার বিছানায় পড়ে আছে পূর্ণচরণ। চোখ খোলা। একটা পাথুরে ভয় তার শরীরে ঠান্ডা জল ঢেলে দেয়। হঠাৎ কারও পায়ের শব্দ শুনতে পায় সে। ঘরের ভেতর নাকি বাইরের উঠোনে? বুঝতে পারে না। আচমকা একটি অগ্নিগোলক ঘরের চালে একপলক জ্বলেই নিভে যায়।

কি? কে? এমন প্রশ্ন কণ্ঠে এসেই তরল হয়ে যায়। পূর্ণচরণ দেবতা কিংবা ঈশ্বরের নামও ভুলে যায়। অন্ধকার ঘরের ভেতরটা আলোয় ভরে যায়। সেই আলোর ভেতর থেকে দিগম্বর স্ফীত উদরের একটি নারীমূর্তি বেরিয়ে আসে। প্রেতিনী নয়, স্বয়ং তার কন্যা মালতি। তার কন্যা মৃত না জীবিত, এমনটা ভুলে যায় পূর্ণচরণ। সে কেবল ফিসফিস স্বরে উচ্চারণ করে, ‘মালতি, আমি তোর বাবা, উলঙ্গ কেন? লজ্জা নেই মেয়ের? বাবার লজ্জা নেই?’

‘পূর্ণচরণ, লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের বাইরের অন্য এক দুনিযার মানুষ আমি, আজ আর আমি তোমার মেয়ে মালতি নই, বরং প্রেতিনী, তোমাকে খুন করলেই আমার আত্মা মুক্তি পাবে,’ ফিসফিস স্বরে কথা বলে মালতি। কথা আর শব্দের তরঙ্গ বাতাসে নাচে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ়, নির্বাক, ভয়ার্ত পূর্ণচরণ। বহু চেষ্টার পর বিড়বিড় করে সে বলে, ‘তোর বাবার কি অপরাধ? কি পাপ করেছে বাবা?

‘জন্মদাতা হয়ে যে কন্যাকে রক্ষা করতে পারে না শয়তানের হাত থেকে, সেই কন্যার পিতৃকুল, পিতৃভক্তি, পিতৃশোক থাকে না, থাকে কেবল পিতার প্রতি ঘৃণা আর প্রতিহিংসা, অজাগতিক স্বরে কথা বলে মালতি। সে পিতার বিছানার পাশে বসে। তার নিশ্বাস থেকে প্রবল ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসছে ক্রমাগত। যেন মৃত্যুহিম।

তার কন্যা জীবিত না মৃত সেই বোধ হারিয়ে ফেলে পূর্ণচরণ। তার ডান হাত যখন স্পর্শমাত্র পায় মালতির, সাপের ছোবলের বিষ যেন ছড়িয়ে পড়ে রক্তের শিরায়। আর্তনাদ করতে গিয়েও থমকে যায় পূর্ণ। সে ছটফট করতে থাকে এবং মুখে বিড়বিড় শব্দ, ‘মাছের শরীরের মতন তোর শরীর এত ঠান্ডা কেন? তুই কি প্রেতিনী? মৎস্যপ্রেতের কন্যা? ভুলে গেলি আমি তোর পিতা?’

‘আমি যে নদীর গহিন তলার ঠান্ডা জলে রাতদিন হেঁটেছি,’ বলতে বলতে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে মালতি। পূর্ণচরণের আত্মা কেঁপে ওঠে।

‘কে, কে তুই? বল তুই কে?’

‘এই দুনিয়ায় আমি তোমার মেয়ে, অন্য দুনিয়ায় কেউ না, সেই দুনিয়ায় পুরাতন দুনিয়ার সম্পর্ক মরীচিকা মাত্র।’

পূর্ণচরণের জগৎ কেঁপে ওঠে। সে বুঝতে পারে প্রবল প্রতিহিংসার দুটো ধারালো নখের শক্ত থাবা তার গলায় চেপে ধরেছে। সে বুঝতে পারে মৃত্যু তার ভবিতব্য। কিন্তু এতটা আতংকিত যে, আত্মরক্ষার চেষ্টা থেকে সে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে। পূর্ণচরণ কেবল শুনতে পাচ্ছে তার প্রেতকন্যার ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, ‘আমি পিতৃরক্ত পান করতে চাই, সেই রক্তই আমাকে মুক্তির পথ চিনয়ে দেবে। তুমি দান কর পিতৃরক্ত আর আত্মা।’

কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণা যখন তার হৃদপিণ্ডে একটার পর একটা পদাঘাত করছে এবং পিষে দলা পাকিয়ে দিচ্ছে, তখনই সে রক্ত বমনের মতো একটা আর্তনাদের অস্ফুট শব্দ করে। তখনই পূর্ণচরণ অনুভব করে তার প্রেতকন্যা অন্তর্হিত হয়েছে। কেবল বিগতকালের কন্যার কৈশোরের কণ্ঠ ভেসে আসছে কানে, ‘বাবা, আর কখনও আমি তোমাকে কষ্ট দেব না।’

না, কোথাও কেউ নেই। কিন্তু জীবিত পিতা আর মৃত কন্যার মধ্যে এই মৃত্যু আর জীবনের খেলার রহস্য চিরকাল দুর্বোধ্যই থেকে যাবে। কেননা এই ঘটনার পর মৃতকন্যা আর কখনও জন্মদাতার সামনে এসে দাঁড়ায়নি। হয়ত আর কখনও দাঁড়াবেও না। পিতাকে সে মুক্তি দিয়েছে বাতাসে ছিটিয়ে দেয়া এই শেষ বাক্য দিয়ে যে, ‘বাবা, জীবনের ওপারের দুনিয়ায় গিয়েও তোমার কন্যার কাছে অজানাই রয়ে গেল, একজন ধর্ষিতার অবৈধ গর্ভ, পাপের দুয়ার, নাকি রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ, কোন্টি গৌরবের?’

প্রেতকন্যার হাত থেকে মুক্তির পর এই প্রথম পূর্ণচরণ এত উচ্চস্বরে দীর্ঘক্ষণ কান্না করল। ধর্ষিতার পিতা হিসেবে দুনিয়ায় মানুষ আর ত্রিভুবনের ঈশ্বরের কাছে আজ তার লজ্জা, ঘৃণা, হীনতা-দীনতার জয় হলো। পঞ্চপিতার শরীর এই পলল মাটি ছুঁয়ে সে শান্তির জন্য প্রার্থনা করে।

সেই রাতেই গ্রামের মানুষ আচমকা গিরিশের বাড়ির চাতাল থেকে কারও বিলাপ শুনতে চায়। বুঝতে পারে এ কান্না ভগবতীর। অবশ্য এমন কান্না অভূতপূর্ব নয় এই পঞ্চপিতা-পিতৃভূমিতে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই পিতৃভূমিতে রয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গোরস্থান। ত্রিশ লাখ কবর, নতুন কবর। এত অল্প সময়ে এত কবরগুহা খননের নিদর্শন আর কোথাও নেই। জল আর নদীর দেশ বলে কথা। যদি হতো মরুভূমি? দুইশ’সত্তুর দিনে ত্রিশ লাখ মানুষের তাজা রক্তে ভরাট হয়ে যেতো পৃথিবীর সব বড় শুকনো নদী। সাতকোটি মানুষের কান্নায় নোনাজলে ডুবে যেতো দশকোটি বৎসর পূর্বে মরে যাওয়া মরুসাগর।

মানুষ আবার ভুলেও যায় বিলাপ। বিস্ময়কর নিস্তব্ধতা নামে কখনও এই কবরে দেশে। পোড়া ভিটের ছাইয়ের স্তূপের দেশে। সন্ধ্যা নামতেই ওজুর পানির টুপটাপ, ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, তারপর নামাজের স্তব্ধতা নামে। সেই স্তব্ধতা ভাঙে আরও পরে, কিংবা ভাঙে না কখনও। যেন অনন্তকালের জন্য প্রকৃতি আর মানুষের এই নীরবতা করুণাময়ের কাছে আত্মসমর্পিত হয়। তখন প্রতিটি চোখ গোধূলির আলোয় ছলছল করে। টলটল করে। যমযম কূপের শান্ত পানির মতো।

অন্যদিকে মাটির তুলসী দেবীতে নয় মাসের তৃষ্ণায় মৃত তুলসী গাছের কংকালের পরিবর্তে একটি শিশু তুলসী গাছের মাটির রসে প্রাণের সংযোগের কি অক্লান্ত চেষ্টা! পরিত্যাগকারীগণ ফিরে এসেছে। তাই সন্ধ্যার আবছায়ায় ঐশ্বরিক গন্ধ ছড়ানো ধূপের ধোয়ায় চার পাতার চারা ওঠে। ক্ষুদ্র একটি তুলসীর চারা যেন শক্তিমান হতে হতে সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

গিরিশের যুবতী বৌ ভগবতী অনেক খুঁজে একটি তুলসীর চারা মরা তুলসী গাছটার জায়গায় পুঁতে দিয়ে জলে চোখ ভিজিয়ে হাতের লোটার জল ঢেলে দেয় চারার উপর। তার বিশ্বাস এই তুলসী চারা তার হারানো শিশুকন্যা। সে ফিরে এসেছে মায়ের কাছে তুলসীর চারার রূপ নিয়ে। তার পুনর্জন্ম হয়েছে মাটির গর্ভগৃহে।

গিরিশকে ভগবতী কথাটা বলে। চোখ মুছে জানায়, ‘আমার মেয়ে অতসী ফিরে এসেছে তুলসী গাছ হয়ে। প্রতি সন্ধ্যায় চারা গাছটায় ধূপ জ্বালাতে গিয়ে ওর মুখমালা দেখতে পাই।’

বৌকে গিরিশ প্রবোধ দিতে চায়, যদিও কষ্টটা তার বুকেও বাজে, ‘ভগবতী, তোমার মরা মেয়ে একদিন আসবে তোমার পেটে, তুলসীর চারাটা দেবী তুলসী, তোমার মেয়ে নয়, বুঝতে চেষ্টা কর।’

ভগবতী উত্তর দিতে পারে না। ঠিক তখনই নিত্যানন্দ হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে গিরিশের উঠোনে এসে দাঁড়ায়, ‘বুঝলি, গিরিশ, আমার লালু ফিরে এসেছে। একেই বলে বিশ্বাসের টান।’

গিরিশ বুঝতে একটু সময় নেয়। লালু হচ্ছে নিত্যানন্দের পোষা কুকুর। যুদ্ধ শেষের প্রায় সাতমাস পর তার বাড়ি ফেরা। এতদিন সে কোথায় ছিল? নিশ্চয়ই সুখে ছিল না। শুকিয়ে গেছে, রোম ও কিছুটা ঝরে গেছে। গলায় রশি বাঁধা। বুঝা যায় কেউ তাকে আটকে রেখেছিল। মুক্তি পেয়েছে। স্বাধীন হয়নি। নতুন প্রভুর বদলে পুরাতন প্রভু। এ ফেরা প্রভুত্বের কাছে ফেরা।

‘লালু ফিরলে আমার অতসীও ফিরবে’, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে ভগবতী। এ-কান্না বর্ষার আকাশের জলজ মেঘের মতো কান্না।

কবে ফিরেছিল অতসী? সেই উদ্বাস্তু সময়ে। করতোয়ার তীরের চরে। ভগবতীকে ডেকেছিল। ধরা দেয়নি। ভগবতীর স্বপ্নে আছে যে, নিশ্চয়ই এই দুনিয়ায়ও আছে সে। কিন্তু কোথায় আছে তার মেয়ে? স্বামী বলেছে পুনরায় তার গর্ভে ফিরবে সে। যে গর্ভগৃহ ছেড়ে দুনিয়ার জমিনে এসেছিল একদিন, সেই শূন্য ঘরে এখনও ফিরছে না কেন তার মেয়ে? প্রতীক্ষায় রয়েছে গর্ভগৃহ। কত আয়োজন।

অতসী মরেনি। নির্দয় ভীরু পলাতক পিতা তাকে মৃত ভেবে রাস্তায় পরিত্যাগ করেছিল পিতৃত্বের ভার লাগবের জন্য। কিন্তু কোথায় খুঁজবে অতসীকে। পুরুষটাকে কি সে সঙ্গে নিয়ে যেতে পাবে? কতবারই তো বলেছে, রাজি হয়নি। একা একটা মেয়ে মানুষ কোন নিরুদ্দেশে তালাশ করবে তাকে?

রূপী বৈরাগিনীর কথা মনে পড়ে ভগবতীর। যুদ্ধের ভেতর গ্রাম ছেড়ে কোথায় চলে গেছে, আজও ফেরেনি। সে গাইতো রাধার বিরহের গীত। ‘আমি মথুরা নগরে প্রতি ঘরে খুঁজিব কোথায় নিঠুর হরি ওই তো বুঝি রূপীর গীত শুনতে পাচ্ছে ভগবতী। হ্যাঁ, স্পষ্ট কানে বাজে।

গিরিশের বুকটাও খলবল করে, মেয়েটার জন্য। সত্যি কি মেয়েটার মৃত্যু ঘটেছিল? ভয়ার্ত পলাতক মন ভুল করেনি তো? যদি সে অজ্ঞান অবস্থায় পথের ধারে পড়েই থাকে, কেউ কি তাকে তুলে নিয়ে গেছে? নাকি বনের পশুরা খুবলে খেয়ে নিয়েছে? গিরিশের চোখে জল আসে। আক্ষেপে মন তার ভেঙে পড়ে। মনেও তো ঠিক পড়ছে না কোন গাঁয়ের পথে পরিত্যাগ করেছিল মেয়েকে। এ যেন স্মৃতিভ্রমের নিষ্ঠুর এক দুনিয়া। অন্ধকার, কি নির্মম আঁধার।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তেরধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব -পনেরো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *