ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব এক

তিনিই জন্মদাতা।

তিনিই ভয়ত্রাতা।

তিনিই কন্যাদাতা।

তিনিই বিদ্যাদাতা।

তিনিই অন্নদাতা।

তাই তিনি পঞ্চপিতা, পিতৃভূমি, পরমেশ্বর। তিনি পঞ্চপুরুষের আদি অখ- রূপ। আদি পিতা, স্বয়ম্ভু তিনি। নিজেই স্রষ্টা। কোটি বৎসর পূর্বে মহাসমুদ্র থেকে তার উত্থান। মৃত্তিকা তার মেদ। বৃক্ষ, তৃণ তার কেশ, নদী তার রক্তশিরা। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের দীর্ঘকায় যিনি, তিনি আবার দেবতা শিবের মতো অর্ধনারীশ্বর। অর্ধেক নারী। অর্ধেক পুরুষ। পুত্রগণ, প্রপুত্রগণ, প্রকন্যাগণ শ্রুতিধর কাকেশ্বরের মুখে এমনি প্রবচন শুনে বিস্মিত। বহু রাত, বহু দিন, বহু বৎসর অতীতের আকাশে লুকিয়ে থেকে তিনি আবার এসেছেন এই লোকালয়ে। শ্রোতাগণ বিশ্বাস করে কাকেশ্বর পূর্বজন্মে কাকপক্ষী ছিলেন। তাই তিনি জাতিস্মর। কাকেশ্বর দাবি করেন অন্য এক জন্মে পলাশি যুদ্ধের সময় তিনি রবার্ট ক্লাইভের গুপ্তচর ছিলেন। তার যাতায়াত ছিল যেমনি কলকাতা দুর্গে, তেমনি মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজের দরবারে। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়ির দুয়ারও ছিল তার জন্য উন্মুক্ত।

কৌতূহলি প্রজারা দূর-তফাতে দাঁড়িয়ে দেখত কে একজন আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা ইরান থেকে আগত খোজাদের মতো লম্বাটে চেহারার মেয়ে মানুষ নবাববাড়ির সদর দরজা অতিক্রম করছে। এটি যে ছদ্মবেশী কাকেশ্বর তা কেউ বুঝতেই পারত না। নবাব সিরাজ জানতেন কাকেশ্বর তারই বিশ্বস্ত লোক। কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে চেনা কি সহজ? এতটুকু বলার পর কাকেশ্বর ঠাঠা হেসে উঠেন। প্রাচীন এবং নবীনগণ পরস্পর মুখ দেখে। হাসি মাখিয়ে কাকেশ্বর বলেন, কালো পোশাকে ছদ্মবেশ ধরে নবাব মহলে প্রবেশ করতেন তিনি, এমনভাবে হাত দুটো দোলাতেন যেন মর্ত্য নয়, অমর্ত্যরে বায়স।

আর ঠিক তখনই ঘনায়মান সন্ধ্যার আবছা আঁধারে প্রাচীন বটগাছটির রহস্যময় গুচ্ছ শেকড়ের অন্ধকার ফোকর থেকে প্রেতের ঠান্ডা নিশ্বাস বের হয়। পর মুহূর্তেই বিদ্যুতের ঝলকের মতো একটি লম্বা আফগান তরবারির শরীর ঝলকে ওঠে। উপস্থিত সমবেত প্রাচীনগণের শরীরে মৃত্যুভয়ের স্রোত বয়ে যায়। কাকেশ্বর তাদের জানান এ নিশ্বাস পলাশির যুদ্ধে নিহত নবাবের রাজপুত্র সেনাপতি মোহনলালের। আবছায়া আঁধারে যে তরবারি বিদ্যুতের মতো ঝলকে ওঠে তা হচ্ছে মোহনলালের তরবারি। কাকেশ্বর এমনও দাবি করেন যে, এই বটবৃক্ষ হচ্ছে পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র আম আর পলাশ বনের পশ্চিম সীমানার যুদ্ধ সাক্ষী সেই বটবৃক্ষটির বংশধর। গঙ্গা-ভাগীরথীর প্রবল বন্যাস্রোত বটের একটি বীজ ভাসিয়ে এনে এখানে প্রজন্ম সাধন করেছে। এখনও স্বর্গদূতের আনীত স্বর্গবৃক্ষের আদি সাক্ষী।

‘আমরা শুনেছি যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগের সময় নবাব সিরাজ একটি বটগাছের আড়াল থেকে, মিরজাফরকে অবলোকন করছিলেন, তবে কি এটি সেই বটেরই বংশধর?’ প্রাচীন ধরিত্রী দাস এর উত্তর জানতে চায়। তখন সমবেতগণ অজাগতিক সেই শীতল নিশ্বাস আর ভৌতিক তরবারির ঝলকের ভয়ার্ত শিহর থেকে মুক্তি পায়।

কাকেশ্বরের স্বর ফিসফিস করে, ‘আজও নবাবের আত্মা ছায়ামূর্তি ধরে সেই যুদ্ধের সময় ক্লাইভের কামানের গোলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বটগাছটির টিবির মতো চিহ্নের পাশে জোনাক রাতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।’

‘কেন, কেন?’ সমস্বর প্রশ্ন আসে।

‘কেন না নবাবের সোনার সুতায় নকসা করা পাদুকাজোড়ার একটি সেই বটের তলায়ই তিনি হারিয়েছিলেন, কাকেশ্বর আকাশে চোখ তুলে বিড়বিড় করেন, ‘যুদ্ধ শেষে যে রাত আসে সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না, ঘোর অমাবস্যা, সাক্ষী ছিল কেবল অন্ধকার রাত।’

তারপর নীরবতা নেমে আসে। অনতিদূর থেকে বাতাস বয়ে আনে ফসলের গন্ধ। কাকেশ্বর ভয়ে ফিসফিস স্বরে বলে, ‘আমি এক নারীর কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তোমরা কি পাচ্ছ?’

‘কই, না তো?’ নীচু গলায় উত্তর দেয় ধরিত্রী দাস।

‘ওই দেখ মাঠের শেষ প্রান্তে ইরানি পোশাক পরা কে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। চেন ওকে? কোন সে রমণী?’

‘সত্যি তো? কে তিনি সোনার পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন? ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন কেন? কেউ কি তাকে হারিয়ে ফেলেছে?’

‘ইনি নবাব সিরাজের বেগম লুৎফা, আজও তিনি স্বামীকে খুঁজে বেড়ান। তার হাতে রয়েছে নবাবের হারিয়ে যাওয়া একপাটি জুতো। গলায় পান্নার তজবি?, কথাটুকু শেষ করে কাকেশ্বর ওঠে দাঁড়ান। কাকের ডানা ঝাপটানোর মতো শব্দ হয়। কাকেশ্বরের দেহ অদৃশ্য অজাগতিক হয়ে যায়। অনতিদূরের মাঠ প্রান্তের নারী মূর্তিটিও আর নেই। গভীর স্তব্ধতা নেমে আসে চারদিকে।

রাত আরও গভীর হয়। চাঁদ ডুবে গেলে আকাশের রাত জমাট বেঁধে তলদেশে মাটির সঙ্গে নিবিড় হয়ে দুর্বোধ্য হয়ে যায়। নিশিপতঙ্গেরা মাটির ছিদ্রপথে বেরিয়ে এসে ডাকতে থাকে। কালো বাতাসে প্রেতাত্মার নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। তখনি ধরিত্রী দাস দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে ফিসফিস কথা কয়, ‘তোরা সবাই জানিস আমাদের আদিপিতাগণ মাতা এবং পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে নবাব সিরাজের হত্যার পর ভয় পেয়ে গভীর রাতে পলাশি ছেড়ে গঙ্গা-ভাগীরথী পেরিয়ে পদ্মা-মেঘনার দেশে চলে আসে।’

‘এর সাক্ষী কে?’ সমস্বরে দাবি ওঠে।

এক চোখ অন্ধ দমনকে বলে, কেন, আমি কি নই?’

তখন দমনক ধরিত্রী দাসের দিকে একচোখে তাকিয়ে তার কথামালা বর্ণনা করতে থাকে, ‘আমার পিতামহ যে কাপালিকের চেলা ছিল তার মাতা ছিল নগরবেশ্যা। সেই বেশ্যার পুত্রটি ছিল এক ইরানি বণিকের অবৈধ সন্তান। সে কিনা আবার নগর আলিওয়ার্দীর বেগম মহলের খোজা প্রহরী। যুদ্ধের ভিতর বেগম মহল থেকে সে হারিয়ে যায়। সে-ই দেখেছিল ভয়ার্ত প্রজাগণ ভাগরথী নদী পার হতে গিয়ে নৌকাডুবিতে অনেকে মরেছে। যারা ছিল জীবিত তারাই নদী পার হয়ে ক্লাইভের সৈন্যদের ভয়ে নদী তীরের গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যায়। তারাই পদ্মা-মেঘনার তীরে বসত গড়ে।’

সমবেতগণ তখন শিউরে ওঠে। যুদ্ধ পলাতকেরাই যে তাদের পূর্বপুরুষ এমন বিশ্বাসে স্থিত হয় তারা। দমনক সেই পুরানকথা বলে চলে। সেই খোজা প্রহরী নবাবের পরাজিত বন্দি সেপাইদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত সেপাইদের লাশ ভাগীরথীর স্রোতে নিক্ষেপের কাজ করে তিন দিবস। সেই খোজা, মৃতদেহ নিক্ষেপের শেষ দিন সন্ধ্যাকালে দেখেছিল যে ইরানি দরবেশের লাশ নদীতে নিক্ষেপ করা হয়, সেই লাশ জিন্দা হয়ে তজবিহ হাতে জলের ঢেউয়ের উপর পা ফেলে নদী অতিক্রম করছে। তার কালো পাগরি থেকে রক্ত ঝরছে। আলখাল্লার রং রক্তবর্ণ।

সেই অলৌকিক পুরুষ নদীর পূর্বতীরে নামাজের ভঙ্গিতে দু’হাত প্রসারিত করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কতক্ষণ? কেউ জানে না, কেননা তখন রাতের অন্ধকার নামে। দমনক এমন দাবিও করে যে, সেই অলৌকিক শক্তির অধিকারী দরবেশের পিছু নিয়েছিল যে দলটি তারা দমনক বা ধরিত্রী দাসদেরই হারিয়ে যাওয়া বংশধর। তারা এমনও শুনেছে সেই হারিয়ে যাওয়া দলটি আপন ধর্ম এবং মূর্তি পূজা পরিত্যাগ করে দরবেশের কাছে ইসলাম ধর্ম কবুল করেছে।Print

তবে তারা এখন কোথায়? এমন কলরবের ভেতর হাহাকার ওঠে। যেন মহাসময়ের বহু যোজনপথের ধূসর একজগৎ। শরীরের কোন রক্তধারা কোথায় কোন নতুন রক্তধারার সঙ্গে মিশে গেছে খুঁজে পাওয়া কারও সাধ্য নয়। দূর আসমানে তখন তারা জ্বলে। তারারা পৃথিবীর সাক্ষী থাকে। শস্যভূমি, বীজের অংকুরোদ্গম, প্রাচীন বৃক্ষের ক্ষয়, পাখির বিষ্ঠা থেকে পরিযায়ী বীজের পরিভ্রমণ এবং নতুন অরণ্য-উপনিবেশ গড়া, সবই মনুষ্যগুলোর চোখে অবোধ্য-রহস্য। তাই এই গ্রামে স্মৃতি হারায় না। পূর্বপুরুষের স্মৃতি ধারণ করে তারা নবান্নে, নববর্ষে। তাদের তারা স্মরণ করে। নবান্ন নিবেদন করে, বসন্তের নবপুষ্প পল্লবে অর্ঘ্য সাজিয়ে মৃত পূর্বপুরুষের আবাহন করে। ওরা বিশ্বাস করে আদি-পিতা-মাতাগণ পাখি-পঙ্গ-চাঁদ-সূর্যের আলোর রূপ ধরে এসে উত্তরপুরুষের নৈবেদ্য গ্রহণ করে আশীর্বাদ করে যায়।

তাই রাত আরও গভীর হলে সমবেতগণ অন্ধকারের ভেতরই বর্ষার জল ভেঙে হাঁটার মতো যে-যার বাড়ি ফিরে যায়। ধরিত্রী দাস তখন একাকী। বাড়ির মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। কালো আলখাল্লা পরা প্রাচীন দরবেশের মতো অন্ধকার রাত নিস্তব্ধ। কিন্তু বাতাস ছিল বলে তেপান্তরের দীঘল শস্য ভূমি থেকে বিন্নিধানের রেণুর ঘ্রাণ বাবুই পাখির ঝাঁকের মতো উড়ছিল। ধরিত্রী দাসের মনে হয় মিথ্যে বলেনি কাকেশ্বর। এই পবিত্র শস্য ভূমির মাটিই তাদের পঞ্চপিতা, পিতৃভূমি, পরমেশ্বর। এই পঞ্চপিতার দেশই উর্বর করেছে মৃত আদি পিতা-মাতার অস্থি, কংকাল, দেহাবশেষ। তাদের পুনর্জাগরণ ঘটে শস্য-দানার অংকুরোদ্গমের ভেতর। তাই বুঝি ধরিত্রী দাসের চোখে জল নামে। পলাশির যুদ্ধ পলাতক নতুন আশ্রয় সন্ধানী আদি পুরুষ আর রমণীদের মুখ স্মরণ করতে চায় সে। মেলাতে পারে না। তারপরও মনে হয় তার হৃৎপিণ্ডে, ধমনিতে ওরা মিশে আছে ঈশ্বরের মতো।

Series Navigationধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব দুই >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *