ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// দশ

পঞ্চপিতা
॥ দশ ॥

সন্ধ্যা নামলে গিরিশের বৌ ভগবতীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল বৌটি? ডাকাডাকির পরেও সাড়া মেলে না। গুজব রটেছে, এই করতোয়ার চরে জলপেত্নিরা ঘুরে বেড়ায়। প্রতি বর্ষায় নৌকাডুবিতে যে সব মেয়ে মানুষের অপমৃত্যু ঘটে তারা সবাই জলপেতিœ হয়ে যায়- জনশ্রুতি এই, কোন এক জেলে যুবককে এই চরেই গলার নলি ছিঁড়ে খুন করে রক্ত চুষে খেয়েছিল এক জলপেত্নি। যুবক জেলের গলায় দাঁতের দাগ মিলেছিল। বোকা জেলে বুঝতে পারেনি। একা অমাবস্যা রাতে মাছ ধরতে এসে পেত্নি ফাঁদে ধরা দেয় সে। আকাশে সে রাতে চাঁদ না থাকলেও তারা ছিল। গাছগাছালি শুন্য চরে তারার আলোয় হঠাৎ জেলের সামনে এসে দাঁড়ায় জলপেত্নি সুন্দরী যুবতীর বেশে। সে জানায় যুবক জেলেকে সে চেনে এবং জলবাসে। স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে গাঙের পাড়ে তার খোঁজেই এসেছে সে তাই।

বোকা জেলে পেত্নি কথায় বিশ্বাস করে। সে ভেবেছে হয়তো এই যুবতী বৌ তাকে গাঁয়ে মাছ নিয়ে ফেরি করতে দেখেছে। লোভ সামলাতে পারেনি। পেত্নির মিলনের আহ্বানে সাড়া দেয়। পাশে যেতেই পেত্নি তাকে দু’হাতে জাপটে ধরে। একি! বৌটির শরীর মরা মাছের মতো ঠাণ্ডা কেন? শরীর থেকেও মাছের গন্ধ ছুটছে। সে তখন বুঝতে পারে বৌটি মানুষ নয়, জলপেত্নি, তখন পালবার পথ ছিল না। পেত্নির পেশির প্রচ- চাপে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জলপেত্নি তার বুকে চরে বসে বাঘের থাবার মতো নখ দিয়ে গলা ছিঁড়ে ফেলে এবং দাঁত বসিয়ে দেয় রক্ত নেমে আসা গলায়। পরদিন জেলেরা তার মৃতদেহ গাঙের চরে পড়ে থাকতে দেখে। প্রাণ শূন্য। শরীর রক্তশূন্য।

তবে কি করতোয়ার জলপেত্নি তুলে নিয়ে গেছে ভগরতীকে? বহুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর নদীর কিনারায় অজ্ঞান অবস্থায় ভগবতীকে খুঁজে পাওয়া যায়। ঝুপড়িতে তুলে আনার অনেক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে ভগবতীর। সে তখন দাবি করে নদীর দিকে সে তার রাস্তায় ফেলে আসা মৃত সন্তানের কান্নার শব্দ শুনেছে। সেই কান্নার শব্দ অনুসরণ করতে করতে সে নদীর তীরে এসে পড়ে। সে এমনও বলে, জলের কিনারে তার সন্তানকে বসে থাকতে দেখেছে। বিড়বিড় করে ভগরতী বলে, ‘আমি আমার মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়াতে গিয়েছি, কি ক্ষুধা তার, কতদিন দুধ পায়নি! আমার বুকে অনেক দুধ জমেছিল। দুধ খাওয়ার পর আমার মেয়ে নদীর জলে নেমে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।’

গিরিশ তাকে বুঝায় এসবই তার মতিভ্রম। তার মেয়ের মৃত্যু ঘটেছে। আবার অন্য মনে ভাবে, হয়তো মৃত মেয়ের আত্মা নতুন রূপ নিয়ে মায়ের বুকের দুধ খেয়ে গেছে। এই অতৃপ্ত শিশু মাকে মুক্তি দেবে না। তাই গিরিশ বলে, ‘বৌ, তোর হারানো মেয়ে একদিন তোর পেটে আবার ফিরে আসবে। যুদ্ধ শেষ হলে আমরা গাঁয়ে ফিরে যাব, তুই, পঞ্চপিতার ইচ্ছায় আবার মা হবি। তিনি চাইলে কি না হয় বল?’

‘যে যুদ্ধ আমার বুকখানি খালি করেছে তাকে পঞ্চপিতা যেন ক্ষমা না করেন, আমি অভিশাপ দিলাম’, ভগবতীর কান্না থামে, থামে না মনস্তাপ। মনস্তাপের ভিতর কতনা কথা।

তারপরও তার ঘুম আসে। করতোয়ার ভাটার স্তব্ধ জলের যত ঘুম। ঘুমের ভিতর সে স্বপ্ন দেখে। বসন্ত বউরি পাখি হয়ে মেয়ে ফিরে আসে মায়ের কাছে। মাথায় লাল ফোঁটা শরীর ঘন সবুজ। সেই পাখি মাকে দেখে। বারবার দেখে।

রাত পোহালে গৃহহারাদের বস্তিতে রূপ কথা চাল-জল নিয়ে আসা ভিন গাঁয়ের মানুষগুলো। প্রাচীন লোকটি হারানো এক পুঁথির বয়ান বলে যায়। সেই পলাশির যুদ্ধের কথা। নবাব সিরাজের কথা। আর বলে অন্তিম যাত্রার কথা। বলে, কিভাবে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। এই জনশ্রুতি তারা বংশপরমপরা স্মৃতিতে বয়ে বেড়াচ্ছে। বিচ্ছিন্ন দলটিকে যে পির-আওলিয়ার সঙ্গে এসেছিল, তার কথা পাড়ে। কিভাবে ধর্ম বদলে পির তাদের মুসলমান করে দেয়, তাও জানায়।

সেই পিরের নামে শপথ নিয়ে প্রাচীন ব্যক্তি বলে, সেই পিরবাবা কবরের ভিতরও জাগ্রত। স্বপ্নে তার দ্বারাই আদিষ্ট হয়ে তারা করতোয়ার চরে এই ঘরছাড়াদের খুঁজে পায়। তারই নির্দেশে খাদ্যের যোগান দিচ্ছে। এ যেন কুদরতি কিসসা।

কেন ছুটে যাচ্ছে, তাদের দিকে ফিরে না-তাকিয়ে করতোয়ার চরে আশ্রয় নেয়াদের কাছে কেন আসা? এ কোন খেলা?

‘এর শানে-নজুল আমরা জানি না, পির বাবার ইচ্ছাই পূরণ করছি’, প্রাচীন ব্যক্তি এমনটাই দাবি করে।

আর তখনই স্তব্ধতা ভেঙে নিত্যানন্দ হাউমাউ কেঁদে ওঠে, ‘আমরাও পলাশির পলাতক। আমরা শুনেছি আমাদের দলবিচ্ছিন্নদের এক দরবেশ উদ্ধার করে তার অনুগামী করেছিল, তারা কোথায়? তোমাদের পূর্ব পুরুষেরাই কি ছিল সেই হারানো কাফেলা?’

তখন কি এক গায়েবি শক্তির ইঙ্গিতে চারদিকে কান্নার রোল উঠে। প্রতিটি মানুষ যেন বর্ষা প্লাবিত উত্তাল ঢেউয়ের করতোয়ায় ডুবতে থাকে। একটা প্রবল ঝড় ওঠে। যেন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বুঝি নিঃস্ব হয়ে যায় ঘরছাড়াগণ। একটা জিজ্ঞাসার প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে তারা জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। ভিনগাঁ থেকে আগতগণ এবং ঘড়ছাড়াগণ বাক্যহারা। একি পঞ্চপিতা আর কবরের ভেতর জাগ্রত দরবেশের জটিল কোনো খেলা? শত শত বছর পর পথহারা বিচ্ছিন্নদের সঙ্গে পুনর্মিলন? পুনর্মিলনের এই কি রহস্য?

একি বাইবেলের সেই ভ্রাতার ভাগ্য, যে মরুভূমিতে হারিয়ে গিয়েছিল এবং হারিয়ে যাওয়া ভ্রাতা তার হারানো ভেড়ার বদলে ভেড়া পেয়েছিল, ঘরছাড়াগণ কি পাবে? পশুদের তারা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করেছিল শস্যভূমি পরিত্যাগের মতো। কিন্তু পোষা কবুতরেরা নিজেরাই প্রতিপালকদের পরিত্যাগ করে। কবুতরেরাও কি দেশান্তর?

কয়েক মুহূর্তের ভেতর এই মহামিলন চোরা অবিশ্বাস আর সন্দেহের গোলকধাঁধা তৈরি করে। এই যে দুটি জনগোষ্ঠী একটি যুদ্ধের ভিতর দিয়ে একে অন্যকে আবিষ্কার করে, এতে সত্যমিথ্যা দোল খায়। কেননা বিচ্ছিন্ন নবাব সময়ের কোনো সাক্ষ্য নেই। যা আছে তা হচ্ছে জনশ্রুতি আর কিংবদন্তি। কেননা ওরা দেখতে পাচ্ছে কেবর ধর্মেই নয়, পোশাকে এবং ভাষায়ও তারা বদলে গেছে। উত্তরাঞ্চলে আর দক্ষিণ অঞ্চলের ভাষার ভেদ। সমতটের বাংলা আর পুন্ড্রবর্ধনের বাংলা মুখের বুলি আলাদা। এ যেন বাইবেল বর্ণিত ‘বাবিলে ভাষাভেদ।’

‘সমস্ত পৃথিবীতে এক ভাষা একরূপ ভাষা ছিল। পরে লোকেরা পূর্বদিকে ভ্রমণ করিতে করিতে শিনিয় দেশে বসতি করিল। পরে এক নর ও উচ্চগৃহ নির্মাণ করিল এবং ভূমন্ডলে ছিন্নভিন্ন হইল। নীচে যাহারা ছিল তাহাদের সঙ্গে উচ্চ বসবাসকারীদের ভাষার ভেদ জন্মাইল। অসন্তুষ্ট সদাপ্রভু মনুষ্য সন্তানদের ভাষা ভেদ জন্মাইলেন। ফলে একজনের ভাষা অন্যজন বুঝিতে পারিল না। এইভাবে ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীর ভাষার ভেদ জন্মাইলেন এবং ভূমণ্ডলে পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন করিলেন।’ [ওল্ড টেস্টমেন্ট, বাইবেল]

তবে কি তারা অভিশপ্ত জাতি? তা না হলে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হলো কেন? কেন, পরস্পরের ধর্মবেধ আর মুখের বুলির ভেদ সৃষ্টি হলো কেন? এমন ভাবনার ভেতর হঠাৎ নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এতক্ষণ মহামিলেনের যে উচ্ছ্বাস বইছিল তা হঠাৎ থেমে যায়। তারা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে। এ যেন বোবা এবং প্রাণশূন্য দৃষ্টি। ঠিক তখনই নিত্যানন্দের আদি পুরুষদের কথা মনে পড়ে। কাকেশ্বর, ধরিত্রী দাস, দমনক, চণ্ডরব আর নীলকণ্ঠ যেন ছায়ারূপ কায়া হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কেবল নিত্যানন্দ নয়, ঘরছাড়াগণ কোন এক যাদুস্পর্শে ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ওরা স্পষ্ট দেখতে পায় আদি পুরুষেরা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই আদি পিতাগণ সমস্বরে অতীন্দ্রিয় এক দুনিয়া থেকে যেন বলছেন, ‘প্রপুত্রগণ, তোমরা ধন্য, কেন না তোমাদের বিচ্ছিন্ন আত্মা আর রক্ত আজ এক মহামিলনের মধ্য দিয়ে পবিত্র হলো। তোমরা আনন্দ কর, কাউকে অবিশ্বাস করোনা। নিজেদের এবং অপরদের ধর্ম আর সুখের বুলিকে ধন্য কর। তোমরা ধন্য।’

এমনটাও কথা হয়, রক্ত সম্পর্কের বাস্তুহারাদের আগতগণ নিজ গ্রামে নিয়ে যাবে এবং উৎসব করবে। বাস্তুহারাগণ রাজি হলেও পরিত্যক্ত ভিট বাড়িতে ফিরতে ব্যাকুল। কিন্তু বহুদূর থেকে ভেসে আসা কামানের অস্পষ্ট গর্জনে ওরা ভয় পেয়ে যায়। এমনও প্রত্যাশা তাদের, বাস্তুহারাদের যে প্রিয়জনেরা যুদ্ধে গেছে তারা ফিরে আসুক এবং সঙ্গে থাকুক। তারপর যাত্রা।

পথিমধ্যে লুণ্ঠিত কন্যার পিতা চোখের পাতা ভিজিয়ে তার হারানো কন্যার কথা পাড়ে। সে রামায়ণের বনবাস কালে রামচন্দ্রের স্ত্রী রাবণ কর্তৃক অপহৃতা সীতাদেবীর দুর্দশার কথা বলে প্রলাপ বকে। যদি কোন দিন তার কন্যাকে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্বার করে ফিরিয়ে দেয় তবে কি সে তাকে গ্রহণ করতে পারবে? সতীত্ব হারানোর সন্দেহে অগ্নি পরীক্ষা করবে না কি সে? যদি পরীক্ষায় হেরে যায় কন্যা, তবে কি পিতা তাকে হত্যা করবে? অস্বীকার করবে? যিশুকে মৃত্যুর পূর্বে শিষ্যের অস্বীকারের মতো?

একদিকে গৃহহীন আর স্বজন হারাদের মহাশোক এবং অন্যদিকে বহু শতাব্দী পর বিচ্ছিন্ন রক্তধারার সঙ্গে পুনর্মিলনের আনন্দে এক মহাঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ওরা। আচ্ছন্নতা কাটলেই ওরা সিদ্ধান্তে আসে যে, পলাশির সেই আদি মহাযাত্রা যা ছিল স্বর্গ তেকে মর্ত্যে বিতাড়িত আদম-হাওয়ার অজানা মর্ত্যযাত্রার মতো অনিশ্চিৎ এবং দুঃখময়, স্মৃতিধরেরা সেই প্রাচীন কিংবদন্তি বলবে পরস্পর সপ্তদিবস সপ্তরাত। ফুরাবে না, সে এক মহাকাব্য, মানুষের দুর্ভোগ অথচ নতুন স্বপ্নের হাাজর পৃষ্ঠার কাব্যকথা। পঞ্চপিতা পিতৃভূমি পরমেশ্বর তার সাক্ষী থাকবেন। একটি জনগোষ্ঠীর সেই রূপকথা ফুরাবে না, হাজার আরব্য রজনী ফুরালেও।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয়ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *