ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয়

পঞ্চপিতা ॥ নয় ॥
পলাশির পলাতকদের বংশধরেরা যেদিন করতোয়া পারে আশ্রয় নেয়, সেদিনই মহাউত্থানের মহাকাল পুনরুত্থান ঘটায় ভাষা শহীদ বরকত আর গণঅভ্যুত্থানের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের। তাদের আত্মা গণকবরের আত্মাদের সঙ্গে প্রবেশ করে সীমান্তযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার ভেতর। এই যে আত্মার ভেতর আত্মার প্রবেশ, তা এই জাগতের নয় বরং অতীন্দ্রিয় জগতের জটিল রহস্য। এই রহস্যের মায়াজালের ভিতরই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মহা বিপর্যয়ের ভিতর আঘাতের পর আঘাতে ছিন্নভিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে হতে নিরুদ্দেশ যাত্রীদের একটি অংশ করতোয়ার পারে পৌঁছে। আসলে এই স্থান সভ্যতা বিচ্ছিন্ন নদীর একটি আদিগন্তবিস্তারী জলমানব বর্জিত নদীর চর। যাত্রীগণ তীর্থমহিমাখ্যাত করতোয়ার স্বচ্ছ জলস্রোতে দীর্ঘদিন পর পবিত্রস্নান করে। আহা! নদী নয় তো স্বর্গের নদী অলকানন্দা। দেবতাদের স্নানভূমি।
‘বৃহৎপরিসরা পুণ্যা করতোয়া মহানদী’। মহাভারতের তীর্থযাত্রী পা-ব পুত্রগণ এ নদীতে অবগাহন করেন। যুদ্ধ পলাতকেরা এই যে পুণ্যস্নান করে তা বাইবেলের নিব যিশুর মতো। ব্যাপটিস্টদাতা পুণ্যাত্মা জন নবিত্ব লাভের পূর্বে যিশুকে পবিত্র নদী জর্ডন দরিয়ায় পুণ্যস্নান করান। তখন পবিত্র আত্মা কবুতরের রূপ ধরে যিশুর মস্তকে বসার পর তা তার আত্মায় প্রবেশ করে। কর তোয়ার পুণ্যস্নানে পঞ্চপিতা পিতৃভূমির সন্তানেরা পথিমধ্যে প্রিয়জন হারানোর শোক সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করে। কেননা পঞ্চপিতার পবিত্র আত্মা তাদের আত্মায় প্রবেশ করে সবার অজান্তে।
সে কারণেই তারা জানতে পারে চট্টগ্রামের শহীদ সূর্যসেনের পুনরুত্থান ঘটেছে, ক্রশে বিদ্ধ যিশুর কবর থেকে তৃতীয় দিবসে পুনরুত্থানের মতো নয়, বরং অর্ধ শতাব্দীকাল পর। ওরা শুনেছে গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অজ্ঞাত কোনো অরণ্যে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিংক্যাম্পে এক প্রভাতকালে সূর্যসেনের আবির্ভাব ঘটে। নিত্যানন্দই সেই বয়ান শুরু করে পদ্মাপুরান পাঠের সুরে।
তরুণ মুক্তিযোদ্ধাগণ দেখতে পায় দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের চোখ তখন সাপের চোখের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দুশমনের গুপ্তচর নয় তো? কিন্তু মানুষটির মুখে হাসি। তিনি জানান তার আগমন ঢাকা সেনানিবাস থেকে। তিনি সিপাই মাসুদ। দুশমনেরা জানে গভীর রাতে অতর্কিত আক্রমণে অন্যান্য সঙ্গিদের সঙ্গে আমার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে কৌশলে আমি পালিয়ে আসি। আজ এসেছি তোমাদের উন্নত ট্রেনিং দিতে এবং যুদ্ধে অংশ নিতে। সাক্ষ্য হিসেবে তিনি তার দুই হাঁটু আর হাতের কুনুইয়ের দীর্ঘ ক্রোলিং করে সেনানিবাস ছাড়ার চিহ্ন দেখান। ঠিক যেমনি যিশুক্রশে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর তিনদিন গর্তে কবর থেকে পুনরুত্থানের পর শিষ্যদের সামনে ক্রশের ক্ষতস্থান দেখিয়ে নিজের সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
টানা একমাস ট্রেনিং শেষ শেরপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিযোদ্ধা দলটি। সারারাত চলে যুদ্ধ। শেষ রাতে যুদ্ধ থেমে যায়। পরাজিত পাকবাহিনী বেশ ক’জন সঙ্গীর লাশ ফেলে পলায়ন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনির ভেতর সিপাই মাসুদ এগিয়ে আসেন। তিনি যোদ্ধাদের অসীম সাহসের প্রশংসা করে যা বলেন, তাতে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। আসমানের দিকে তাকিয়ে সিপাহি মাসুদ বলেন, ‘বন্ধুগণ, আমি মাসুদ নই, আমি তোমাদের সূর্যসেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বন্দি অবস্থায় যে ফাঁসিতে প্রাণ দেয়। আমার অতৃপ্ত আত্মা তাই বারবার ফিরে আসে ন্যায়ের যুদ্ধে। এবার আমার বিদায়ের সময় সমাগত। মনে রাখবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কিন্তু বিজয়ের মধ্য দিয়েও শেষ হয় না। বিদায় বন্ধুগণ। গণযুদ্ধ জিন্দাবাদ।’
নির্বাক বিস্মিত যোদ্ধাগণ দেখতে পায় সিপাহি মাসুদের দেহের রূপান্তর ঘটে একপলকে। সূর্যসেন। বিপ্লবী সূর্যসেন। সূর্যসেন হেঁটে যান আকাশের শূন্যতায় পা ফেলে। ধীরে ধীরে তার শরীর সূর্যের আলোর পর্দার ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়।
নিত্যানন্দের বয়ান শেষ হলে কে একজন চেরাগি ফকিরের কথা স্মরণ করে। কিন্তু নিত্যানন্দ স্মরণ করতে চায় সেই সব পঞ্চপিতার পুত্রদের, যারা যুদ্ধে গিয়ে এখনও কোনো সংবাদ পাঠায়নি প্রিয়জনদের। তারপর যখন দূর গ্রাম থেকে এই উদ্বাস্তুদের জন্য গোপনে খাদ্য নিয়ে আসা গ্রামবাসীদের দেখতে পায়, তখন এই নরক জীবনের কষ্টের কথা স্মরণ করে তারা হাহাকার করে ওঠে। এক দিকে এই নির্জন চরে পশুর মতো জীবন আর অর্ধাহার তাদের ধৈর্য্যরে সীমা ভেঙে দিতে চায়। গ্রামবাসীরা উদ্বাস্তুদের যুদ্ধের রূপকথার গল্প বলে। তবু ওরা সীমান্ত পারি দিতে চায়। ওরা সীমান্তের ওপারের রূপকথা শুনেছে। ওখানে খাদ্যের শত শত পাহাড়-পর্বত। দেবতা শিবের জটা থেকে প্রবাহিত অমৃত ধারার গঙ্গা দেবভূমি হিমালয় থেকে পতিত হচ্ছে ওই দেশের মাটিতে। ওই পবিত্র ভূমিতে পা দিলেই যেন সব দুঃখ-শোক বিলীন হয়।
খাদ্য বিতরণকারীরা নদীর দীর্ঘ চরের বালিময় চিহ্নহীন পথে হারিয়ে যায়। পূর্ণচরণ, ভবদেব, নিত্যানন্দ, গিরিশ, কামাখ্যা চরণ এবং অন্যসব উদ্বাস্তুগণ নিশ্চুপ হয়ে যায় কখনই, যখন কপালের দোষের সীমানা খুঁজেও পায় না। যখন সন্ধ্যা নামে তখন আলোহীন অন্ধকার ঝুপড়ির ভেতর নীরবতা ভেঙে ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে ওঠে গিরিশের যুবতী বৌ ভগবতী। সে তার তিন মাসের অসুস্থ মৃতপ্রায় শিশুকন্যাকে অন্ধকার রাস্তায় পরিত্যাগ করে এসেছে। গিরিশের মনে হয়েছিল শিশুটি আর জীবিত নেই। সে স্তনের দুধও পরিত্যাগ করেছে, নেতিয়ে পড়েছে বৌ’র কোলে। গিরিশ তার নিজের স্ত্রীর পথক্লান্ত শরীরকে পৃথিবীর চেয়ে ভারি এই মৃত শিশুর বোঝা থেকে মুক্তি দিতে চায়। এ তো জন্মদাতা পিতার নয়, বরং রক্ষাকর্তা স্বামীর ধর্ম।
‘আমার কাছে তুলে দে বৌ, ওটা মরে গেছে,’ বলতে বলতে স্ত্রীর কোল থেকে শিশুটিকে টেনে তুলে নেয় শোকহীন পিতা। নরকযাত্রী দলটির সবার পিছনে ছিল ওরা। অন্ধকার অজানা পথে দল থেকে হারিয়ে যাবার ভয় মৃত্যুভয়ের চেয়েও ভয়ংকর। এরই মধ্যে দু’জন হারিয়ে গেছে। হয়তো আর হারিয়ে যাওয়া দলটিকে ওরা কোনোদিন খুঁজেই পাবে না। তাই গিরিশের কাছে যখন মনে হয় শিশুটির শরীর শীতের জলের মতো ঠাণ্ডা এবং বুকে কানচেপে ধরেও হৃৎপিণ্ডের আলামত খুঁজে পায় না, সে তখন আর জন্মদাতা পিতা থাকে না, শ্মশানচণ্ডাল হয়ে যায়। কাঁই আঁধারে পথের পাশে সে একটি প্রাচীন বেলগাছের তলায় শিশুটিকে পরিত্যাগ করে। কান্নারতা স্ত্রীর মুখে এক হাতে চেপে ধরে অন্যহাতে ওকে টানতে টানতে এগিয়ে চলে। কাফেলার অনেক পেছনে ওরা। ওই পেছনেই মৃত্যুর পদধ্বনি। আতঙ্কের আঁধার।
গিরিশের স্ত্রীর কান্না দেখে পূর্ণচরণও কেঁদে ওঠে। সে তার বিবাহযোগ্য কন্যা মালতিকে হারিয়েছে। নৌকা করে নদী পার হবার পথে অন্য নৌকার একদল সশস্ত্র পুরুষ তার কন্যাকে জোর করে তুলে নেয়। নারীর বিনিময়ে প্রাণ, এই নিষ্ঠুর যুক্তিতে পূর্ণচরণ এবং অপরাপর যাত্রীরা দম বন্ধ করে পড়ে থাকে।
পূর্ণচরণের কান্না আর বিলাপ শুনে এগিয়ে আসে নিত্যানন্দ। ফ্যালফ্যাল চোখে নিত্যানন্দকে দেখে পূর্ণচরণ। নিত্যানন্দ বলে, ‘পূর্ণ রে, কান্দিস না, এখন কান্দাকাটির সময় না। যুদ্ধ থামলে দেশে ফিরে দিন রাত কান্দিস।’
পাশের ঝুপড়ির জহিরুল শেখ পূর্ণচরণের ঝুপড়িতে প্রবেশ করে, কিয়ামতের কথা, হারিয়া দোজখের কথা বলে, আর বরে আল্লাহ রাসুলের বান্দার ঈমান পরীক্ষার কথা। শেষে বলে, ‘পূর্ণভাই, কান্দা থামা, খোদা বেরাগী হবে, মেয়েকে ফিরা পাবি, খোদার উপর ছেড় দে ভাই।’
হ্যাঁ, জহিরুলের খোদা আর পূর্ণচরণের ভগবান, এই জটিল রহস্যের ভেতর হারিয়ে যেতে যেতে এক সময় পূর্ণচরণের কান্নাও ফুরিয়ে পূর্ণচরণ অপলক তাকিয়ে থাকে জহিরুলের চোখে। তখন আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে বলেই জোনাকের আভা পড়েছিল জহিরুলের চোখে-মুখে। পূর্ণচরণের মনে হয় জহিরুলের চোখের মনি দুটো এক জোড়া পূর্ণিমার চাঁদ। জীবনে এই প্রথম জহিরুলকে চিনতে চায় পূর্ণচরণ। হাজার বছর বংশপরমপরায় পাশাপাশি গ্রাম-পাড়ায় বসবাস করছে, বিবাদ দ্বন্দ্ব যে হয়নি এমন নয়, তবে অবিশ্বাস বা ঘৃণা করেনি কোনকালে। সুখে-দুখে, পালা-পার্বনে, প্রতিদিনের জীবনে ভালোবাসার অভাব হয়নি। তারপরও মনে হয় পূর্ণচরণ সম্পূর্ণ চিনতে-বুঝতে পারেনি জহিরুল শেখকে। কোথাও একটা ফাঁক থেকেই গেছে হাজার বছরেও। জটিল রহস্যময় সেই ফাঁক। দুর্ভেদ্য।
সত্যি তাই। পূর্ণচরণরা কি জহিরুলদের চিনতে পেরেছে? জানতে পেরেছে? জহিরুলরা কি এইভাবে জেনেছে যুগযুগান্তর প্রতিবেশি হয়ে, বসবাস করেও, পূর্ণচরণদের? একে অন্যের আল্লাহ-ভগবান, পরব, পূজা, রোজা সবই তো দূর থেকে দেখা। মনের ভিতর যে খোদা আর ভগবান তা কি তারা একে অন্যের বিশ্বাসের গভীরে প্রবেশ করে চিনতে পেরেছে? কোনদিন চেনার চেষ্টা করেছে? চেনা-জানার ভেতর অদৃশ্য যে ফাঁক রয়েছে তা কি ওরা বুঝতে পেরেছে পরস্পরের ঘরে বসে রান্না ভাত খেয়েও? একটি যুদ্ধ, ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়, সেই সত্যের, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি দুটো মানুষকে আজ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারা বুঝতে পারে এতকিছুর পরেও তারা একে অন্যের কাছে অচেনাই রয়ে গেছে। সেই অক্ষমতা, সেই অপরাধবোধ তাদের দুটো মানুষের চোখে জল গড়ায়। প্রশ্নটা ওদের গোলকধাঁধায় ঠেলে দেয়।
রাতে ঘুম আসে না জহিরুলের। চাঁটাইয়ের বিছানার তলায় করতোয়া নদীর চরের ঠান্ডা বারি। কাশফুল গাছের বেড়ার ফাঁকে চরের জোনাক লেপটে আছে। গাছ-গাছালি শূন্য কাশবনে ছাওয়া চা বাতাস দোল খায়। অনতিদূরের করতোয়ার জলে হয় তো ঢেউ খেলে। সেই বাতাস নদীর জলে ভিজে এসে চরের কাশ ঝোপে লুটিয়ে পড়ছে। তারই মৃদু শন্ শন শব্দ শুনতে পায় জহিরুল। আর কতদিন, পোড়া ভিটে আর গণকবরের গাঁয়েই ফিরে যাবে সে। আবার নতুন ঘর বানাবে। নিত্যানন্দ রাও ফিরে যাবে। সে তাদের হিন্দুস্থানে যেতে দেবে না। ওই দেশে গেলে কেউ আর ফেরে না। সেই ছোটবেলা, মনে আছে আজও, দেশ ভাগের পর যারা গ্রাম ছেড়ে গেছে তারা কি আর ফিরে এসেছে? না, ফেরেনি। ওই দেশটা রাক্ষসী, মানুষকে গিলে খায়। যে যায়, সে আর ফেরে না। ইচ্ছে থাকলেও আর ফেরা হয় না। মরণকালে সেই আক্ষেপটাই টিকে থাকে। আর সব শেষ হয়ে যায়।

ReplyForward
Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আটধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *