ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তের


পঞ্চপিতার এই গ্রামে মালতির লাশ শ্মশানের আগুনও পায় না, গোরস্থানের মাটিও না। লাশের অভ্যন্তরে অদৃশ্য আর একটি লাশ। পৃথিবীর কেউ ওকে চেনে না, দেখেওনি কোনোদিন। তার পিতা অজ্ঞাতধর্মও অজ্ঞাত। একের অভ্যন্তরে দুই। যুদ্ধ পলাতক কুমারী নারীর ধর্ষণ, গর্ভধারণ এবং আত্মহননের লাশের বিধান মানুষের শাস্ত্রে নেই। তাই নদীর অতল জলের গহনে নিক্ষিপ্ত হয় মালতির লাশ। একের ভেতর দুই।

কিন্তু মালতির লাশ নদীতে যারা নিক্ষেপ করে তারা দেখতেও পায় না কি করে মৃত মালতি তার পেটে মৃত শিশুর ভ্রƒণ নিয়ে নদীর তলদেশ দিয়ে হেঁটে চলেছেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিরামহীন হেঁটে হেঁটে মালতি একদিন সমুদ্রের অতলে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই অদৃশ্য জগতে মালতির রূপান্তরও ঘটে বারটি পূর্ণিমা আর বারটি অমাবস্যা রাত কাটিয়ে। মালতি মৎস্যকন্যা হয়ে যায়। মৎসকন্যা মালতি দীর্ঘ সাঁতারের পর একদিন তার চিরচেনা নদীতে চলে আসে। সে খোঁজে তার পিতা পূর্ণচরণকে। কিন্তু সাক্ষাৎ ঘটে না। হয়ত সময়ের পূর্ণতা আসেনি। কবে আসবে?

পূর্ণচরণ প্রতিজ্ঞা করেছে সে আর কোনোদিন নদীর জলে নামবে না। কেননা এই নদীর জলেই তার মেয়ের লাশ গ্রামবাসী ভাসিয়ে দিয়েছে। তাই নদীর সঙ্গে তার আড়ি। কিন্তু মৎস্যকন্যা মালতি তো তার পিতার সাক্ষাৎ চায়। কিন্তু মেলে না। অথচ গ্রামবাসীদের অবাক করে দিয়ে নদীর জেলেরা জানায় তারা এক মৎস্যকন্যাকে নদীর জলে সাঁতার কাটতে দেখেছে। একবার নয়, বেশ ক’বার। এমনটা ঘটেছে জোনাকপড়া রাতে। যতবারই কাছে যেতে চেয়েছে ততবারই জলের তলায় হারিয়ে যায় মৎস্যকন্যা। তজ্জব এই, যারা পূর্ণচরণের মেয়ে মালতিকে দেখেছে তারা দাবি কছে মৎস্যকন্যার মুখখানা পূর্ণচরণের মেয়ে মালতির মুখের সদৃশ। সে মালতিই, অন্য কেউ নয়।

কিন্তু ফালগুনের শেষ পূর্ণিমা রাতের পর আর কখনও নদীতে মৎস্যকন্যার মুখ দেখতে পায়নি জেলেরা। মৎস্যকন্যার পাঁচালি পূর্ণ-র কানে গেলে ছটফট করে সে। নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে একদিন জোনাকে পূর্ণচরণ গাঙের তীরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তার মৎস্যকন্যা মেয়ের মুখটা যদি এক পলক দেখতে পেতো! প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সামনে জোনাকপড়া গাঙে কলাপাতার শিরের মতো মৃদু ঢেউ ভাঙে। মনে হয় তার মেয়ে মালতির ঢেউ খেলানো চুল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে পূর্ণ-র। বিড়বিড় করে বলে ‘স্বর্গশিশুর রূপ ধরে আমার কছে ফিরে আয় মা। যুদ্ধের কত গল্প জমে আছেরে মা আমার বুকের ভেতর। কি ভয়ঙ্কর যুদ্ধরে মা মালতি।’

জোনাক রাত গাঙের জলে আরও গভীর হয়। নিস্তব্ধতা আরও ঘন জমাট বাঁধে। পূর্ণচরণ বুঝতে পারে তার মেয়ের মৎস্যকন্যা রূপ আসলে জনরব। পুনরায় মনে হয়, হয়ত মিথ্যে নয়, প্রেতাত্মা তো কত রূপই ধরে। তারপর নির্জন রাত ভেঙে সে যখন ঘরে ফিরবে বলে হাঁটতে থাকে, নদীর তীর ছেড়ে, তখন চাঁদ আকাশের পশ্চিম কোণে কাঁত হয়ে পড়ে। আলোময় জোনাক ছায়ার বর্ণ নেয়। হঠাৎ পেছনে সে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পায়। এক পলকই সে দেখতে পায় কে একজন ঘোমটায় মুখ ঢেকে উল্টো দিকে দ্রুত হাঁটছে। তার পেছনটাই দেখতে পায় পূর্ণ। পলকে সেই ছায়াশরীর অদৃশ্য হয়ে গেলে কারও ঠান্ডা নিশ্বাস তার পিঠ স্পর্শ করে। ভয় পেয়ে যায় পূর্ণচরণ।

পূর্ণচরণ হাঁটতে থাকে। দূর থেকেই হঠাৎ সে দেখতে পায় তার বাড়িটা আগুনে পুড়ছে। আকাশে আগুনের ঢেউ। কেবল তার নয়, ওই দূরে জহিরুল শেখদের পাড়ার দিকেও আগুন। ঘরপোড়া গন্ধ তার নাকে লাগে। আশ্চর্য এই, আতঙ্কিত কোনো জনকোলাহল নেই। সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে পুনরায় হাঁটতে থাকে। বাড়ির খুব কাছাকাছি এসেও সে আগুন দেখতে পায়। আরও একটু এগিয়ে গেলেই বাড়ির লাগোয়া বাঁশ ঝোপের ভেতর থেকে একটি সাদা রং বিড়ালকে বেরিয়ে এসে তার সামনে হাঁটতে দেখে সে। বিড়ালের ছায়া নেই। দু’চোখে দুটি সূর্য।

ততক্ষণে আকাশের কোণে চাঁদ একেবারে হেলে পড়েছে পুকুরের স্বচ্ছজলে ডুবতে থাকা পিতলের থালার মতো। আঁধার আরও ঘন হবার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু অন্ধকার দুর্ভেদ্য নয়, পানসে রং। সেই পানশে জলো-জলো অন্ধকারে বাঁশের ঝোপের খুব কাছে এলে হঠাৎ আগুন অদৃশ্য হয়ে যায় বর্ণহীন বাতাসের মতো। একি! পূর্ণচরণ তো তার উঠোনে দাঁড়িয়ে। ওই অন্ধকারও তার রিলিফের টিনের ঘরের চাল দেখতে পায় সে। জলের উপর রোদপড়া রঙের মতো ঠিক। মাথা উঁচু করেও জহিরুল শেখদের পাড়ার দিকে কোনো আগুনের চিহ্নই দেখতে পায় না সে। তবে কি অলৌকিক অগ্নিকা- দেখতে পেয়েছে পূর্ণচরণ? যুদ্ধের আতঙ্ক-স্মৃতি কি তাকে প্রতারণা করছে? আজও কি সেই আতঙ্ক তার বুকে বেঁচে আছে?

কিন্তু এটা কে? কে বসে আছে তার আবছায়া অন্ধকার বারান্দায়? অবিকল মালতির মতো। স্নান শেষে বারান্দায় বসে রোদে পিঠ পেতে যেমনি প্রতিদিন চুল শুকাতো মালতি। তবে কি মালতির প্রেতাত্মা? পেত্নিরা তো রাতের বেলাতেই পিঠভরতি খোলাচুল ছড়িয়ে অন্ধকারের শীতলতায় ভেজা চুল শুকায়! আর এক পাও এগোতো পারে না পূর্ণচরণ। সে নির্বাক এবং মরা গাছের দণ্ডায়মান কা-মাত্র। যেন এক সত্য-মিথ্যার গোলকধাঁধার দুনিয়া।

মাত্র এক মুহূর্ত। হঠাৎ পিঠভরতি চুল বাহুড়ের ডানার মতো ছড়িয়ে ঠান্ডা বাতাস পূর্ণচরণের সারা শরীরে ছিটিয়ে দিয়ে, অদৃশ্য হয়ে যায় প্রেতমানবী। পূর্ণচরণের মুখে অস্ফুট শব্দ-‘মালতি’। তখন বাড়ির বাইরের বাঁশঝোপে বাতাস দোল খায়। অট্টহাসি আর কান্নার মিশেলে ধারালো শব্দ তরঙ্গ আছাড় খায় ঘোর অন্ধকারে।

তারও কিছুক্ষণ পর রাত পোহায়। কাকজ্যোৎস্নার ঘোলাটে বর্ণ আলো গলিত পানসে আঁধারে ছড়াতে থাকে। পূর্ণচরণ ঘরে ডুকে তাজ্জব! মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পিতার স্মৃতির কাছে ফেলে রেখে যাওয়া মালতির বাসি কাপড়। মৃত মেয়ের পিতা ভয়ে ভিজে থিক্থিক্, অথচ যতদিন বেঁচেছিল ততদিন সেই কন্যাই ছিল তার শান্তি আর সাহসের বৃক্ষছায়া। তাই সে এখন ছায়াশূন্য, রিক্ত।

মৃত নয়, বরং জীবিত মেয়ের চিরচেনা শরীরের ঘ্রাণ তখন স্পষ্ট অনুভব করে পিতা পূর্ণচরণ। জোরের আলো খোলা চৌকাঠের তলায় গড়াগড়ি খায়। পূর্ণচরণ স্পষ্ট দেখে মেয়ের একগোছা ছেঁড়া চুলের দলা গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। সেই চুল তুলে নেয় পিতা। এদিক ওদিক তাকায়। নিরুদ্দেশ থেকে ঘরে ফেরার পরও বিষণ্ন মালতি টেনে টেনে মাথার চুল ছিঁড়ে ঘরের বেড়ার এখানে ওখানে গুঁজে রাখতো। তবে কি তার মেয়ে হারানো সেই চুলের খোঁজে আজ ফিরে এসেছিল? সে চুলতো ওর অস্তিত্বের চিহ্ন।

আরও অনেক পরে মাঠের দিকে হেঁটে যায় পূর্ণচরণ। যুদ্ধ-শেষের ফসলের মাঠে বীজ বুনেছে। অংকুরিত হচ্ছে বীজেরা। হলদেটে সবুজ। সূর্যের আলো আর মাটির সঙ্গে অংকুরের প্রসব যন্ত্রণা এবং জন্মের আনন্দের খেলা চলে। এ খেলা রহস্যময়, কেননা মাটিতে পূর্ণচরণ মেয়ে মালতির ছেঁড়া চুলের গন্ধ খুঁজে পায়। দু’হাতের তালুতে মাটি চেপে ধরে পূর্ণচরণ। হাতের তালুর নীচে ধানের অংকুর নিশ্বাস ফেলে। চোখ বুঁজে পূর্ণচরণ বিড়বিড় করে, ‘পঞ্চপিতা, আর কত, আর কত কষ্টের খেলা খেলবে আমাকে নিয়ে? আমি তো খুব ক্ষুদ্র, বড় নির্বল।’

নিত্যানন্দ সবই জানে। পূর্ণচরণকে নিয়ে সে যেতে চায় বহুদূরের সেই গ্রামে, যেখানে পলাশির পলাতকদের হারিয়ে যওয়া অবশিষ্ট মানুষগুলোর নিবাস। করতোয়া নদীর কথা মনে পড়ে তার। সেই নির্জন চর আর আত্মগোপনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে সে পূর্ণচরণের সামনে। তাদের রক্তধারা বইছে যে বিধর্মীদের ধমনীতে, সেখানে যেতে চায় সে। শত শত বছর পূর্বের সেই বিচ্ছিন্ন হবার স্মৃতি আর শ্রুতি তাকে আন্দোলিত করে। আদি স্মৃতিবাহী মন পাখি হতে চায়। চলুক পূর্ণচরণও তার সঙ্গে। পলাশির আম বাগানের ঘ্রাণ হয়ত পাবে ওদের শরীরে।

পূর্ণচরণ রাজি হয় না। সে যেতে চায় পির-দরবেশের ওরশ দিবসে। পিরের প্রধান মুরিদের চৌদ্দতম বংশের যিনি আছেন, তাকে নাকি বাবা দরবেশ ওরশের পূর্বরাতে সাক্ষাৎদান করেন। সে সব গায়েবি কথা শুনতে পেলে নিশ্চয়ই পূর্ণচরণ তার মেয়ে হারানোর দুঃখ সহ্য করার সাহস পাবে। তার মতো মেয়েও প্রেতজীবন থেকে পাবে মুক্তি। দরবেশ বাতলে দেবেন মুক্তি আসানের পথ।

প্রেতাত্মার মুক্তির পথ খুঁজে পায় না পূর্ণচরণ। পির বাবা তাকে যা জানান তাতে সে যতটা হতাশ, তার চেয়ে ভীত হয়ে পড়ে অধিক। কেননা, আত্মঘাতিনীর মুক্তির উপায় নেই। সে অনন্তকাল ভয়ঙ্কর প্রেততৃষ্ণায় কাতর হয়ে ছুটে বেড়াবে এই দুনিয়ায়। তার যেমনি নেই বেহেশত, তেমনি নেই দোজখ। তা হলে কি করবে পূর্ণচরণ? এক এক সময় মনে হয় মুক্তিটা আত্মঘাতিনী মেয়ের নয়, বরং তার নিজের জন্য প্রয়োজন। দিন-রাত প্রেতকন্যা পিতার উপর তার ক্রোধ বর্ষণ করেই চলেছে, এক একবার ঘাতকমূর্তি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কন্যা তো এখন মৃত্যুর দূত!

এবার পূর্ণচরণ গাঁয়ের পুরোত ঠাকুরের বিধানকেই মেনে নেয়। আয়োজন করে প্রেত তর্পণের। প্রেতপি- দান করে। কিন্তু সবই বৃথা। প্রেতিনী তাকে মুক্তি দেয় না। ঘুমের বিছানায় অন্ধকার ঘরে অগ্নিচোখ দেখতে পায় সে। পায়ের শব্দ, চুড়ির ঝন ঝন আওয়াজ শুনতে পায়। ঘরের বাইরে অট্টহাসি কিংবা কান্নার শব্দ কানে আসে তার। ফসলের ক্ষেতে কাজ করতে গেলে নির্জন দুপুরের রোদের মরীচিকায় খুব কাছে ভয়ঙ্কর স্মৃতি দেখতে পায় সে পলক মাত্র। ত্রিসন্ধ্যায় পূর্ণচরণ সুবচনী দেবীর মূর্তিও দেখে। কোলে তার মৃত শিশু। অবিকল মালতির মুখ। দেবী আর পেত্নীর রূপ ভয় দেখায় তাকে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব বারধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *