ধারাবাহিক// উপন্যাস // এক্সপেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব ছয়

থাকতেও কেন থাকে না কিছুই?
জার্মানী গিয়ে বোধহয় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আশফাক। প্রায় মাস ছয়েক পর ওর মেইল পায় লরা। তাতে প্রশ্ন, সোহা কেমন আছে? এনি ইম্প্রুভমেন্ট ?
লরার রাগ হয়নি। সোহার বিষয়ে এ্যাশের ফিলিংস ওর জানা আছে। অবশ্য এই বয়সে এসে রাগটাগও মরে যায় বোধহয়। না হলে, এ্যাশ কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে সেই মেয়ের সম্মন্ধে জানতে চাইলেও লরার রাগ হবে বলে মনে হয় না। বিয়ের সংখ্যাভেদ আছে, আছে বয়সের ব্যারিয়ার। একটা দুইটা, বড় জোর চারটা, তা-ও প্রাপ্তবয়স্ক হইবার পর। প্রেমের তো এমন বিধি নিষেধ নেই। যখন খুশি যত খুশি প্রেমে পড়, প্রেম কর। এ্যাশ এক সময় লরার প্রেমে পড়েনি। লরা একা পড়েছিল। এখন হয়তো এ্যাশ সত্যিই ওর প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়তেই পারে। এ্যাশ ওর প্রেমে পড়েছে কথাটা ভেবে লরার কি ভাল লাগছে না? সারা দিনের ক্লান্তিভরা শরীর-মন সব সময় ইমার্জেন্সির উপযুক্ত রাখতে গিয়ে ও ভাল লাগালাগিরও সময় পায় না। শুধু মাত্র তখন, যখন একটা ফ্রেশ ঘুম হয়, ঘুম ভাঙ্গার পর মনটা কেমন ভেজা ভেজা লাগে। ভাবতে ভাল লাগে এ্যাশ ওর পাশে ঘুমিয়ে আছে। বিছানার উপর হাত বুলিয়ে ও সেই এ্যাশকে টের পেতে চায়। এ্যাশের চুলে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে ডাকে, উঠবে না ?
অনেক দিন পর আশফাকের মেইল এল। ও শুধু লিখেছে, বোন ম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিণত করা সম্ভব। আরিফ বাবা হতে পারবে। এর সাথে অনেকগুলো ওয়েব সাইটের ঠিকানা, ব্যস ! লরা নিজে এত ব্যস্ত ছিল, ওয়েব সাইটগুলোতে ঢুঁ মারার সময় বের করতে পারেনি। আশফাকের মেইলটার রিপ্লাই দেওয়ারও সময় পায়নি। এরই মধ্যে ওর ঠিকানায় চলে আসে আশফাকের পাঠানো অনেকগুলো জার্নাল, ম্যাগাজিন। ড. করিম নায়েরনিয়া এবং তাঁর টিমের যুগান্তকারী সাফল্যের সংবাদ সবকটাতে।
ড. করিম নায়েরনিয়া ও তাঁর টিম ক্যান্সার আক্রান্ত পুরুষদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগীর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁরা কিছু বোন ম্যারো সরিয়ে রেখেছিলেন গবেষণার জন্য। পুর্ণবয়স্ক স্টেম সেলে ভর্তি এই বোন ম্যারো আর এই স্টেম সেলগুলো রক্ত, হাড়, মাংসপেশী এবং এরকম আরো অনেক কিছুর টিস্যু বা কলা তৈরির জন্য কাজে লাগে। ড. নায়েরনিয়া এবং তাঁর দল পুরুষের অন্ডকোষে স্পার্ম তৈরির জন্য এবং নারীর ডিম্বাশয়ে ডিম্ব তৈরির জন্য যে রকম কোষ থাকে, তার খুব কাছাকাছি কোন কোষ বা সেল খুঁজছিলেন। বোন ম্যারো সেলের অল্প কিছু স্টেম সেল স্পার্ম তৈরি করতে পারে বলে দেখা গেল। নির্দিষ্ট টিস্যু তৈরি করার জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত হলে স্টেম সেলগুলো সেই নির্দিষ্ট টিস্যুই তৈরি করতে পারে। কয়েক দিন বয়সী ভ্রুন থেকে সংগ্রহকৃত স্টেম সেল নিয়ে নানান কাজে উৎসাহী গবেষকদের তাই অভাব নেই। পূর্ণাঙ্গ টিস্যুর মত কম আয়ু নয়, স্টেম সেল অনেক দিন বাঁচে। সঠিক ল্যাব কন্ডিশনে কিছু কিছু স্টেম সেল অমরত্ব পেয়ে যায় বলে বলা যায়। বন্ধ্যা পুরুষের বোন ম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিণত করা সম্ভব। তখন সে সহজেই বাবা হতে পারবে। ইঁদুরের বোন ম্যারো থেকে আদিম স্পার্ম সেল তৈরি করা হয়েছে, ইঁদুরের ডিম্বাশয়ে নিষিক্ত করায় জীবন্ত ইঁদুরের জন্ম হয়েছে। মেয়ে ইঁদুরের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা এরকমই ঘটে। বোন ম্যারো সেল পরিণত হয় আদিম এগ সেলে।
ড. নায়েরনিয়ার টিমের সাথে এই আড়াই বছর কাজ করেছে আশফাক। জুনিয়র রিসার্চার হলেও সাফল্যের আঁচ ভাল ভাবেই টের পেয়েছে ও। এই আঁচও মুছে দিতে পারে না সোহাকে। আশফাক কান পাতলেই নিজের মনের গভীরে শুনতে পায় সোহার দীর্ঘশ্বাস। কেঁপে ওঠে প্রতিবার।
আরিফ বাবা হতে পারবে।
একটু ফ্রি হতেই ফিরতি মেইলে লরা প্রশ্ন করে, খবরটা কাকে দেব ? লরা নাকি আরিফকে ?
আশফাক রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে বলল, বেটার আরিফকেই দাও। রাতের গভীরে সোহাকে বুকে টেনে এনে ফিসফিস করে ওকে সুখবরটা দিক্ না আরিফ। সোহা সুখের কান্নায় ভিজিয়ে দিক্ আরিফের বুক।
লরা জবাবে লেখে, এ্যাশ ! য়্যু বিকাম জ্যুসি ! কারণ কি ?
জানি না। সোহা, দোলা এবং সাবিনারা ভালবাসায় ভিজে যাক্, এই চাওয়াটা নিজের মনের গভীরে খুউব খুউব টের পায় ও। কেন, জানে না।
লরা আরিফের মোবাইলে ফোন করে বলে, আমি ডাক্তার লরা কবীর বলছি।
জ্বী !
গুড নিউজ।
বুঝতে পারছি না।
পুরুষের বোন ম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিণত করা সম্ভব।
আরিফ কিস্যু বুঝতে পারছে না। বলে, বুঝতে পারছি না।
আপনি আপনার বোন ম্যারো সেলের দৌলতে বাবা হতে পারবেন।
বোন ম্যা—সেটা কি?
আপনার অস্থি মজ্জা থেকে নেওয়া কোষকে বোন ম্যারো সেল বলে। এই বোন ম্যারো সেলের বদৌলতে আপনি বাবা হতে পারবেন।
আ—আমি বুঝতে পারছি না।
আপনার বোন ম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিণত করা যাবে। এই স্পার্ম সোহার ডিম্বাশয় থেকে উৎক্ষিপ্ত ডিমকে নিষিক্ত করে ভ্রুনে পরিণত করতে সক্ষম।
আমি বুঝতে পারছি না।
আপনি বাবা হতে পারবেন, এবার বুঝতে পারছেন ?
আরিফ জ্বী জ্বী করতে থাকে ঘর্মাক্ত শরীরে। লরা ফোন রেখে দেয়। একটু পর আবার ফোন আসে আরিফের ফোনে। ও পাশে লরার কণ্ঠ।
আপনি সোহাকে খবরটা দেবেন।
জ্বী।
কিভাবে দেবেন ?
দেব…এই তো দেব।
গাধার মত এক্ষুণিই আবার ওকে ফোন করবেন না।
তাহলে ?
ও যেন কিচ্ছু বুঝতে না পারে। বাসায় যাবেন রাতে, পারলে আজকে অন্য দিনের চেয়ে দেরি করে যাবেন।
জ্বী…আমার তো…
তর সইতে হবে। দেরি করেই যাবেন, ঠিক আছে ?
জ্বী !
আজকে খুব বেশি কথাবার্তাও বলবেন না ওর সাথে। অন্য দিনের মতোই ঘুমিয়ে পড়বেন। মাঝ রাত্রে ওর ঘুম ভাঙ্গাবেন। জোরে জোরে ধাক্কা মেরে না, খুব আদর করে ওর ঘুমটা ভাঙ্গাবেন। তারপর…
ডাক্তারদের এরকম অদ্ভুত প্রেসক্রিপশন সম্মন্ধে কখনো শোনেনি আরিফ। নিজে বাবা হতে পারবে, এরকম গরম খবরের চাইতেও গরম মনে হচ্ছে লরার প্রেসক্রিপশন।
…তারপর, ওকে বলবেন। কি বলবেন ?
আরিফ আমতা আমতা করে বলে, বলব…তুমি মা হতে পারবে, সোহা। তোমার কষ্টের দিন শেষ।
ধমকে ওঠে লরা। কষ্ট বুঝি আপনার ছিল না ?
জ্বী….ছিল।
তাহলে সোহার কষ্টের কথা সোহাকে শোনাবেন কেন ?
তাহলে কি বলব ?
বলবেন, সোহা, আমি বাবা হতে পারব। আমি এখন আমার অক্ষমতাকে জয় করেছি। আমার কষ্টের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। আমি তোমার সন্তানের বাবা হওয়ার ক্ষমতা পেতে যাচ্ছি।
জ্বী, বলব।
আরো বলবেন, আমার অক্ষমতার কারণে তুমি যে আমাকে ঝেড়ে ফেলে দাওনি, এজন্য তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
জ্বী !!
কেন, সোহা অক্ষম হলে ওকে আপনি ঝেড়ে ফেলতেন না ? ন’ বছর ধরে ওর সাথে সংসার করতেন ? ও তো করেছে।
আরিফ কিছু বলে না। ওর বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল এক বিবাহিত পৌঢ়ের সাথে। প্রথম স্ত্রী তাকে সন্তান দিতে পারেনি। ওর বোনটাও মা হয়নি। লোকটা আবারো বিয়ে করত হয়তো বা, করলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু সে সুযোগ ঘটার আগেই মৃত্যু ঘটে যায় তার। বোনটা তার সতীনের সাথে স্বামীহীন সংসারে সুখে-শান্তিতে আছে।
মোজাফফর ভাই আরিফের খালাত ভাই। বিয়ের পঁচিশ বছর পর বেচারা মারা গেলেন নিঃসন্তান অবস্থায়। ভাবি একা একা খালি ভিটে পাহারা দেন আর অপেক্ষা করেন নিজের মৃত্যুর। ভাবি এবং বড় বোন আর তার সতিনের অবস্থা যদিও কাজী শরিফুল্লার মত খারাপ না। বেচারার বউটা মরে গেল আগে। প্রায় নব্বই হয়ে গেছে বয়স, ছেলেপুলে না থাকায় স্রেফ মানুষের দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। বুড়ো বয়সে ছেলেপুলে না থাকলেও চলে, বউ না থাকলে চলে না। শেষ মেষ কাজী বছর চল্লিশেক বয়সের এক বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন। বিধবার চার মেয়ে বিয়ের যোগ্য, দুই ছেলে বেকার। এরা সবাই এখন কাজীকে চুষে খাচ্ছে।
লরা লাইন কেটে দিয়েছে। আরিফের মনের ভেতরে আনন্দটা জমাট বাঁধতে থাকে এবার। বললেই হ’ল, সোহা ওকে ঝেড়ে ফেলতে পারত ! পুরুষ যা পারে, নারী কি তা পারে? ঝেড়ে ফেলা-টেলা নারীর কাজ নাকি ? কোলে টানার জন্য নারী, কোমলা নারী। ভাগ্যিস, নারী কোমলা। দোলার ব্যাপারটা জানার পর সোহা কঠিন হয়েছে। বরফে তাপ দিলে বরফ তো গলে, গলে না ?
সোহা গলল না।
কঠিন গলা করে আরিফকে ওর সিদ্ধান্তের কথাটি জানিয়ে দিল। বলল, তোমার বাচ্চা আমি পেটে ধরব না। অসম্ভব!
আরিফ ওকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে, আমার গুদু বাবুটা রাগ করেছে।
না না, আমি রাগ করে বলছি না। একদম ঠান্ডা মাথায়, ভেবেচিন্তে এই ডিসিশান নিয়েছি।
আরিফ হাসে।
সোহা বুঝতে পারে না আরিফের হাসির কারণ। হাসি থামিয়ে আরিফ বলে, বিয়ের পর তুমি রীতিমত হুমকি দিয়েছ আমাকে, বাচ্চা না দিলে এটা করবে সেটা করবে। একবার তো রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে থাকলে সাত দিন। সেই রাগ ভাঙ্গাতে আমার খরচ হল দশ-বার হাজার।
ওটা আমি ফেরত দিয়ে দেব।
কিভাবে ? ও আচ্ছা, তুমি তো এখন আবার চাকরি কর। তোমার এখন কত টাকা !
তোমার চাইতে তো বেশি নয়।
আরিফ ছুটির দিনের আলসেমি নিয়ে বলল, কী আমার তোমার করছ ! আমার টাকা কি তোমার টাকা নয় ?
আমার টাকা কি তোমার টাকা ?
অবশ্যই। আরিফ ঝোঁকের সাথে খুব জোর দিয়ে কথাটা বলেছে। সোহার স্থির হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে একটু কুঁচকে গেল। সোহা বলল, তোমার টাকার একটা অংশ আমার হাতে দিয়ে তুমি বল, হাতখরচ নাও। প্রতি মাসেই তুমি আমাকে হাতখরচ দাও। আমি তোমাকে ওরকম হাতখরচ দিতে গেলে, তুমি বলেছিলে-বউয়ের টাকা হাত পেতে নেওয়া পুরুষের কম্ম নয়। বলনি ?
আরিফ ধমকায়। বলে, নারীবাদীদের মত কথা বলো না তো। একটা বাচ্চার জন্য কষ্টকর অপেক্ষার শেষ হতে যাচ্ছে, আনন্দ করবে না তুমি ?
তোমার বাচ্চা ?
ইয়েস, আমার বাচ্চা।
তোমার বাচ্চা আমি নেব না।
আরিফ রাগে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে চিৎকার করতে লাগল, খানকি, তুই সত্যিই একটা খানকি মাগি। জামির বাচ্চা নেওয়ার জন্য প্রাণ আইঢাই করছে, না ?
সোহা দাঁতে দাঁত চেপে থাকল। ওর চোখে পানি আসেনি। ও শুধু আরিফের কান্ড দেখছিল। আরিফ যখন ঝটকা টানে ওর খোপা খুলে ফেলল আর চুলের গোড়ায় মারাত্মক টান লাগল, তখন আরেকবার কথাগুলো চিবাতে চিবাতে ও বলেছিল, আমি তোমার বাচ্চা নেব না।
আরিফ ওকে ছুঁড়ে মেরেছিল দেয়ালের উপর। দেয়াল থেকে মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে সোহা হাঁফাচ্ছিল। আরিফ ওর ঘাড় চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রশ্ন করে, কেন নিবি না ? কেন ? কেন নিবি না, বল হারামজাদি।
আরিফের মুখের উপর থেকে এত দিন আটকে থাকা মুখোশটা খুলে পড়ে গেছে। ওর সত্যিকারের মুখটা বেরিয়ে পড়ায় দেখা যায়, এই মুখ একদম হুবহু ওর আব্বাজানের মুখ। সোহা প্রবল ঘৃণা নিয়ে ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কারণ, তুমি পুরুষ নও।
আরিফের চোখে আগুন জ্বলে উঠেও আবার কেন যেন নিভে যায়। ও যেন সোহাকে ভয় পেয়েছে।
সোহা বলে, তুমি একটা কাপুরুষ। দোলাকে আগুনে ফেলে দিয়ে তুমি লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিলে। তোমার সাহস নেই। তুমি একটা নোংরা শুঁয়ো পোকা।
ঘৃণায় মুখ কুঁচকে যায় সোহার। আরিফ ভয় পেয়েছে। সোহার মুখের উপর এটে বসা দোলার মুখখানা দেখে ও ভয় পেয়েছে। ও মাটিতে বসে পড়ে সোহার পা দুটো চেপে ধরে কেঁদে ফেলে। বলে, আমাকে মাফ কর। তুমি আমাকে মাফ কর।
লরাও একই কথা বলে, মাফ করে দাও। সোহার হাতের উপর হাত রেখে বলে, কি লাভ !
না হোক লাভ। আমি ওকে শাস্তি দিতে চাই। দোলার পক্ষ হয়ে আমিই ওকে শাস্তি দেব।
তারপর ?
ও পরিশুদ্ধ হলে, যদি হয়, তখন আমি সোহা হয়ে ওর পাশে দাঁড়াব। ওর কষ্টগুলো মুছে দেব।
ততদিন ?
আমি একটা ছোটমোট থাকার জায়গা খুঁজছি। পেলে খুব ভাল হ’ত। দিনের পর দিন ঐ শ্মশানে থাকতে আর ভাল্লাগছে না। লোকটার সাথে দেখা হলেই মনে হয়, প্রাণহীন একটা মানুষ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জন্মান্ধদের মত, মরেও মরেনি। করুনা চেয়ে তাকিয়ে থাকে। কতক্ষণ আর সহ্য হয় ?
লরা আশফাককে মেইলে জানায়, সোহা আরিফের সাথে থাকতে চাইছে না। আসলে পারছে না। ও থাকার জায়গা খুঁজছে। হেল্প করব ?
আশফাক লরাকে অনুরোধ করে ওর ছেড়ে আসা ফ্ল্যাটে সোহাকে রাখতে। খালি পড়ে আছে ফ্ল্যাটটা, দেখার কেউ নেই। সোহা থাকলে ভালই হবে।
লরা সোহাকে নিয়ে আসে আশফাকের ফ্ল্যাটে। দুজনে মিলে দেখতে থাকে খুব এলোমেলো কিন্তু খুব বিষণ্ন জায়গাটাকে। সোহা বলে, আহা ! কেউ কখনো মায়া দিয়ে ঘরটাকে গোছায়নি।
এ্যাশ যা এলোমেলো !
কেউ কি পারত না তার ঘরটাকে গুছিয়ে দিতে ?
লরার ভ্রু কুঁচকে যায়। বলে, কেউ বলতে কি কোন মেয়েকে বোঝাচ্ছ ? এ্যাশের মা, বোন কিংবা বউ ? এই থিওরি ঝেড়ে ফেল তো। ছেলেদের এলোমেলো ঘর, এলোমেলো জীবন গুছিয়ে দেওয়া ছাড়া কি মেয়েদের আর কাজ নেই ?
সোহা জানালার বাইরে ছায়া হতে থাকা দিনের আলো দেখতে দেখতে বলে, মেয়েদের কিন্তু ভাল লাগে।
ভাল লাগে বলে ভাবতে শেখে মেয়েরা, তাই ভাল লাগে।
সোহা এভাবে ভাবতে থাকে। ভাল লাগে, এই তথ্যটাই আসলে শিখে এসেছে ও। তাই বুঝি ভাল লাগে ? বিয়ের পর আরিফের শার্ট বার বার ভাঁজ করত, বিছানা ঠিক করত…কী যে ভাল লাগত ! আরিফও করেছে অনেক কিছু। ওর চুল বেঁধে দিত, হাত-পায়ে লোশন মাখিয়ে দিত, পানি খাওয়ার পর মুখ ভিজে গেলে হাতের তালু দিয়ে পানি মুছিয়ে দিত, জ্বর হলে স্যুপ রেঁধে ওকে খাইয়ে দিত…আহা, কী সব দিন ! আরিফ ওর সাথে এত কিছু করত দোলার সাথে ঐসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আর ও কিছুই বুঝতে পারেনি। আরিফ ওকে বলেছে, সোহাই তার প্রথম এবং শেষ প্রেম। সোহা নিশ্চিন্তে তা-ই বিশ্বাস করেছে। সোহার চোখ জ্বলে ওঠে নিজেকে বোকা হিসেবে দেখে। ও কত বোকা, আরিফের সব কথা বিশ্বাস করেছিল ! ছি ছি !
ছেলেরাও বোকা হতে পারে। সোহার এক বান্ধবী পলা ছিল ছেলেদের সাথে খাতির করতে ওস্তাদ। ওর যে কতগুলো প্রেম হয়েছিল, তা বুঝি ও নিজেও জানতো না। প্রতিটা ছেলে জানত, সে-ই পলার প্রথম প্রেম। পলা ওদের কাছে বলত ছেলেদের ভেঙ্গে পড়ার গল্পগুলো। দারুন রূপসী পলা খেলত, ছেলেদেরকে নিয়ে দারুন খেলতে জানত এবং পারতও। পলা বিয়ে করে চলে যায় আমেরিকায়। ওদেরকে বলেছিল, সব কলঙ্ক এ দেশেই থুয়ে যাচ্ছি। নাও আই এম আ ভার্জিন, এগেইন।
কেমন আছে পলা ? ডাক্তার আশফাকের ছোট্ট অগোছালো ফ্ল্যাটটা গোছাতে গোছাতে রাত নেমে এসেছিল। ঘুমুতে যাওয়ার আগে বাতির সুইচ অফ করলে এক রাশ গাঢ় ছায়া ওকে যখন জড়িয়ে ধরল, তখন পলা কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করল ওর। এরপর বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা দিতে মনে হ’ল, এই প্রথম কোন পর পুরুষের বিছানায় শুচ্ছে ও। কথাটা মনে করেই মনটাকে কষে ধমকাল। কোন রকমের সস্তা সেন্টিমেন্ট ও আর মনে ঠাঁই দেবে না। অনেক হয়েছে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট // নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব পাঁচধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব সাত >>

One thought on “ধারাবাহিক// উপন্যাস // এক্সপেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব ছয়

  • জুলাই ২১, ২০২০ at ১০:৩৬ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অনেক বড় লেখকের লেখা।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *