উপন্যাস

উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব নয়

পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে শফিকের। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ শেষ দিন তার। এ জন্য আগে থেকেই পার্টির  প্ল্যান করা ছিল। সব ক্লাসমেট একত্র হয়েছে এই রেস্টুরেন্টে। একদম সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাড়া করা হয়েছে ফ্লোরটা। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই আড্ডা মারছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এভাবে হয়তো সবার আর দেখা হবে না। এ জন্য সবাই মিলে পরীক্ষার আগেই  প্ল্যানটা করা হয়েছে। এখানে ওদের মধ্যে বাইরের কেবল ফারিয়া, শফিকের গার্লফ্রেন্ড। ফারিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও সবাই তাকে নিজেদের মানুষই ভাবে। এদের সঙ্গে ফারিয়াও সেভাবেই মেশে। আর সে প্রায় সবাইকে চেনে। শফিককে মোটামুটি সবাই পছন্দ করে বলে ফারিয়াকেও ওদের মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি।

শফিক, ফারিয়া, তানজিন আর মিলা মিলে উত্তর দিকের এক টেবিলে আড্ডা মারছে। সবাই যার যার প্ল্যান নিয়ে কথা বলছে। কে কী হতে চায়, চাকরির বাজার কেমন এখন ইত্যাদি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুবাদে চাকরি নিয়ে ওদের তেমন কোনো টেনশন নেই। ওরা জানে, চাকরির বাজারে ওদের ডিমান্ড আছে। ফারিয়া বলল, ‘মিলা, তুমি কোথায় জয়েন করবে?’

মিলা ভাবলেশহীনভাবে বলল, ‘তানজিনের হোটেলে।’

তানজিন ওর বয়ফ্রেন্ড। মিলার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল, শফিক বলল, ‘চাকরি করবি না?’

মিলা বলল, ‘চাকরি তো করবই। আমি আদর্শ গৃহিণীর চাকরি করব। তানজিন চাকরি করবে আর আমি ওর জন্য রান্না করব। ইউটিউব দেখে অনেক রান্না শিখব। ঘরবাড়ি গোছাব, বাচ্চাকাচ্চা সামলাব।’

তানজিন বলল, ‘ওসব ধান্দা বাদ দাও। যার যার তার তার পদ্ধতিতে সংসার চলবে। ইনকামের সমান সমান সংসারে খরচ হবে। রান্না আমিও করব। ঘরের কাজও করব।’

মিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘কী বলো তানজিন! আমি কত আশা করে আছি একজন আদর্শ গৃহিণী হব। বাইরে কাজটাজ করব না। আর তুমি এখন কী বলছ এসব?’

‘ঠিকই বলছি। সংসারে দুজনার কন্ট্রিবিউশন সমান হবে। মুখে মুখে তো তোমরা নারী অধিকার, সমান অধিকার এত কথা বলো। বাস্তবে কেন শুধু পুরুষকে খাটাতে চাও?’

ফারিয়ার গায়ে লাগল নারীদের নিয়ে কথা বলায়। সে বলল, ‘অবশ্যই সমান অধিকার। ঘরের কাজটাকে তোমরা ছেলেরা এত ছোট করে দেখ কেন তানজিন?’

শফিক বলল, ‘আহা, কে ছোট করে দেখেছে? তানজিন বলেছে ঘরের কাজও ভাগাভাগি করে করবে।’

ফারিয়া বলল, ‘অবশ্যই ছোট করে দেখেছে। বাইরে কাজ করলে ইনকাম হয় আর ঘরের কাজে কোনো টাকা পাওয়া যায় না বলে তোমরা ঘরের কাজকে কাজই মনে করো না। এটা কিন্তু খুব অন্যায়। ঘরের কাজের যদি পারিশ্রমিক দেওয়া হতো, তাহলে সব ছেলে ফতুর হয়ে যেত।’

মিলা সায় দিল ফারিয়ার কথায়। বলল, ‘ঠিকই বলেছ ফারিয়া। ছেলেগুলো মনে করে ঘরের কাজ কাজই না। ঘরের কাজের যে দাম, তা যদি আমাদের হাউজওয়াইফরা কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিত, তাহলে পুরুষের আর বাইরে ফুর্তি করতে হতো না। একদম টাইট হয়ে যেত।’

তানজিন বলল, ‘তোমরা কিন্তু আমাদের কথার ভুল মানে করছ। আমরা মোটেও ঘরের কাজকে ছোট করছি না। বরং বড় করে দেখছি বলেই ঘরের কাজও ভাগাভাগি করে করতে চাচ্ছি।’ বলে সে শফিকের দিকে তাকাল সমর্থনের আশায়। শফিক মাথা নেড়ে সায় দিল।

ফারিয়া বলল, ‘তাহলে ঠিক আছে। দুটো কাজই সমান সমান গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা ঘরেরটা সামলায় বলেই তো পুরুষেরা এত দিন এত নিশ্চিন্তে বাইরে কাজ করতে পেরেছে।’

শফিক বলল, ‘তাহলে কি এখন থেকে সেই নিশ্চয়তার দিন শেষ? সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বন্ধুগণ!’

ফারিয়া বলল, ‘কিছুটা তো শেষই। ঘর-বাহির দুই জায়গাতেই দুজনকে কাজ করতে হবে।’

তানজিন বলল, ‘ফারিয়া, তুমি কিন্তু এবার ওদের দিকে সায় দিচ্ছ। আমি গৃহিণীই হতে চাই। চাকরিবাকরি আমার ভালো লাগে না।’

ফারিয়া বলল, ‘ওকে, তুমি তাহলে ঘরের কাজের জন্য বেতন নেবে। তাহলে তোমার ঘরের কাজও হলো, আবার চাকরিও হলো।’

তানজিন বলল, ‘আহা, কী পক্ষপাততুষ্ট বুদ্ধি দিচ্ছ ফারিয়া। ঘর কি শুধু ছেলেদের একার নাকি? ঘর তো মেয়েদেরও। তাহলে আবার তাকে বেতন দিতে হবে কেন?’

ফারিয়া বলল, ‘দুজনেরই। তবে তুমি যেহেতু বাইরেই থাকবে, তোমার কাজের অংশটাও তো তোমার বউকে করতে হবে। এ জন্য ওটার জন্য তার টাকা প্রাপ্য হবে।’

শফিক বলল, ‘বাহ! নিজের ঘরের কাজের জন্য টাকা! ফারিয়া তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি।’

ফারিয়া বলল, ‘দেখো, এভাবে বললে কিন্তু আমিও চাকরিবাকরি কিছু করব না। মিলার মতো গৃহিণী হব।’

শফিক বলল, ‘সবার মাথা গরম হয়ে গেছে। সবাইকে কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াতে হবে।’ সে ওয়েটারকে ডেকে পানীয়ের অর্ডার দিল। এর মধ্যে পাশের জটলা থেকে হিমেল, নাহিদ, জনি, শিফা, লাবণীরাও এল। চেয়ার টেনে একে একে সবাই বসে পড়ল। বন্ধুদের এমন মিলনমেলা, এমন প্রাণখোলা আড্ডা তো সচরাচর হয় না। সবাই সবার সঙ্গে কথা বলছে। কারও ওপর কেউ খেপে থাকলেও আজ যেন কোনো বিরূপতা নেই। কোনো হিংসা-দ্বেষ নেই।

শফিক ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলে এল। সবার খোঁজখবর নিল। রাফসান ক্লাসে আসে না বেশির ভাগ দিনে। ওর বাবার ব্যবসায় সময় দিতে হয় তাকে। এ জন্য সচরাচর ওর সঙ্গে দেখা হয় না শফিকের। আজ সেও হাতে অনেকটা সময় নিয়ে এসেছে। পরীক্ষাও ভালো হয়েছে তার। ক্লাসের সবচেয়ে নাক উঁচু মেয়েটাও অন্যদের সঙ্গে যেচে যেচে আলাপ করছে। খুব আনন্দমুখর পরিবেশে আজ সবাই সময় কাটাচ্ছে। শফিকের চেহারায় তবু কেন যেন একটা অস্থিরতা। ফারিয়া বিষয়টা খেয়াল করল। সে শফিককে একা এক পাশে ডেকে নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে শফিক, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

শফিকও যেন বলতে চাচ্ছিল ফারিয়াকে, সে বলল, ‘এখানে সবার মধ্যে কথাটা বলতে চাই না। আমার এখন উঠতে হবে।’

‘উঠতে হবে মানে? কোথায় যাবে তুমি?’

‘আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। যেতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই।’

‘ওহ, তাই বলো। আমি ভাবলাম কি না কি! এত ইতস্তত করার কী আছে, সবাইকে বলে চলো আমরা বেরিয়ে যাই।’

‘না, না। সবাইকে বললে এই আড্ডার মুড নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যরাও যেতে চাইবে। তার চেয়ে এক কাজ করি, আমি চলে যাই, তুমি ওদের সঙ্গে থাকো। দুজনেই চলে গেলে বিষয়টা খারাপ দেখা যায়।’

‘তোমার ইন্টারভিউয়ের কথা আমাকে আগে বলোনি তো! বলার মতো সময় ছিল না। আজ সকালে মেইল খুলে দেখি ওরা ভাইভার জন্য ডেকেছে।’

‘কবে অ্যাপ্লাই করলে?’

দুই মাস আগে অন ক্যাম্পাস জব রিক্রুটমেন্ট এক্সাম হয়েছিল। বহু নামীদামি আইটি কোম্পানি ক্যাম্পাসে এসেছিল ইয়াং ট্যালেন্টের সন্ধানে। শফিক তখনই পরীক্ষাগুলো দেয়। অনেকগুলো প্রোগ্রামিং টেস্ট, বেসিক নেটওয়ার্কিং, ডেটা স্ট্রাকচার, অ্যালগারিদম টেস্ট দেয় শফিক। শফিক জানে সে মেধাবী ছেলে। তবে এত তাড়াতাড়ি যে রেজাল্ট দিয়ে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকবে, সেটা সে ভাবতে পারেনি।

শফিক বলে, ‘অনলাইনে অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম বেশ আগে। আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম। ওদের মেইল পেয়ে মনে পড়েছে। একটা সফটওয়্যার ফার্ম। বেশ প্রেস্টিজিয়াস জব, এখানে হলে অনেক টাকা স্যালারি পাওয়া যাবে।’

‘বাহ, তাহলে তো বেশ ভালো। দারুণ হবে। আমার বাসার অবস্থাও তো তুমি জানো। ক্রমাগত চাপ দিয়েই যাচ্ছে।’

‘সে তো দেবেই। মেয়ে বড় হলে মা-বাবা অনেক টেনশন করেন। বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পান না।’

‘আহা! এমনভাবে বলছ যে মনে হচ্ছে তোমার অনেকগুলো মেয়ে, আর তাদের বিয়ে দেওয়া নিয়ে তোমার প্রচুর টেনশন হয়েছিল।’

ফারিয়ার কথা শুনে শফিক হো হো করে হেসে উঠল। ‘সব সময় কি বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হয় নাকি? আশপাশের মানুষদের দেখে বোঝা যায় না?’

‘হয়েছে। তোমাকে আর বুঝতে হবে না। তুমি এখন যাও। লেট হয়ে যাচ্ছে।’

ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা বসে আছেন, তাদের প্রত্যেকে মধ্যবয়সী। শফিকের আন্দাজ এরা সবাই প্রজেক্ট ম্যানেজার, আর্কিটেকচার বা টিম লিডার ধাঁচের কেউ হবে। সবাইকে বেশ আন্তরিক মনে হলো। সম্ভবত এসব ক্রিয়েটিভ কাজ করা মানুষগুলো এমনই হয়। শফিকদের এক স্যারও আছেন, সিদ্দিকি স্যার। সফটওয়্যার প্রকৌশলে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী মানুষ। কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায়ই নেই তিনি এত বড় জিনিয়াস। এরাও হয়তো তেমন মানুষ। বোর্ডের সদস্যরা শফিককে কিছু ট্রাবলসুটিং, ডেটাবেইস ও প্রোগ্রামিংয়ের ওপর প্রশ্ন করল। বাড়ি কোথায়, দেশেই থাকবে কি না, অফিসের কাজে বিদেশে যেতে হলে কোনো আপত্তি আছে কি না, বিদেশি ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করতে পারবে কি না, ওয়ার্ক লোড নিতে পারবে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। এখনকার প্রতিষ্ঠানগুলো খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে এমপ্লয়ি নির্বাচন করে। একাডেমিক রেজাল্টগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে পেয়ে যায় তারা। খোঁজখবরও করে ইন্টারনেটে। হয়তো শফিকদের টিচার লেভেলে এদের ভালো যোগাযোগ আছে। আর সফটওয়্যার ফার্মগুলো সব সময় খোঁজ রাখে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কতজন পাস করে বের হচ্ছে।

শফিকের মনে হলো, এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড ধাঁচের পরীক্ষা। সে এ রকম বস এবং টিম পেলে খুশিই হবে। রাশভারী বস কিংবা পরিবেশ তার পছন্দ নয়। যদিও সে এর আগে কোথাও ইন্টারভিউ ফেস করেনি, তবে বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনে যেটুকু জেনেছে, এই মিটিংটাকে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলাই বোধ হয় ভালো। শেষের দিকে সবচেয়ে কম কথা বলা মানুষটি শুধু শফিকের কাছে এক্সপেক্টেড স্যালারিটা জানতে চাইল।

Series Navigation<< <strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব ছয়</strong><strong>উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব নয়</strong> >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *