উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব আট

৮.

মতিন সারা দিন রহিম মিয়ার বাড়ির কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বিকেলটায় যখন গরু-বাছুর নিয়ে মাঠে যায় তখন ওর সমবয়সী কয়েকটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়। এই ছেলেগুলো সবারই মা–বাবা আছে, আশ্রিত নয়। কিন্তু হতদরিদ্র পরিবারের। এদের মধ্যে কারও কারও পরিবারের ভালো জমিজমা ছিল একসময়। বছরের খাবার হয়ে আরও উদ্বৃত্ত থাকত ধান-গম। মৌসুমে হতো রাই-সরিষা-কলাই। কিন্তু এখন আর কিছুই নেই। এ অবস্থার জন্য দায়ী হলো যমুনা। সর্বনাশা নদী। আগের দিন রাতেই হয়তো সব ছিল, সকালে উঠে দেখে কিছু নেই। ধানি জমি, বাগান, গোয়ালভরা গরু সবই চলে গেছে নদীর হাঁ-করা মুখের ভেতর। যমুনাপারের মানুষেরা যেন ভাগ্যের বিচিত্র খামখেয়ালের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। শত পরিশ্রমের পরও তাদের চেয়ে থাকতে হয় নদীর দিকে। নদী রুদ্র রূপ নিলে কেউ আর রেহাই পায় না। যুগ যুগ ধরে এখানকার মানুষ এভাবেই টিকে আছে। এখানে জীবনধারণ এত সস্তা তবু কয়েক বছর আগেও এখানকার অনেক মানুষ দুবেলা ভাত খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারত না। কষ্টেসৃষ্টে একবেলা ভাত জুটত তাদের। বাকি দুবেলা শাকপাতা, রুটি এসব খেয়ে থাকতে হতো; বিশেষ করে বর্ষার সময়টাতে খুব অসুবিধা হতো। এলাকায় কোনো কাজ নেই, খেতখামার জলের নিচে, রিকশা-ভ্যান চালানোও বন্ধ, চারদিকে পানি, গবাদিপশুগুলো চরানোর মাঠ থইথই করছে জলে, তখন মানুষের অনাহার শুরু হতো। নিজেদের খাওয়ার চেয়েও তখন অভাবী মানুষেরা গৃহপালিত পশুপাখির খাবারের জন্য বেশি চিন্তা করত। কারণ, সেগুলোই হয়তো তার একমাত্র সম্পদ। বর্ষা চলে গেলে ওই পশুপাখিই তাদের আয়ের উত্স হয়ে উঠবে। সে কারণে তাদের বাঁচাতে হবে সবার আগে। এখন বর্ষা আসি আসি করছে। মতিনের অবশ্য চিন্তা নেই। সে যে বাড়িতে থাকে, তারা যথেষ্ট অবস্থাশালী পরিবার। এই পরিবারে আসার পর কখনোই খাওয়া-পরা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি তাকে। সে তার কাজগুলো করে শুধু, অন্য কিছু নিয়ে সে ভাবেই না। মতিন একটু একটু বুঝতে শিখেছে এখন। সমবয়সী বন্ধুদের কষ্ট কিছুটা স্পর্শ করে তাকে। শফিকদের বাড়িতে কাল ভোজ। মাদ্রাসা থেকে কিছু ছেলেকে পেট পুরে মাছ, মাংস, মিষ্টি খাওয়ানো হবে। রহিম মিয়ার ছেলের পরীক্ষা সামনে। এটা যে সে পরীক্ষা নয়, একেবারে ফাইনাল পরীক্ষা। এটাতে পাস করলেই ছেলে তার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবে। মনের মধ্যে যতটা খুশি, ততটাই যেন উত্কণ্ঠা রহিম মিয়ার। সে কারণেই এই আয়োজন করা হয়েছে। এই ছেলেরা বাড়িতে এসে দোয়াদরুদ পাঠ করবে আর পেট পুরে খেয়ে যাবে। অবশ্য রহিম মিয়া এদের সবাইকে কিছু না কিছু টাকা বকশিশ দেন। তালেবে আলিমদের দাওয়াত দিলে খালি হাতে যেতে দিতে হয় না। এটাই অলিখিত নিয়ম। যার যার সামর্থ্য অনুসারে টাকা দিয়েও দেয় গ্রামের আবস্থাপন্ন পরিবারেরা। কয়েক দিন ধরেই এই অনুষ্ঠানের কথাবার্তা চলছিল রহিম মিয়ার বাড়িতে। শুধু হুজুরদের খাওয়ানো হবে, নাকি গ্রামের দুই-চারজন মুরব্বিকেও বলা হবে, এটাই ফাইনাল করা যাচ্ছিল না। রহিম মিয়ার এক রকম মত, শফিকের মায়ের আরেক রকম মত। এদিকে শফিককেও জিজ্ঞেস করা যায় না, সে এত হই-হাঙ্গামা পছন্দ করে না। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, এখন আপাতত মাদ্রাসার ছাত্রদেরই খাওয়ানো হবে। পরে শফিকের রেজাল্ট দিলে গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে বড় আয়োজন করে খাওয়ানো হবে। এই গ্রামের প্রথম কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছে তার ছেলে, এটা কি কম কথা? পরের ভোজে কয়েকটা আস্ত গরু জবাই করা হবে, তেমনই  প্ল্যান রহিম মিয়ার। অবশ্য তখন তো শফিক বাড়িতে থাকবে। সে বাধা দিতে পারে এসব করতে। কিন্তু রহিম মিয়া তখন তার কথা শুনবে না। মাদ্রাসার ছেলেদের সঙ্গে আরও কিছু ছেলে খাবে সেই ভোজে। এরা সবাই মতিনের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব। শফিকের মাকে মতিন রাজি করিয়েছে। যখন এই ভোজ নিয়ে নানা পরিকল্পনা হচ্ছিল, তখন মতিনের মনে হলো তার বন্ধুরাও দিনের পর দিন ভালো খাবার খেতে পায় না। মাদ্রাসার ছেলেদের বয়সীই তো ওরা। ওদেরও তো ইচ্ছে করে এক-আধটা দিন বছরে ভালো খেতে। আজ তার যদি রহিম মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় না জুটত, তাকেও হয়তো ওদের মতো কিংবা ওদের চেয়ে আরও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। এসব ভাবতে চায় না সে। তবু মাঝে মাঝে ভাবনা আটকানো যায় না। মাথার মধ্যে না ভাবতে চাওয়া চিন্তার পোকাগুলো কিলবিল করতে থাকে। সে যতই তাদের তাড়াতে চায়, ততই যেন জুড়ে বসে। তার তখন ভাইবোনের কথা, মায়ের কথা সব মনে পড়ে। হয়তো বন্ধুদের মধ্যে সে তার বাকি ভাইদের ছায়া দেখতে পায়। সে জানে না আজ তারা কোথায় কীভাবে আছে। হয়তো রাস্তায় ধাক্কা লাগলেও কেউ কাউকে চিনতে পারবে না। নিয়তি এমনই। মতিনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু কাদের। কাদেরদের একসময় ভালো অবস্থা ছিল। কিন্তু কাদের সেটা দেখেনি। মায়ের মুখে শুনেছে কেবল। কাদেরের যখন এক বছরও বয়স পূর্ণ হয়নি, তখনই তাদের পরিবারে দুরবস্থা নেমে আসে। যমুনার ভাঙনে সব চলে যায়। এমনকি বসতবাড়িটাও বাঁচানো যায়নি। কাদেরের বাবা এলাকার মেম্বার ছিল। রাশেদ মেম্বারের প্রতাপ ছিল একসময়। তখন তার যৌবনকাল। আজকাল কেউ আর বুড়ো রাশেদ মেম্বারকে দেখে সেই কথা কল্পনাও করতে পারবে না। শরিকের জমিজমাগুলো ভাগ হয়ে তার ভাগে যা পড়েছিল, সেটা টিকে থাকলে রাশেদ মেম্বারের দুই পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারত। মতিন কাদেরসহ সবাইকে বলল, ‘ওই কাদের, কাইলকা তোগো সবার দাওয়াত। দুফর বেলা গোসল সাইরা ভালো জামাকাপড় পইরা চইলা আসবি।’

কাদের বলল, ‘কিসের দাওয়াত?’

‘দুফরবেলা খাওনের দাওয়াত।’

‘মিলাদ হইব?’

‘হ, মিলাদ। তয় খালি সিন্নি খাওয়াইব না। পেট ভাইরা গোস্ত-ভাত খাওয়াইব।’

মিলাদে সিন্নি ছাড়াও যে গোস্ত-ভাত খাওয়ানো হবে, এ কথা শুনে তাদের চোখে খুশির ঝিলিক দেখা গেল। এই এলাকায় সাধারণত মিলাদ হয় মসজিদে। অবস্থাপন্ন অথবা কখনো কখনো কম অবস্থাপন্নরাও মসজিদে শুক্রবারগুলোতে সিন্নি দেয়। কাদের, মতিন, জব্বার, রাসু এরা সবাই নিয়মিত মসজিদে যায় শুক্রবার। নামাজ পড়ার পর সেখানে প্রায় দিনই সিন্নি খেতে দেয়। এই সিন্নি হয় সাধারণত গুড় আর চাল দিয়ে তৈরি পায়েস। কপাল ভালো থাকলে সিন্নির সঙ্গে জিলাপিও পাওয়া যায় দু-এক দিন। মতিনের বন্ধুরা মতিনের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত। ওরা যে জায়গাটায় খেলে, বসে, আড্ডা দেয়, সেটা একটা অর্ধচন্দ্রাকার মাঠের মতো। ওই খালি জায়গাটা বাদে পরের জায়গাগুলোতে ধানের চারা লকলক করে বেড়ে উঠছে। হালকা বাতাসে ঘন সবুজ হয়ে দুলছে তারা। মাঠের জায়গাও অনেক। ওদের গরুগুলো সেখানে চরে। তবে এখানে আনার পথে বেশ সাবধান থাকতে হয়। গরুগুলো আইলের ওপর দিয়ে আসার সময় ধানের চারায় মুখ দেওয়ার চেষ্টা করে। এই ধানখেত অন্য লোকের হলেও রাখাল ছেলেরা জানে এগুলোকে রক্ষা করতে হয়। খাবারের যে কী মূল্য এটা ওদের মতো করে আর কেই-বা জানবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *