উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব চার
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব সতেরো
- উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব উন্নিশ
৪.
রহিম মিয়া তার ছেলের আচরণে অবাক হন মাঝে মাঝে। শহরে গিয়ে তিনি শফিকের বন্ধুদের দেখেছেন। তাদের লাইফস্টাইল শফিকের চেয়ে একেবারে আলাদা। খুব জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করে তারা। টাকাপয়সা মুড়িমুড়কির মতো ওড়ায়। দামি ফোন, ড্রেস, ল্যাপটপ সব নতুন চাই তাদের। আর শফিককে তিনি ফার্স্ট ইয়ারে একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন, সেটা দিয়েই দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছে। তার ফোনটাও পুরোনো হয়ে গেছে। এবার যখন সে বাড়ি এসেছিল, রহিম মিয়া তাকে নতুন একটা লেটেস্ট মডেলের ফোন কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শফিক বলেছিল, ‘কী দরকার? এটাতেই তো দিব্যি চলে যাচ্ছে।’ পরে রহিম মিয়া কিছু টাকা দিয়ে দিতে চাইলেন ল্যাপটপ কেনার জন্য। শফিক সেই টাকাও নেয়নি। বলেছে, লাগলে জানাবে। কিন্তু কখনোই বাড়তি টাকা নিতে চায় না শফিক। সহজ, সাধারণ জীবনের দিকেই যেন তার ঝোঁক। এ জন্য রহিম মিয়া তার ছেলেকে অন্যদের সঙ্গে মেলাতে পারেন না। তার বয়সী অন্য ছেলেরা যেমন, সে তেমন নয়। ছেলের কথা সবাইকে বলতে গর্ব হয়।
মতিন গিয়েছিল খেয়াঘাটের বাজারে। সকালবেলা এই বাজারটায় নদীর মাছ পাওয়া যায়। বেলে, চিংড়ি, আইড়, পাবদা, ট্যাংরা আরও হরেক রকমের মাছ নিয়ে আসে স্থানীয় জেলেরা। মাঝে মাঝে দুই-চারটা হাঁস-মুরগিও পাওয়া যায়। আসে মাচা থেকে সদ্য কেটে আনা লাউ, কুমড়ো, খেতের বেগুন, ঢ্যাঁড়স, পুঁইশাক আর নানা পদের শাকসবজি। একদম টাটকা জিনিস পাওয়া যায় ঘাটের বাজারটায়। সব মিলিয়ে বাজারের আয়ু থাকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এরই মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতারা তাদের বেচাকেনা শেষ করে ফেলে। রোদের তেজ বেড়ে যেতে যেতে বাজার ভেঙে যায়।
এই গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে সকালবেলা রান্না হয়। বেঁচে থাকার জন্য যারা মূলত কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল, সেসব বাড়ির পুরুষেরা খুব ভোরবেলা, আবছা আলো যখন সবে ফুটতে শুরু করেছে, আগের দিনের পান্তা খেয়ে জমির কাজে বেরিয়ে যায়। মেয়েরা ঘর-গৃহস্থালির প্রাথমিক কাজ সেরে, হাঁস-মুরগির খোঁপ ছেড়ে দিয়ে, তাদের খেতে দিয়ে তারপর তারা রান্না বসায়। রান্না শেষ হতে হতে মাঠ থেকে পুরুষেরা ফিরে আসে এবং নদীতে বা পুকুরে চট করে গোসল সেরে খেতে বসে। তখন তাদের খাবারটাও হয় দেখার মতো। মাঠফেরত পুরুষেরা তখন সামান্য তরকারি দিয়ে এক-দুই গামলা ভাত একাই সাবাড় করতে পারে।
শফিকদের বাড়ির কেউ খেতে কাজ করতে যায় না। কিন্তু তবু গ্রামের সব বাড়ির মতো এই বাড়িতেও সকালের রান্নাটাই প্রধান। দুপুরের খাবার গ্রামের মানুষের কাছে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সকালের বেঁচে যাওয়া খাবারই তারা কোনো রকমে খেয়ে নেয়। আর রান্না হয় রাতে। আগে গ্রামের লোকের কাছে রাত ১০টাই মধ্যরাত মনে হতো। কিন্তু এখন অনেক গ্রামেই লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। গ্রামের মানুষও এখন অনেকটা রাত জাগে। মতিন বেশ কিছু তাজা বেলে আর ট্যাংরা মাছ নিয়ে ফিরে আসে। খেতে বসে রওশন আরার চোখ ছলছল করে। শফিক বেলে মাছ খুব পছন্দ করে; বিশেষ করে বর্ষার শুরুতে শাপলা দিয়ে বেলে মাছের তরকারি খেতে চায় শফিক। অনেক দিন হলো ছেলেটা বাড়ি আসে না। রহিম মিয়াকে রওশন আরা কয়েকবার বলেছেন ছেলেকে খবর দিতে। তিনি অবশ্য ফোন করেছিলেন কিন্তু বাড়িতে আসার কথা বলতে পারেননি। পড়ালেখার ব্যস্ততার কথা বলেছিল তখন শফিক। খেতে খেতে সেই কথাটা আবার তুললেন রওশন আরা। ‘শফিকরে যে খবর দিতে বলছিলাম, দিছিলা?’ স্বামী রহিম মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। আমতা-আমতা করে রহিম মিয়া জবাব দিলেন, ‘ফোন করছিলাম। বাড়ি আসার কথা বলতে পারি নাই।’
‘কেন?’
‘তোমার ছেলে খুব ব্যস্ত ছিল সেই সময়। বলার সুযোগ পাই নাই।’
রহিম মিয়া বেশ রাশভারী লোক। তার ব্যক্তিত্ব প্রবল। কিন্তু রওশন আরার মেজাজ খারাপ থাকলে বা মন ভালো না থাকলে সেই সময়ে তিনি তাকে সমঝে চলেন। খুব একটা ঘাঁটান না। তার মেজাজ তিরিক্ষি করে দিলে, সেটা সহজে ভালো হয় না। ২৭ বছরের দাম্পত্যজীবনে তিনি এটা খুব ভালো করেই টের পেয়েছেন। ছেলের জন্য বেশ কয়েক দিন ধরে রওশন আরার মন কাঁদছে। এ সময় তিনি যা বলবেন, তাতেই সায় দিতে হবে। একবার মন খারাপ করিয়ে দিলে তিনি বাড়ির কারও সঙ্গেই কথা বলবেন না। একদম চুপচাপ হয়ে যাবেন। রওশন আরা বললেন, ‘আজ আবার ফোন করবা। সামনের সপ্তাহে চলে আসতে বলবা।’
‘ঠিক আছে, আজই ফোন করব আবার।’
‘কেমন বাপ তুমি, ছেলের জন্য তোমার মায়াদয়া নাই?’
‘মায়াদয়া থাকবে না কেন? কিন্তু সামনে ওর পরীক্ষা। এই সময় কি সে বাড়ি আসতে পারবে?’
‘তুমি তো আসতেই বলো নাই। আসতে পারবে কি না, সেটা পরের ব্যাপার।’
রহিম মিয়া টের পাচ্ছেন স্ত্রীর মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। তিনি বিষয়টা হালকা করতে চাইলেন। বললেন, ‘একটু পরেই আমি ফোন করব। তোমার সঙ্গে কথা বলায় দিই? তুমি আসতে বলবা?’
‘তুমি জানো না আমি ফোনে কথা বলতে পারি না। তুমি বলবা আমার কথা।’
মায়েদের নাকি ছেলের দিকেই টান বেশি থাকে। রহিম মিয়া তার স্ত্রীকে দেখে ব্যাপারটা বোঝেন। দুদিন পরপর খোঁজ দিতে বলেন। খোঁজ না পেলে ছটফট করতে থাকেন। কিন্তু তিনি ফোনে কথা বলাটা এখনো শিখে উঠতে পারেননি। এবার নাকি শফিক এসে তাকে শেখাবে। এই গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় ফোন ব্যবহারে বেশ অসুবিধা। বাজারে গিয়ে ফোন চার্জ করাতে হয়। সেখানে সোলার এনার্জির ব্যবস্থা আছে। গ্রামে বিদ্যুৎ আসবে শোনা যাচ্ছে দুই বছর ধরে। এ জন্যই রহিম মিয়া সোলার লাগাননি এখনো। কিন্তু বিদ্যুৎ আসতে দেরি হচ্ছে দেখে রহিম মিয়া ভাবছেন সামনের বছরের প্রথমেই যদি বিদ্যুৎ না আসে, তাহলে তিনি একটা সোলার প্যানেল বসাবেন বাড়িতে। ছেলেটা তো হারিকেনের আলোতেই পড়ালেখা করল কিন্তু মেয়ে সেটা আর করতে চাইছে না। ইলেকট্রিসিটি না হলে আর চলছেই না।
ছোটবেলায় শফিক যেমন ছিল, ছোট বোন আদর ঠিক তার উল্টো। সে বাড়িতে সোলার প্যানেল বসানোর জন্য অতিষ্ঠ করে ফেলেছে। স্কুলের গণ্ডি এখনো পেরোয়নি সে। কিন্তু খুব ফ্যাশনসচেতন। সব সময় দামি জিনিস চাই তার। আর রহিম মিয়াও মেয়ের সব আবদার মেটানোর চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়ে দুটো ছাড়া তার আর টাকা খরচের জায়গাই বা কোথায়। অবশ্য ঠিকাদারি কমিয়ে দেওয়ার পর থেকে তার নগদ টাকাও কমে গেছে। রহিম মিয়া চিন্তা করে রেখেছেন, ছেলে চাকরিতে জয়েন করার পর তিনি যে টুকটাক কাজ করতেন, তাও আর করবেন না। শুধু জমিজমাগুলো দেখভাল করবেন। এই বয়সে এখন আর শহরে দৌড়াদৌড়ি ভালো লাগে না। ছেলে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে, তখন তার তো বলতে গেলে আর খরচই নেই। মেয়ের পেছনে যা খরচ, সেটা রহিম মিয়া হিসাবের মধ্যেই নেন না। তবে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার একটাই দুশ্চিন্তা। এত শৌখিন মেয়ের জন্য জুতসই পাত্র পাওয়া যাবে তো? আর পাত্র মানে তো শুধু পাত্র না, তার পরিবার শিক্ষা-দীক্ষা, বংশ সব মিলতে হবে। যারতার হাতে তো মেয়েকে দিয়ে দেওয়া যায় না।