উপন্যাস

উপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব এক

রাহিতুল ইসলাম

১.

ফারিয়া কফিশপটার এক পাশের টেবিলে বসে ছিল। এই কোনাটা একটু নির্জন। সে বেশির ভাগ দিনে এই জায়গাটাতেই বসে। শফিকেরও পছন্দ বোধ হয় জায়গাটা। শফিকের যাতে আসতে অসুবিধা না হয়, এ জন্য ড্যাফোডিল ইউনভার্সিটির পাশের এই কফিশপটা বেছে নিয়েছে ফারিয়া। ফারিয়া এবার ফাইনাল ইয়ারে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী ফারিয়া খুব ক্যারিয়ারসচেতন। সে এখন থেকেই পত্রপত্রিকায় তার সাবজেক্ট রিলেটেড জবগুলো দেখছে। পাস করার পরই সে জবে জয়েন করবে ভাবছে। অন্যদিকে শফিক একটি স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। সেও খুব ক্যারিয়ারসচেতন। ইতিমধ্যে সে কয়েকটি অন-ক্যাম্পাস আইটি জব ফেয়ারের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরীক্ষা ভালোই দিয়েছে। চাকরির বিষয়ে বেশ আশাবাদী। এখন জব রিলেটেড অন্য ওয়ার্কশপগুলো করছে সে। শফিক সব ব্যাপারে সিরিয়াস হলেও তার সময়জ্ঞান নিয়ে ফারিয়া বিরক্ত; বিশেষ করে তারা যখন দেখা করে, তখন বেশির ভাগ দিনে ফারিয়া আগে এসে বসে থাকে। পাঁচ-দশ মিনিট লেট না করে শফিক আসেই না। যদিও হওয়ার কথা ছিল এর উল্টো।
আজও ঠিক ১৩ মিনিটের মাথায় শফিক হন্তদন্ত হয়ে ফারিয়ার টেবিলে আসতে গিয়ে অন্য একটা টেবিলের সঙ্গে গুঁতো খেতে খেতে একটুর জন্য বেঁচে গেল। ফারিয়া তাকিয়ে ছিল তার আসার দিকে। খুব হাসি পেল তার। কিন্তু হাসা যাবে না। হাসলেই শফিক খেপে যাবে। নিজের নাজুক অবস্থা শফিক কাউকে দেখাতে চায় না। এটা ফারিয়া খুব ভালো করে জানে। শফিক এসেই ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল। সে বলল, ‘কতক্ষণে এসেছ?’
ফরিয়া কপট রাগের ভঙ্গি করে বলল, ‘অ-নে-ক-ক্ষ-ণ। তোমার তো সব সময় আমাকে বসিয়ে রাখতে ভালো লাগে।’
‘আরে ধুর। কী যে বলো তুমি। আমি তো ক্লাসটা শেষ করেই আসতে যাচ্ছিলাম। শারমিন আর রাজু ধরল। ওদের সঙ্গে একটু হাই-হ্যালো করে এলাম।’
শারমিনের কথা শুনে একটু জেলাস হয়ে গেল ফারিয়া। বলল, ‘শারমিন ওই মেয়েটা না?’
শফিক বুঝল ফারিয়া কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু তবু সে প্রশ্ন করল, ‘কোন মেয়েটা?’
‘ওই যে তোমার ওপর ক্রাশ খাইছিল। এখন তো না চেনার ভান করবাই।’
শফিক হাসল। হাসলে ছেলেটাকে খুব নিষ্পাপ মনে হয়। ফারিয়া তার মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। শফিক বলল, ‘হা হা হা, আমি তো ওই ঘটনার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি এখন মনে করিয়ে দিলে।’
‘ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার এত হাই-হ্যালো করতে হবে কেন।’
‘আরে, কী বলো! ক্লাসমেট না আমরা? ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।’
রাগে ফারিয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে। ‘রাখো তোমার ভদ্রতা। ক্লাসে অন্য কোনো মেয়ে নাই? ওই শারমিনের সঙ্গে এত ভদ্রতা দেখানোর দরকার কী?’
‘আমি কি গিয়ে সেধে সেধে গল্প করছি? এখন কেউ ডাক দিলে কথা না বলেই চলে আসব? কিছু না হোক আমরা তো সহপাঠী।’
‘কে ডাক দিয়েছে তোমাকে? শারমিন না রাজু?’
‘ওরা দুজনই ডাকল।’
‘দুজনে মিলে তোমাকে ডাকতে হলো? একজন ডাকলে তুমি শুনতে পেতে না? তোমার কি কানে প্রবলেম?’ ‘ওহহ্ ফারিয়া, তুমি কিন্তু শুধু শুধু ঝগড়া করতে চাচ্ছ। টিউটরিয়ালের ব্যাপারে ওদের সঙ্গে কথা হলো।’
‘ওহহ্। আমি শুধু শুধু ঝগড়া করি। আর তোমার ওই শারমিন খুব মধুর মধুর কথা বলে?’

শফিক দেখল অকারণে বিষয়টা কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। সে ওয়েটারকে ডেকে কফির অর্ডার দিল। একবার খেপে গেলে ফারিয়াকে থামানো মুশকিল। যেকোনো জায়গায় সে সিনক্রিয়েট করতে পারে। ওয়েটার আসায় পরিস্থিতি আপাতত একটু শান্ত হলো। তবে এটা হলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে। ফারিয়া এখানকার একপ্রেসো কফিটা পছন্দ করে। আপাতত শফিক ওটাই অর্ডার করল। ওয়েটার চলে গেলে ফারিয়া আবার মুখ খুলল। সে বলল, ‘বলো?’

‘কী বলব?’
‘তোমার শারমিন খুব মধুর কথা বলে কি না?’

শফিক বলল, ‘জগতের সবচেয়ে মধুর কণ্ঠ হলো ফারিয়া নামের মেয়েটার। সে এখন আমার মুখোমুখি বসে আছে।’ বলেই সে হাতটা ধরল ফারিয়ার। ফারিয়া আরও কিছুক্ষণ রেগে থাকার চেষ্টা করলেও শফিকের এই আচরণে মন থেকে সব রাগ চলে গেল ফারিয়ার। সে বলল, ‘অভিনয় তো ভালোই শিখেছ।’
শফিক জানে এটা অভিনয় নয়। ফারিয়াকে সে যা বলেছে, মন থেকেই বলেছে। ফারিয়ার কণ্ঠই তার কাছে সবচেয়ে মধুর কণ্ঠ মনে হয়। শফিক অবশ্য শারমিনের সঙ্গে কথা হওয়াটা এড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু পারতপক্ষে শফিক মিথ্যে কথা বলে না। এ জন্য মাঝে মাঝেই তাকে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্তু সে হাসিমুখে সব বিড়ম্বনা সইতে রাজি আছে। ফারিয়া শফিককে শারমিনের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু শফিক সেই নিষেধ মানতে পারেনি। শারমিনের ঘটনা শফিকই ফারিয়াকে বলেছিল।ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই শারমিন প্রেমে পড়ে শফিকের। শফিক প্রথমেই বলে দিয়েছিল তার গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু শারমিনকে থামানো যায়নি। সে দিন দিন আরও ক্রেজি হয়ে ওঠে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান শারমিন জীবনে রিফিউজ হতে শেখেনি। যখন যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। ফলে শফিকের না বলাতে সে যতটা না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি ইগোতে লেগেছে তার। সে অনেক দিন অনেকভাবে শফিককে ডিস্টার্ব করেছে। কিন্তু শফিক তার অবস্থান থেকে সরেনি। আবার একই ক্লাসে পড়ার কারণে শফিক চায়নি সম্পর্কটা এমন জায়গায় যাক, যাতে তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। তবে শারমিন বেশি দিন তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেনি। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, দ্রুতই অন্য একটা ছেলে, ওদেরই সহপাঠী রাজুর সঙ্গে রিলেশন তৈরি হয়েছে শারমিনের। এখন ওরা তিনজনই ভালো বন্ধু। শুধু ফারিয়াই ওই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারে না। তবে আজকে ফারিয়ার মেজাজ খারাপ হওয়ার অন্য কারণও আছে। বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। সামনের সপ্তাহে যেতে বলেছে। শফিককে বললে শফিক এসব পাত্তা দেয় না। সে জানে, আজও পাত্তা দেবে না। তবু বলল, ‘বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছিল। যেতে বলেছে।’

শফিক নির্বিকার উত্তর দিল, ‘বেশ। ভালো তো! গিয়ে ঘুরে এসো।’
‘তুমি বোঝোনি ব্যাপারটা। পাত্রপক্ষের লোকজন দেখতে আসবে।’
‘আমাদের ব্যাপারটা তো তোমার বাড়ির লোকেরা জানে। এখনই এসব করছে কেন তাহলে।’
‘সে কথা তো তুমিও জানো। আমরা সমবয়সী। এ জন্যই ভরসা পায় না বাসায়। তা ছাড়া মফস্বলের মেয়ে হিসেবে আমার বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। সেটাও তো তোমাকে দেখতে হবে।’
‘মফস্বলের মেয়ে হলে কী হবে? তুমি এখন দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ো। তোমাকে মফস্বলের মেয়ে হিসেবে ট্রিট করলে কীভাবে হবে?’
‘বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকলে মা-বাবা সব সময়ই টেনশন করে। তা ছাড়া তুমি তো এখনো চাকরি করছ না। একজন বেকারের হাতে কেউ নিজেদের মেয়েকে তুলে দেয়?’
‘এটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এখন কী করবা?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘চলো বিয়ে করে ফেলি।’
‘ধুর। ইয়ার্কি কোরো না তো! কী করা যায় তার একটা বুদ্ধি বের করো।’
‘আমি বুদ্ধি বের করব কীভাবে? তোমার বাড়ির লোকজনকে সামলানোর দায়িত্ব তোমার। আমার বাসায় যদি আমাকে বিয়ে দিতে চায় তাহলে আমি সেটা ঠেকাব।’
‘উফফ্, তোমাকে বলাই ভুল হয়েছে। তুমি কিছুই সিরিয়াসলি নাও না।’
‘আচ্ছা, আমাকে কী করতে হবে বলো।’
‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। মেন্টাল সাপোর্ট দাও আমাকে। আমি সব ঠিক করে ফেলব।’
শফিক হাসল। সে বলল, ‘তো, ভাইজান করেন কী?’
‘কোন ভাইজান?’
‘যিনি দেখতে আসবেন। বিয়ে হলে তো আমার ভাইজানই হবে।’
‘ওহহ ভাইজান একজন ইঞ্জিনিয়ার। টিএসসিতে ঘুরতে এসে আমাকে দেখেছে। এরপর বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে।’
‘বাহ! এত ভালো পাত্র, আর তুমি পাত্তা দিচ্ছ না!’
‘রাখো তোমার ভালো পাত্র। ভালো পাত্র আমার দরকার নেই। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি দ্রুত একটা চাকরিবাকরি জোগাড় করে বাসায় প্রস্তাব দাও।’
‘আমাদের ব্যাপারটা দুই পরিবারই জানে। তাদের সম্মতিও আছে শুনেছি এত দিন। তাহলে এখন এমন করছে কেন বুঝতে পারছি না।’
‘মানুষের মন কখন ঘুরে যায় কে জানে? হয়তো এত ভালো পাত্র ওরা হাতছাড়া করতে চায় না।’
‘হাতছাড়া করতে চায় না মানে কী? বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেবে নাকি?’
‘সেটা হয়তো করবে না। তবে সবাই মিলে বোঝানোর চেষ্টা করবে।’
‘ওহ, তাহলে তো আর প্রবলেম নেই। তুমি গিয়ে ঘুরে এসো। বেড়ানোও হবে, ছেলে দেখাও হবে।’
‘হুম, সেটাই করতে হবে বোধ হয়।’
‘কবে যাচ্ছ?’
‘পরশু পর দিন। তুমি বাসস্ট্যান্ডে যাবে আমার সঙ্গে।’
‘আমি যাব তোমাকে অন্য ছেলে দেখতে আসবে সেখানে এগিয়ে দিতে! তুমি এত নিষ্ঠুর! তোমার কি মায়াদয়া নেই?’
‘অবশ্যই মায়াদয়া আছে। সে জন্যই যেতে বলছি। ধরো, আমাকে যদি ওখানে বিয়ে দিয়ে দেয় তাহলে আর দেখা না-ও হতে পারে। সে জন্যই মায়া করে বাসস্ট্যান্ডে এগিয়ে দিতে বলছি।’
ফারিয়ার রসিকতায় শফিক না হেসে পারল না। সে বলল, ‘ঠিক আছে। এত মায়া উপেক্ষা করে না যাওয়াটা বোধ হয় উচিত হবে না।’

Series Navigationউপন্যাস।। চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব দুই >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *