উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১১-পর্ব

আলী আসগর তো অনেকদিন বাড়ি আসে না। ওকে বাড়ি আসতে খবর দেব। বাড়ি আসলে ওকে অনেক বুঝিয়ে বলব- ওর জায়গা সম্পত্তি আমার দরকার। ও তো ঢাকায় বাড়ি করেছেই। যদি রাজি হয়তো ভালো- নইলে কাগজপত্র আগেই তৈরী রাখব, জোর করে আমার নামে লিখিয়ে নেব-

যদি লিখে না দেয়?

বরকত আলীর মুখে-চোখে লাভার মতো হিংস্রতা ফুটে উঠে- যদি লিখে দিতে না চায়, জোর করে লিখিয়ে নেব। তারপর খুন করে কচা নদীতে পাথর বেঁধে ভাসিয়ে দেব।

হয়েছে- পারভীন ধমকে ওঠে- এসব বুদ্ধি এখন থাক। রাত বিরেতে কে কোথায় বসে শুনে ফেলবে-চলো ঘরের ভেতর চলো।

হ্যারিকেন নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে যায় পারভীন আর বরকত আলী। জানায় চুপচাপ বসে থাকে অধ্যাপক টুনটুনি। একি শুনছেন তিনি? তিনি কি ভুল শুনেছেন? নাকি এটা স্বপ্ন? মায়া? যাদু? না, সবই সত্যি, তাকে তাঁর পিতার ঔরসজাত ভাই খুন করবে, খুন করার জন্য প্লান করছে কেন, সম্পত্তির প্রয়োজনে? হায় জীবন? গায় সম্পত্তি! একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত জমি-জমা দরকার? মূলত এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

টুনটুনি অধ্যাপক পাখি হওয়ার পর মানুষের যে পরিচয় পাচ্ছেন, বিষ্মিত হয়ে যাচ্ছেন! তাহলে আমি কোথায় বাস করছি? বিষাক্ত বাতাসে বাস করছি? কোথাও আমার জন্য কোনো সুখবর নেই- সব জায়গায় হিংস্র চিতাবাঘের লোভে চকমকে দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য! এই জগতে-মানুষের পৃথিবীতে বাস করা কোনো যোগ্যতাই আমার নেই! ঘরে শত্র, বাইরে শত্র-তারপরও এতদিন কীভাবে জীবনকে বহন করে চলেছি? এবং এই চমৎকার শত্রদের আমি এতদিন ভালোবেসেছি-শ্রদ্ধা করেছি-অধ্যাপক টুনটুনি ইচ্ছে হয়-বড় ভাই বরকত আলীকে ন্যাংটা করে উদোম মাঠে নিয়ে চাবুক পেটা করতে । পেটাতে পেটাতে গায়ের চামড়া খুলে লবণ দিয়ে মুড়ে দিতে। কঠিন শাস্তি দিতে চায় মন, মনের ভেতরের প্রতিশোধ স্পৃহা মাঠ ঘাট পথ প্রান্তর কাঁপিয়ে অ্যাপক টুনটুনির চোখে কান্না আসছে। প্রাণপণ চেষ্টায় তিনি কান্নাকে থামানোর চেষ্টা করছেন।

কিন্তু জীবনের যাবতীয় সুরভি ধৈর্যকে উপেক্ষা করে বেদনাপ্লুত কান্না দুচোখ বেয়ে নেমে আসে ঝরনাধারার বেগে। সমগ্র মানব চরাচরের প্রতি বিজাতীয় এক প্রকার ঘৃণায় তাঁর মন-মানবিকতা অস্বস্তিতে কাঁপতে থাকে। জীবনের একি দুর্দশা? এই ক্ষয়ে যাওয়া, নষ্ট, পঁচা স্বার্থপর জীবন তিনি কখনও প্রত্যাশা করেন নি। এই ঘর, বাড়ির আশপাশে তাঁর থাকতে ইচ্ছে করছে না। নিঃশ্বাসে অব্যক্ত বিষ। তিনি অন্ধকারে আকাশে উড়লেন।

উড়গলেন তো উড়লেন, কিন্তু কোথায় যাবেন এই ঘুটঘুটে অচিন অন্ধকারে? উপরে বিশাল আকাশ, আকাশ ভরা তারার মেলা, মাটির পৃথিবীতে নিকৃষ্ট অন্ধকার গাছপালার অশরীরী ভূত হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও জন-মানবের সাড়া নেই। নাম না জানা পোকামাকড়ের একটানা অদ্ভূত শব্দ শোনা যায়। উড়তে উড়তে থামলেন-কয়েক মুহূর্ত, তারপর অন্ধকার আকাশ থেকে নামতে থাকলেন নিচের দিকে অধ্যাপক টুনটুনি এবং নামলেন, পিতার করবস্থানে।

পিতা মাহবুব আলম শুয়ে আছেন এখানে। তাঁর সিঁথানে একটি বিশাল তুলাগাছ দাঁড়িয়ে। কবরটা ভেঙে চুরে, বৃষ্টির পানিতে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে আছে। নাম না জানা লতাগুল্মে ঢেকে গেছে পিতার কবরের পবিত্র মাটি। তিনি কোনোদিন তাঁর জন্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন নি। আজ প্রায় সমতল কবরের পাদদেশে অন্ধকারে চুপচাপ বসে থেকে আপন মনে কথা বলছেন অধ্যাপক টুনটুনি পাখি: পিতা! তুমি কি এখানে এই মাটির মধ্যে মিশে একাকার হয়ে এখনও জেগে আছো? নাকি রূপান্তরের খেয়ায় ভেসে ভেসে অনন্তকালের স্রোতে মিশে গেছো? পিতা, কেন তুমি আমার মাকে দ্বিতীয় বৌ করে এনেছিলে? কোথায় আমার মা? তুমি কি জানো? কেমন আছো পিতা তুমি অমরলোকে? আমার মাকে বিয়ে করলে, আমাকে পৃথিবীর পৃষ্ঠায় আনলে কিন্তু পিতা সুখ তো পেলাম না। বড় হয়ে জেনেছি আমার মা সংসার ছেড়ে চলে গেছেন মৃতলোকে, চোখে দেখেছি তাঁর স্নিগ্ধ মৃতদেহ। আজও কেউ বলল না- কোথায় তিনি গেছেন? কবে আসবেন নাকি আশার ভেলায় ভেসে ভেসে আমার জীবন ভেসে যাবে অকূল সাগরে তোমার সন্তানেরা কেন আমাকে খুন করতে চায়? আমি যেদিন বড় হয়েছি, আমাকে বুঝতে শিখেছি আমি জীবনের চড়াদামে-সেদিনই তোমান সন্তানদের সব ছেড়ে দিয়ে চলে গেছি অনেক দূরে। পিতা, তুমি কোনোদিন ভাবতেও পারবে না-কী অসীম কষ্টে যাতনায় আমি আমাকে তিলতিল করে তৈরী করেছি। আজ, এই পৌঢ় বয়সে এসেও আমাকে খুব করতে চায়-কেন?

ক্লান্ত, অবসন্ন অধ্যাপক টুনটুনি অথবা আলী আসগর একসময়ে ঘুমিয়ে পড়েন কবরেম পিতার কবরের পাদদেশে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখতে পান- তার মা শেফালি বেগম দাওয়ায় বসে আছেন-নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে-মধুর জন্য এক পয়সার একটি বাঁশি নিয়ে।

কে কাঁদে এমন করে? এমন গভীর অন্ধকারে? উঠে বসে সে। নামে বিছানা থেকে।

আলঅ আহসান ঘুমায় ড্রয়িংরুমে। পেছনের বারান্দায় মা-বাবার বিছানা। ডানপাশের বারান্দা কাম ডাইনিং রুমের পাশে আলাদা একটা রুমে থাকে মৌলি। মৌলির রুমে অনুমতি ছাড়া ঢোকা নিষেধ। ড্রয়িংরুমে ছেড়ে বড় ঘরে ঢোকে, বড় ঘর থেকে এসে দাঁড়ায় মায়ের ঘরের সামনে আলী আহসান। হ্যাঁ, থেতলানো কান্নাটা মাই উৎপাদন করছেন। মাকসুদা বেগম বিছানায় এলোমেলোভাবে বসে বসে কাঁদছেন, মনে হচ্ছে কান্নাটা বুকের ভেতর গভীর গোপন কোনো কারখানা থেকে আসছে- বিস্মিত আলী আহসান- তার মা কাঁদতে পারেন? তিনি কাঁদেন? যিনি প্রচণ্ড প্রভাব আর শাসনের চাবুক নিয়ে চারজনের সংসারটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছেন নিষ্ঠুর সহিসেন মতো- তিনি কেন গভীর রাতে কাঁদেন?

মা?

দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দেয় আলী আহসান। কান্না থামে মাকসুদা বেগমের।

থানা থেকে আসতে আসতে তাঁর বুক ঠেলে এই কান্নাটা কুমিরের মতো বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। আলী আহসান কি সহজ-সরলভাবে দারোগার কাছে সামনা সামনি মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এল? দারোগা অবাক চোখে তাকে আর আহসানকে দেখছিল। তার চোখে ছিল কুৎসিত দৃষ্টি। থানা থেকে এসে আবার জয়পুরহাট কলেজে ফোন করেছিলেন, না, অধ্যাপক আলী আসগর পৌঁছাননি সেখানেও। তাহলে কোথায় গেল মানুষটা? ঢাকার হাসপাতাল, মর্গ খোঁজা হয়েছে-কোথঅয় মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সারা জীবনের কৃত অপরাধসমূহ এসে হাজির হয় মাকসুদার টেবিলে। দুঃখে ক্ষোভে রাগে তার মানসপটে বিপুল অভিমান জমা হয় অধ্যাক আলী আসগরের জন্য। হ্যাঁ, সে অন্যায় করেছে, সে ঝগড়া করেছে, সে অকথ্য বলেছে-কিন্তু প্রতিবাদ কেন করেন নি আসগর? সবসময় কেন মুখ বুঁজে সহ্য করেছেন? শাসন করলে, ভুলটা ধরিয়ে দিলে তিনি এমন করতেন না। তাঁর স্বভাব-চরিত্রের মধ্যেই কর্কশ ভাবমূর্তি রোপিত। সারা দিনের, সন্ধ্যার হাহাকার বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন না খেয়ে। হঠাৎ শেষ রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আটকে চেষ্টা করেছেন অজস্র দিনের জমানো জমা খরচের প্রতিরোধ ভেঙে এই প্রবাহিত কান্নাকে রোধ করতে পারেন নি- কোত্থেকে যে কান্ন বন্যার বেগে বের হচ্ছে বুঝতে পারছেন না। লজ্জায় তিনি বিছানায় চুপচাপ বসে থাকেন। মায়ের সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার ডাকে আলি আহসান- মা?

কি?

আহসান রুমে প্রবেশ করে লাইট জ্বালায়। মশারীর মধ্যে আলুথালু মাকসুদা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। আলী আহসান চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার চিরকালের অহংকালী মায়ের অনিন্দ্য পরাজয় দেখে।

মা?

কি? ডাকছিস কেন?

পানি খাবে?

দে এক গ্লঅস-

আহসান পানির জন্য পাশের ঘরে যায়। আর তখনই মনে পড়ে মাকসুদা বেগমের-সত্যিই তো, তার কন্ঠ আঠালেঅ, মুখ তৃষ্ণার্ত। ভয়ানক তৃষ্ণায় তার শরীর জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে। কিন্তু সব হানিয়ে ছেলের কাছে এই ধরা পড়ে যাওয়া, এই অনুশোচনা তাকে আরও নিৎস্ব করে তোলে আলী আহসানের কাছে। আলী আহসান-মেয়ে মৌলি তাকে ক্ষমা করবে না। সহস্র অভিযোগে অভিযুক্ত করবে তাকে, সব তীর একত্রিত হয়ে তাকে বিদ্ধ করবে, তার সুখ, সম্মান, সংসারের অধিকার সব-সব ভেঙে পড়বে নিমেষে, কুহবে। মাকসুদা বেগম এখন অসম্ভব এক ভয়ে আক্রান্ত- যদি আর কোনোদিন অধ্যাপক এই বাড়িতে ফিরে না আসেন সব দায়িত্ব পড়বে তার ঘাড়ে। এখন কি করবেন তিনি? কোথায় যাবেন? কীভাবে খুঁজে বেন করবেন আলী আসগরকে?

আলী পানির গ্লাস নিয়ে আসে- পানি নাও।

মাকসুদা বেগম পানির গ্লাস নিয়ে পানিটা পান করে গ্লাটা ফিরিয়ে দেয়-আমমার গুম আসছে নারে।

কেন?

জানি না।

চোখ বুঝলেই কেবল তোর বাবাকে দেখি।

কি দেখো?

বুড়িগঙ্গার স্রোতে একটা ভেলায় সে সাদা কাপড় পরে বসে আছে।

বলো কি?

হ্যাঁরে, বাবা, কি করব আমি! চোখ বুঝলেই দেখতে পাই ঐ দৃশ্য। তাই চোখ খুলে বসে থাকি।

তাহলে এক কাজ করো-

কি?

তুমি শুয়ে পড়ো- তোমার পাশে বসে আমি মাথায় হাত বুলাই।

আচ্ছা-মাকসুদা অসহায় পুতুলের মতো শুয়ে পড়ে।

মিহি চাঁদোয়া আলোর ঘোমটা খুলছে মাত্র-পৃথিবী।

কবরস্থানে ঘুমন্ত অধ্যাপক টুনটুনির ঘুম ভাঙে। তিনি চারপাশে তাকান। কি করবেন তিনি? ভয়ানক স্বস্তির মধ্যে তিনি ডানা মেললের আকাশে। অবাক লাগছে তাঁর- ছোট বেলায় তার কোনো ভয় ডর ছিল না, রাতে-অমাবশ্যায় যখন তখন নানা জায়গায় গেছেন। অথচ আজ তিনি সারা রাত কবরস্থানে , অসংখ্যা কবর ও কবরের মানুষের সঙ্গে কাটিয়ে ছিলেন, কোনো ভয় শংকা তাকে বিচলিত করেনি। ভয় মনের মধ্যেও আসেনি।

একেবারে গাছপালা ছাড়িয়ে তিনি উপরে উঠে গেলেন। অদ্ভুত অপরূপ সৌন্দর্য-সমস্ত চরাচর জুড়ে। যেদিকে চোখ যায়-ভোরের কুয়াশা ঢাকা মৃদু আলোয় ঢেকে আছে পৃথিবী । নিস্তব্ধ, অচঞ্জল, স্বপ্নভূক পৃথিবী। এত সৌন্দর্য চোখে সহ্য হয় না। তিনি ভাসমান এবং স্থির থেকে তাকালের পূর্বাকাশে। জীবন- পাখিজীবন, তিনদিনের পাখিজীবন তার সার্থক। সূর্য ডিমের লাল কুসুমের আকার নিয়ে টলোমেলো পদ্মপাতায় শিশির বিন্দর মতো উঠে আসছে ক্রমাগত উপরের দিকে, আস্তে আস্তে। সূর্যযত উপরে উঠছে, লাল রঙটা দিকে দিকে ফিকে হচ্ছে। পৃথিবীতে হিমায়িত আলো রঙিনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। নিচে গাছপালায় বসবাসরত পাখিদের ঘুম ভাঙছে। তারা ডাকছে, উড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে জীবনের জন্য চারদিকে।

পৃথিবীর অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে তিনি, অধ্যাপক আলী আসগর অথবা অধ্যাপক টুনটুনিপাখি সিদ্ধান্ত নিলেন- পাখি জীবনের আর মাত্র দেড়দিন বাকি আছে, তিনি সত্যি তার চারপাশের মানুষ সম্পর্কে, চারপাশের মানুষদের তাঁর সম্পর্কে আরও ধারণা পেতে চা। তিনি পিরোজপুর জেলার ভানডারিয়া বোথলা গ্রাম থেকে আড়াআড়ি ভাবে ছুটলেন জয়পুরহাটে। তাঁর সহকর্মী-ছাত্রছাত্রীদে রকাছে যাবেন। তাদের ভাবাটা নিজের জন্য জানা খুবই জরুরি দরকার।

তুমি কি মনে করো আমার সাহায্য ছাড়া জুরাইন এলাকায় তোমরা থাকতে পারবে? এক মুহূর্ত? যদি আমি চাই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তোমাদের এই বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারি? তোমাকে ইচ্ছে করলে তেল নুন মরিচ গরম মসলা ছাড়া করে খেতে পারি- এখানের কেউ কিচ্ছু বলবে না আমাকে-দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার।

ভেতরের খাটে কসে শুনছে মাকসুদা বেগম। দু’দিন আগে এই মানুষটা দেখলে শরীরের ভেতর কী অপরূপ এক ঢেউ খেলে যেত, মনে হত-শরীরের নদী ভেঙে ভেঙে কূল-কিনারা হীন বান আসছে অথচ আজ ঘৃণার বেহালা বাজছে। ইচ্ছে করছে লোকটাকে ন্যাংটা করে দুমড়ে মুচড়ে ভাঙা গাড়ির মতো পাঁচশো বছরের পুরোনো দুর্গন্ধে ভরপুর এক গভীর পায়খানায় ফেলে দেয়। কিন্তু কিচ্ছু করতেপারে না- মাকসুদা বেগম চুপচাপ বসে থাকে।

সকালে মৌলি জরুরি প্রয়োজনে ইউনির্ভাসিটিতে চলে গেছে। আলী আহসান তার পিতাকে খুঁজতে হাসপাতাল, মর্গ, থানায় গেছে। আর তিনি মাকসুদা বেগম হঠাৎ শরীরের যাবতীয় শক্তি বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন ঘরে, একা। কোথও যেতে ইচ্ছে করছে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পৃথিবীর সব ক্লান্তি, বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করেছে অক্টোপাসের মতো।

এই সময়ে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার এসে সামনে দাঁড়ায়। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। মুখেখ ক্রর হাসি, মোলায়েম দৃষ্টি চোখে-দৃষ্টিকে রাজ্যের অভিজ্ঞ হায়নার ছায়ারা হাসে খেঁক শিয়ালের ধূর্ততায়। অথচ সেই শুরুতে মাকসুদা বেগমের পিছনে লেগেছিল শূকরের মতো। মাকসুদার মুখের একচিলতে অনুকম্প মাখা হাসির জন্যে ভিখেরির মতো অপেক্ষায় থাকত যে দেলোয়ার, সেই-চিরচেনা দেলোয়ারের এ কি রূপান্ত, ইস্পাত প্রতরণা!

কথা বলছো না কেন মাকসুদা? আমার প্রিয় মাকসুদা বেগম?

তারপরও নিশ্চুপ মাকসুদা।

দরজা অতিক্রম করে ভেতরে ঢোকে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার। বসে মাকসুদা বেগমের পাশে। মুখে দানবের হাসি-আমি জানি, তুমি খুন করে লুকিয়ে রেখেছো অধ্যাপক আলী আসগরকে। এখন ভাব করছো-ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানো না- দেলোয়ার মুখটা নামিয়ে আনে মাকসুদা বেগমের ঠোঁটের উপর। কিন্তু আশ্চর্য মাকসুদা বেগমের ঠোঁট জোড়া পাথরের মতো শক্ত, নিরেট। কোনো কোমলতা নেই। কর্কশ ঠোঁট। ব্লেডের মতো ধারালো ঠোঁট কেটে রক্তপাত হচ্ছে। চোখ দুটো মাকসুদার মার্বেলের মতো স্থির। অক্ষি গোলক। সাঈদ হোসেন দেলোয়ার অসম্ভব ভয় পায়। মাকসুদার সারাটা শরীর ঠান্ডা, হিম শীতল। সে ঝেড়ে দেয় মাকসুদা বেগমকে।

ভয়ে ভয়ে তাকায় দেলোয়ার-মাকসুদা কি মরে গেছে? কেউ কি দেখে ফেলল তাকে, এই ঘরে? মাকসদার কাছে? লোকাল সম্ভ্রান্ত মাস্তান, ক্ষমতাসীন দলের হোমনা-চোমনা সাঈদ গোসেন দেলোয়ারের কলিজা বুক থেকে ছিটকে বের হতে চায়। ঘটনা কি কেউ দেখল? জলজ্যন্ত মেয়ে মাকসুদা বসে আছে খাটে, চিবাচ্ছিলো পান-কত চেনা মাকসুদা তার, ওর শরীরের কোথায় ক’টা তিল আছে, কাটা দাগ আছে- ও কোনভাবে সুখ পায়-সুখে খিস্তি ঝাড়ে-সব জানে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার। অথচ আজ এবং গত দু’দিন ধরে অনেকদিনের চেনা-জানা ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্ঠতম মাকসুদা বেগমকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। মাকসুদা তাকে চেনে না। কেন? এমন ঘটল মাকসুদা এবং তার মাঝে? আর সত্যি অধ্যাপক আলী আসগর কোথায় গেলেন?

ঝট করে মাকসুদা ছেড়ে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার দরজায় এসে দাঁড়ায়। মাকসুদা উঠে বসে। স্থির তাকিয়ে থাকে দেলোয়ারের দিকে। দেলোয়ারের শরীরে ঘাম দেখা দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে দেখছে সে মাকসুদাকে। পেছনে পা বাড়িয়ে দরজা অতিক্রম করতে যাচ্ছে দেলোয়ার। তার মনে হচ্ছে মাকসুদা একটা ভৌতিক মানুষ। পেছনে পা দুটো নিয়ে দরজা অতিক্রম করে পেছনে ফিরতেই দেখা মৌলির সঙ্গে। মৌলি তাকে দেখছে আর হাসছে। মৌলির দিক তাকিয়ে থাকে দেলোয়ার-মৌলি কোত্থেকে এসেছে? এখন কেন এল? মৌলি কি জেনে গেছে ওর মায়ের সঙ্গে আংকেল সাঈদ হোসেন দেলোয়ারের লীলা? নিকষিত হেমপারে রতিচক্র? কুসুমে কুসুমে তারা গন্ধবিলাস ছড়ায়? তাহলে হাসে কেন মৌলি? সাঈদ হোসেন দেলোয়ার মৌলিকে অত্রিকম করে চলে যায়- যাবার সময় নিয়ে যায় মৌলির শরীরের লবণাক্ত ছন্দ, কামকাতরতার নিবিড় উষ্ণতা।

সাঈদ হোসেন দেলোয়ারের সঙ্গে শরীর সঙ্গীত রচনা হয়েছিল কবে? মাকসুদা বেগম সে দিনটি ভোলেনি। দেলোয়ার যা কিছু করে একটি চমৎকার পরিকল্পনা করে ধীরে ধীরে এগোয়। অবস্থা বুঝে কখনও কখনও পিছিয়েও যায়। এই পিছিয়ে যাওয়া মানে পরাজিত হওয়া নয়, যুদ্ধের জন্য বিপুল প্রস্তুতি নিয়ে আবার আসা। রচনা করার কৌশল মাত্র। শুরুতেই মাকসুদা বেগম একজন সংবেদনশীল মহিলা হওয়ায় দেলোয়ারের চোখ দেখেই বুছতে পেরেছিল-এই চোখ কি দেখে? কি চায়? দেলোয়ার তার দৃষ্টি দিয়ে মাকসুদাকে লেহন করত। মাকসুদা কখনও কখনও বিরক্ত হলেও কখনও কখনও যে অপাঙ্গে উপভোগ করতেন না, তেমন নয়। মনে মনে হাসতেন। উপভোগ করতেন একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষের কল্পনার কামনার লেলিহান স্বাদ। অধ্যাপক আলী আসগর নির্বিবাদী মানুষ। সব সময় পড়াশোনা আর নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকাই তার কাজ। তার চারপাশের কি ঘটছে জানার চেষ্টা করতেন না। সহকালী অধ্যাপক হিসেবে প্রমোশন পেয়েছেন এবং তাঁকে ঢাকার বাইরে প্রান্সফার করে কর্তৃপক্ষ। তিনি অম্লানবদনে সংসার মাকসুদা বেগমের হাতে দিয়ে চলে যান যশোরে। মাস তিনেক পরে বাসায় আসেন জ্বর নিয়ে।

Series Navigation<< অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১০ম-পর্বউপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১২তম-পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *