ছোটগল্প।। কক্সবাজারে একদিন।। ক্বণন নিয়োগী

“সারাদিন বসে বসে খালি গেম খেলা! কাজটাজ কিছু কর। পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে পড়বি না মানলাম। তাই বলে সারাদিন খেলবি নাকি, অ্যা? সদ্য এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়া তুষারকে শাসাচ্ছেন মা। পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই দিন হলো। সেই যে তুষার রুমের ভিতর ঢুকেছিল এক মুহূর্তেও জন্যও বের হয়নি। এমনকি খাবারও তাকে রুমে দিয়ে আসতে হয়। তাকে সমবসময় হয় মোবাইল অথবা ল্যাপটপ হাতেই দেখা যায়।

“মা, পরীক্ষা তো শেষ হলো। এতদিন পড়াশোনা করেছি। এখন সমস্যা কী একটু খেললে?”

“একটু খেললে তো ভালোই হতো। দেখ একবার নিজেকে। দুইদিন হলো সারা দিন রুমের ভেতরেই ছিলে। বাকি তিন মাস তহালে কী করবে তুমি? সারাটা দিন কি খেলে আর সিনেমা দেখে কাটাবে? আরও কত কী-ই তো করার পারো। এরপর এসে যদি দেখি এই বসে আছিস বাসা থেকে বের কওে দেব।” কথাগুলো বলেই মা চলে গেলেন রান্না করতে। তুষার তখন খেলছিল মোবাইল ফোনে। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল মাত্র ৩% চার্জ আছে ফোনে, ফোন চার্জে, আর সে তখনো সেটি চালাচ্ছে। তারপর খেলা বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে তার মায়ের কথাগুলো ভাবতে থাকে। সত্যিই সে কেমন যেন লাইফলেস হয়ে পড়েছে। না, এমন জীবন কারো কাম্য নয়। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। রুমের সাথেই বাথরুম। তুষার যায় বাথরুমে। আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। রাত জেগে সিনেমা দেখলে যা হয় আর কি! কালকে দেখছিল ‘রাতসাসান’।

তামিল এই শব্দটির অর্থ পিশাচ। সিনেমা দেখে সে পাগল হয়ে যায়… এতো ভালো সিনেমাও যে হতে পাওে এটা না দেখলে মনে হয় সে জানতেই পারত না। ধানমন্ডির একটি বাসার নিচততলায় থাকে তুষার, তার মা-বাবা, ছোটো বোন নিশাত ও তার দাদাভাইকে নিয়ে। বাসাটা খুব বেশি বড় না হলেও বেশ সুন্দও আর পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসে। তুষার নিজের মুখ ধোয়। বারবার পানির ঝাপটা দেয়। তারপর বের হয়ে গামছা দিয়ে নিজের মুখ মোছে। মুখ মুছে গামছা রাখছে আর ভাবছে কী করবে। সে প্রথমত তার রুম থেকে বের হলো। বের হয়ে তার পা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। মাংসের চমৎকার ঘ্রাণ বের হচ্ছে রান্নাঘর থেকে। তুষারের জিভে জল আসে। সে রান্নাঘরে যায়। মুরগির মাংস রান্না করছে মা।

খাবারটা তুষারের খুব প্রিয়। দেখেই মন ভালো হয়ে উঠল। সে সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রান্না হতে দেখল। তার মা সবাই খেয়াল করছে কিন্তু কিছুই বলছে না। তুষার বের হতে যাবে এমন সময়…

“আরেকবার ফোন ধরলে হাত ভেঙে ফেলব বলে রাখলাম।”

মায়ের ধমক খেয়ে তুষারের মন খারাপ হলেও সে ভাবতে লাগল আবার কথাগুলো। সে কি এতই বেশি গেম খেলে? হয়তো এই দুদিনে তাই ঘটেছে। চুপচাপ রান্নাঘরে থেকে বের হয়ে আসে সে। রান্নাঘরের পাশেই ডাইনিং টেবিল। তার পাশে দাদার ঘর। দেখে তার দাদাভাই পত্রিকা পড়ছেন। কিন্তু চশমা ছাড়াই দেখছেন।

“কী হয়েছে দাদাভাই, চশমা পরোনি কেন?”
“ও তুষার। আসলে চশমাটা অনেক খুঁজলাম কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না রে,” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন দাদাভাই।
“ভালোমতো খুঁজেছো তো?”
“তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।”
“নিজের মাথায় একবার হাত দাও।”

“মাথায় হাত দিব মানে?” কথাটা বলেই মাথায় হাত দিয়ে দেখে সেখানে চশমা রেখে সারা বাসা খোঁজা শেষ। নিজের দাদাকে এমন অবস্থায় দেখে তুষারের অনেক হাসি পায়। সে বের হয়ে আসে দাদার রুম থেকে। পাশেই তার বোন নিশাতের রুম।

সদ্য নবম শ্রেণিতে ওঠা নিশাত খুব ভালো রেজাল্টের সাথেই অষ্টম শ্রেণি পার করেছে। তার ভাইয়ের মতো সেও খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট। তারা দুই ভাইবোন স্কুলে সব সময় প্রথম স্থান দখল করে আসছে। যদিও নিশাত তুষারের মতো এত পড়ালেখা কখনোই করেনি। বিশেষ করে তুষার কখনো তার বোনকে পড়তে দেখেনি। সবসময় সে হয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে নয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বোনের রুমে তাকাতেই তুষার দেখে সে পড়ছে। ব্যাপারটা দেখে তুষার ভাবে যে এটা আসলে কীভাবে সম্ভব।

“কী রে এই সময়ে পড়াশুনা করছিস যে, তোর শরীর খারাপ-টারাপ হয়েছে নাকি রে?”

“মজা করার সময় পাও না, না? কালকে আমার ফিজিক্স পরীক্ষা, জ্বালিয়ো না তো।”

“সে কি, জ্বালাচ্ছি মানে, আগুন কোথায়?”

“নাহ, আর ভালো লাগছে না। মা, মা, দেখ ভাইয়া ডিস্টার্ব করে।”

“এই তুষার, তোর বোনের পরীক্ষা। ওর রুম থেকে আয়।”

বোনকে ক্ষেপিয়ে তুষারে বেশ মজাই লেগেছে। আরো কিছুক্ষণ জ্বালাতে চাচ্ছিল কিন্তু ছেড়ে দিল। তখনই মা তার উপর রাগ করে রয়েছেন।

“মা, আমি একটু বের হচ্ছি।”

“কোথায় যাচ্ছিস তুষার?”

“এই তো সামনেই। একটু হেঁটে আসছি আরকি।”

“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।”

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিজের ফোনটা সঙ্গে নিয়ে যায়। লিফট থাকলেও সিঁড়ি দিয়ে নামতেই পছন্দ করে। বাইরে এসে তার বেশ ফুরফুরে লাগছে। এসএসসি শেষ হওয়ার তার মনে হচ্ছে যে বেশ স্বাধীন এখন। জাহিদকে ফোন করে সে।

“হ্যালো দোস্ত, কী করিস?”

“এই তো একটা সিনেমা দেখা শেষ করলাম।”

“কাজ না থাকলে বাইরে আয়।”

“এখন বাইরে এসে কী করব?”

“আরে ভালো লাগছে না। তাই একটু ঘোরাঘুরি করতাম।”

“ধুর, এখন মন চাচ্ছে না।”

“বের হ তো বাসা থেকে।”

“আচ্ছা দাঁড়া আসছি।”

জাহিদ তুষারের ছোটবেলার বন্ধু। একটু কালো তার গায়ের রং। তাই বন্ধুরা সব মিলে ওর নাম দিয়েছিল ক্যালুফর্নিয়া। কিন্তু এই নাম শুনলে সে নিজেই হাসে, বিরক্ত হয় না। যেহেতু বিরক্ত হয় না তাই এই নাম ধরে ডেকে আর কেউ মজা পায় না। এখন সবাই আবার জাহিদ বলেই ডাকে। জাহিদের বাসাও ধানমন্ডিতে। তুষারদের থেকে মাত্র দুই গলি পরেই তাদের বাসা।

তুষার অপেক্ষা করছে তাদের অতি পরিচিত টংঘরে। আসলে দুই ছই দেওয়া একটি সাধারণ দোকান। কিন্তু প্রায়শই এই সাধারণ দোকানের ধোয়া ওঠা চায়ে জমেছিল কত অসাধারণ সময়। এসব কিছু তুষার মনে করতে থাকে।

দশ মিনিটের মাথায় জাহিদ এলো। দুটো চায়ের কথা বলে বসল বেঞ্চিতে। জাহিদ এসে বলল,

“কীরে ইন্টারমিডিয়েটের বই কিনে পড়েও ফেলছিস মনে হয়।”

“ভাই, আমি ফার্স্ট হই ঠিক আছে, তার মানে এই না যে সারা দিন পড়ালেখা করি। আর এখন ছুটি।

“আরে জানি। তা হঠাৎ বাইরে এলি কেন?”

“বাসায় আর কত? দুই তো আমার ঘরেই কাটালাম।”

“চল বিকালে বইমেলায় যাই। যাবি?”

“আজকে কত তারিখ রে?”

“ফেব্রুয়ারির ২৬। প্রায় শেষ দিকে।”

“না, আজকে আর যাব না। চল কালকে যাই।”

“আমার সমস্যা নাই। আমি সবসময় ফ্রি।”

“তাইলে তো হলোই। মাহির, প্রদীপ আর আহাদকেও বল ফোন দিয়ে। একসঙ্গে সবাই যাই।”

“আহাদের নাম্বার আমার কাছে নাই। তুই দিস।”

“আচ্ছা, দিব নে।”

চা খাওয়া শেষে ঐ দিনকার মতো ওরা বাসায় চলে যায়। রাতে খাবার টেবিলে যখন সবাই খেতে বসেছে, তুষার বাবাকে বলল, বাবা, কালকে বইমেলায় যাব। কিছু বই কিনব। টাকা লাগবে।”

“কত লাগবে?”

“এই তো দুই-আড়াই হাজার হলেই হবে।”

“কাল আমি বের হওয়ার আগে নিস।”

“ভাইয়া আমার জন্য একটা বই আনতে পারবে?” পাশ থেকে বলল নিশাত।

“আচ্ছা, এনে দিব।” বোনকে আশ^স্ত করে তুষার।

পরের দিন তিন হাজার টাকা নিয়ে বের হয় তুষার। তুষার আর জাহিদ একসঙ্গে বাসে ওঠে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বইমেলায় পৌঁছায়। এক ঘণ্টার ভেতইে মিলিত হয় চার বন্ধু। কিন্তু প্রদীপ আসতে পারেনি। সে সপরিবারে কক্সবাজারে বেড়াতে চলে গেছে।
সবাই মিলে ঘুরে বেড়াল, বই কিনল, গল্প করল। সবাই জানাল, কেউ এখন ব্যস্ত নয়। তুষারের বোনের পরীক্ষা, তাই সে কোথাও যেতে পারবে না পরিবারের সাথে। জাহিদের বাবা চাকরির কাজে ঢাকার বাইরে। মাহির আর আহাদেরও ঘুরতে যাবার কোনো প্ল্যান নেই।

“চল আমরা বন্ধুরা মিলেই কোথাও বেড়াতে যাই,” জাহিদ প্রস্তাব দিল।

“গুড আইডিয়া,” আহাদ এক কথায় রাজি।

“কিন্তু ঢাকাতেই ঘুরি না কেন। বাইরে যাওয়াটা সেফ না,” মাহির বলল।

“এই মাহির, তুই এত ভয় বাস কেন রে?” আহাদ বলল।

“এই তুষার কিছু বল,” জাহিদ তুষারকে চুপ থাকতে দেখে বলল।

“যাব ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে কখনো পারমিশন দিবে না।” তুষার বলল।

“একবার চেষ্টা করেই দেখ। যদি দেয়। শোন চেষ্টা না করেই যদি হাল ছেড়ে দিস তা হলে তুই জীবনে কিছুই করতে পারবি না। মনে কর আন্টি রাজি, কিন্তু তাই জানিসই না। সবটা মিস করবি।
“একবার আন্টিকে বলেই দেখ না।” আহাদও যোগ দিল জাহিদের সাথে।
“ঠিক আছে কথা বলে রাতে গ্রুপে জানাব,” বলল তুষার।

“আর মাহির, তুই যাবি মানে যাবি। আমি জানি আন্টি তোর যাওয়ার ব্যাপারে আরো খুশিই হবে,” আহাদ শাসনের ভঙ্গিতে মাহিরকে বলল। বাসায় ফিরে এসে হাতমুখ ধুয়ে নেয় তুষার। সদ্য কেনা বইগুলো নিয়ে বসে পড়ে। তেরোটা বই কিনেছে। বই, ভাড়া আর খাবার খরচে তিন হাজার টাকা পুরো শেষ। প্রথমে বই না খুলে গেল তার বোনের রুমে।

“কী রে পরীক্ষা কেমন দিলি?”

“ভালোই হয়েছে। বইটা এনেছো?”

“হ্যাঁ। এই নেয়।”

“থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”

নিশাতের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে তুষার। বিছানায় বসে দেখতে থাকে বইগুলো। “এখন বাজে রাত আটটা,” মনে মনে ভাবে সে, “রাত দশটার সময় খাবার খাব। দুই ঘন্টার মধ্যে চিকন বইটা পড়া যাবে।”

এই ভেবে সে হাতে নিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাঠ্যায়ের ‘হিরা মানিক জ্বলে’ বইটি। এই বইটির কথা সে তার স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়েছে। তাই কৌতূহলটা একটু বেশি।

“ভাইয়া…”

“কী হয়েছে?” তুষারের মুখে বিরক্তি।

“ভাত খেতে আসো তাড়াতাড়ি।”

“দাঁড়া, আর দুটি পৃষ্ঠা বাকি।”

“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসো।” বলেই চলে গেল নিশাত।

গল্পটা তুষারের বেশ ভালো লেগেছে। গল্পটা পড়ে তুষারেরও ইচ্ছে করে একটু অ্যাডভেঞ্চার করবে। তুষার ভাবতে থাকে জাহিদ আর আহাদের কথা।

“কী হলো, আসছিস না কেন?” মা এসে বললেন এবার।

“এই তো আসছি,” তুষার উত্তর দিল।

“তাড়াতাড়ি আয় সবাই তোর জন্য বসে আছে।”

বইটা রেখে তুষার হাত ধুয়ে খেতে যায়। খাবার টেবিলে বলেই বসে, “মা, আমরা ভাবছিলাম ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়া যায় কিনা।”

“নিশাতের পরীক্ষা রেখে আমরা বেড়াতে যাব?”

“না, মানে আমরা বন্ধুরা,” কথাটা বলে একটু ঘাবড়ে যায় তুষার।

“তোর বাবা বললে যাবি।”

এটাই তুষার ভেবেছিল। সে জানে তার বাবা জীবনেও রাজি হবে না। তবু সে বলল, “বাবা,

আমরা বন্ধুরা ভাবছিলাম একটু ঢাকার বাইরে ঘুরে আসি…”

“তো যা। কবে যাবি?”

তুষার তো থ মেরে যায়। এত সহজে তার বাবা রাজি হয়ে গেল। যাক, ভালোই হলো তবে।

“কোথায় যাবি বললি না যে,” বাবা জিজ্ঞেস করেন।

“এখনো ঠিক করিনি। কালকে ঠিক করব।”

রাতে তুষার তাদের গ্রুপে একটা ম্যাসেজ পাঠায়, “কালকে সবাই টেক আউটে আসবি পাঁচটার সময়।”

তুষার যখন বের হয় তখন ঘড়িতে পাঁচটা সাত। সে মনে মনে ভাবে সবাই তার জন্য অপেক্ষা করায় প্রচুর রেগে আছে। ভেতরে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে আবিষ্কার করল বাজে পাঁচটা তেত্রিশ। সে যখন টেক আউটে বন্ধুদের খুঁজছে তখন সে আবিষ্কার করল সেই সবার আগে এসেছে। ছয়টার মধ্যে সবাই পৌঁছে গেল। চারটা বার্গার অর্ডার করে আহাদ বলল,

“কী রে পারমিশন দিল, তুষার?”

“হ্যাঁ। আমি ভাবিইনি পেয়ে যাবো।”

“কনগ্রেটস, বলছিলাম না পারমিশন পেয়ে যাবি,” জাহিদ বলল।

“এই শোন, আমার বাবা আর তার কিছু বন্ধুরা একটা গেস্টহাউসের মালিক।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। জায়গাটা বেশ সুন্দর,” আহাদ বলল।

“না। আমার মুড অ্যাডভেঞ্চার করার,” বার্গারের একটা কামড় বসাতে বসাতে বলল তুষার,

“কোনো অপরিচিত জায়গায় গেলে দারুণ অভিজ্ঞতা হবে।”

মাহির বরাবরই ভীতু স্বভাবের। তাই সে কোনো কিছুতেই রাজি হতে চাচ্ছিল না, বিশেষ করে তুষারের কথায় বলল, “দোস্ত, ইয়ে মানে, অচেনা জায়গায় যাওয়াটা কিন্তু বিপজ্জনকও হতে পারে। তো আহাদের কথাই শোনা উচিত।”
অনেকক্ষণ তর্কবিতর্ক হলো। প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো সময় চলে গেল। শেষমেষ ঠিক হলো নারায়ণগঞ্জে আহাদের গেস্টহাউসটা। মাহিরের ভয়ের জন্য শেষ পর্যন্ত এই ‘নিরাপদ’ স্থানটাই বেছে নেওয়া হয়। অবশ্য, মাহির ছাড়া কেউই রাজি হচ্ছিল না গেস্টহাউসে যেতে। আহাদ তুষারের কানে কানে কী একটা বলে। কিছুক্ষণ ভেবে তুষার রাজি হয়ে যায়। জাহিদ জাহিদ তুষারের মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। তবু সে সায় দেয়। এরপর আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে যে যার মতো বাড়ি চলে যায়।

রাতের বেলা, হঠাৎ করে তুষারের ফোন থেকে ‘টুইং’ করে একটা শব্দ আসে। ইনবক্স চেক করে। জাহিদ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।

“হঠাৎ আহাদের কথায় রাজি হলি কেন? ও তোকে কানে কানেই বা কী বলল?”

“সে যা বলল তা তুই শুনলেও পাগল হয়ে যাবি। যাওয়ার জন্য।”

“কী বলেছে?”

“জায়গাটায় না কী ভূতুরে কা- ঘটে মাঝে মাঝে।”

“কী রকমের?”

“সেটা বলেনি। তবে অ্যাডভেঞ্চারের এ থেকে ভালো সুযোগ আর পাবি না।”

“হুমম। ব্যাপারটা আসলেই বেশ ইন্টারেস্টিং।”

“আচ্ছা পরে কথা হবে। এখন বই পড়ছি গল্পের।”

“আচ্ছা পড়। বাই?”

তুষারের হাতে গল্পের বই থাকলেও সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে তাদের যাওয়ার দিন আসবে।

তুষাররা রওনা হবে আগামীকাল। তুষারের মা ওর কাপড়-চোপড় বের করে গুছিয়ে দেন। সঙ্গে কিছু বিস্কুট আর একটা পানির বোতল। তুষার ফোন চার্জে দেয়। মা কিছু বাড়তি টাকাও দেন বাবার অজান্তে। এদিকে, আহাদের বাসায় আহাদ মাকে বলেছে, “মা, গাড়ি লাগবে না। আমরা সবাই বাসে যাব।”

“কিন্তু বাসে গেলে তোমার জন্য বেশি চিন্তা হবে।”

“মা, সমস্যা নাই। চিন্তা করো না। আমি ফোন দিব।”

“কিন্তু বাসারকে যে বললাম…”

“বাসার আঙ্কেলকে মানা করে দেও তো।”

সকালে অ্যালার্ম বেজেই চলছে। সবাই উঠলেও তুষার নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। নিশাতের প্রচন্ড-রাগ হলো। সবার ঘুম ভাঙিয়ে নিজে শান্তিমতো ঘুমাচ্ছে। সে ডাইনিং টেবিলে গিয় জগ থেকে গ্রামে পানি ঢালল। আস্তে করে গেল তুষারের ঘরে। তারপর সে দেখল তুষার তখনো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। গ্লাস নিয়ে সে রেডি। হঠাৎ ঝপাৎ করে আওয়াজ হলো।

“ওরে বাবারে, ডুবে গেলাম।”

চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠল তুষার। সে কিছুই বুঝতে পারছে না কী হলো। নিশাত নিজের রুমের দিকে দৌড়ে পালায়। নিজের বালিশের আশপাশে পানি দেখে অবশেষে সব বুঝল তুষার। কিছুটা রেগে গেলেও ঘড়ি দেখে বুঝল সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। উঠে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। তারপর টেবিলে যায়। মা নাশতা দেন।

“আস্তে খা তো।”

“না, মা, দেরি হয়ে গেছে অনেক।”

“তোর বন্ধুরা কত সময় ঠিক রেখে আসবে তা আমি জানি।”

“জাহিদ আসেনি এখনো?”

“ও এখনো ঘুমাচ্ছে। ফোন দিয়েছিলাম।”

তুষার খাবার শেষ করে তাড়াতাড়ি জাহিদকে ফোন দেয়। তিনবার ফোন দেওয়ার পর সে ধরে।

“কোথায় তুই?”

“হ্যাঁ, ঘুমাচ্ছি। এত সকালে জ্বালাচ্ছিস কেন?”

“তুই কি যাবি না নাকি?”

“কোথায়?” … ও হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম। দাঁড়া উঠি। তুই এক কাজ কর। রেডি হয়ে আমার বাসার নিচে চলে আয়।” বলেই লাইন কেটে দেয়। তুষার আর শার্ট আর প্যান্ট পরে। ফোন আর মানিব্যাগ পকেটে ঢুকালো। তারপর ব্যাগটা আবার দেখে কিছু বাদ পড়েছে কিনা। এরপর বের হয়।

“রিকশায় যাব?” মনে মনে ভাবল তুষার, “নাহ, থাক। ও তো ঘুম থেকেই ওঠেনি। হেঁটেই যাই।”

হাঁটতে থাকে তুষার। দুই গলি পরেই জাহিদেও বাসা। বাতাসটা বেশ পরিষ্কার। এখনো গাড়িটারি এতো বের হয়নি। গত রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তার পাশের গাছগুলো যেন নতুনভাবে জীবন পেয়েছে। কতই না প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে ওদের। পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা চিকচিক করছে। দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায় তুষারের। সে উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না। তার ব্যাগটা ভারি হলেও সে সেটা এতক্ষণেও টের পায়নি। সে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ডাক শুনে, “তুই তুষার! কোথায় যাচ্ছিস?

“ও! ভুলে।”

তুষার আবিষ্কার কওে সে জাহিদেও রাসা পার হয়ে আরো একটু এগিয়ে গেছে। জাহিদ তাকে পিছন থেকে ডাকছে। সে গেটে দাঁড়িয়ে আছে ওর জন্য।

“তুই একটা রিকশা নিবি না? কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি তোর আইডিয়া আছে?”

“আমি রেডি হয়ে ফোন দিয়ে শুনি তুই ঘুমাস। তোর নামতে দেরি হবে দেখেই তো ধীরে ধীরে হেঁটে আসলাম।”

রওনা হলো দুই বন্ধু একসঙ্গে। অনেক খুঁজে একটা সিএনজি ট্যাক্সি ঠিক করে। স্টেশনে গিয়ে দেখে আহাদ বসে আছে, মাহির আসেনি।

“মাহির মনে হয় আসবে না।,” জাহিদ বলল।

“দাঁড়া কল দিই একটা,” আহাদ বলল ফোন হাতে নিয়ে। সে কল দিতে যাবে এমন সময় দূও থেকে জাহিরকে দৌড়াতে দেখল তিন বন্ধু।

“সরি দোস্ত, একটু দেরি হয়ে গেল।”

চার বন্ধু বাসে ওঠে। তখন বাজে সকাল সাতটা। ওদের বের হওয়ার কথা ছয়টার সময়। কিন্তু সবসময় তারা যেভাবে সবকিছুতে দেরি করে আসছে আজকের মতো দিনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাস চলছে আপন গতিতে। হঠাৎ সব থেমে যায়। ঢাকা শহরের গাড়ি থেমে যাওয়ার এই দৃশ্যটা খুবই স্বাভাবিক। একা থাকলে বেশ বিরক্তিকর হলেও ওরা একসঙ্গে বলে ভালোই সময় যাচ্ছে। তুষার একটু পড়–য়া আর ফার্স্টবয় হওয়ায় এখানেও তাকে ক্ষেপানো হচ্ছে।

“তুষার কি ইন্টারমিডিয়েটের বই এনেছিস রাস্তায় পড়ার জন্য?”

“আরে রাস্তায় কী পড়বে ওর তো সব বাসাতেই শেষ।”

তুষার কিছু বলতে পারছে না। তার কারণ আসলেই তার ব্যাগের ভিতর একটা বই আছে। যদিও পাঠ্র বই না, গল্পের বই। মার্ক টোয়েনের লেখা। তুষারের খুবই প্রিয় একজন লেখক। বইটা সে বইমেলা থেকে কিনেছিল। পড়া হয়নি। তাই ভাবল যদি অবসর পেলে পড়তে পারবে। প্রায় চার ঘণ্টা লাগল সেখানে পৌঁছাতে। রাস্তায় একবার বাস থেমেছিল অনেকক্ষণ, চাকা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে। সেখানেই আধ ঘণ্টা শেষ। চারজন একসঙ্গে যাচ্ছে, তাই তুষার ভেবেছিল গল্প করতে করতে গেলে সময়টা ভালোই কেটে যাবে। কিন্তু কীসের কী? তুষার বাদে সবাই প্রায় পুরোটা সময় ঘুমিয়েছিল। তুষারের ভাগ্য ভালো ছিল যে সে বইটা নিয়ে এসেছিল। তাই তার সময় খুব একটা খারাপ খাটেনি। ওখানে পৌঁছাতে তুষারের বইটা আরো বিশ-পঁচিশ পৃষ্ঠার মতো বাকি ছিল। বাস আবার থামায় তুষার ভাবছিল কিছু নষ্ট হলো কি না। কিন্তু যখন দেখে সবাই লাগেজ নিয়ে নামছে তখন বন্ধুদের ডাক দেয়।

গেস্ট হাউসের মুখে দাঁড়িয়ে দুজন লোক। কাছে এসেই সবাই দেখে,, আসলে একজনই তার শরীরটার জন্য তাকে দুটো মনে হচ্ছে। কালো ফ্রেমের একটা চশমা, চুলগুলো সোজা।

“ইনি হচ্ছেন মি. রাইয়ান,” পরিচয় করিয়ে দিল আহাদ, “এই গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার।”

“তোমরা নিশ্চয়ই আহাদের বন্ধু। তোমাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো,” গম্ভীরভাবে বললেন মি. রাইয়ান।

“না, কোনো সমস্যা হয়নি। তবে আমরা বেশ ক্লান্ত,” আহাদ বলল মি. রাইয়ানকে। তারপর

আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই চল ভেতরে। রুম দেখিয়ে দিই। ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।”

গেস্টহাউসটা বাইরের দিকটা বেশ সুন্দর। আশপাশে দু-একটি বাড়িঘর ছাড়া তেমন কোনো বাড়িঘর নেই। তবে অনেকগুলো বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর কাজ চলছে। সামনে আছে সরষের ক্ষেত। গেস্টহাউসটা মোটামুটি বড়োই বলতে হয়। আমরা চারজন এক রুমে থাকব। আলাদা চারটি বিছানা, দুটি জানালা, একটি অ্যাটাচড বাথরুম, থাকার জন্য ভালোই। আর ছিমছাম পরিবেশটা মনকে সজীব করে তোলে। সবাই ফ্রেস হচ্ছে আস্তে আস্তে, তুষার তার মাকে ফোন করে।

“হ্যালো, মা। পৌঁছেছি মাত্রই।”

“রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

“না, কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু একটু জ্যাম ছিল, তবে হ্যাঁ…।”

“হ্যাঁ, মানে? কী হয়েছিল?”

“তেমন কিছু না, বাসের চাকা নষ্ট হয়েছিল একবার।”

“আচ্ছা, সাবধানে থাকিস। কী করছিস এখন?”

“এই তো খেতে যাব।”

“আচ্ছা যা। রাখি।”

সবাই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়। আহাদ বলল সে এখানে আরো কয়েকবার এসেছে। কারণ তার বাবার বন্ধুরা এখানে পিকনিক স্পট ঠিক করেছে। নিচে যাওয়ার আগে মাহির জিজ্ঞেস করল, “আহাদ, খাবার কি রাইয়ান আংকেল রান্না করবেন?”

“না। রান্না করছে আবরার ভাই। ও জানিস, আবরার ভাইয়ের কণ্ঠ কানিকটা মেয়েদেও মতো, কিন্তু এ নিয়ে ভুলে হাসবি না। সে অল্পতেই এত রেগে যায়, কী করে বুঝে না।”
খাবার টেবিলে আমরা যখন আছি তখন একটা মেয়েলি কণ্ঠে কে জানি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল, “খাবারটা কী রকম লাগল।”
ঘুরে দেখি একটা ফর্সা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে উৎসাহী চোখে। বুঝলাম এই আমাদের এখানকার বাবুর্চি।

“এক কথায় অসাধারণ, “জাহিদের সংক্ষিপ্ত উত্তর, যদিও তাকে ভাত আর আলুভর্তা খেতে দিলেও সে একই কথা বলত কিন্তু খাবারটা সত্যি দারুণ হয়েছে।

“খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা আজ একটু রেস্ট নেব,” জাহিদের প্রস্তাব, “তারপর কালকে থেকে ঘুরব, কী বলিস?”

“হ্যাঁ, আজ অনেক ক্লান্তি লাগছে,” মাহির সায় দিল।

“তোদের যেমন মন চায়,” আহাদ বলল।

এসব কিছুতে তুষার মনে মনে খুশি। কারণ সে বইটা শেষ করতে পারবে। খাওয়া শেষে যে যার রুমে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে।

“অনেক দেরি হয়ে গেছে, তুষার এখানো আসেনি কেন রে?” জানতে চাইল মাহির।
“হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমার কাছেও ভালো ঠেকছে না। এই জাহিদ একটু দেখ না গিয়ে

তুষার কোথায় আছে,” আহাদ বলল।

“যাব? আচ্ছা দাঁড়া যাচ্ছি। ছাতাটা দেয়”

তুষারকে খুঁজতে ছাতা নিয়েই বেরিয়ে পড়ে আহাদ। বিকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। চারজনই গভীর ঘুমে অচেতন ছিল। জাহিদের ফোনের শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। জাহিদ কথা বলতে বলতে রুমের বাইরে চলে যায়। ঘুম থেকে সবার উঠতে উঠতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আবরার ওদের চা-নাশতা দিয়ে আসে রুমেই। ওরা খাচ্ছে, আহাদ বলল,

“জায়গাটা খুবই ইন্টারেস্টিং।”

“কেন রে? মাহির জিজ্ঞেস করল।

“তুই না বললি ভূতুরে?” তুষার মন্তব্য করল।

“ভূতুওে বলেই তো ইন্টারেস্টিং।”

“ভূতুওে মানে,” মাহির আঁতকে ওঠে।

“ভূতুরে মানে এখানে অনেক ঘটনা লোকমুখে শোনা যায়।”

“যেমন,” জাহিদ জানতে চায়।

“যেমন ধর…”

কথাটা শেষ করতে পারেনি আহাদ। তার আগেই বাইরে একটা লোকের আর্তচিৎকার শুনতে পায় ওরা। বাইরে তাকায় তুষার। এমনিতেই অন্ধকার, তার উপর বৃষ্টি পড়ছে বলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

“আমি নিচে গিয়ে দেখি,” বলল তুষার।

তুষার নিচে যায়। আহাদ তাকে যাওয়ার সময় একটা ছাতা দেয়। অনেক সময় পার হলেও তুষার ফেরেনি বলে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। জাহিদ বেরিয়েছে তুষারকে খুঁজতে। জাহিদ আশপাশে ঘুরে অবশেষে তুষারের ছাতাটি পায়, কিন্তু আশপাশে তুষারকে দেখতে পায় না। ফোনের টর্চ জ্বালায়। পাশে সরিষার ক্ষেতে তুষার পড়ে আছে, জাহিদ তাড়াতাড়ি ফোন করে মাহিরকে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। কী করবে ভাবতে থাকে জাহিদ। হঠাৎ কল আসে জাহিদের ফোনে।

“জাহিদ, পেয়েছিস তুষারকে?”

“হ্যাঁ, আহাদ। কিন্তু সমস্যা আছে, জলদি মাহিরকে নিয়ে চলে আয়।”

জাহিদ কল কেটে দেয় তুষারকে রাস্তায় উঠানোর চেষ্টা করে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজরতে দৌড়ে আসে মাহির আর আহাদ। তারা সবাই মিলে কোনো মতে টেনে তুলর তুষারকে। পরে নিয়ে আসে গেস্ট হাউসে। রুমে ফিরে দেখে তুষারের মাথার সামনে ফেটে গেছে। রক্ত বের হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য এতক্ষণ যেটা কেউ টের পায়নি। আহাদ গিয়েছে মি. রাইয়ানের কাছে। পথে আরবারের সঙ্গে দেখা।

“রাইয়ান আংকেল কোথায়?”

“উনি তো বাইরে গেছেন এখনো ফিরেনি। কিছু লাগবে?”

“আশপাশে ডাক্তার আছে কোনো?”

“দাঁড়ান আমি ফোন দিচ্ছি।”

আহাদ উপরে চলে আসে। তুষারের জ্ঞান ফিরে। আধঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার চলে আসে। ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ করে দেয় তুষারের মাথায়। পরে কিছু ওষুধ দিয়ে দেন।

“এগুলো খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“ধন্যবাদ…”

“দাইয়ান। ডাক্তার দাইয়ান।

“ধন্যবাদ ডা. দাইয়ান।” বলল জাহিদ।

“কী হয়েছে? আমাকে খুঁজছিলে? হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা মি. রাইয়ান জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন আর দরকার নেই,” আহাদ বলল।

আহাদ ডা. দাইয়ানকে এগিয়ে দিতে যায়। মি. দাইয়ানও চলে যাচ্ছিল। তুষার দেখে মি. রাইয়ানের পুরো শরীর ভেজা।

রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ওরা গল্প করতে বসে। আহাদকে তার অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে বলে জাহিদ।

তুষারও তাগাদা দেয়।

“আচ্ছা তো যা বলছিলাম, এখানে মাঝে মাঝেই কিছু কর্মী গায়েব হয়ে যায়।”

“কর্মী মা?” তুষার জিজ্ঞেস করে।

“অনেকগুলো নতুন বিল্ডিং উঠছে দেখলি না? সেখানে কাজ করে যেসব কর্মী তাদের কথাই বলছি তোদের।”

“গায়েব হয়ে যায় বলতে?” সভয়ে জিজ্ঞেস করে মাহির।

“কেউ কেউ বলে তারা হঠাৎ করে আর কাজে আসে না। কয়দিন পর জানা যায় তারা বাড়িতেও পৌঁছায়নি। তাদের যে আসলে কী হয় কেউ জানে না।”

“কে? কে ওখানে?” হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে তুষার। দরজার পাশে একটা ছায়া দেখল সে মাত্র। আহাদ দৌড়ে যায়। দেখে মি. রাইয়ান দাঁড়িয়ে আছে।

“কিছু লাগবে নাকি তোমাদের?”

“না, না। আপনি হঠাৎ?

“এজন্যই আসছিলাম। আর কিছু নয়।” বলেই চলে যায়।

তুষার নিচে যায়। দেখে মি. রাইয়ান দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু তখন আর কিছু বলল না। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশ তখনো মেঘলা ছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো। চার বন্ধু একটু চমকে ওঠে। ভূতের গল্প বলে মাহির। ভীতু হলে কী হবে, বেশ সুন্দরভাবেই বলে গল্পটা। বিদ্যুৎ চমকালে সাধারণত আমরা তেমন ভয় পাই না, কিন্তু এবার সবাই ছোটখাটো একটা চিৎকারই দেয় বলতে গেলে।

“না, আজকে আর না। চল ঘুমিয়ে পড়ি।” জাহিদের এই প্রস্তাবে সবাই রাজি। যে যার মতো শুয়ে পড়ে।

সকালের আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। চারদিক রোদ ঝলমল করছে। চিকচিক করছে গেস্ট হাউসের সামনের রাস্তাটা। চারবন্ধু ঠিক করে আজকে একটু বাইরে বের হবে। দেখবে চারপাশে কী আছে। নাশতা খাওয়ার সবাই নিচে নামে। খাওয়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মি. রাইয়ান।
জাহিদ জিজ্ঞেস করে, “রাইয়ান আঙ্কেল, আপনার শার্টে ওটা কী?”

“ও কিছু নয় তো।” বলে নিজের শার্টের হাতা ঢেকে ফেলে। তুষার ষ্পষ্ট দেখে সেখানে রক্ত লেগে আছে।

“দেখে তো রক্ত মনে হচ্ছে…”। কথাটা শেষ পারে না জাহিদ।

“বললাম তো তোমরা খাও। সমস্যা নেই কোনো।” বলেই চলে যায়।

“ভারি অদ্ভুত লোক তো।” বলল মাহির।

“আরে বাদ দে। উনি এমনই।” রুটির টুকরো মুখে দিয়ে বলল আহাদ।

খাওয়ার পর রুমে গিয়ে রেডি হয় সবাই। তুষারের বেজে ওঠে।

“কী রে কী করছিস?”

“এই তো খাওয়া শেষ। এখন একটু বাইরে যাব।”

“ও! বেশি দূর যাইস না, আর সাবধানে থাকিস।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

নিজের মাথার আঘাতটার কথা আর কিছু বলেনি তুষার। ও যখন একটা লোককে দৌড়াতে দেথে তার পিছনে যাচ্ছিল। তখনই কেউ একটা আঘাত করে তাকে মাথায়।

“কী তুষার কী করছিস? তাড়াতাড়ি চল।”

“হ্যাঁ। আসছি।”

চার বন্ধু বের হলো। বাইরে কিছুদূর সুন্দর বাগান। তারপর কতগুলো নতুন বিল্ডিং এর ইটের কাঠামো। হঠাৎ জাহিদ একটা জায়গায় কিছুটা জটলা দেখতে পায়। চারজন যায় সেখানে কী হয়েছে দেখার জন্য। দেখে একজন লোক হাউমাউ করছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে এক লোক কালকে নিখোঁজ হয়েছে। ইনি তারই ভাই।

“ব্যাপারটা অনেকটা আহাদের গল্পের মতো না?” বলল জাহিদ।

“তার মানে কাহিনিটা সত্য,” সায় দিল তুষার।

“দোস্ত, আমার খুব ভয় করছে। চল ফিরে যাই।”

গেস্টহাউসে যেতেই মি. রাইয়ান জাহিদকে একটা গামছা দেয়।

“ধন্যবাদ রাইয়ান আঙ্কেল।”

কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যায় মি. রাইয়ান। ওনার কাজকর্ম কেমন যেন সন্দেহজনক। তুষারের একটু খটকা লাগে। কেননা, মি. রাইয়ানকে তো ওরা কিছুই বলেনি। তাহলে উনি কী করে জানলেন যে জাহিদের গামছা লাগবে।

সবাই রুমে চলে যায়। তুষার আর এ নিয়ে কিছু বলেনি। তারা ভালোভাবে জায়গাটা ঘুরে ‍দেখতেই পারেনি। আহাদ তাদের আশ^স্ত করে যে, বিকেলবেলা ওরা আবার বের হবে। দুপুরের খাবার ওরা বেশ মজা করেই খায়। ফ্রাইড রাইস, চিকেন সবই ছিল অনন্য। জাহিদ তো চার প্লেট খেয়েছে।

“আবরার ভাই যা রান্না করে রে, একদম সেরা।” জাহিদ বলল।

“তোকে দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।” আহাদ বলল।

“যেমনে খাচ্ছিস মনে হয় কত বছর কিছু পেটে পড়ে নাই,” হাসতে হাসতে বলল মাহির।

“পানিতে হাবুডুবু খেয়ে খিদে আরো বেশি লেগেছে। আবরার ভাই আরো এক প্লেট

দেন তো। এই তুষার পানির গ্লাসটা দে,” জাহিদ বলল।

এদিকে কী হচ্ছে তুষার কিছুই খেয়াল করেনি। দুদিনও হলো না আর কী না এত এত ঘটনা ঘটল তাদের সাথে। কেউ তুষারকে লক্ষ করেনি। সবাই খাবার নিয়ে ব্যস্ত।

“চল খাবারের ছবি পাঠাই প্রদীপকে।”

“গুড আইডিয়া,” বলেই ছবি তোলা শুরু করে জাহিদ। পাঠানো হয় প্রদীপের ইনবক্সে। কিছুক্ষণ পর প্রদীপের রিপ্লাই দেখে জাহিদের কালো মুখ আরো কালো হয়ে যায়।

“কী রে কী হলো?” আহাদ জিজ্ঞেস করল।

মাহির জাহিদের ফোন নিয়ে হাসে আর আহাদকে দেখায়। প্রদীপ রিপ্লাইয়ে তাদের ফোনবুকের ছবি দিয়ে জাহিদের ছবিতে ‘হা হা’ রিঅ্যাকশন দিয়েছে।

১০

বিকেলবেলা আবার বের হয় চার বন্ধু। তারা হাঁটতে হাঁটতে কাছেই একটা পোড়াবাড়ি দেখতে পায়।

“দেখ, দেখ একটা প্রাচীন বাড়ি,” জাহিদ বলল।

“চল, দেখে আসি জায়গাটা,” তুষার বলল।

তুষারের কথায় সবাই মিলে যাচ্ছে। যখন মূল ফটকের কাছে পৌঁছে তখন দেখা হয় ডা. দাইয়ানের সাথে।

“কী খবর? তোমার মাথার ব্যথাটা কি কমেছে?”

“জি, কমেছে।”

“তা কীসের সাথে লেগেছিল?”

“জানি না। মনে হয় ভারি কিছু দিয়ে মেরেছে?”

“তো ডাক্তার আঙ্কেল কোথায় যাচ্ছেন?” পাশ থেকে জাহিদ জিজ্ঞেস করল।

“বোঝোই তো ডাক্তার মানুষ। সব সময় রোগী নিয়ে থাকতে হয়।”

এই বলে চলে যায়। ফটকটা খুলতেই ক্যাচক্যাচ করে শব্দ হয়। ওরা ওই পোড়াবাড়ির আঙিনাতে প্রবেশ করে। সেখানে চারপাশে কতকগুলো আগাছা। সেইটা আগে কোনো সুন্দর বাগন ছিল দেখলেই বোঝা যায়। ওরা ধীরে ধীরে সদর দরজার দিকে এগোয়। ধাক্কা দেয়। কিন্তু খুলে না। জং ধরে গেছে। মনে হয়। আরো জোরে ধাক্কায় এবার জাহিদ।

“আরো ছাগল সিটকানিা খোল,” পাশ থেকে আহাদ বলল।

“ও! তাই তো।” নিজের বোকামি দেখে নিজেই হাসে। এবার খুলে যায় দরজা। দরজা খুলতেই রাজ্যের বাদুড় উড়ে বের হয়ে আসে। ওরা কিছুটা সরে যায়। মাহির একটু বেশি দূরেই সরে যায়।

“দেখে চল এক,” জাহিদ বলল পাশ থেকে।

“দেখতো এটা কী?”

কৌতূহলী তুষার নিজেই ফোনের লাইট অন করে দেখে সেটা কী। চারজনের কেউই ওটা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওরা যে যার মতো পালিয়ে যায় সেখান থেকে। দৌড় দেয় গেস্টহাউসে। ওদের শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে যায়। ঘরে ঢুকে ছেড়ে দেয় ফ্যান। মাহির তো জ্ঞানই হারিয়ে ফেলে। পানি দিয়ে মাহিরের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে ওরা। একটু ধাতস্থ হয় তুষার।

“আচ্ছা, আমরা দৌড়ালাম কে?” তুষার জিজ্ঞেস করে তার বন্ধুদের।

“কঙ্কালের মুখটা মনে হয় দেখিসনি ভালো মতো?” মাহির ওকে ভেংচিয়ে বলে।

“ভাই, এত পুরান একটা পোাবাড়িতে কঙ্কাল থাকা অস্বাভাবিক কিছু না,” তুষার জোর

গলায় বলল, “আমাদের ভেতরটা দেখা উচিত ছিল। কে জানে কোনো গুপ্তধন পাওয়া যায় কি না?”

“তুই কি পাগল হলে গেলি নাকি? গুপ্তধন গল্পের বইয়ে হয়, বাস্তবজীবনে একটা হাস্যকার ব্যাপার ছাড়া কিছুই না, বুঝলি? মাহির বলল।

“ভাই সায়েন্সের ছাত্র হয়ে আমি অন্তত ভূতে বিশ্বাস করি না,” তুষারের এ-কথায় মাহির দমে যায়। কেননা, রেজাল্ট খুব বেশি খারাপ না হলেও জিপিএ ৫ না পাওয়ার স্কুল বাধ্য করে তাকে কমার্স নিতে। একটু খারাপ লাগে তার তুষারের এই কথায়।

“আমার মনে হয় তুষার ঠিক বলেছে,” মাহির সায় দিল, “কে জানে হয়তো আসলেই কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যাই।”

“আমি অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছি, “জাহিদের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

“চল রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবার যাই সেখানে।” তুষারের এই প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়। সবাই রাতের খাবার বেশ মজা করে খায়। শুধু মাহিরের গলায় যেন খাবার আটকে যেতে লাগল। খাবার শেষে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে যখন বের হতে।

“কী রে মাহির কী ভাবছিস?” তুষার জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, না কিছু না।”

“কী হ্যাঁ না করছিস। গেলে চল। আমরা থাকতে তোর কিছু হবে না।” মাহির কোনো উত্তর দিতে পারেনি। চুপচাপ বসে থাকে। রাত বারোটার সময় ওরা বের হয়। তিনজন মাত্র নিচে নেমেছে, মাহির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে যাবে, তার বন্ধুদের সে একা ফেলবে না। নিচে নেমে এসেই সে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

“মাহিরের গলা না?” আহাদ বলল।

“হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চল, গিয়ে দেখি কী হয়েছে।” তুষার বাকি দুজনকে তাড়া দেয়। ওরা সব এসে দেখে মাহির নিচে মেঝেতে পড়ে আছে। মি. রাইয়ানও ছুটে এলেন। তার হাতে একটা সাদা বিছানার চাদর। সেটাই বাইরে শুকাতে দিয়েছিলেন, এখন নিয়ে এসেছেন মাহিরের মুখে পানি ছিটানো হচ্ছে।

“এই তো চোখ খুলছে,” মি. রাইয়ান বলল।

“জলদি, ওকে ওপরের নিয়ে চল,” তুষার বলল জাহিদ ও আহাদকে। মি. রাইয়ান উপর পর্যন্ত গেলেও

ওদের ঘরে আর যান না।

“মাহির, মাহির, কী হয়েছিল? জানতে চায় জাহিদ।

“আরো বলিস না। বিরাটকার সাদা ভূত”

“সাদা ভূত! অবাক হয় তুষার।

“হাসবি না। সত্যি বলছি। পুরো ধবধবে সাদা,” মাহির বলতে থাকে।

“আহাদ, জাহিদ তোরা জানিস রাইয়ান আঙ্কেলের হাতে একটা সাদা চাদর ছিল।” তুষার বলল।

“তার মানে কী হতে পারে তুষার?” আহাদ জিজ্ঞেস করল।

“আমি জানি না। বাট সামথিং ইজ ডেফিনেটলি নট রাইট।”

১১

তুষারের সিদ্ধান্ত নেয় এবার ওরা চারজনই যাবে সেই পোড়াবাড়িতে। রাত তখন দুটো। চারদিকে ছমছমে ভাব। সবকিছুই নির্জন নিস্তব্ধ। পোড়োবাড়ির আঙিনায় পা রেখে ওরা। এমন সময় কী একটা ডেকে ওঠে আশপাশ কোথাও থেকে।

“ওটা কী ছিল?” মাহির সভয়ে জিজ্ঞেস করে।

“একটা প্যাঁচা।” জাহিদের জবাব।

সবাই দেকে তাদের সামনের বড় গাছে দুটো প্যাঁচা বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওরা ধীরে ধীরে যেতে থাকে। দরজা খোলার আগেই তুষার ওদের বাদুড়ের ব্যাপারে সাবধান করে দেয়, এবং বলে দেয় কেউ যেন চিৎকার চ্যাঁচামেচি না করে। দরজা আস্তে আস্তে খুলে ফেলল।

“আজব ব্যাপার তো।”

“কী হয়েছে তুষার?” জাহিদ বলল।

“দরজাটা না আমরা খোলা দেখে গেলাম, এখন লাগাল কে?”

“তাই তো। লাগালো কে? জাহিদও ভাবে।

“আচ্ছা, এইগুলো পরে ভাবিস। এখন চল।” তাগাদা দেয় আহাদ। ভেতরে ঢুকে ফোনের টর্চ অন করে চারজনে। বাড়িতে একটা উৎকট গন্ধ। যেন মারা মানুষের গন্ধ। কথাটা চিন্তা করেও এক প্রকার জোর করেই চিন্তাট মন থেকে তাড়িয়ে দেয়।

“জায়গাটা বেশ ময়লা, না?” আহাদ বলল।

“ঠিকই বলেছিস,” জাহিদ সায় দিল।

“এই তোরা এখানে দেখ,” মাহিরের কথায় সবাই ঘরের ওই দিকটাতে চায়।

“রক্ত” তুষার অস্পষ্ট সুরে বলল।

“এখানে তো এটা স্বাভাবিকই,” জাহিদ বলল।

“না, রক্তটা বেশ তাজা। যেন কিছুক্ষণ আগের,” তুষার বলল।

তুষারের এ-কথাটা সবাইকে ভাবনায় ফেলে। আহাদ বলে পরে ব্যাপারটা দেখার কথা। সময় নষ্ট না করে চলবে না।

“জাহিদ,” তুষার ডাকে, “জায়গাটার কয়েকটা ছবি তুলে নে তো।”

“কিন্তু লাইট তো নাই।”

“আমরা লাইট ধরছি। ত্ধুসঢ়;ই ছবি তোল।”

জাহিদ ছবি তোলে। এমন সময় খটাশ করে দরজা লেগে যায়। সবাই থমকে যায়। সাহস ফিরে পেয়েই চিৎকার করে।

“কে? কে এখানে?”

ওরা তাড়াতাড়ি দরজার কাছে যায়। হঠাৎ করেই প্রচ- গরম লাগে গায়ে। দেখে, কে যেন বাড়িটার চারদিকে আগুন লাগিয়েছে। ভাগ্যিস পোড়োবাড়ি। সহজেই একটা ভাঙা দেয়াল পেয়ে যায় ওরা। বেরিয়ে এলো কোনো রকমে। তারা তাকিয়ে দেখে একটা ছায়া রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। তারাও পিছু নেয়। কিন্তু ধরতে পারেনি। চার বন্ধু গেস্টহাউসে ফিরে আসে। কেউ তাদের মারতে চায়। কিন্তু কেন? ভাবতে থাকে ওরা।

“চল কালকে এটা নিয়ে ভাবা যাবে। এখন ঘুমা সব।” আহাদের কথায় তুষার একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে চার বন্ধু।

১২

এগারোটার দিকে ফোনের কড়া রিংটোন ঘুম ভাঙলে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামে তুষার।

“হ্যালো, কে?”

“কী রে, নিজের মাকে চিনতে পারিস না?”

“ও মা! বলো।”

“এখনো ঘুমাচ্ছিস কেন?”

“বেশি সকাল তো হয়নি।”

“বেশি হয়নি? একটু পরেই দুপুর হবে। এগারোটা বাজে। তাড়াতাড়ি ওঠ।”

কেটে যায় ফোন। তুষার চোখ কচলায়। সে দেখে জাহিদ ও মাহির ঘুমে অচেতন হলেও আহাদ নেই কোথাও। আহাদকে খুঁজতেই যাচ্ছিল তুষার। এমন সময় সে দৌড়ে রুমে এসে চিৎকার শুরু করে,

“তাড়াতাড়ি ওঠ। বড় একটা সারপ্রাইজ আছে।”

“কী সারপ্রাইজ?” জাহিদ ঘুমন্ত চোখে বলে।

“আরে আয় তো,” কথাটা বলেই নিচে চলে যায়।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই এত বেশি আনন্দিত হয় যে বলার মতো না।

“প্রদীপ তুই?” তুষার চিৎকার করে ওঠে।

বন্ধুকে দেখে সকলে বেশ আনন্দিত হয়। নাশতা খাওয়ার পর সবাই প্রদীপকে ঘিরে বসে গল্প শোনার জন্য।

“তুই আাদের না বলেই কক্সবাজার কেন এলি?” জাহিদ বলল।

“আরে, মা-বাবা প্ল্যান করেছিল। আমি নিজেই জানতাম না। পরীক্ষা দিয়ে বাসায়

যাইতেই হঠাৎ বলে ব্যাগ গোছা। কাল কক্সবাজার যাব।”

“গেলি ভালো কথা কিন্তু একবারও তো বললি না।” অভিমানী সুরে বলল তুষার, “ঐদিন বাদ

দে, একদিনও বলিসনি। ফোন না দিলে তো জানতেই পারতাম না।”

“ তোরাও তো কিছু বলিসনি। জাহিদ ঐ ছবিটা না পাঠালে তো আমিও জানতাম না।”

“আচ্ছা এসব বাদ দে। ওখানে কী কী করলি?” মাহির জানতে চায়।

“ শোন, বাসে গেলাম। তো টিকেট সেই দিনের রাতেরই ছিল। পুরো রাস্তাই ঘুমায়ে কাটালাম। হোটেলে উঠে যে সুন্দর একটা পরিবেশ পেলাম। চারপাশ এত পরিচ্ছন্ন। নিলাম দুটি রিকশা। লাগেজ ছিল অনেক। তারপর হোটেলেটা যে কী সুন্দর ছিল!” মোবাইল ফোনে কিছু দেখায় প্রদীপ। ছবিগুলো সে তুলেছে অসাধারণ।

“এইবার আমি সার্ফিং শিখছি। প্রথম প্রথম যে ভয় লাগত। একবার যখন পারলাম তখন

করতেই থাকলাম। আর থামাথামি নেই।”

“আর কী কী করেছিস?” আহাদ জিজ্ঞেস করল।

“আমার বাবার কিছু পরিচিত মানুষ আছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে ভলিবলও খেলেছি। দারুণ এক খেলা, অনেক মজার।

“কী কী খেয়েছিস?” জাহিদের কাছে প্রত্যাশিত এক প্রশ্ন করল এতক্ষণে।

“এতো জিনিস মুখে বলা সম্ভব না। ছবি দেখ।” প্রদীপ ছবি দেখায়।

“তা তোরা চারজন এখানে কী কী করলি?” প্রদীপ জানতে চাইল।

“আমরা তো চরম অ্যাডভেঞ্চার করেছি,” মাহির বলল।

“তাই নাকি। কী রকম?” প্রদীপ জানতে চাইল।

একে একে সব কথা খুলে বলল সবাই। প্রদীপ হাঁ করে সব কথা শুনছিল। ওদের কথা শেষ হলে বলল,

“আহ্ধসঢ়;! কী মিসটাই না করলাম।”

“সমস্যা নাই।” আহাদ বলল,“ও তোরা জানিস কাল যে আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল ব্যাটা ভালো মতো রাগতে পারেনি বৃষ্টির জন্য।”

“তার মানে ভেতরে যা আছে এখন সব পাওয়া যাবে।

“হ্যাঁ, অবশ্যই,” আহাদের মন্তব্য।

“দাঁড়া, আগেই না।” তুষার বলে একটু থামে।

“কিছু হয়েছে?” মাহির জানতে চায়।

“এবার একটু বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে। আগে ব্যাপারটা দেখ একবার। কেউ আগুন কেন লাগালো? তারা কিছু একটা লুকিয়েছিল। সেটি যাতে আমরা না দেখি। তার সব চিহ্ন তাই নিশ্চিহ্ন করতে চায়, মুছে ফেলতে চায়।”

“ঠিক।” প্রদীপ সায় দেয়।

“জাহিদ, তোর ফোনটা দে। দেখি ছবিগুলো।”

জাহিদ তার ফোন দেয়। পাঁচ বন্ধু বসে ছবিগুলো দেখতে থাকে। অন্ধকার হলেও মোটামুটি সব বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে কী আছে না আছে। সবকিছু ময়লা, জঞ্জাল। পুরনো আসবাবপত্র সব ক্ষয়ে গেছে। হঠাৎ তুষারের চোখ একটা ছবিতে আটকে যায়। অস্পষ্টভাবে সে বলল,

“সিঁড়ি।”

“কী বলিস?” জাহিদ বলল।

“সিঁড়ি।”

“সিঁড়ি মানে?”

“সিঁড়িটা দেখ একবার। কত পরিষ্কার মনে হচ্ছে না।?”

“হ্যাঁ তো।”

“ যে বাড়িতে কেউ থাকে না, সে বাড়ির সবকিছু ময়লা। সেখানে সিঁড়িগুলেয় ধুলো নেই কেন? নিশ্চয়ই উপরে কিছু আছে।”

“আমি কিছু মিস করিনি তাহলে,” প্রদীপ বলল হাসতে হাসতে।

“আজকে থাক, কালকে গভীর রতে যাব আমরা সবাই।” তুষার বলল দলনেতার মতো।

“ওকে। চল আজকে পাশের ওই দিকে ফুচকা খাই। ওখানার ফুচকা বেস্ট।” আহাদ মন্তব্য করল।

বিকেলবেলা পাঁচবন্ধু ফুচকা খেতে যাওয়ার সময় পথে একটা সুন্দর বাড়ি দেখতে পায়।

“এটা কার বাড়ি রে?” তুষার জিজ্ঞেস করে।

“ডা. রাইয়ানের বাড়ি।” আহাদ বলল।

“ও। তা তোর ফুচকাওয়ালা কোথায়?” জাহিদ অনেক উৎসাহী। ফুচকা খেতে খেতে অনেকগুলো গল্প হয় তাদের মধ্যে। ওরা জানে না সামনে ওদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।

১৩

পাঁচ বন্ধু একসাথে এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিযানে। পাঁচজন একসাথে কত সমস্যাই না সমাধান করতে পেরেছে। রাতে খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবার অভিযানে নামে সবাই। এবার একটার সময় রওনা হয় ওরা। খুব সাবধানে ফেলতে থাকে প্রতিটি পদক্ষেপ। পোড়োবাড়ি দরজাটা অর্ধেক ভেঙে গেছে। ভেরতটায় ছাই পড়ে আছে কোথাও। ওরা প্রথমেই চলে যায় সিঁড়ির ওদিকটায়। ধীরে ধীরে উঠতে থাকে ওপরে। সিঁড়ির ধাপ শেষ হতেই দোতলার আশপাশে দেখে। কালকের আগুনে ছাদ ভেঙে পড়েছে কিছু অংশের। আশপাশটা ভালো মতো দেখে। কতকগুলো ঘরের দরজা।

“ওই দরজা দেখ একবার,” প্রদীপ বলল।

“কী আছে ওখানে?” তুষার জানতে চাইল।

“কিছু একটা চকচক করছে,” প্রদী কাছে যায়, “একটা তালা।”

“তালা তো থাকতেই পারে,” জাহিদ বলল।

“আরে দেখ আগে, তালাটা পুরো নতুন,” প্রদীপ বলল। প্রদীপের কথায় সবার দরজা চলে যায় দরজার দিকে।

“হ্যাঁ, ঠিকই তো। এত পুরনো বাড়িতে চকচকে নতুন তালা,” আহাদ বলল।

“আহাদ, তালাটা ভাঙতে পারচি?” তুষার বলল।

“চেষ্টা করে দেখি,” আহাদ উত্তর দিল।

পাথর দিয়ে কিছুক্ষণ বাড়ি দিয়ে তালা ভেঙে ফেলে আহাদ। রাত দুইটার সময় যতবার আহাদ বাড়ি মারছিল শব্দগুলো অনেক হচ্ছিল। ওরা ভয় পায় যদি কেউ এসে যায়। তালা ভেঙে ওরা ভেতরে যায়। আশপাশে কিছুক্ষণ খোঁজে। কিন্তু সবকিছু পরিষ্কার, তেমন ধুলো নেই। মনে হয় কেউ থাকে এখানে।

“চল যাই। শুধু শুধু এত কষ্ট,” জাহিদের মুখে হতাশা।

ওরা বের হচ্ছিল, তখনই “এক মিনিট,” বলে তুষার ভেতরে যায়।

“কী হয়েছে তুষার?” মাহির বলল।

“এই ফ্রিজটা এখানে কেন?” তুষার ফ্রিজের কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে। তারপর পাঁচজন যা দেখে তার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক মাংস রাখা ফ্রিজে। প্রথমে গরু বা এই জাতীয় ভাবলেও পাশেই দেখে একটা মানুষের কাটা মাথা। তুষার তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দেয় ফ্রিজের দরজা। ওরা ফিরে আসে গেস্টহাউসে। সবাই ঘামতে থাকে ভয়ে। তুষার জানালা খুলতে যায়। দেখে মি. রাইয়ান বের হচ্ছে। কিছু বোঝা আর বাকি রইল না। সব জায়গায় এই লোকটা কেন?

“ওই লোকগুলো গায়েব হওয়ার কারণ বুঝলাম,” জাহিদ বলল।

“আমি মনে হয় এটাও বুঝেছি কাজটা কার?” তুষার বলল, “ওই দেখ মি. রাইয়ান বাইরে ঘুরছে”।

“আগেই কিছু করা যাবে না। প্ল্যান কওে ধরতে হবে ওকে।” প্রদীপ বলল।

“আর তাড়াতাড়ি করতে হবে,” মাহির বলল, “কে জানে আমাদেও সাথে কী করবে?”

সবাই এক ভিন্ন উত্তেজনা অনুভব করে।

১৪

সকাল থেকেই সবাই লক্ষ করছে মি. রাইয়ানের কাজকর্ম। স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তুষার আগের ঘটনাগুলোর কথাও তার বন্ধুদের জানায়। ওরা মোটামুটি নিশ্চিত মি. রাইয়াওে মাথা ঠিক নেই। উনিই ওই মানুষগুলোর হারিয়ে যাওয়ার কারণ। তারা দেখে মি. রাইয়ান বাইওে দায়ে শান দিচ্ছে। ওদেও হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মি. রাইয়ান বললেন, “আজকে তোমাদের স্পেশাল মেন্যুর জন্য কাজ করছি। কিছু লাগলে পরে এসো।”

“যা করার আজই করতে হবে।” মনে মনে বলল তুষার।

দুপুরের আগে তুষার জাহিদ আর মাহিরকে পাঠায় ডা. দাইয়ানের বাড়ি। ওরা সেখানে ডা. দাইয়ানকে সব বলবে। তারপর সাহায্যেও জন্য নিয়ে আসবে। কেননা, ওরা পাঁচজন কিছু করতে পারবে না। আর এখানে ডা. দাইয়ান ছাড়া কাউকে ওরা চেনেও না। তুষার জাহিদের ফোনটা কাছেই রেখেছিল। ছবি দেখে প্রমাণ বের করবে। কিছুক্ষণ ছবি ঘাঁটার পর একটা ছবিতে তুষারের চোখ আটকে যায়।

“ওহ নো।” মাথায় হাত দেয় তুষার।

“কী হয়েছে?” আহাদ এগিয়ে আসে। এসে দেখে জাহিদ যখন সেলফি তুলছিল পেছনের গাছটার পাশে মি. দাইয়ান দাঁড়ানো। তিনিই ওকে ধাক্কা মারেন।

“আর আমার ওদেরকে ডা. দাইয়ানের ওখানেই পাঠালাম? প্রদীপ অবাক। তুষার মাহিরকে ফোন দেয়। ফোন ধরছে না সে। তার মানে ডা. গাইয়ানের কবলে ওরা। তুষার আর আহাদ দৌড় দেয় সেখানে। প্রদীপ মি. রাইয়ানের সাথে পুলিশকে ডাকার জন্য গিয়েছে। ওরা বাসার কাছাকাছি যেতে যেতে একটা প্ল্যান করে। গিয়ে প্রথমেই জানালা দিয়ে উঁকি মারে। দেখে ডা. দাইয়ান জাহিদকে বাঁধছে। মাহিরকে অলরেডি বাঁধা শেষ। আহাদকে পাঠায় ওপাশ দিয়ে। তুষার নিজে জানালা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। তুষার ঢুকে টেবিলের

নিচে লুকায়। টেবিলে বড় একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। তার আড়ালেই চলে যায়। ডা. দাইয়ান জাহিদকে বেঁধে ফেলেছে। জানালার কাছে এসে পর্দা লাগাচ্ছে যাতে কেউ না দেখে। আহাদ ঢুকতে পেরেছে কি না জানে না তুষার। দেখে দাইয়ান কাঁচি আর চাকু দেখছে। কী করবে ভাবছে এমন সময় তুষারের ফোন বেজে ওঠে। দাইয়ান তাকায় টেবিলের নিচে। তুষার ফোনটা অফ করে টেবিলের নিচ থেকে বের হয় পাশের রুমে চলে যায়। পাশে কাঠের একটা বড় তক্তা দেখে হাতে নেয়। ডা. দাইয়ানের কাছে এলে ছুড়ে ফেলে তার দিকে। কিন্তু গায়ে লাগেনি। দাইয়ানের হাতে তখন চাকু। বসিয়ে দেয় তুষারের পেটে। তুষার ব্যথায় কোঁকাতে থাকে। তখনই পিছন থেকে আহাদ আসে। ডা. দাইয়ান তার জন্য কিছুটা প্রস্তুত ছিলেন।

দাইয়ান হাতের চাকুটা ঘোরায় বাতাসে। রক্ত টপটপ করে পড়ছে। পাশে তুষার অচেতন। আহাদকে মারতে আসেন ডা. দাইয়ান। কিন্তু আহাদ উল্টিয়ে ফেলে দেয় তাকে। তায়াকোয়ানতোতে আউড্যান ব্ল্যাক বেল্ট সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুপোকাত কওে ফেলে তাকে। প্রদীপ ততক্ষণে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আসে। তুষারকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় কাছের হাসপাতালে। সেখান থেকে বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আনা হয়। দুদিন পর তুষারের জ্ঞান ফিরে। চোখ মেললে নার্স ডাক্তারকে খবর দেন। তুষারের মা ছুটে আসে হাসপাতালে। বন্ধুরাও আসে।

“আমি কোথায়?” জিজ্ঞেস করল তুষার।

“তুই ঢাকায়। আজ দুদিন পর তোর জ্ঞান ফিরেছে,” প্রদীপ বলল।

“আজকে তোকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে ডাক্তার বলেছেন। তুই বাড়ি যেতে পারবি। যেখানে তোর বোন ও দাদা অপেক্ষা করছে। ৯ মার্চেও ওই ঘটনার পর ১১ মার্চ জ্ঞান ফিরে তুষারের দুদিন এই অবস্থায় থাকে দেখে সবাই খুব চিন্তিত ছিল। এখন সবাই চিন্তামুক্ত। বাসায় যাওয়ার আগে তুষার একবার রাস্তায়

নামে। বাসায় গেলে নিশাত আর দাদাভাই ছুটে আসে। তুষার সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিশাতকে একটা বক্স দে, সুন্দর প্যাকেট মোড়ানো।

“হ্যাপি বার্থে নিশাত।”

খুশিতে চোখে পানি চলে আসে নিশাতের। সবাইকে খুশি দেখে তুষারও খুশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *