উপন্যাস।।অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।২য় পর্ব

উড়ছেন ইচ্ছেমত। উড়ছেন আর উড়ছেন। দিকবিদিক ছুটছেন। ছোটার আনন্দে আত্মহারা টুনটুনি পাখি অধ্যাপক আলী আসগর।

ছুটতে ছুটতে অধ্যাপক টুনটুনি পাখি একটা নাম না জানা নদীর তীরে বাদাম গাছের প্রসারিত ডালে বসেন। পুচ্ছ নাচায়। কেমন একটু ক্লান্তি অনুভব করেন তিনি। ডানায় রিনরিনে ব্যথা মনে হচ্ছে। জীবনে প্রথম পাখি হয়ে আকাশে উড়লে ক্লান্তি তো লাগবেই। বাদামগাছের ডালে অধ্যাপক টুনটুনি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম থেকে তার ঘুম ভাঙল। বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যার দিবে। চমকে উঠলেন অধ্যাপক টুনটুনি। পথঘাট চিনে বাসায় ফিরে যেতে পারবেন তো? একি করছেন তিনি? মানুষ থেকে টুনটুনি পাখিতে রূপান্তরিত হওয়ার আনন্দে-আবেগে আকাশের শূন্য পথ পাড়ি দিয়ে না জানি কোথায় কতদূর এসে পড়েছেন। পেটের মধ্যে ক্ষুধার প্রবল তাড়না অনুভব করলেন অধ্যাপক টুনটুনি। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুক ভরা বিপুল তৃষ্ণা। ভয়ে আর ভাবনসায় আবার শূন্যে ডানা মেলে দিলেন। চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসলেন একটা অজানা নদীর চরে। চঞ্চু ডুবিয়ে পানি পান করলেন। খুব ভালো লাগে। আবার উঠে এসে বসলেন সিরিজ গাছের উঁচু ডালে। পথটা চেনার চেষ্টা করলেন। ডানা মেলে দিলেন শূন্যতায়। উড়ে চললেন অধ্যাপক টুনটুনি ঢাকার দিকে, তাঁর বাসায়। সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে ধূসর পৃথিবীতে। প্রকৃতিতে মৃদু বাতাস। আকাশের ঈশান কোণে কালো মেঘ। রাখালেরা ঘরে ফিরছে। সামনে গরুর পাল। ধুলো উড়ছে। কিন্তু কোনো রাখালের হাতে বাঁশের বাঁশি দেখতে পেলেন না। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। এদেশ থেকে কি বাঁশি হারিয়ে যাচ্ছে? অথচ ছোটবেলায় কত বাঁশি বাজিয়েছিলেন! বুকের মধ্যে বিষণ্ন সুর মোচড় দিয়ে ওঠে। এখন তিনি উড়ছেন বিশাল এক সবুজ মাঠের উপর দিয়ে। কৃষকেরা ফলিয়েছে আদিগন্ত মাঠজুড়ে মানবিক সবুজ, বিচিত্রবর্ণ ও রঙের রবিশস্য।

উড়তে উড়তে সন্ধ্যা অতিক্রম করে রাতে দিকে তিনি ঢাকা শহরের উপকন্ঠে পৌছুলেন। হাঁপাচ্ছেন। ডানা ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। বসলেন একটা বাড়ির কার্নিশে। কার্নিশ থেকে উঠলেন ছাদে। দেখলেন আলো ঝলমল বিশাল বস্তির ঢাকা শহর। হঠাৎ তাঁর মনে হল সকাল থেকে তিনি বাসায় নেই, ফেরেন নি-কেউ কি তাঁকে ভাবছে? মাকসুদা কি একবারও মনে করেছে? কোথায় গেল মানুষটা? তাঁর জন্যে নিশ্চয় উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটোছুটি করছে স্ত্রী মাকসুদা, মেয়ে মৌলি, ছেলে আলী আহসান। না, কাজটা তিনি ঠিক করেন নি। মাকসুদা হয়ত অন্যায় করেছে, ভুল করেছে, কিন্তু তাঁর এভাবে সারাটা দিন বাইরে কাটিয়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। এখনই তাঁর বাসায় ফিরে যাওয়া উচিত। চারপাশটা তাকিয়ে তিনি বুঝলেন, এটা রামপুরা এলাকা। আসমানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল টিভি টাওয়ার। বাসায় ফেরার জন্য ডানা মেলতে যাবেন- হঠাৎ শুনতে পেলেন খিলখিল হাসির শব্দ। চমকে তাকান অধ্যাপক টুনটুনি।

বাড়ির ছাদে বিরাট পানির ট্যাংকির সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসা একজন যুবক। যুবকের কোলে একজন যুবতির এলোকেশে এলায়িত রূপ কম্পমান কামনা সঙ্গে থরথর কম্পমান ঠোঁট এক জোড়া। যুবক মাথা নুইয়ে মেয়েটির মসৃণ নরম উষ্ণ ঠোঁটে চুমু খেতে চায়। আর তখন মেয়েটি দেখতে পায় অধ্যাপক টুনটুনিকে।

দেখছো-তোমার সব ইতরামো ঐ টুনটুনি পাখিটি দেখছে- মেয়েটির অন্নপূনা মুখে হাসির ঢিল।

হাসে যুবক-দেখুক। ঐ টুনটুনি পাখিটিও ওর বৌকে, প্রেমিকাকে এমনি আদর করে-ছেলেটি তার মুখটাকে নামিয়ে আনে মেয়েটির মুখের কাছে।

দুটো প্রাণ মিলেমিশে একাকার। মানবজনম ওদের স্বার্থক-অধ্যাপক টুনটুনি লজ্জা পান। ফিক করে হেসে আকাশে ডানা মেলে দেন। পেছনে পড়ে থাকে মেয়েটি আর ছেলেটির নির্মল নিস্তব্ধ অমৃত সমান ভালবাসা। অমৃত মন্থন আর উপভোগের তুমুল তৃষ্ণা।

সারাদিনের দুঃখ ভুলে তিনি ছুটে চলেছেন প্রিয় সংসারে। সন্তান-স্ত্রীর কাছে। প্রত্যেক মানুষ তিল তিল কষ্টে গড়ে ঐ টুনটুনি পাখিটি দেখছে- মেয়েটির অন্নপূনা মুখে হাসির ঢিল।

হাসে যুবক-দেখুক। ঐ টুনটুনি পাখিটিও ওর বৌকে, প্রেমিকাকে এমনি আদর করে-ছেলেটি তার মুখটাকে নামিয়ে আনে মেয়েটির মুখের কাছে।

দুটো প্রাণ মিলেমিশে একাকার। মানবজনম ওদের স্বার্থক-অধ্যাপক টুনটুনি লজ্জা পান। ফিক করে হেসে আকাশে ডানা মেলে দেন। পেছনে পড়ে থাকে মেয়েটি আর ছেলেটির নির্মল নিস্তব্ধ অমৃত সমান ভালবাসা। অমৃত মন্থন আর উপভোগের তুমুল তৃষ্ণা।

সারাদিনের দুঃখ ভুলে তিনি ছুটে চলেছেন প্রিয় সংসারে। সন্তান-স্ত্রীর কাছে। প্রত্যেক মানুষ তিল তিল কষ্টে গড়ে তোলে এক একটা সংসার নামক সম্পর্কের অদ্ভুত কারখানা। মাকসুদা সময়ে সময়ে যতই খারাপ ব্যবহার করুক-তাকে তো ভালোও বাসেন প্রচণ্ড। সারা জীবনে মাকসুদাকে তিনি কি দিতে পেরেছেন? সেই যে বিয়ের সময় প্রায় বিশ-বাইশ বছর আগে ক’খানা গয়না দিয়েছিলেন-আর কি কিছু দিতে পেরেছেন? তাঁর অক্ষমতাকে উপলব্দি করে মাকসুদা কখনও কখনও যে তাকে বিরক্ত করেনি এমন নয়। তারপরও স্ত্রী তো? সুখে-দুঃখে অনেক বছর কেটেছে, মেয়ে মৌলি মায়ের চেয়েও পয়মন্ত। সংসারে কোনো চাহিদা নেই। যখন যা পায় তাই নেয়। কোনো বাড়তি পাওয়া-পাওয়া নেই। মেধাবী ছাত্রী। দেখতে সুন্দরীও বটে। বি,এ,পড়ছে। ছেলেটার আলী আহসানকে নিয়ে একটু দুঃশ্চিন্তা হয়।

সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এখনই বন্ধু-বান্ধবের বিরাট বহর। না, সংসার জীবনে তিনি খুব দুঃখে আছেন-এমন মনে হচ্ছে না। কথা ছেলেটা একদম শোনে না। এখনই নিজেকে স্বাধীন নৃপতি ঘোষণা করেছে। বড় আশা ছেলেটাকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু ভাবনার মধ্যে টুনটুনি অধ্যাপক উড়তে উড়তে রামপুরা পার হয়ে বাসাবো অতিক্রম করে কেবল যাত্রাবাড়ি বিপজ্জনক মোহনায় পৌঁছেছেন। যাত্রাবাড়ির এই অসংখ্যা রাস্তার মিলিত মোহনা বড় অদ্ভুত। বাস ট্রাক রিকশা টেক্সি অটোরিক্সা এবং মানুষ মিলে এক অস্থির ভয়ংকর জায়গা। উড়তে উড়তে অধ্যাপব টুনটুনি দেখতে পান ধাবমান একটি ট্রাকের নিচে একটি লোক থেঁতলে যায় নিমেষে। মুহূর্ত মাত্র চারদিক থেকে মৌমাছির মতো অজস্র লোক এসে চড়াও হয় ট্রাকটার উপর। ট্রাক ড্রাইভারটাকে টেনে-হেঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনে লোকজন। কেউ কেউ ট্রাকটার গায়ে লাথি মারছে। সামনের কাচ ভেঙে সহস্র টুকরো। থেঁতলে যাওয়া লোকটি পিচঢালা রাস্তায়, শুয়ে আছে- নিথর নির্বিকার। আর কোনোদিন সে পাশ ফিরে শোবে না। কোটিবার ডাকলে ফিরেও তাকাবে না।

সেকেন্ড মাত্র জীবন কোথায় কোন শূণ্যে মিলিয়ে যায়? কেমন জীবন? জীবনের কি কোনো আকার আছে? অধ্যাপক টুনটুনি পাখি তাকার নিচের ছোট হালকা শরীরটার দিকে। এই শরীরটার মধ্যে লুকিয়ে ছিল নিঃশব্দ জীবনখানা! আনমনে ভয়ানক ভাবসায় পড়ের টুনটুনি পাখিটি। আছে কি জীবনের কোনো নিগুঢ় রঙ? কেমন সেই রঙ? পানির মতো বর্ণহীন, মদের মতো কটু রঙ? না, মৃত্যুর রঙকে আঁকা সম্ভব নয়। মৃত্যু নিজেই একটি অপরূপ রঙ!

ইতোমধ্যে পুলিশ এসে চারপাশটা ঘিরে ফেলেছে। লোকজনের বিশাল জটলা হঠাৎ ট্রাকটা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ট্রাক ড্রাইভারটা আহত বাঘের মতো চিৎকার করে। পুলিশ ট্রাকে আগুণ দেখে হতভম্ব। কারা বা কে কখন আগুণ লাগাল? সহস্র সহস্র লোক চারিদিকে। কাকে ধরবে পুলিশ? যাত্রাবাড়ির চৌরাস্তাটা আগুনের মহোৎসবে নেচে ওঠে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।। ১ম পর্বউপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৩য় পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *