উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৯ম- পর্ব

গেলে অসুবিধা কি? আমি তো ভালো করে সব কথা বলতে পারব না। তুমি সব বলবে- বলে আহসান।
ঠিক আছে, চল।
আলী আহসান ঢোকে ঘরের ভিতর জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করার জন্য। মাকসুদা তাকায় মৌলির দিকে- দেখলি মৌলি?
কি মা?
আলী কিভাবে মুখের উপর কথা বলল? কত সাহস আর যুক্তি?
এটাই তো স্বাভাবিক মা। ও বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে, সব বুঝতে পারে- ওর কথায় কষ্ট পেও না মা।
না, না হাসার চেষ্টা করে মাকসুদা- কষ্ট পাইনি, মুগ্ধ হয়েছি।

দরজায় এস দাঁড়ায় সাঈদ হোসেন দেলোয়ার। সাঈদকে দেখেই বিরক্তির সঙ্গে পাশের রুমে চলে যান মাকসুদা। তাতে সাঈদের কিছু যায় আসে না, সে ভেতরে ঢোকে। তাকায় মৌলির দিকে। মৌলির আলোছায়ায় চোখে মুখে হাসি। হাত বাড়ায় সে। সাঈদ মুহূর্তে পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে হাতে দেয় মৌলির। মৌলি দ্রুত প্যাকেকটাকে বুকের দুই পায়রার মাঝখানে সযত্নে রেখে দেয়।

তোমার মা-আমার পরম পূজনীয় ভাবী, আমার সঙ্গে মনে হয় একটু দুর্ব্যবহার আরম্ভ করেছেন!
ঠোঁট উল্টায় মৌলি-তার আমি কি জানি?
জানো, সবই জানো। কিন্তু এখন না জানার ভান করছো-
অধ্যাপক টুনটুনি পাখি বিরামহীন উড়ে চলেছেন্

উদ্দেশ্য একটাই সন্ধ্যার আগে গ্রামের বাড়ি পৌঁছুবেন। তিনি লঞ্চ বা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নন। বিষাক্ত, দূষিত মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত এই শহরে তিনি আর থাকতে চান না। প্রিয় গ্রামে, ফেলে আসা শৈশবের মাঠে, কচা নদীর পারে- পাখি হয়ে উড়বেন, ঘুরবেন, বসবেন, আড্ডা দেবেন বাকি দুটো দিন। অসাধঅরণ অভিজ্ঞতায় তাঁর চারপাশে বন্ধু বান্ধব, ভাই বোন-চাচী চাচাদের পাশ দিয়ে উড়ে যাব, কেউ বুঝবে না, তাদের এত কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়া টুনটুনি পাখিটি আসলে মানুষ। তাদের নিকট আত্মীয়-আলী আসগর। তিনি সব দেখবেন, জানবেন-হাসবেন, খেলবেন-কিন্তু অন্যরা চুপচাপ থাকবে। কখনও তাঁর এই পাখি হওয়ার গল্প বললে বিশ্বাসও করবে না। না করাটাই স্বাভাবিক। উড়তে উড়তে বিশাল একটা নদী পার হতে হতে তিনি ভাবছেন- তিনি নিজেই পাখি- নিজের কাছে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। ষাট বছর বয়সের একজন মানুষ যাও সত্তুর কেজি ওজন-সেই তিনি এখন মাত্র কয়েক আউন্সের একটি ছোট টুনটুনি পাখি। উড়ে চলেছেন বহুদূরের পথে-নদী নালা, খাল বিল, মাঠ প্রান্তর পার হয়ে।

উড়তে উড়তে সত্যি তিনি, অধ্যাপক আলী আসগর অথবা আলী আসগর টুনটুনি পাখিটি সন্ধ্যার কিছুটা আগে নিজ গ্রামে পৌঁছে যান। তার কী অপরূপ আনন্দ! কি বিস্ময়কর সুখ সারা শরীর মনে প্লাবিত হচ্ছিল-বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তিনি পাগলের মতো সারা গ্রাম চক্রাকারে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি-এই উঠোন থেকে ঐ উঠোনে, এই সজনে গাছ থেবে তেঁতুল গাছে, বারান্দা থেকে রান্নাঘরে, রান্নাঘর থেকে পুকুর ঘাটে-অবিশ্রান্ত ছোটাছুটি করে চলেছেন তিনি। মানব চরাচরে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি আর কখনও ঘটবে তিনি বিশ্বাস করেন না। ছুটতে ছুটতে অধ্যাপক টুনটুনি এসে কচা নদীর পারে একটি বট গাছের ডালে বসেন। উঁচু, বিরাট একটা বটগাছ আকাশে ডালপালা ছড়িয়ে বেশ সুখে সংসার পেতেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু বেশিদিন এই সুখ তার সহ্য হবে না। কারণ রাক্ষসী নদী কচা ভাঙতে ভাঙতে প্রায় রাস্তাটা গিলে খাবার কাছাকাছি এসেছে। হয়তো তিন চার মাস পর আসলে এই বটগাছ দেখা যাবে না, মাটি ও বটগাছ খেয়ে ফেলবে- কচা নদী।

কচা নদী ছিল আলী আসগরের শৈশবের আশ্রয়। সুখের হিরন্ময় ঘর।

কখন, কোনদিন মনে পড়ে না, তবে যেকোনো একদিন শৈশবের মধুরূপী আকর্ষণে সময় পেলেই লুঙ্গি পরে, কাঁধে গামছা নিয়ে ছুটে আসতেন, কচা নদীর পারে। একেবারে নদীর ধারে, কেয়া গাছের আড়ালে ঘাস লতাপাতার উপর বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনে রাতে সকালে বিকেলে। কি দেখতেন শৈশবের আসগর এই নদীর বুকে? তিনি দেখতেন নদীর ঢেউ, ভেসে আসা কচুরিপানা, মরা পশুদের লাশ, লাশের উপর কাকদের ভিড়-চিৎকার আর পচা মাংস ভক্ষণ। দেখতের দূরে, অনেক দূরে, একটি বিরাট লঞ্চ অথবা জাহাজের ছবি। সামনে এসে সেই ছবিটি স্পষ্ট হত, যত কাছে আসত, চোখের সামনে দিয়ে সশব্দে গর্জন করতে করতে  পানি ভাঙতে ভাঙতে চলে গেছে জাহাজ, আবার দূরে, বহুদূরে উল্টোদিকের সীমান্ত রেখায়। একসময়ে দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যেত সেই বিরাট জাহাজটি। আলী আহসানের মনে ও চোখে লেগে থাকত বিরামহীন সুখের স্মৃতি। গ্রামের লোকজন একসময়ে বলাবলি করতে আরম্ভ  করল মাহবুব আলমের ছোট ছেলেটা বোধহয় পাগল।

কেন?
দিন-রাত সবসময় নদীর তীরে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে- হাসতে হাসতে কেউ উত্তর দিত।

হাং! সেই নদী থেকে, অপরূপ দৃশ্যাবলি থেকে কতদিন বঞ্চিত তিনি। প্রায় বছর পাঁচেক তো হবেই তিনি বাড়ি আসেন না। আজও যে এসেছেন তা কেবল তিনিই জানেন। অন্যরা জানবে না। বললে বিশ্বাস করবে না। এমনকি তাকে দানব বা অশুভ শক্তির ছায়া প্রপাত ভেবে খুন টুন করতে পারে। কাউকে তাঁর জীবনের এই অলৌকিক অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করাও যাবে না।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। নদীতে মাঝারি স্রোত। জেলেরা নৌকায় জাল তুলছে। পশ্চিমাকাশে লাল আবীর। তেলিখালির মোহনায় জ্বলে উঠেছে বাতি। একবার জ্বলে একবার নেভে। শৈশবে এই বাতিটাকে মনে হত রহস্যের এক বিপুল বাড়ি। দিনের বেলায় আলো জ্বলে না। সন্ধ্যা হলেই দেখা যায় একবার জ্বলছে, একবার নিভছে। কেউ কি আলো জ্বালিয়ে দেয়? সেই রহস্য আজও রহস্য রয়ে গেল তাঁর কাছে। অবশ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তো আছেই। না, তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনে শৈশবের রূপকথার রহস্যময়তার দরজা খুলতে চান না। থাক, সেটা তার জীবনে রহস্যই থাক।

তিনি বাড়ি ফিরে আসছেন। পথে দেখতে পেলেন নাসির লুঙ্গি তুলে প্রসাব করছে হটিবনের পাশে বসে। এই প্রৌঢ় বয়সেও অধ্যাপক টুনটুনির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি সাঁ করে প্রসাবরত নাসিরের মাথায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, নাসির হতভম্ব, মাথঅয় হাত দিয়ে চিৎকার করে দাঁড়ায়। টুনটুনি পাখি উড়ে পাশেই একটা বকুল গাছের ডালে বসে। হতভম্ব নাসির এদিন ওদিক তাকায়। ঘটনাটা কি? নাসিরের বয়স পড়েছিল, ঠিক আছে, সে সতর্কতার সঙ্গে আবার লুঙ্গি তুলে অসমাপ্ত প্রসাব সমাপ্ত করতে বসে। প্রসাব করতে করতে চারপাশে তাকায় আবার যেন আক্রমণ না আসে-সতর্ক সে। হাসে টুনটুনি ঝাঁপিয়ে পড়ে নাসিরের মাথায়। নাসির ভয় পায়-অশুভ অশরীরী কোনো আত্মা টাত্মা নাকি! দৌড় আরম্ভ করে নাসির। যাকে বলে কাছা মেরে ভো দৌড়। টুনটুনি নাসিরের পিছু ধাওয়া না করে কিছু দূরে খালের উপর পুলের আড়ায় বসে। খুব হাসি পাচ্ছে অধ্যাপক টুনটুনির।

তাঁর কাছে যদি সেই অলৌকিক বোধিবৃক্ষের নিচে ঘুঙুর-মুহূর্তে মানুষ হয়ে থাকার ক্ষমতাটাও দিত, নাসিরের সামনে সামান্য টুনটুনি পাখি থেকে রূপান্তরিত আলী আসগরকে দেখলে, ভয়ে বিষ্ফোরিত চোখে হঠাৎ মারা যেত। না দিয়ে ভালোই করেছে। তাহলে হয়তো অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হতেন তিনি।

বয়স হলে কি মানুষ সাহস বিসর্জন দেয়? শৈশব-কৈশরের সেই তাগড়া নাসিরের সামনে আজকে টুনটুনি পাখি হয়ে তিনি যা করলেন, তখন করলে নাসির উল্টো টুনটুনি পাখি ধরার চেষ্টা করত, প্রয়োজনে মনে করলে বাড়ি থেকে জাল আনত। সারারাত পাহারার ব্যবস্থা করত ও। শৈশবের সব খেলা আর অপকর্মের সঙ্গী নাসির। ওর সঙ্গী হয়ে আলী আসগর অনেক অপকর্ম করেছে। অনেক বাড়িতে রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে আনারস, কাঁঠাল, পেঁপে, সফেদা, পাকা কলা, নারকেল পেড়ে এনেছেন। খোপ থেকে মুরগী এনে রান্না করেছেন-খেয়েছেন। দুপুরে প্রায়ই বোথলা খালের পুলের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে খালের পানিতে ঝপাৎ শব্দে পড়তেন। চারপাশে রাশি রাশি পানি পুথিঁর দানার ছন্দে ছড়িয়ে পড়ত- কী সুখ! কী স্মৃতি! দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত পানিতে ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলেন। হস্ত মৈথুনের স্বাদ প্রথম পেয়েছিলেন নাসিরের কাছে মনে আছে আজও স্পষ্ট । তখন তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবেন। পরীক্ষার মাস তিনেক বাকি। নাসির কোনোদিন স্কুলে যায়নি। বাড়ির কাজ করত- গরু রাখত, হালচাষ করত। আর সময় সুযোগ পেলেই ছুটে আসত পাশের বাড়ির একই বয়সের আলী আসগরের কাছে।

দুপুরে স্কুল থেকে এসে কেবল বসেছে আলী আসগর। সামনে এসে দাঁড়ায় নাসির-
চল।
কোথায়?
আরে ল না। হাত ধরে আলী আসগরের-একটা মজার খেলা শিখেছি।
কোথায়?
গতকাল নানাবাড়ি গিয়েছিলাম। এক মামাতো ভাই-কায়সার টাউনে থাকে, ও শিখিয়েছে। খুব ভালো খেলা, চল।
নাসির এত আগ্রহ নিয়ে যখন বলছে, অবশ্যই সত্য এবং বিষয়টি অবশ্যই নতুন. অভিনব। আলী আসগর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নাসিরের সঙ্গে। আলী আসগর অবাক হয়ে দেখে নাসির পথ ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকছে। ওর পিছু যেতে যেতে প্রশ্ন করে আসগর- কোথায় যাচ্ছিস?
আরে আয় না!

যেতে যেতে জঙ্গলের ভেতর, একটা ছায়াঘেরা জায়গায় অনেক গাছের আড়ালে ঘাসের উপর বসে পড়ে নাসির। ওকেও পাশ বসতে বলে। নাসির বসেই লুঙ্গি তুলে দু’দিকে পা ছড়িয়ে আরামের সঙ্গে বসে ডান হাতের মধ্যে নুনুটা নিয়ে উপর নীচ করতে থাকে। আলী আসগর হতবাক হয়ে নাসিরের কাণ্ড দেখে- কি করছিস এসব?
নুনুর উপর হাতের কসরত করতে করতে আরামের আবেগে চোখ বুজে নাসির বলে-তুইও কর না, খুব মজা পাবি।
কি বলছিস?
আহা করে দেখ না-

আলী আসগর আর আলী আসগরে নেই। সে হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। কি করছে এসব নাসির? এর কি নাম? নাসিরের মুখ থেকে গভীর আরাম আর আত্মতৃপ্তির বিশ্রী এবং অদ্ভুত কম্পমান এক শব্দ ভেসে আসে। অপলক চোখে ওর শরীরের কোষে কোষে আবেগ থরো থরো কম্পন, শুয়ে পড়ে মিলেমিশে একাকার হওয়ার অদ্ভুত কৌশল দেখতে দেখতে নিজের শরীর ও নুনুতে একটা অজানা শিরশির উত্তেজনা অনুভব করে। এবার আর নাসিরকে বলতে হয় না, নিজেই বসে যায় ঘাসের উপর মাটিতে। লুঙ্গি উচিঁয়ে নুনু নিয়ে পৃথিবীর নিবিড়তম একান্ত গোপন শিল্পময় খেলায় মেতে উছে ডান হাতে, নাসিরের মতো। শুরুতে হাতটা কম্পমান থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে হাতটা অপরূপ এক শিল্পকলায় পরিণত হয় এবং পুরোটা শরীর আনন্দে অপাথির্ক অসামান্য লোকায়েত শারীরিক হাস গেয়ে ওঠে। আর অবাক হয়ে দেখে কৈশোনে সুবর্ণ তোরণে উত্তীর্ণ বয়োসন্ধিক্ষণের মুখোমুখি একজনকে। নাসিরের নুনুর ছিঠদ্র থেকে কি আঠালো সাদা সাদা তরল পদার্থ বের হচ্ছে ঝলকে ঝলকে আর নাসির দু’দিকে দুপা ছড়িয়ে মাটিতে চিৎহয়ে শুয়ে পড়েছে। নাসিরের বুকটা উঠানামা করছে। ওর দুই চক্ষু মুদ্রিত। নাসিরের সুখটা পরমভাবে আকর্ষণ করে আলী আসগরকে। ডান হাত ব্যাথা হলে সে বাম হাতে নুনুর উপর শিল্পচর্চা করতে থাকে এবং এক অপরিণামদর্শী ঈর্ষাকাতর অনুরাগ শরীরে সেতারের মতো বেজে ওঠে। অনেকক্ষণ ধরে দু’হাতে সেতার বাজাতে বাজাতে চরম মুহূর্তে দেখতে পায়- তার নুনুর ছিদ্র থেকেও নির্গত হচ্ছে তরল সাদা সাদা আঠা এবং পুলকে শিহরণে শুইয়ে পড়ে গাসের ইপর সটান। শুরু হল জীবনভর শিল্পসাধনার এক অন্য রূপান্তর। স্ত্রীকে এখনও কাছে পান না যখন, তিনি শৈশব-কৈশোরের বন্ধু নাসিরের শেখানো শিল্পকলায় প্রবেশ করেন অপার আনন্দ অবগাহনে।

কত রত এমন হয়েছে- বড় আশা করে শারীরিক ক্ষুধা ও আকর্ষণ নিয়ে মাকসুদার কাছে গেঝেন, শরীরে হাত রেখেছেন-মাকসুদা গোখরো সাপের ফণা তুলেছেন-যাও। চোখে মুখে তীব্র ঘৃণা, উপহাস।

মানুষ নয়, ইঁদুর হয়ে, মুষিক হয়ে, কুকুর-বেড়াল হয়ে চুপ থেকেছেন লাশের মতো। তারপর এক সময়ে নাসিরের মেখানো ামোঘ হস্তশিল্পকরণে লিপ্ত হয়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করেছেন। তখন বুছতে না পারলেও তিনি এখন বুঝতে পারেন, কেন মাকসুদা তাকে বারবার অবজ্ঞার গ্রেনেড ছুঁড়ছেন! তিনি জানতেন না- তার সাজানো সংসারে কখন ঢুকেছে বাঘডাস এক গোপন পথে।

একটি দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ পায় তাঁর বুকের হভীর গহীন থেকে।

রাত নেমে গেছে পৃথিবী জুড়ে। গ্রাম রাতের কালো পর্দায় ঢেকে গেছে। চারদিক থেকে কেমন একটা বেদনাবিধূর শ্যামল গন্ধ এসে নাকে লাগে। দূরে এবং কাছে কয়েকটা বাড়িতে রান্নার আগুন দেখতে পান তিনি। পাশের কোনো একটা বাড়ি থেকে বাচ্চাদের পড়ার শব্দ ভেসে আসে, মাগো, আমান শোলক বলা কাজলা দিদি কই, বাঁশ বাগানে মাথঅর উপর চাঁদ উঠেছে ওই-দীর্ঘ বছর পর হঠাৎ :ূসর রাতে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এই অসাধারণ নষ্টালজিক কবিতাটা শুনে অসম্ভব মন খারাপ হয় অধ্যাপক টুনটুর্নি

তিনি দেখতে পান-রাস্তার ওপাশ থেকে হেরিকেন নিয়ে দু’জন লোক কথা বলতে বলতে পুলের উপর এসে উঠেছে। পুলের রেলিংয়ের আড়ালে নিজের ছোট্ট শরীরটা লুকিয়ে ফেলেন তিনি। কথা বলতে বলতে লোক দু’জন অতিক্রম করে চয়ে যায়। একজনকে চিনতে পেরেছেন, সেই স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সৎ মানুষ। সঙ্গের লোকটাকে অধ্যাপক টুনটুনি চিনতে পারেন নি। পুল থেকে অন্ধকার আকাশে ডানা মেলে দিলেন। রাতের নিস্তব্ধ নিথর চমৎকার অন্ধকার দেখে তাঁর ভেতরের সমস্ত কষ্ট, ক্লেদ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। নিজেকে নির্ভার, ভয়ানক সুখী মনে হয়। আপন মনে শিষ বাজাতে বাজাতে বাড়ির দিকে যাত্রা আরম্ভ করলেন। পুল থেকে বাড়ি হেঁটে পৌছুতে লাগে বিশ মিনিট। তিনি তো হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে জলে এলেন মিনিটখানেকের মধ্যে।

শ্যামপুর নতুন থানা।

বিশাল লাল সিরামিকের অট্টালিকায় থানার কাজকর্ম চলে। ওসি ছুটিতে। ওসির দায়িত্ব পালন করছে দ্বিতীয় দারোগা-আবদুল মান্নান ভূইয়া। লোকটার মুখ চৌকো।নাকের নিচে হিটলারী গোফে যতেœর সঙ্গে কলপ লাগায়। মাথার অর্ধেক চুল পাকা। অনেক সময় মহারাজ নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের রাজদরবারের ভাড়ের মতো লাগে তাকে দেখতে। পান চিবান সবসময় ছাগলের ঘাস খাওয়ার মতো। মুখে থাকে আজেবাজে গানের কলি। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আগে খাগড়াছড়ি ছিল। কি একটা মাইয়া মানুষ আর পাঁচ লাখ টাকার একটা কেসে কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তিমূলন ট্রান্সফার করেছিল ঢাকার মিরপুর থেকে। মশার কামড়ে, জঙ্গলে জঙ্গলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস- কষ্টে সিষ্টে থেকে এই মাস দুে হল ঢাকায় ফিরে এসেছে, এজন্য কর্তৃপক্ষকে খুশি করতে ব্যায় হয় পাঁচ লক্ষ টাকা। শ্যামপুর আসতে চায়নি সে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আপাতত এখানে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছে- বলে থাকছে। কাজ করতে এসে দেখে, না জায়গাটা খারাপ না। প্রতি মাসে পাঁচ লাখ তোলা তেমন কোনোাা সমস্যা না। এমনিতে চোর গুণ্ডা বদমাইশ চ্যাচ্ছোর মাগী-মাগীর দালালে এলাকাটা ভরা। বাড়তি পাওনা- এই এলাকায় আছে বেশ কিছু শিল্প কারখানা। যেসব কল-কারখানার কারবারের আবার ঠিক নাই-যত বেঠিক থাকবে-তত মাল আসবে, আসতেই থাকবে।

বিকেল পার হবে হবে করছে। আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া-চেয়ারে পাছা রেখে টেবিলে বুটসহ পা জোড়া তুলে দিয়েছে, গান গাইছে-দরাজ গলায়-দিনের নবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাইটা যায়, ছাগল একটা বান্ধা ছিলো গাছেরও তলায় গো, গাছেরও তলায়… বেসুরো কণ্ঠে গানটি গাইতে গাইতে হঠাৎ মান্নান বূঁইয়ার মাথায় একটা প্রশ্ন আসে-আচ্ছা চৌদ্দশত বছর আগে কি ছাগল আছিলো? তাছাড়া আরব দেশের মরুভূমিতে তো ঘাস লতাগুল্ম জন্মায় না- ছাগল কি খেয়ে বাঁচবে? মরুভূমিতে ভেড়ার চাষাবাদ হওয়াটাই স্বাভাবিক। শালা যে ব্যাটা এই গান লিখেছে ওর কাণ্ডজ্ঞান কম, তবে গানটির সুরেরা মধ্যে একটা আন্তরিকতা আছে- আর এই আন্তরিকতার টানে সময়ে অসময়ে গানটা গেয়ে থাকে সে, হেড়ে গলায়, কখনও সুরে, কখনও বেসুরে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৮ম পর্বঅধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১০ম-পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *