উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব দুই

।।দুই ॥

ধরিত্রী দাস বিশ্বাস করে পৃথিবী-মাতার সে দাস। সেবক। শস্য ফলানো আর মাতা-বসুমতীর সেবা করা। একই কাজ। এই বিশ্বাস যে তার অন্তরে স্থাপন করেছে সে হচ্ছে জাতিস্মর কাকেশ্বর। নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাইভের হয়ে সে যে ছদ্মবেশে গুপ্তচরের কাজ করেছে পূর্বজন্মে, তার সেই দাবি মেনেও এই অলৌকিক কথক মানুষটিকে ঘৃণা করতে পারে না। ধরিত্রী দাসের বিশ্বাস, কোনো না কোনো জন্মে পলাশি যুদ্ধের পাপের ফল কাকরূপ নিয়ে সে নিশ্চয়ই ভোগ করেছে। আজ তেপান্তরের মাঠে গ্রামবাসীর সঙ্গে কাজ করতে এসে সে মধ্যমাঠে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন বট গাছটির দিকে তাকায়। ওই গাছে আত্মঘাতী কিংবা দুর্ঘটনায়-অপঘাতে মৃত মানুষের প্রেতাত্মা বসবাস করে। কংকালের হেঁটে বেড়ানোর কথাও শুনেছে সে। কাকেশ্বরের মুখের বয়ানই সে গ্রামবাসীকে শোনায়। এ যেন বাল্মীকির রসায়ন পাঠ।

পলাশির পরাজয় এবং নবাবের হত্যাকাণ্ডের পর যে সব সেপাই ভাগীরথী পেরিয়ে পুতুল নবাব মিরজাফরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এই অঞ্চলে সমবেত হয়েছিল, ক্লাইভের বাহিনী আর মির জাফরের বাহিনী তাদের তাড়া করে ধরে এনে এই বটগাছের তলায় সারবদ্ধ দাঁড় করিয়ে অগ্নিকামানের গোলায় জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অর্ধ দগ্ধ লাশগুলো স্তূপীকৃত পড়েছিল বটের তলায়। সে এক বিশাল কংকালের পাহাড়। গভীর রাতে সেই কংকালগুলো জেগে উঠতো। ওরা যুদ্ধপ্রশিক্ষণের ভঙ্গিতে এই তেপান্তরের মাঠে ছুটে বেড়াতে গেলে গ্রামের অনেকেই সেসব কংকাল-সেপাইদের দেখতে পায়।

এবার কথক দমনক ধরিত্রী দাসকে হারিয়ে দিয়ে নিজের বয়ান খুলে ধরে। আমি শুনেছি কোনো কোনো শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথির জোছনাকালের গভীর রাতে মির কাশিমের ঘোড়ার পায়ের শব্দ আজও শোনা যায় মুর্শিদাবাদের পথে-প্রান্তরে। শুধু শোনা কেন, নগরবাসীরা নাকি স্পষ্ট দেখেছ উন্মুক্ত তরবারি হাতে নবাবের হত্যাকাণ্ডের সাক্ষীকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করতে।

একথা শোনামাত্র ধমকে ওঠে ধরিত্রী দাস। সে বলে, পলাশি যুদ্ধের পর ফরাসি সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে বণিকের ছদ্মবেশে যে রাজপুরুষ মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন, আমি তার বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারি। তিনি এসেছিলেন যে ফরাসি গোলান্দাজ বাহিনী নগরের পক্ষ নিয়ে ক্লাইভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে। তিনিই দেখেছিলেন নবাব সিরাজ আর মিরকাশিমের অশ্বারোহী ছায়া মূর্তিকে ধুলো উড়িয়ে ভাগীরথী নদীর দিকে ছুটে যেতে। ভগবানগোলার যে ঘাটে পলাতক নবাব ইংরেজ সৈন্যদর দ্বারা ধৃত হয়েছিলেন, ক্ষণকাল সেখানে ছায়া মূর্তিদ্বয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল। পূর্ণিমার চাঁদ ডুবে গেলে সেই ছায়ামূর্তিও অদৃশ্য হয়ে যায়।

এক ত্রিসন্ধ্যার আবছায়ায় গুপ্তচর কাকেশ্বরের প্রেত শরীরের মুখোমুখি হয়েছিলেন নবাব বেগম লুৎফুন্নেছা। যুবতী বেগমের কোলে তার শিশু সন্তান। বেগমকে চিনতে পারে কাকেশ্বর। তিনি জানতে চান, ‘বেগম সাহেবা, আপনি এখানে? আমরা জানতাম ক্লাইভের আদেশে নির্বাসন যাত্রাপথে ধলেশ্বরী নদীতে নৌ দুর্ঘটনায় আপনার সলিলসমাধি হয়েছে, তবে কেন ফিরলেন মুর্শিদাবাদে?

‘নবাবের শিশু সন্তানকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে’, অজাগতিক স্বরে উত্তর দেন বেগম।

‘আপনি অদৃশ্য হয়ে যান বেগম সাহেবা, মুহম্মদি বেগ আপনাকে উন্মাদ হয়ে খুঁজছে। আপনাকে পাবার আশাই বন্দি নবাবকে বিষাক্ত ছোরার আঘাতে সে হত্যা করেছে। বড় নিষ্ঠুর সে, বড় নির্দয়।’

‘কাকেশ্বর, আমি তোমাকে যেমনি জানি গুপ্তচর হিসাবে, তেমনি জানি নারীলোভী মুহম্মদি বেগকে। আমার শরীর এখন অজাগতিক, তাই বিশ্বাসঘাতক আমাকে স্পর্শও করতে পারবে না।’

‘বেগম সাহেবা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

‘তোমার পাপের ক্ষমা নেই কাকেশ্বর। এই বাংলার মাটিতে তোমার, মিরজাফরের, মুহম্মদি বেগের যুগ যুগ ধরে জন্ম হবে। কেননা নিহত নবাবের লাশ হাতির পিঠে চাপিয়ে প্রজাদের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্য যেদিন নগরী প্রদক্ষিণ করানো হচ্ছিল, সেদিন লাশবাহী হাতির পেছনে মিরজাফর, মুহম্মদি বেগ এবং তুমিও ক্লাইভের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে নগর প্রদক্ষিণ করেছিলে। কি উচ্চ ছিল তোমার কণ্ঠ! কি কর্কশ!’

এবার ধরিত্রী দাসের গলা বুঁজে আসে। সে উচ্চস্বরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ধরিত্রী দাস একথা বলে বিলাপ করতে থাকে যে, যেদিন কাকেশ্বরের মুখে সে এই কাহিনি শুনছিল, সে দিন ছিল সূর্যগ্রহণের কাল। রাক্ষস রাহু সূর্যকে গ্রাস করলে সারা দুনিয়া রাতের মতো কালো ছায়ায় ডুবে যায়। আসমান থেকে মৃত আর অর্ধমৃত পাখির ঝাঁক উল্কার মতো লুটিয়ে পড়ছিল মাটিতে। ছিন্ন পালকে ঢাকা পড়েছিল শস্যভূমি। পালকে পালকে রক্তের ফোঁটা।

মানুষ ভয়ার্ত হয়ে পড়েছিল এ কারণে যে, আগুনের ডানা মেলে ফেরেশতাদের মতো অলীক এক পুরুষ আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসে নবাবের শিশু সন্তানকে বেগমের কোল থেকে তুলে নিয়ে পুনরায় আকাশেই অদৃশ্য হয়ে যায়। ভয়ার্ত প্রজাগণ মিরজাফরের আদেশে ছুটে যায় সিরাজের হত্যাকাণ্ডের প্রকোষ্ঠের দিকে। ওরা দেখতে পায় জমাট রক্তে পতঙ্গরা উড়াউড়ি করছে। নিহত নবাবের লাশটি যে টেনে হিঁচড়ে বারান্দা পর্যন্ত আনা হয়েছিল, তার আলামত স্পষ্ট। সিঁড়িতে রক্তের চিহ্ন। মিরজাফর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যা ঘটেছে সে মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে, তোমরা দুঃখ করো না, বরং আল্লাহর গুণকীর্তন করো এই কারণে যে, তিনি তোমাদের অত্যাচারী নবাবের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’

প্রজাগণ নির্বাক। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা শূন্য নবাব মহলের দিকে বারকতক দৃষ্টি ফেলে ভাগীরথী নদীর পথে হাঁটতে থাকে। সবাই নদীতে নেমে স্নান করে ভেজা কাপড়ে বিলাপ করতে করতে গ্রামে ফিরে যায়। সাতদিন পর হঠাৎ এক সকালে তারা ভাগীরথীর তীরে নৌকা থেকে নামতে সাধক রাম প্রসাদকে দেখতে পায়। ওরা বিস্মিত! ওরা ভীত!

রক্তবর্ণ পোশাক পরিহিত শ্মশ্রুমণ্ডিত সাধক রামপ্রসাদ শ্যামা সংগীত গাইতে গাইতে শোকাহত স্তব্ধ নগরীতে প্রবেশ করেন। এ গান তার নিহত হতভাগ্য নবাবের উদ্দেশ্যে। মিরজাফর আর ক্লাইভের সৈন্যরা নগর থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত নগরীর প্রজাদের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে জানান, কেন তিনি আজ নগরে এসেছেন।

নৌপথে নবাব সিরাজ কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ ফিরেছিলেন। গঙ্গার ঘাটে নাইতে নেমে রামপ্রসাদ গাইছেন শ্যামা সংগীত। মুগ্ধ নবাবের নৌকা তীরে ভেড়ে। মাঝি-মাল্লারা জানায় ইনিই হচ্ছেন রাম প্রসাদ। নবাব তার সাধক-গায়ক প্রজার নাম জানতেন।

‘সাধক, তুমি যাবে আমার দরবারে? মন্দির গড়ে দেব। দরবারে তুমি গান শোনাবে। লখনৌর গায়ক আছে আমার দরবারে। যাবে তুমি আমার সঙ্গে? নবাব সিরাজ জানতে চান।

রামপ্রসাদ অবাক হয়ে নবাবকে দেখেন। চিনতে পারেন।

কিছুটা ভড়কে গেলেও সামলে নিয়ে রামপ্রসাদ নবাবকে সেলাম ঠুকে বিনীতস্বরে বলেন, আমাকে ক্ষমা করবেন বাংলার নবাব, আমার মা কালী কি মুসলমান রাজাদের দরবারে যেতে রাজি হবেন?’

‘কি বলছ সাধক, আমার দরবারে হিন্দু মন্ত্রী আছে, সেনাপতি আছে, তাদের জন্য আছে মন্দির, তাছাড়া আমি যে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সব প্রজারই নবাব, আমার আবার জাত-ধর্ম কি?’

‘আমায় ক্ষমা করুন নবাব বাহাদুর, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও আমাকে ডেকেছেন, যাইনি, সংসার ছাড়া পাগল মানুষ আমি, মায়ের মন্দির ছেড়ে কোথাও আমি যাব না। এযে আমার দুর্মতি। অধর্ম।’

‘কোনোদিন যদি মন পাল্টায় তবে যেও সাধক,’ এমন বাক্য শুনে রামপ্রসাদ যখন গঙ্গার জল থেকে দৃষ্টি তোলেন, তখন দেখতে পান নবাবের ময়ূরপংখী নৌকা মধ্যনদীতে। নবাব দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি চন্দননগরের ফরাসি কুটিরের সুউচ্চ মিনারে।

আজ নবাব সিরাজের রক্তে রঞ্জিত মুর্শিদবাদের রাজপথে উদভ্রান্তের মতো ঘুরছেন রামপ্রসাদ। আক্ষেপ হচ্ছে নবাবের জন্য। মনে পড়ে নবাবের শেষ কথাটি। তাই বিড়বিড় করে বলেন, ‘হতভাগ্য নবাব, আমি তো আজ মন পাল্টেই আপনার কাছে এসেছি নবাব, আপনি নাই, কে শুনবে আমার গান? আমি যে অনুশোচনার আগুনে পুড়ছি।’

‘আমি কি দুখেরে ডরাই?

দুখে দুখে জনম গেল, আর কত দুখ দেও, দেখি তাই॥

আগে পাছে দুখ চলে মা, যদি কোনখানেতে যাই।

তখন দুখের বোঝা মাথায় নিয়ে, দুখ দিয়ে বাজার মিলাই॥’

ধরিত্রী দাসের চোখ থেকে এখন সাধক রামপ্রসাদ এবং দেবীকালী হারিয়ে যায়। কেননা সংসার নিরাসক্ত, জীবন নিরাসক্ত, যুদ্ধ নিরাসক্ত, রাজা-প্রজা নিরাসক্ত রামপ্রসাদের কাছে মা কালীর মতোই পলাশি ঘোর কালো অন্ধকারে ডুবে যায়। পলাশির আম্র আর পলাশ গাছের পত্র-পল্লব ক্লাইভের কামানের গোলায় ছিন্ন-ভিন্ন, আগুনে পোড়া। এসবই কালী সাধকের কাছে দুঃখ। সিরাজের রক্ত ছিটানো রাজপথে দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়ে দুঃখ বিলাসী সাধক সংসারনিরাসক্ত রামপ্রসাদ অনন্তকাল ঘুরে বেড়াবেন স্বপ্ন-কুহকের ভিতর। কেননা দুঃখ বিজয় তো পলাশির পরাজয়ের মতই আদিগন্ত মহাকাল রামপ্রসাদের কাছে।

ক্লাইভের গুপ্তচর কাকেশ্বরের পাপ ধরিত্রী দাসের চোখে যে গোলকধাঁধার জটিল মেঘ তৈরি করে, সেই মেঘের আড়ালে বসেই বুঝি মানুষটিও শুনতে পায় সিরাজ-শূন্য মুর্শিদাবাদের খাস মহল, বেগম মহল আর শূন্য অস্ত্রভাণ্ডরের ভাঙা দুয়ারে ভাগীরথীর দমকা বাতাস কান্নার মতো শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলছে কেমন করে। তাই তার মনে হয় মহাকালের সাক্ষী এই ভাগীরথীর বুকে যে স্রোতে বইছে তা জলধারা নয়, সিরাজের বুকের রক্তধারা।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব একধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিন >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *