উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব -পনেরো

বর্ষা প্রায় এসেই গেছে। প্রাক বর্ষার বৃষ্টি হয়। পঞ্চপল্লবের এই গ্রাম আবার রূপ বদলায়। আম, বট, পাকুড়, ডুমুর গাছে সবুজ পাতা। বেল, আমলকী আর অশোক গাছে ছাওয়া এই গ্রাম যেন রামায়ণের সীতার বনবাসের অরণ্য। গ্রামের পঞ্চবটীতে পাখিরা উড়াউড়ি করে। স্মৃতিভ্রষ্ট হতে চায় এই গ্রাম। যুদ্ধের দুর্ভোগের রক্তাক্ত স্মৃতি। কিন্তু পারে না। কারবালার যুদ্ধ আর কুরুক্ষেতের যুদ্ধ একাত্তরের যুদ্ধের সঙ্গে একাকার হয়ে নতুন এক মহাকাব্য হতে চায়। কেবল যুদ্ধ, মৃত্যু, দুর্ভোগই নয়, যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত ভালোবাসাও ঝরাপাতার বনে বসন্ত ডেকে আনতে চায় কিশলয় জাগাতে চায়। কিন্তু সময়টা এক গোলকধাঁধা যে!

কামাখ্যাচরণের মেয়ে আরতিয় সদ্য বিবাহিত স্বামী জয়দেব ওই যে যুদ্ধের ভেতর স্ত্রীকে ফেলে পিতা-মাতার হাত ধরে সীমান্ত পেরিয়ে গেছে, সে আর ফেরেনি। এতবড় সীমান্ত, কোন পথে পরিবারটি নিরুদ্দেশ হয়েছে, এ গ্রাম ও গ্রামের কেউ জানে না। অনেক খুঁজেছে কামাখ্যাচরণ, হদিস পায়নি তাদের। এখন এই সদ্য বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে কি করবে সে? জানা থাকলে না হয় সীমান্ত পেরিয়ে মেয়েকে রেখে আসতো তার শ্বশুর ঘরে। কিন্তু কোন ঠিকানায়?

সব সংবাদই রাখে পাশের গাঁয়ের যুদ্ধ ফেরৎ তপন। একদিন পারেনি, সাহস ছিল না। আরতিকে নিয়ে পালিয়ে যেতে সাহস পায়নি। চোখের সামনে বিয়ে হয়ে যায় আরতির, ঠেকাতে পারেনি। গরিবের ছেলে বলে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি কামাখ্যা। অথচ আজ কতইনা সহজে পাওয়া যায় আরতিকে। হাত বাড়ালেই মেলে। একটা যুদ্ধ, গণহত্যা, দুর্ভোগ। সব বদলে দিয়েছে তপনের।

আরতিকে আজ জোর করে ঘরে তোলার সাহসও আছে তার। এতদিন যা ছিল না। কিন্তু আজ আর মনটা সায় দেয় না। আরতি বিবাহিতা, যদিও ওর কুমারিত্ব হরণ সে-ই করেছিল প্রথম। তবু অন্য একটা পুরুষ আরতির শরীরের সমস্ত অজানা রহস্যকে উন্মোচন করে গেছে বহুবার। একটা গোপন প্রতিহিংসা সাপের জিহ্বা দেখায়।

ইচ্ছে জাগে একবার খোঁজ নিয়ে আসে আরতির। কিন্তু তার তো এখন সময় কম। সব মানুষ ছুটছে শহরে। বাণিজ্য, চাকরি, শিক্ষা, এ যেন এক গোলকধাঁধা। একটা বিবাহিতা, নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর বাসি শরীরের মেয়ের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় না। স্বাধীন দেশের শহর তাকে ডাকে। একটা গ্রাম্যপ্রেমে মন আর ভরে না। ভবিষ্যতের কত স্বপ্ন উঁকি দেয় মনে। বুঝতে পারে এই যে গ্রাম ছেড়ে নগরে ছুটে যাবার প্রতিযোগিতা তা শিখিয়েছে একটা যুদ্ধ আর বিজয়। বন্যার জল ঘরে ঢুকে পড়লে ঘরকুনো ব্যাঙের দশা তার। সাঁতরাতে ইচ্ছে করে অন্য আরও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা রক্ষীবাহিনী। কোথাওনা কোথাও একটা কিছু জুটে যাবেই।

একটা যুদ্ধ। ভালোবাসার আবেগেরও রূপ বদলে দিয়েছে। কাছে পেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মনটা সায় দেয় না। কখনও মনে হয় যে মেয়েকে ফেলে রেখে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সে হচ্ছে বাসি-ছেঁড়া রংচটা একটি কাপড় মাত্র। আবার এটাও বুঝতে চায়, অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া প্রেমিকা কি অশুচি হয়ে যায়? উত্তরটা বড় জটিল।

অন্যদিকে কামাখ্যাচরণ বড় আক্ষেপে পড়ে। কোনো যে সেদিন তপনের হাতে তুলে দেয়নি আরতিকে। সে বুঝতে পারে আরতির স্বামী জয়দেব আর কখনও ফিরবে না। এদিকে আবার দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। ভীরু বাঙালিকে পাঞ্জাবিয়া সাহসী ডাকাত বানিয়ে গেছে। লাজুক বাঙালি পাঞ্জাবিদের কাছে শিখেছে নারী ধর্ষণ। এসব ভয়ের কথা কামাখ্যাকে শুনতে হয়। কখন কি ঘটে যায়।

এক দুপুরে রাস্তায় পেয়ে যুদ্ধের কথা শোনার অছিলায় তপনকে বাড়ি ডেকে নিয়ে আসে কামাখ্যা। আরতির সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে অবাক হয়ে যায় তপন। আরতির চোখে বিচ্ছেদের কাতরতা নেই, স্বামী নিরুদ্দেশের উদ্বেগও নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধা অবাক হয় বই কি! এ যেন অবিশ্বাস্য। সে বুঝতে পারে এই যুদ্ধটা লাজুকলতা একটি বাঙালি মেয়েকে কতটা বদলে দিতে পারে। ভেঙেচুরে পাল্টে দিতে পারে।

‘ভালো আছ আরতি? ভালো তো?’ উত্তরটা জানা থাকলেও আরতির মুখ থেকেই শুনতে চায় তপন। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে আরতি নির্বিকারভাবেই বলে, ‘যুদ্ধে গেলা, সবাই বলে খুব সাহস তোমার।’

‘গরিবি আর কত সহ্য হয়? বাপ-দাতারা তো চিরকাল গরিবির বশ্যতা মেনেই জীবন কাটান, যুদ্ধের কাছেই জানলাম, স্বাধীনতার কাছেই শুনলাম, গরিবিটা পাপ। তাকে প্রশ্রয় দেয়া এক মহাপাপ।’

‘আমিও জানলাম, যে পুরুষ বৌ ছেড়ে পালায় তাকে ঘৃণা করতে, তাই চোখের জলের কথা আর মনে নেই। চোখের জল আরতির পরাজয়।’

‘আরতি, তোমার বুঝি অন্য কথা নেই?’ কত কথা লুকানো থাকে মানুষের বুকে। ‘না, নেই। একদিন ছিল, আজ আর নেই। এটা তুমি বুঝ না কেন?’

তপন আর কথা বাড়াতে পারে না। আরতির এই বদলে যাওয়া তাকে অবাক করে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করে স্বামী ছেড়ে যাওয়ার এই অপমান কি করে সে সহ্য করছে? আরও ইচ্ছে হয় জানতে আরতি কেন তার বিষয়ে এত নির্বিকার। যুদ্ধ থেমে যাবার মতো আরতির যুদ্ধও কি থেমে গেছে? তপন গোলক ধাঁধায় পড়ে। তপন আরও বিস্মিত হয় এটা দেখে যে, মুখে নয়, শারীরিক ভাষায় তপনকে বিদায় জানিয়ে আরতি ঘরে ঢুকে যায়। হয়ত তপনের আরও কিছু কথা বলার ছিল কিংবা শোনার। অথচ তাকে পথে নামতে হয় এমন এক যোদ্ধার মতো যার বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে যায় যুদ্ধ অসমাপ্তই থেকে যায়, বিজয়ের চেয়ে রণেভঙ্গ দিয়ে আত্মগোপনই শ্রেয় হয়ে ওঠে।

অথচ এই আরতি তপনকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিল। সন্ধ্যায় গাঁয়ের নির্জন পঞ্চবটী তলায় হাজির হয়েছিল আরতি। তপনও এসেছিল। কিন্তু সে ছিল পঞ্চবটীর গাছের আড়ালে দাঁড়ানো। হাজার চেষ্টায়ও সামনে এগিয়ে হাত ধরতে পারেনি আরতির। মেয়েটির হাত ধরে পলায়নের ইচ্ছের হঠাৎ মৃত্যু ঘটে। সে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হঠাৎ মরুভূমির কথা মনে আছড়ে পড়ে তার। তৃষ্ণা ক্ষুধা। মরীচিকা। তারপর মরুবালিতে লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ। দুটো কংকাল। একটি নারী, অপরটি পুরুষ। শিউরে উঠেছিল তপন। এক অনিশ্চিত বিভীষিকাময় যাত্রা!

আড়াল থেকে আরতিকে তপন দেখছিল এক সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়াচ্ছন্নতার। অপেক্ষার বিষে শরীর পুড়ে যাচ্ছে একটি যুবতীর। সে কাঁদছে। চুল ছিঁড়ছে নিজের হাতে। অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে কি সব বলছে। তপন পারেনি আড়াল ভেঙে আরতির সামনে এসে দাঁড়াতে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকার যখন আরও ঘন হয়, তখন সে শুকনো পাতায় পায়ের মচমচ শব্দ শুনতে পায়। সে শব্দও হারিয়ে যায়। একটা নারী ছায়ামূর্তিকে অন্ধকার গ্রাস করে। চরাচর নিস্তব্ধ। নিশি পাখি গাছের ডালে ডালার শব্দ তোলে। বাতাস দোল খায় পাতায়। কারও দীর্ঘশ্বাস যেন নির্জনতাকে খান খান করে জমিন থেকে আসমানে একাকার হয়ে যায়।

আসমানের ওই দিকচক্রকালে কয়েকটা তারা জ্বলে। আয় তখন দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে তপন। মুখে অস্ফুট শব্দ। না। সে আরতির নাম উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু আরতি কোথায়?

সে তার একটা হাত জাপটে ধরতে চায়। নিয়ে যেতে চায় অন্য কোথাও। কিন্তু আরতি নেই। তপনকে ঘন অন্ধকার গ্রাস করে। সে যেন ওই মহাকাশের মহাশূন্যের ঘোর অন্ধকার কৃষ্ণগহবরে নিক্ষিপ্ত হয়।

রাতের দ্বিতীয় প্রহরে আকাশে চাঁদ উঠলে তপন আবিষ্কার করে সে পড়ে আছে গাঁয়ের হাই স্কুলের বারান্দায়, যেখান থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আর এগোতে পারেনি শহরের কলেজের পথে। দারিদ্র্য তার পায়ে শেকল আটকে দেয়। সেই পায়ের শেকলটাকেই ভাঙতে চায় সে আজ। গণহত্যা, গ্রামে হানাদারদের হামলে পড়া, চিরকালের ঘরকুনো গ্রাম্য মানুষগুলোর পেছনে শান্তির বেহেশত পূর্ণ কুটির ফেলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর আর সীমান্তে ছুটে বেড়ানোর স্মৃতি রক্তে মিশে গেছে। তাই আজ তপনও যেতে চায় আরবের তেলের দেশে। ওখানে মরু সাইমুমের বাতাসে উড়ে বেড়ায় পেট্রোল ডলার। ধরতে না-পারলেই জীবন অর্থহীন।

ওই তো গাঁয়ের নঈমুদ্দিনের বড় ছেলে বিদেশি জাহাজে করে সমুদ্র পারি দিয়েছে চাকরি নিয়ে। ছোট ছেলেটা শহরের কলেজে পড়তে গেছে ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়র হবে বলে। আবু বকরের দুই ছেলেই কোথায় কোন শিল্পকারখানার বাজারে মুদির দোকান দিয়েছে।

তপন শেষটায় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেখিয়ে যোগ দেয় রক্ষী বাহিনিতে। সবুজ রং পোশাক। কাঁধে চাইনিজ রাইফেল। দাঁপিয়ে বেড়ায় ডাকাত আর নকশালদের খোঁজে। তপনের বাবা রক্ষীর বাবা। বুক চেতিয়ে চলে। গাঁয়ে তার কদর বাড়ে।

এসব জানার কথার নয় আরতির। তবু কানে আসে। অবাক ঘটনা। একদিন পিতাকে প্রায় জেদ ধরেই পাঠিয়ে দেয় তপনদের বাড়ি। তপনের পিতার কাছ থেকে অনেক বলে-কয়ে নিয়ে আসে তপনের সাদাকালো একটি ফটো। তপনের পিতাও আনন্দ পায়। অনেক ছবির মধ্যে ছেলের একটি ছবি আরতির পিতার হাতে তুলে দেয়। পিতার বিশ্বাস ছেলের এই ছবি ঘরে ঘরে থাকা দরকার, জাতির পিতার মতো।

তপনের প্রতিকৃতি। সাদাকালো। লম্বা চুল। মুখভরতি দাড়ি-গোঁফ। কাঁধে রাইফেল। মুক্তিযোদ্ধা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আরতিদের মাটির দেয়ালে ঝুলছে। আয়নায় বাঁধানো। আরতি সকাল-সন্ধ্যা ছবির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পিতা-মাতা দেখে মেয়ে সেই ছবিতে শুকনো ফুলের বাসী মালা পরিয়ে দিয়েছে। যেন মৃত, বিগতকালের প্রিয় কোনো মানুষ। এমন একজন মানুষ যে প্রাচীর পৃথিবীর শেষ স্মৃতি।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *