ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব পনেরো

বিচিত্র বৈচিত্রে বাঁচো বাছা
আস্তে আস্তে জোসেফ মেঙ্গেলেজ ওয়ার্ল্ড-এর চেহারাটা স্পষ্ট হতে শুরু করে। মানুষ আর শিম্পাঞ্জির কোষ-মিলনে জন্ম নেওয়া অদ্ভুত না মানুষ না শিম্পাঞ্জি যেমন আছে, রাতের বেলায় গায়ে নীল আলো ছড়াতে পারা শূকরের মতো আলোকিত মানুষও আছে যারা আলো ছড়ানো সামুদ্রিক মাছের কোষের ভাগ পেয়েছে। এই বিচিত্র মানুষের বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আশফাকের, ও দিতে চায়ও না। খাঁচার এপাশে থাকা আশফাকের মতো পুরনো মানুষরা গবেষণার প্রয়োজনে এসে দাঁড়ায় আর বিচিত্র বৈচিত্রে ভরপুর নতুন প্রজাতির মানুষদের চোখের দিকে তাকানোর বৃথা চেষ্টা করে। কেন যেন মনে হয়, এই মানুষগুলোর চোখে যে যন্ত্রণার আঁক ফুটে ওঠে, তা প্রকাশের উপায় জানা নেই ওদের। আশফাকের মতো পুরনো মানুষরা তো ভাব প্রকাশের কায়দা শিখে ফেলে হেসেছে, হাউমাউ করে কেঁদেছে। এরা কি সেরকম পারে? না মানুষ না শিম্পাঞ্জি খিদের যন্ত্রণায় কি করবে বুঝে উঠতে পারে না, মানুষের মতো পেট চেপে ধরে পেটে পাথর আছে কি না দেখতে পারে না, আবার শিম্পাঞ্জির মতো বুকে চাপড়ও মারতে পারে না। বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনের জন্য পরিবেশের সাথে হাজার বছরের খাপ খাওয়ানোর কাজ তো এরা করেনি, দুই প্রজাতির তথ্য ওদেরকে বিভ্রান্ত করে রাখে। ওরা কিছুই হতে পারে না। হয়তো হবে কোন একদিন। যদি সে সুযোগ ওরা পায়।
সুযোগ পাওয়াটাই আসলে বড় ব্যাপার। নতুন প্রজাতিগুলোর উপর নানা রকমের পরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষার ধাক্কায় দেদারছে মরে ওরা। এরকম এক মৃতপ্রায় হাতিমানুষকে নিয়ে ঘটে গেল অন্য রকমের ঘটনা।
বছর দেড়েক বয়সী হাতিমানুষ শিশুটির সারা শরীরে ক্ষত ছিল। কোন্ ধরনের ওষুধের পরীক্ষা ওর উপর হয়েছে, বলা সম্ভব নয়। নানা ধরণের পরীক্ষা হয়েছে, কোনটায় কি হ’ল সাদা চোখে দেখে কি বোঝা যায়? হেঁচকি তুলতে থাকা শিশুটি শুঁড় উঁচিয়ে কুঁই কুঁই করছিল। ওর গায়ে ভেজা তোয়ালে দিয়ে আরাম দেওয়ার জন্য পাঠানো হ’ল সম্পুর্ণ মানুষ এক নারীকে। এই নারীও বন্দী, ডিম্ব কোষ দেওয়ার জন্য একে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নারী যখন শিশুটির গায়ে হাত রেখেছিল, তখন কিরকম চমকে উঠেছিল ওটা। নারী কোমল ভাবে হাত বুলিয়ে হাতিমানুষটার মাথায় আদর করছিল। এক সময় ওটাকে কোলে তুলে নিল। বুকে চেপে ধরল পরম মমতায়। নারীর বুকে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল বেচারা। ওখানেই মৃত্যু হ’ল ওর।
এই নারীর ডিম্ব কোষ আর পুরুষ হাতির স্পার্ম নিষিক্ত করেই নাকি জন্ম দেওয়া হয়েছিল হাতিমানুষ শিশুটিকে। নারী এসব জানে না, হাতিমানুষ শিশুটিও জানে না কিছুই। কিন্তু বুকের গভীরে টান টের পেয়েছিল দু’জনই। মানুষের বা হাতিদের ভালবাসার ক্ষমতা আছে, এই ক্ষমতা এক হয়ে গিয়েছিল না মানুষ না হাতিটির মাঝেও।
হাতিমানুষ শিশুটির জন্য হাহাকার করে কেঁদেছিল সেই নারী। ওকে কোথাও সরিনয়ে নেওয়া হ’ল বলে আশফাক আর বেশি কিছু জানতে পারল না। এর পর পরই ওকেও অবশ্য সরিয়ে আনা হয় অন্য সেলে। নারীর ডিম্ব আর স্পার্ম থেকে ভ্রুন তৈরি করার পর কি হচ্ছে ও জানতে পারছিল না। এই সেলে আসার পর খানিকটা আন্দাজ করতে পারল।
ভ্রুনের জেনেটিক গঠনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইচ্ছে মতো মানুষ তৈরির কাজ চলছে।
ইচ্ছে মতো! নীতি নৈতিকতার কোন বালাই থাকবে না?
কেন থাকবে না? জোসেফ মেঙ্গেলজ ওয়ার্ল্ডে এই নীতি নৈতিকতা নির্ধারণ করেন যিনি, তিনি সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরের কেউ, গাদা গাদা জোসেফ মেঙ্গেলে তার ঠিক করে দেওয়া নিয়মে বাকি কাজ করিয়ে নেয়। কাজ করানোর জন্য যাকে ওদের দরকার, তাকে দিয়েই কাজ করায়। করিয়েই নেয়।
আশফাককে দিয়ে যেটুকু হওয়ার কথা, সেটুকু ওরা করিয়ে নিয়েছে। খুব বেশি দিন এখানে থাকতে হবে না বলে মনে হচ্ছে ওর। এরপর হয়তো ওকে মেরে ফেলা হবে। আসলেই কি করা হবে, সে সিদ্ধান্তের জন্য জোসেফ মেঙ্গেলে-রা অপেক্ষা করছিল সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরের সেই একজনের জন্য। সেই একজন কে, তা জানা হয়নি আশফাকের, আরিয়ানা রিস্তা বা অন্যদের। তবে, কেউ একজন তো আছে আসলেই।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব চৌদ্দধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব ষোল >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *