অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১০ম-পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।। ১ম পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।২য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৩য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।৬ষ্ঠ-পর্ব
- অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।।৫ম- পর্ব
- অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৭ম- পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৮ম পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৯ম- পর্ব
- অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১০ম-পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১১-পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১২তম-পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। শেষ-পর্ব
পা দুলিয়ে আবার গাইতে আরম্ভ করে- একটা ছাগল বান্ধা ছিলো গাছেরও তলায় গো, গাছেরও তলায়- সুরের রেশ শেষ হতে না হতেই দরজা থুলে যায় রুমের মধ্যে প্রবেশ করেন মাকসুদা বেগম, তার পেছনে আলী আহসান।
পা নাচানো থামিয়ে সোজা হয়ে বসে আবদুল মান্না ভূঁইয়া তাকায় আগন্তুকের দিকে-বসুন। পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসেন মাকসুদা বেগম এবং আলী আহসান। থানা আদালত পুলিশ এদের অনেক গল্প দূর থেকে শুনেছেন- পুলিশেরা পোশাকা পরলে আর মানুষ থাকে না, পুলিশ নামে একদল ইতর প্রাণীতে রূপান্তির হয়। কিন্তু এখন জীবনের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে পুলিশেন খাঁচায় ফুকতে হয়েছে।
বলুন- কি করতে পারি আপনাদের জন্য? জানতে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া।
আমার হাজব্যান্ড গতকাল থেকৈ বাসায় ফিরে আসেনি- হতাশ গলায় কথা বলেন মাকসুদা বেগম।
কেন?
সেটা জানলে আপনাদের কাছে আসতাম না- নিশ্চয়ই।
রাইট। মাথা নাড়ে দারোগা-রাইট, কার্যকরণ জানলে কেন আমাদের কাছে আসবেন? তো আপনার হ্যাজবেন্ড করেন নি?
সরকালি কলেজের প্রফেসার-
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কোন কলেজে পড়ায় এখন?
জয়পুরহাটে।
নাম?
অধ্যাপক আলী আসগর।
কখন কীভাবে কোথায় গিয়েছিলেন- ওনার বন্ধুবান্ধব কে কোথায় কি করেন-বিস্তারিত বলুন তো-
মাকসুদা যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে আস্তে ধীরে অধ্যাপক আলী আসগরের অন্তর্ধান বিষয়ে কথা বলেন।
সব শুনে দারোগা আবদুল মান্নান ভূইয়া মাথা নাড়ায়- না না। ব্যাপারটা যত সহজে বলছেন, আসল ব্যাপারটা তত সহজ নয় বলে মনে হচ্ছে। একজন বয়স্ক শিক্ষিত মানুষ-বলা নেই কওয়া নেই বাসা থেকৈ বের হয়ে যাবে, আর ফিরে আসবে না। উনি বাসা থেকে কি ঝগড়া করে বের হয়েছেন?
টেবিল খামচে ধরেন মাকসুদা বেগম- উনি ঝগড়া করবার মানুষ নন।
তাহলে?
তাহলে মানে?
এই রকম শান্ত একজন মানুষ হঠাৎ হারিয়ে যাবেন কেন?
মা? এতোক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল আলী আহসান- সত্যি কথা বলো। লুকিয়ো না কোনো কিছু-
দারােগা ফিরে তাকায় আলী আহসানের দিকে, আহসান দারোগার চোখে চোখ রেখে বলে- দেখুন, আমাদের বাবা খুব শান্ত, নিরীহ একজন মানুষ। সারাজীবন বই নিয়ে কাটিয়েছেন। যখনই সময় পেয়েছেন- বই নিয়ে বসেছেন।
কি ধরনের বই?
হরেকরকমের বই-গল্প, উপন্যাস-কবিতা-নাটক,সঙ্গীত, রাজনীতি সমালোচনা-সব ধরনের বই তিনি পড়েন। বলা যায় বইয়ের পোকা তিনি। কিন্তু আমাদের মা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে বাবার উপর চটে থাকতেন। হ্যাঁ, প্রায় সবসময়ই। কারণে-অকারণে গালাগাল করেন। যেদিন বাবা চলে যান বাসা থেকে, সেদিনও মা অকথ্য গালঅগাল করেছেন তাঁকে। হাড়িপাতিল আসবাবপত্র ভেঙেছেন ঘরের। কিন্তু-
দারোগা তাকিয়ে থাকে আলী আহসানের মুখের দিকে- পাশে মাকসুদা বেগম নিশ্চুপ বসে থাকেন, শ্বাস-প্রশ্বাসনের শব্দও শোনা যায় না- এতোটাই স্থির পাথর তিনি। তার সাম্রাজ্য কি ভেঙে পড়ছে? টলটল অশ্র“বিন্দুর মতো? যে ছেলে মেয়ে তার মুখের উপর কথা বলতে সাহস পেত না, সেই পুত্র আজ দারোগার কাছে, তারই সামনে বসে… মাকসুদা বেগম হতভম্ব। জগৎ-সংসার বুঝি আজ উল্টো পায়ে হাঁটছে-তিনি ভাবছেন। মাথার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। খুব কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছেন দাঁতে দাঁত চেপে মাকসুদা বেগম।
হ্যাঁ বলুন, থামলেন কেন? দারোগা টিপ্পনী লাগায়।
বুঝলেন অফিসার-আগেও আমরা দেখেছি, মা কথা বলতে আরম্ভ করলে বাবা বাইরে চলে যেতেন, আবার ঘন্টা তিনেক পর ঠিকই বাসায় ফিরে আসতেন এবং আমাদের নিয়ে তাস খেলতে বসে যেতেন।
তাই?
কিন্তু এবারের মতো কখনও এতো দেরি করেন নি। আমরা খুব শংকিত-
হাসপাতালে খোঁজ -খবর নিয়েছে?
জ্বী না।
তাড়াতাড়ি হাসপাতালে খোঁজ নিন। আর আপনার বাবার একটা ছবি দিয়ে যান। আমরা সর্বাত্মন চেষ্টা করব আপনার বাবাকে খুঁজে বের করতে জীবিত অথবা- থেমৈ যায় দারোগা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। থমথমে মেঘে আক্রান্ত মুখের মধ্যে কথা আটকে ফেলে দারোগা মান্নান ভূঁইয়া। তার কুচকুচে চোখে দিকে মাকসুদা বেগম এবং আলী আহসান বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দারোগার মাথাটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখে এবং মনে মধ্যে গানটা ফিরে আসে-দীনের নবী মোস্তফায়…।
বছর দশেক আগে, এই এলাকায় তাদের বাড়িটাই ছিল সবচেয়ে বড়। দক্ষিণমুখী বিরাট দোতলা র্ঘ দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। অধ্যাপক আলী আসগরেরা চার ভাই, দুই বোন। বোনদের বিয়ে বাবা মাহবুব আলমই দিয়ে গেছেন। তাদের সংসারে এখন ছেলে-মেয় নিয়ে দুই বোনের ভালোই আছে। তিনি কনিষ্ঠ সন্তান। বড় তিন ভাই;র মধ্যে মেজটা একটা খচ্চর, স্বার্থপর, অত্যন্ত নীচু শ্রেনীর মানুষ। গ্রামীণ নস্ঠমানুষদের একজন- মেজো ভাই বরকত আলী।
বাবা মারা যাওয়ার বছরখানের মধ্যে সব জায়গা-জমি ভাগ-বাটােয়ারা করার ব্যবস্থা করে সে। একেবারে বড় ভাই ঢাকায় চাকরি করে। সেজোটা থাকে খুলনায়- মেজো বরকত আলী কুমিরের ক্ষুধার সবটা নিজের অধিকারে নেয়। আসগর যখন নবম ম্যেণীতে পড়ে তখন বাবা মারা যায় হঠাৎ। তারপর থেকে সবটুকু নিজের অধিকারে নেয় বরকত আলী। ইতোমধ্যে জীবন থেকে কত ফালগুন মাস আগুন ঝরিয়ে চলে গেছে- জীবনে এসেছে কত পরিবর্তন-চিন্তাই করা যায় না। আসলে সব সুখের মেছো ভাই বরকত আলীর মতো দু’একটা অশুভ শক্তি থাকেই, নইলে জীবন এত বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরে উঠবে কেন? বাবার রেখে যাওয়া বড় ঘরটা ভেঙে নিজের মতো করে ছোট ঘর উঠিয়ে নিয়েছে। শহর থেকে এসে কোনো ভাই দু’একবেলা ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকবে, উপায় নেই। খুলনার ভাই চাকরি শেষে চলে এসেছেন গ্রামে। বড় ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়- সংসারের অনেকগুলো পোষ্য তাঁর। এসব মিলিয়ে সব পানি আবার এসে জমছে গ্রামে।
অধ্যাপক টুনটুনি পাখি উড়ে এসে বসলেন মেজো ভাইয়ের টিনের চালে। তিনি বুঝতে পারছেন না রাত ক’টা বাজল? সন্ধ্যা না গভীর রাত? নিঝুম রাত? নিঝুম গ্রাম। অথচ অবাক ব্যাপার-মেজো ভাইয়ে ঘরের সামনের ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। তিনি লোকজনেরও আভাস পাচ্ছেন। ভেসে আসছে টুকরো টুকরো কথার শব্দ। কারা কথা বলছে? কি কথা বলঝে? মেজো ভাই বরকত আলীর গলার শব্দ শোনা যায় স্পষ্ট ভাবে। এমনিতেই অধ্যাপক টুনটুনির কৌতুহলের সীমা নেই। তিনি পাখি হয়ে দেখতে এসেছেন জন্মস্থান, আঁতুরঘর। সবাইকে দেখবেন তিনি কিন্তু কেউ তাকে দেখবে না। দেখলেও দেখবে ছোট্ট একটি টুনটুনি পাখিই। তিনি, অধ্যাপক আলী আসগর- টুনটুনি পাখি উড়ে এসে জানালার আড়ালে বসলেন। ভেতরে উঁকি দিরেন। মজার কাণ্ড-বড় তিনভাই একত্রে বসে কথা বলছে। ধরণ ধারণ দেখে বোঝা যাচ্ছে- খুব সিরিয়াস কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে। খটকা লাগে টুনটুনি পাখির-যদি সংসার বা বাড়ির জায়গাজমি নিয়ে কথাবার্তা হয়-তাহলে তাকে খবর দেয়া হল না কেন?
মেজো ভাই বরকত আলীর স্ত্রী পারভীন ঘরের ভেতর থেকে খাবার নিয়ে আসে। গরম ভাত-মুরগীর মাংস। সবাই হাত ধুয়ে খেতে বসে। অধ্যাপক টুনটুনি’র পেটের মধ্যেও ক্ষুধাটা প্রবলভাবে সাড়া দিয়ে ওঠে। সারাটা বাড়ি মুরগীর মাংসের বুনো গন্ধে মৌ মৌ করছে।
মুখের ভাত চিবোতে চিবোতে কথা বলে মেজো ভাই- যে খুলনায় থাকত-সবই বুঝলাম, মেজো ভাই- তোমার ছেলেমেয়ে বেশি, লেখাপড়া শেখোনি- কিন্তু লেখাপড়া করতে তো তোমাকে কেউ নিষেধ করেনি? বাবা তো অনেক চেষ্টা করেছিলেন তোমাকে নিয়ে-
হ্যাঁ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু লেখাপড়া আমার ভালো লাগেনি, তাই করিনি। আমি ভেবেছি আরো চার ভাই সবাই যদি লেখাপড়া করে শহরে চলে যায়- আমাদের সম্পত্তি বাড়িঘর তো একজনকে সামলাতে হবে। আমিই না হয় দেখব-একটানা কথা বলে থামে বরকত আলী।
কিন্তু মেজো ভাই- তুমি আলী আসগরকে অপছন্দ করো আবার ওর সম্পত্তি দখলে রাখতে চাও- এটা কেমন কথা?
মুখে ভাত আটকে যায় রবকত আলীর। পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী পারভীন পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়, ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি পান করে বরকত আলী- আমি তাকে অপছন্দ করি না- অপছন্দ করি ওর বৌকে। ওর বৌটা আমাদেরকে মানুষ মনে করে না। গ্রামের মানুষ বলে অবজ্ঞা করে-০
বড় ভাই এতক্ষণ চুপচাপ ভাত খাচ্ছিলেন- তিনি মুখ খুললেন- আলী আগসরের বৌটা খারাপ না, মনে হয়। মাকসুদার স্বভাব সত্যি কথাটা মুখের উপর বলা। যেমন তুই সারাটা জীবন আলী আসগরের জমি ভোগ করছিস, ঢাকায় ওর বাসায় জীবনে এককাঁদি কলা, একটা নারকেল পাঠিয়েছিস?
বড় ভাই! অবাক কণ্ঠে কাতরভাবে বলে বরকত আলী-নিজের তো হয় না- পাঠাব কেমন করে? এতগুলো ছেলেমেয় আমার। কোনোভাবে দিন চলে যায় আর কী!
হাসেন বড় ভাই- মানুষের স্ভভাবটাই এমন-যা পায়, ভোগ করে। মনে করে সবটাই তার। যদি আলি আসগর শহরে না থেকে গ্রামে থাকত, তাহলে? ওই সব ধানাই-পানাই বাদ দে, যার যার সম্পত্তি তার তার কাছে ফেরত দিয়ে দে। আমি তো আগামী বছর গ্রামে এসে থাকব, বাড়িঘর তুলব। বাড়ির কাছ দিয়ে ঢাকা শহর থেকে সরাসরি বাস আসা-যাওয়া করে-শহরে থেকে আর মজা পাই না- খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায় বড় ভাই। তার সঙ্গে সেড়ো ভাইও চলে যায়। সামনে শূন্য ভাতের থালা নিয়ে একা বসে থাকে বরকত আলী। ঘরের ভেতর থেকে আসে পারভীন।
কী হল? বসে আছো কেন? তুমি ভেবেছো ভাইরা তোমার পক্ষ নেবে? পডারভীন রাগতভাবে সামনে বসে- পেট ভরে খেয়ে গেল আর যার যার জায়গা জমিন তাদের ফেরত দিতে বলে গেল। নাও-তার ধোও- পারভীন পানির গ্লাস বাড়িয়ে ধরে।
হাত ধুতে ধুতে আপন মনে কথা বলে বরকত আলী- তাই বলে আমার আপন ভাইয়ের আমার পক্ষে থাকবে না? তারা পক্ষ নেবে সৎ ভাই আণী আসগরের?
আমার বড়ভাই তো তোমাকে আগেই বলেছিল-বুদ্ধি দিয়েছিল তুমি তো শুনলে না?
দেখো একটা মানুষকে খুন করা হল সবশেষ ধাপ। খুন না করেই যদি আলী আসগরের সম্পত্তি আমার দখলে আসে, সেটাই কি ভালো নয়?
কীভাবে দখল আসবে শুনি?