উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৩য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।। ১ম পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।২য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৩য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।৬ষ্ঠ-পর্ব
- অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।।৫ম- পর্ব
- অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৭ম- পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৮ম পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৯ম- পর্ব
- অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১০ম-পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১১-পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১২তম-পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। শেষ-পর্ব
চারদিরটা লেলিহান আগুনের শিখায় উজ্জ্বল। একজন পুলিশ কনস্টেবল দৌড়ে একটা টেলিফোন কক্ষে ঢুকে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করবার জন্য।
অধ্যাপক টুনটুনি পাখি বিষণ্ণ মনে যাত্রাবাড়ি ওভার ব্রীজের কার্নিশ থেকে আবার আকাশে ডানা মেলেন। রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। উড়তে উড়তে অধ্যাপক টুনটুনি পাখি দেখতে পান একটি রিকশায় তার বন্ধু নজরুল কবীরকে। হঠাৎ অধ্যাপক টুনটুনির মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। সে ভয় দেখাতে চায় নজরুল কবীরকে। দ্রুত আকাশ থেকে নেমে আসে তীব্র গতিতে নজরুল কবীরের কাছে। কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে নিমেষে উড়ে যায়। হতভম্ব নজরুল অবাক চোখে এদিক ওদিক তাকায়। কিছু সে দেখতে পায় না। অন্ধকার আকাশে ডানে বামে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, না, তার দৃষ্টিতে কিছুই পড়ছে না। হয়তো কোনো ভুল হয়েছে তার। আবার রিকশায় আরাম করে পায়ের ওপর পা তুলে বসে। কিছুক্ষণ আগে ঝুমকার ঠোঁট রেখে আসা শেষ চুমুটার স্বাদ আপনমনে উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই আবার অধ্যাপক টুনটুনি পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ে নজরুল কবীরের উপর। মাথার খাড়া এবং ঝাঁকড়া চুলে টুনটুনি পাখিটি রেখে যায় তার তীক্ষ পায়ের নির্মম আঁচড়।
কর্কশ কন্ঠে নজরুল দু’হাতে মাথা সামলাতে থাকে- আরে! এসব কি হচ্ছে?
মধ্যবয়স্ক রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে চালাতে ফিরে তাকায়- কি অইচে? চিল্লান ক্যান?
একটা পাখি-
পাখি?
হ্যাঁ।
রিক্সাঅলা অবাক হয়ে হাল্কা ফ্যাকাশে হলুদ আলো আঁধারির মধ্যে চারপাশে তাকায়- কই পাখি?
এই তো এইখানে ছিল-
কি করতাছে আপনারে?
বারবার আমার মাথার উপর চক্কর দেয়। মাথায় নখ বসিয়ে দিতে চায়
রিকশাওয়ালা খিক খিক শব্দে হাসে- বুজছি!
কি বুঝছো!
আপনে বিয়া করছেন?
বুদ্ধিজীবী টাইপের মানুষ নজরুল কবীর রিকশাওয়ালার কথার উত্তর দেয় গম্ভীর কন্ঠে- না
তাইলে সিগগীর আপনের বিয়া অইবে।
কেমনে বুঝলা?বিয়ার সময় মাইনষের মাথার উপর পাখি দেখতে পাওয়া যায়। আচ্ছা কনতো পাখিটার রঙ কি? কাল?
তোমাকে এসব কে বলেছে? রঙ তো দেখিনি
রিকশাওয়ালা রসিক হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে জবাব দেয়- বুঝলেন না স্যার! গেরামে আমরা মুরুব্বীর মুহে শুনচি-
তুমি শুনছো আমার বালডা- মনে মনে গালি দেয় নজরুল কবীর রিকশাঅলাকে।
রিকশা এসে থামে জুরাইন রেলগেটে। নজরুল রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে আবার চারপাশটা ভালো করে দেখে বাড়ির রাস্তা ধরে। মাথার উপর অধ্যাপক টুনটুনি উড়ছেন আর ডানা ঝাপটাচ্ছেন। মুখে তার অনাবিল হাসি। নজরুল কবীর যদি জানতে পারত- পাখিটি কি এবং কে- ওর হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যেত। বড় অদ্ভুত মানুষ এই নজরুল কবীর। ঢাকা শহরে প্রবেশের পর পরই নজরুলের সঙ্গে হঠাৎ পরিচয়। সেই পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। দীর্ঘ সাতাশ-আঠাশ বছরেও সেই বন্ধুত্ব অটুট। মাঝে-মধ্যে যে সম্পর্কের টানাপোড়ন হয়নি- এমনও নয়। অধ্যাপক টুনটুনির মনে পড়ে যায়- যখন কলেজে পড়তেন, সেকেন্ড ইয়ার ইন্টামিডিয়েটে, সিদ্ধেশ্বরী কলেজে, থাকতেন রামপুরার উলন রোডে মসজিদ মেসে। মাঝে মাঝে রাত ন’টা, দশটায়- এমনকি বারোটায়ও মেসে এসে হাজির হত নজরুল কবীর। হালকা পাতলা গড়ন। চওড়া মুখ। সাদা সারিবদ্ধ দাঁত। অতোটুকু পুঁচকে শরীর কাঠামোর ভেতর থেকে কথা বের যথেষ্ট উচ্চগ্রামে। ব্যাকরণসম্মত শাণিত উচ্চারণ। তারপর দুজনে মিলে রাতভর আড্ডা। মসজিদের ছাদে উঠে রাতে আকাশে ঝুলন্ত চাঁদ দেখা আর গল্প বলা, স্মৃতির নদীতে স্মৃতির নৌকো ভাসানো ছিল তাদের অভ্যাস। সাম্প্রতিক সময়ে এক খ্যাতনামা সাংবাদিকের মেয়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা বলত। একবার নজরুল কবীর রাত বারোটার দিকে প্রস্তাব করে- চল, রাস্তায় ঘুরে আসি।
হঠাৎ এ্যাডভাঞ্জেরার গন্ধে আলী আসগর রাজি হয়ে যান। রুম থেকে জামাটা নিয়ে লুঙ্গি পরেই দু’জনে রাস্তায় নামে। মেসের দু’জন বন্ধু কিবরিয়া আর মাহমুদও তাদের সঙ্গী হয়। উলন রোড থেকে রামপুরার মেইন রোডে উঠে হাঁটতে দেখতে পায়- একটি চায়ের দোকান। চারজনে বসে চা খায়। গল্প করে। পাশ দিয়ে কয়েকজন ভাসমান শরীরশিল্পী চলে যায়। যেতে যেতে তাকায় ওদের দিকে। ওরাও তাকায়। মাহমুদের এইসব ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ। সে ধনুকের ঢংয়ে উঠে দাঁড়ায়।
হাত ধরে বসিয়ে দেয় আলী আসগর- পকেটে টাকা আছে?
না।
তাহলে যাচ্ছো কোন সাহসে? শেষে এতমাত্র সম্পদ বলতে নুনু, সেটাও কেটে রেখে দেবে ওরা।
তখন তোর অবস্থাটা কি হবে- ভেবে দেখেছেন? প্রশ্ন করে কিবরিয়া।
ষাঁড় না আবাল গরুদে রূপান্তরিত হবি- বলে আলী আসগর।
তখন একলা একলা গান গাবি- নাই টেলিফোন, নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম- মন্তব্য করে আলী আসগর।
বয়স্ক চায়ের দোকানদার ফোঁকলা দাঁতে হাসে। তার সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় অন্যরা। ভাসমান শরীরশিল্পীরা হতাশ হয়ে চলে যায়।
হঠাৎ মাহমুদ প্রশ্ন করে আলী আসগরকে- তোর কোনো অভিজ্ঞতা আছে?
কোন ব্যাপারে?
এই যে নুনু কাটার ব্যাপারে?
না। তবে একটি ঘটনা জানি।
কি ঘটনা?
শুনবি?
কিবরিয়া খুব আগ্রহী হয়ে ঘনিষ্টভাবে বসে-বল।
ঘটনাটা বলার জন্য কেবল মুখ খুলছে ঠিক তখনই পাশে পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামে। আলী আসগর, নজরুল কবীর, কিবরিয়া, মাহমুদ স্বাভাবিক। কারণ ওরা ওদেরকে চেনে। সবাই খেটে খায়। পড়াশোনা করে। কিবরিয়া কেবল ব্যতিক্রম। সে মেসের কাছেই বড় ভাইয়ের বাসায় খায়। মেসে ঘুমায়, আড্ডা দেয়। পুলিশের এস আই মৃণাল কান্তি দাস এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। পেছনে আরও তিন-চারজন পুলিশ।
আপনারা এত রাতে এখানে কি করছেন?
হঠাৎ এস আই দাসের প্রশ্নে প্রত্যেকে নির্বাক। কে কি বলবে- বুঝদে পারছে না। আর এই রকম পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।
খুব সাহসী বলে নিজেকে উপস্থাপন করবার এতট াপ্রবণতা আছে নজরুল কবীরের। সে উঠে দাঁড়ায়- আমরা একটু আড্ডা দিচ্ছি।
এস আই মৃণাল কান্তি দাসের চোখ কপালে, তাকায় ঘড়ির দিকে- রাত একটা ঢাকা শহরের নির্জন রাস্তায় আড্ডা দিচ্ছেন?
জ্বী।
কেন? কাজ নেই?
মাহমুদ উঠে দাঁড়ায়- আসলে আগামীকাল তো ছুটির দিন, সারাদিন টিউশনি করি তো, আড্ডা দেয়ার সময় পাই না- তাই-
মৃণাল কান্তি দাসের বোধহয় একটু মায়াই হল- ঠিক আছে, বাসায় চলে যান।
যাচ্ছি।
এস আই মৃণাল গাড়িয়ে উঠবার জন্য এক পা বাড়িয়েছেন, নজরুল কবীর চা ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে- চাচা আরও চার কাপ চা বানান, তাকায় মৃণালের দিকে- চা টা খেয়েই চলে যাব।
নজরুল কবীরের কন্ঠে এবং কথায় এক ধরনের অহংকার প্রকাশ পাচ্ছিল। মৃণাল হঠাৎ স্থির দাঁড়িয়ে যায়, মৃণালের পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবল, বুকের ব্যাজে যার নাম আইয়ুব খান- সে কানে কানে একটা কিছু বলে। মৃণাল সামনে আসে, মুখে কাঠিন্য- চা পরে খাবেন, আগে গাড়িতে উঠুন।
চারজনের মাথায়ই মধ্য রাতে বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত বর্ষিত হয়- এবং চারজনই হঠাৎ একই সমতলে দাঁড়িয়ে যায়। সবার চোখ-মুখ ফ্যাবাশে। কিবরিয়া হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। পেটের মধ্যে ডালে চালে পায়খানায়-প্রশাবে একটা ওলট পালট খিচুরি তৈরির অস্বাভাবিক ঘোটাঘুটির শব্দ পায় সে। জারে কিবরিয়া- পুলিশ, যদিও জনগণের বন্ধু বলে একটা তথাকথিত কথা প্রচলিত আছে, কিন্তু মনুষ্য সমাজে মানুষের তৈরী এমন আন্তরিক হন্তারক শত্র“ আর হয় না। একবার ধরে ঢুকাতে পারলেই কর্ম সাবাড়।
মাহমুদ হতভম্ব, কোথা দিয়ে কি ঘটতে যাচ্ছে? কেন ঘটতে যাচ্ছে! কাল সকালে ধানমন্ডি যাওয়ার কথা আছে একটা চাকরির ব্যাপারে, দেশীয় একজন সরকারি আমলার সঙ্গে দেখা করতে। তার বাসায় খালি হাতে তো যাওয়া যাবে না- চাকরি হোক তার না হোক অন্তত তিন চার কেজি মিষ্টি তো নিতে হবে। যে কারণে বহুকষ্টে পাঁচশ টাকা যোগাড় করেছে। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যাই হোক- সেই পাঁচশত টাকার চকচকে নোটটা আবার প্যান্টের পকেটে আছে। টাকাটা কি নিয়ে যাবে পুলিশ- অথবা জনগণের তথাকথিত বন্ধুরা? তার শরীরে ঘাম দেখা দেয়।
আলী আসগর নিশ্চুপ। সে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে মাত্র। আবার চা দোকানদারের সঙ্গে পুলিশ নামক হায়েনাদের কোনো যোগসাজশ নেই তো? পুলিশে ধরলে টাকা পেলে কিছুটা উচ্ছিষ্ট পায় হয়তো এই টুপি মাথায় লেখা রয়েছে- যদিও বিসমিলাহ স্টোর! চা দুধ কলা মুড়ি মুড়কি বিক্রি হচ্ছে। পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা, বিনা পুঁজিতে পুলিশের সঙ্গে দহরম মহরমের কারণে ট্যাকে আরও কিছু আসছে হয়তো তার! নজরুল কবীর সামনে যায় মৃণালের-কণ্ঠে এবার কিছুটা অনুরোধ-দেখুন, আমরা কোনো খারাপ ছেলে নই-
কথা কম বলেন- এস আই মৃণাল কান্তি দাসের কন্ঠে রুক্ষতা- যা বলছি, তাই করুন। নইলে-
ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে থাকা লোকজনের মুখে উচ্চারিত ‘নইলে’ শব্দটি বহুমাত্রিক রূপ অর্জন করে। অগত্যা মধুসূদন চারজনই পুলিশের গাড়ির পেছনে উঠে বসে। গাড়ি ছেড়ে দেয়। সময় এবং পরিস্থিতি আশ্চর্যভাবে কেটে যাচ্ছিল। ভেতরে আর কয়েকজন পুলিশ, দু’একজন শিকার মানুষও ছিল। নজরুল কবীর, কিবরিয়া, আলী আসগর, মাহমুদ কেই কারো দিকে তাকায় না। চুপচাপ পাশাপাশি বসে আঝে, যেন ধ্যান করছে সবাই। গাড়ি ছুটে চলেছে, ছুটছে। মাঝে-মধ্যে কেউ কেউ ঘুমিয়ে গেছে। ঘুম ভাঙল, তখন ফজরের আজান হচ্ছেম চারদিকে। গাড়ি দাড়িয়ে আছে কমলাপুর রেল স্টেশনে। একজন কনস্টেবল এসে ওদের চারজনকে নামতে বললে- ঘুম জড়ানো চোখে, হাই তুলতে তুলতে নামে। নেমে দাঁড়াতেই কনস্টেবল বলে- স্যার আপনাগো সোজা বাসায় যাইতে কইচে।