উপন্যাস

উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।। ১ম পর্ব

পলক মাত্র, অধ্যাপক আলী আসগর, যার বয়স প্রায় ষাট বছর, ওজন- সত্তুর কেজি প্রায়, দেখতে দেখতে, মাতাল বাতাসের ঘূর্ণিপাকে পচিঁশ গ্রাম ওজনের একটি টুনটুনি পাখিতে রূপান্তরিত হলেন। তিনি বিপন্ন বিষ্ময়ে কয়েক মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে রেললাইনের উপর দাড়িঁয়ে রইলেন। মানুষের অস্তিত্বে বিলীন হয়ে তিনি সত্যি একটা পাখি! এতোটা হালকা! পুরো ব্যাপারটা মেনে নিতে নিতে তিনি ডানা ঝাপটাতে লাগলেন, সঙ্গে পুচ্ছ নাচতে লাগল তাঁর। ঘটনাটা এত অলক্ষ্যে ঘটেছে যে কোনো সাক্ষী নেই। এক অশরীরি অলৌকিক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে তার মনে, ভাবনার জগতে।

ফাল্গুন মাস শেষের প্রান্তে, চৈত্র আসছে প্রায়, আকাশে বাতাসে প্রকৃতিতে সবুজে মৃদু মসৃণ হাওয়া, কাঁপন লাগে পত্র পল্লবে। এই রকম সুশোভিত এক নিটোল বর্ণাঢ্য দুপুরে, বিষাদগ্রস্ত অধ্যাপক আলী আসগর এসে বসলেন রেললাইনের উপর দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে বিষণ্ণ মনে। ঢাকা শহরের উপকন্ঠে, বুড়িগঙ্গার তীরে ক্রমশ বর্ধিষ্ণু এলাকা জুরাইন। এখানে চোর বদমাশ গুণ্ডা-মাগী-কেনা বেচার দালাল, খুনী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, সবই আছে। সবাই আছে। আবার এখানে নিরীহ গোবেচারা দিনমজুর, রিকশাঅলা, দোকানের ছাপোষা কর্মচারী- তারাও আছে। থাকতে হয়। জুরাইনে যেমন উঠতি টাকাওয়ালার বিশাল অট্টালিকা-শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ আছে-তেমনি আছে পঁচা দগদগে মলমূত্রের পানির উপর চটের বেড়ার ঘর। আর এদের সংখ্যাই বেশি।

অধ্যাপক আলী আসগর এই দুইয়ের মাঝখানের মানুষ। যাদেরকে বিদগ্ধজন, অর্থনীতিবিদরা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বলতে ভালোবাসেন। অধ্যাপক আসগর এই দুই শ্রেণীর কোন শ্রেণীতে পড়েন সেটা অবশ্য যথেষ্ট বিবেচনার বিষয়। তাঁর স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো, অনেক মেদবহুল। মুখটা চৌকা, চোখ দুটো ভাসমান আকারে বেশ বড়। স্বভাবে যথেষ্ট বিনয়ী, অহংকারহীন মানুষ। কথা বলেন নরম স্বরে ও সুরে। তিনি সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। সমাজ এবং বিজ্ঞানের দুটো পরস্পর বিষয়কে একটি সমান্তরাল সরলরেখায় স্থাপন, প্রতিস্থাপনের মধ্যে দিয়ে তিনি অধ্যাপনার পেশাকে যথেষ্ট উচ্চমানে নিয়ে গেছেন। দেশ-বিদেশে তার প্রচুর ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে আছে।

কিন্তু তার স্ত্রী মাকসুদা বেগমের স্বভাব-চরিত্র ঠিক বিপরীত। মাকসুদা যখন কথা বলেন চারপাশের বাতাসও ভয় পেয়ে যায়, অথবা ভয়ে কাঁপতে থাকে- এতো তীব্র, স্বরগ্রাম এতো উঁচু! চেহারার মধ্যে প্রাচীনকালের একটা নৈব্যেক্তিক ভাঁজ এবং ভাব-যা অনেক সময় প্রিয় মানুষজনদের কাছে দুর্বোধ্য করে তোলে তাকে। পান খান অনবরত। মোটা ঠোঁট জোড়া লালে লাল-টইটম্বুর। স্বাস্থ্য মাঝারি মানের। হাসিটা এখনও ঢেউ ওঠে। শরীরের গাথুঁনী চমৎকার। আর রঙ? রঙিন সাদা। মনে হয় ইউরোপের জাতক। সারা অঙ্গে একটা ঢেউ খেলানো নিপাট সৌন্দর্য চকচক করে।

দুপুরে স্ত্রী মাকসুদা বেগমের কাছ থেকে তীব্র স্বরগ্রামের মর্মান্তিক গালিগালাজ খেয়ে বিষণ্ন বদনে, অবসন্ন শরীরে এসে বসেছেন রেললাইনের উপর অধ্যাপক আলী আসগর। প্রকৃতির অপরূপ রূপের বিপুল ক্যানভাস, বিশাল সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলেন। ভূলে গেলেন স্ত্রী মাকসুদা বেগমের কিছুক্ষণ আগের অকথ্য গালি গালাজ। আপন মনে চারদিক দেখতে দেখতে বললেন-বাহ! সুন্দর।

এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার। অধ্যাপক আলী আসগর একজন প্রকৃতিপ্রেমিকও বটে। তিনি বসেছিলেন একটি অচেনা বৃক্ষের নিচে। বৃক্ষের পাতারা পানপাতার মতো গোলাকার কিন্তু আকারে খুব ছোট। রঙ গাঢ় সবুজ। বয়সী পাতারা পেকে হলুদ রঙ ধারণ করে। ঝরে পড়ার আগে আলতো লাল রঙ ফুটে ওঠে পাতার শরীরে। মৃদু বাতাসে  ঝরছে টুপটাপ। বাতাস বইছে খেয়ালি সুরের মতো। অধ্যাপক আলী আসগর প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে প্রকৃতির অপরূপ রূপের সাগরে ডুবে জীবন ও সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে যেতে চাইলেন। কিন্তু তাকে ঘিরে তাঁরই অলক্ষ্যে বাতাসের পাহাড় তৈরী হচ্ছে- তিনি টের পেলেন না। এক অসম্ভব সুন্দরের ধ্যানে তিনি মগ্ন হতে চাইলেন। এতোসব কিছুর পরও তার কানে ভেসে আসতে থাকে স্ত্রী মাকসুদা বেগমের গালি, বিকৃত বিকট মুখের কদর্য আস্ফালন। সুন্দর মুখ যখন বিকৃত হয়- তখন এতো বদর্যরূপ ধারণ করে যে অনেক সময়ে ভয় পেতে হয়। অধ্যাপক আলী আসগর তেমনই ভয় পান তাঁর বিবাহিত স্ত্রী মাকসুদা বেগমকে।

জয়পুরহাটের সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন আলী আসগর। গতকাল দুপুরে ঢাকার বাসায় এসেছেন। জুরাইনে কাঠা তিনেক জমি কিনেছেন তিনি অনেক কষ্টে, ধার-কর্জ করে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে। সেই জায়গায় চার রুমের একটা আধা পাকা আধা কাঁচা বাসাও তৈরী করেছেন। অধ্যাপক আলী আসগর অবশ্য কথা প্রসঙ্গে স্বীকার করেন- হোক না আধা পাকা আধা কাচা বাড়ি, তবুও বিশাল ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই তো! এই ঠাঁই করার পেছনে তার নিজের আগ্রহ, অবদান, কাজ খুবই কম। যা করার করেছেন মাকসুদা বেগম।

রাদটা গেছে। বেলা এগারোটার দিকে মাকসুদা বেগম সামনে এসে দাঁড়ায়। আলী আসগর সবেমাত্র কাঁচা বাজার সেরে দৈনিতটা খুলে এক চিলতে বারান্দায় বসেছেন আয়েশ করে।

টাকা দাও- মাকসুদার বাজখাঁই গলা।

পত্রিকা থেকে মুখ তোলেন অধ্যাপক আসগর, দেখের স্ত্রী তাম্বুল চর্চিত প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই মুখখানা। এই মুখখানা বিকৃত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে কেমন আকার করবে ভাবছেন এবং মনে মনে ভয়ে শিউরে উঠছেন।

কথা শুনছো আমার।

কি?

টাকা দাও-

অধ্যাপক আলী আসগর পত্রিকার পাতায় চোখ রাখের- আমি টাকা নিয়ে আসিনি।

কেন? ফোঁস করে ওঠেন মাকসুদা বেগম।

বেতন পাইনি তো। যতোটা সম্ভব মোলায়েম কন্ঠে স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করছেন তিনি। এছাড়া আপাতত তাঁর কোনো উপায়ও নেই তার সামনে।

আজ মাসের আট তারিখ-বেতন পাওনি আমাকে বুঝতে হবে?

হ্যাঁ মাকসুদা বেতন পাইনি-অধ্যাপক আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখেন। তোমার সঙ্গে মিথ্যা কেনো বলবো?

আলী আসগর আপন মনে পত্রিকা পড়ছেন। পত্রিকার শিরোনাম-নওগাঁয় তিনজন এসিড দগ্ধ। বাগেরহাটে একই রাতে নয় বাড়িতে গণডাকাতি। ছাত্রদল নিয়ে সরকারে তোলপাড়। সনির মৃত্যু কি কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙাতে পারবে? সংসদের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে ছেড়ে দিন; কাদের সিদ্দিকী, এরশাদকে আমি কুড়িয়ে নিইনি; বিদিশা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংবাদ; সম্মেলন; সন্ত্রাসীদের রক্ষা করছে বুয়েট প্রশাসন-ভিসির পদত্যাগ দাবি, মুকি ও টগর এক আতঙ্কের নাম-

মাকসুদা বেগম দমকা বাতাসের গতিতে অধ্যাপকের হাত থেকে পত্রিকাটা কেড়ে নেন, ছুঁড়ে মারেন বাইরে দলা-মোচা পাকিয়ে কি বলছি কারে যায় না? টাকা দাও- বলদর্পী মহিষের মতো সমানে হাত নাড়ছেন। মাকসুদা। ইতোমধ্যে কমনীয় মুখের ইপর রুক্ষ ভয়ংকর কদর্য রূপটি ফিরে এসেছে।

আলি আসগর হাই তোলেন। আড়মোড়া ভাঙেন। তাকান রণমূর্তি মাকসুদার দিকে, মুখে মৃদু হাসি এনে বলেন- তোমাকে বলছি তো বেতন এখনও পাইনি। গত মাসের বেতন পেতে কয়েকদিন দেরি হবে।

কেনো দেরি হবে?

হবে। প্রসাশনিক জটিলতা দেখা দিয়েছে, তাই-

টাকা না নিয়ে বাসায় আসলে কেন?

কী আশ্চর্য! বাসায় আসবো না- ছুটি পেয়েছি তাই এসেছি।

এসেছো বেশ করেছো- টাকা আনোনি কেন?

মাকসুদা, বলেছি তো টাকা কয়েকদিন পরে পাব।

আগামীকাল যে আমার বড় বোনের বাড়ি থেকে মেহমান আসবে, তাদের জন্য বাজার করতে হবে না?

বেশ তো করবে বাজার।

টাকা পাব কোথায়?

তারা তো প্রায়ই আসেন এ বাসায় বেড়াতে। সব সময়ই মুরগী-বিরাণী খাওয়াতে হবে এমন তো কথা নেই। যা আছে তা দিয়ে চালিয়ে নাও-

কী বললে? পাহাড়ের চুড়োয় আগুণ লেগেছে- মাকসুদা বেগমের চোখ-মুখ রাগে ফুলে লাল-আমার বোন প্রায়ই তোমার বাসায় আসে? তারা মুরগী বিরাণী খায়। কোমরে আচঁল পেঁচালেন মাকসুদা- সামনে যা কিছু পাচ্ছেন, ছুঁড়ে মারতে আরম্ভ করলেন বাইরে। দেয়ালের সঙ্গে লেগে কাপ, পিরিচ, প্লেট, সোফাসেট, টি-পট হাঁড়িপাতিল ভাঙতে থাকে। বিকট শব্দে, মুখের অশালীন-ভৌতিক কথায় চারপাশটা নরকে পরিণত হয়েছে।

চারদিকে উৎসুক উৎকট মানুষের ভিড় জমেছে। খেলাটা তাদের জন্য ভারি উপভোগের। কিছুক্ষণ দেখলেন আলী আসগর সবকিছু। তারপর উঠে দাঁড়ালেন এবং মাকসুদা বেগমের বিকট চিৎকার চেঁচামেচি ছিঁচকাদুনের ভেতর তিনি বাইরে রেললাইনের সমান্তরাল রেলপথের উপর দু’পা দুদিকে ছড়িয়ে বসে পড়লেন। দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে, অক্ষমতায় ভেতরটা জ্বলে জ্বলে ছাই হচ্ছে। এরই নাম জীবন। এরই নাম সংসার? এরই নাম সুখ? আর এরই জন্য মানুষ এতো পরিশ্রম করে?

বাতাসটা নেমে আসছে লক্ষ লক্ষ নৃত্যপটিয়সী মেয়ের নূপুরের নিক্কনের সুচারু বিন্যস্ত নিবিড় শব্দে, ফিসফিস করে দ্রুত থেকে দ্রুত বেগে। অনেকট চাদরের মতো বাতাস গুচ্ছ জড়িয়ে ধরে অধ্যাপক আলি আসগরকে চারপাশ থেকে। বাতাসে বাতাসে ফুলের অদ্ভুত সুগন্ধ। বাতাসের মধ্যে কলকল ছলছল হাসির ঢেউ। চমকে চোখ খোলেন অধ্যাপক!

কেমন আছেন?

কে?

আমি!

অধ্যাপক চারিদিকে তাকার-প্রায় জনমানবশূণ্য নির্জন দুপুর। কে কথা বলছে তার সঙ্গে? তিনি কি পাগল হয়ে গেছেন? তার চারপাশের বাতাসে অগণিদ অজস্র ঘুঙুরের মর্মর শব্দ তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ নৃত্য করছে ঝড়ের সর্বনাশে।

আমি কে?

নিরাকার মিষ্টিমধুর অমৃত হাসি-আমি! আমি ইচ্ছাপূরণ। তুমি যে গাছটির নিচে বসে আছো, এই গাছটি আসলে একটি বোধিবৃক্ষ। দুঃখভারাক্রান্ত মনে চৈত্রের এই দিনে এই সময়ে যে এই বৃক্ষের নিচে এসে বসে থাকে- তার যেকোনো একটা ইচ্ছে আমি পূরণ করি।

তাই?

হ্যাঁ, বলো তুমি কি চাও।

আমার তো কিছু চাইবার নেই। পারলে তুমি জগৎসংসারের সমস্ত মানুষদের দুঃখ-ক্লেশ দূর করে দাও।

আবার হাসে বাতাস- সে কি রিনিরিনি ঝিনিঝিনি হাসি-হাসির শেষে ইচ্ছাপূরণ বলে-জগৎ সংসারের সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্ব আমার নয়। সেসব দেখবার জন্য আলাদা গোষ্ঠী, শ্রেণী আছে। তাছাড়া মানুষ হিসেবে তুমি খুব ভালো। নিজের জন্য কিছু চাইলে না। অথচ অন্যান্য মানুষেরা অর্থহীন আত্মপ্রেমে পাগল। এমন সুযোগ পেলে সবার আগে নিজের জন্য টাকা-পয়সা চাইত। তুমি কি চাও-সেটা বলো।

কিছুটা সময় আত্মগতভাবে ভাবেন অধ্যাপক আলী আসগর। এবং ভাবনা শেষে অথৈ শূণ্যতার দিকে তাকিয়ে বললেন-আমার দীর্ঘদিনের একটা ইচ্ছে-

বলো তোমার ইচ্ছে।

আমার চারপাশের মানুষজন আমাকে নিয়ে কি ভাবে আমি জানতে চাই-সেটা কি সম্ভব?

ঘুঙুর আবার হাসে- তুমি খুব অবাক মানুষ অধ্যাপক আলী আসগর। আমাদের অভিধানে অসম্ভব বলে কিছু নেই।

তাহলে আমাকে সেই মন্ত্র দাও।

দেখো অধ্যাপক আলী আসগর- আমরা আমাদের কোনো মন্ত্র কাউকে শেখাই না। তবে তোমার স্বার্থহীন এই বিকল্প ভাবনাটা আমাকে আনন্দ দিয়েছে। বরং একটা কাজ করা যায়- অবশ্য তুমি যদি রাজি হও।

কি কাজ?

তোমাকে আমি একটা ছোট্ট পাখি বানিয়ে দিতে পারি তিনদিনের জন্য। তুমি পাখি হয়ে প্রিয় মানুষজনের আশেপাশে থাকবে গোপনে লুকিয়ে, তখন তারা তোমাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবে, তাতে টের পেয়ে যাবে-

আমি রাজি।

ভেবে দেখো? মানুষ থেকে পাখি হওয়ার পরে তোমার অনেক অসুবিধা হবে। কি রকম?

খাওয়া-দাওয়া, থাকা। তুমি মানুষ- মানুষের মতো সবকিছু করতে পারবে না, খেতে পারবে না, রাতে থাকতে হবে গাছের ডালে অথবা কোনো বাড়ির কার্ণিশে। পারবে?

সেটা কোনো সমস্যা হবে না, তুমি আমাকে পাখি বানিয়ে দাও।

ইচ্ছেপূরণ অরূপকুমারীর কথা থেমে যায়। অধ্যাপক আলী আসগরের চোখের সামনেই বাতাসের একটি মায়াবী কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে থাকে, সঙ্গে বাজতে থাকে ঘুঙুরের সুর, সুই কুণ্ডলি কথা বলে- অধ্যাপক আলী আসগর তোমাকে পাখি বানানো হবে- তিনদিন তিন রাতের জন্য। তিন দিন তিন রাত পর ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, তোমাকে এখানে ফিরে আসতেই হবে এই সময়ে। আর বোধিবৃক্ষের নিচে আসলেই পাবে এই ঘুঙুরের শব্দ। মনে রেখো পৃথিবীর কোথাও এমন ঘুঙুরের শব্দ নেই। আর সঙ্গে সঙ্গে তুমি আগের আলী আসগর হয়ে যাবে। আবার ভেবে বলো রাজি আমার প্রস্তাবে?

বলেছি তো, আমি রাজি।

বেশ! চক্ষু মুদ্রিত করো।

অধ্যাপক আলী আসগর চক্ষুদয় মুদ্রিত করলেন। নিমেষে শুনলেন তার চারপাশে অমিত্রাক্ষর ছন্দে মর্মর সুরের ঐক্যতানে মায়াবী ঘুঙুর বাজছে। এমন নিবিড় আকুল যন্ত্রণাবিদ্ধ সুর তিনি আর শোনেননি। ঘুঙুরের সুরে তিনি প্রায় জ্ঞানহারা। হঠাৎ থেমে যায় ঘুঙুরের শব্দ। চোখ খোলেন তিনি। দেখতে পেলেন আর তিনি মানুষ অধ্যাপক আলী আসগর নন, তিনি একটি পাখি। টুনটুনি পাখি। সত্তর কেজি ওজনের দশাসই অধ্যাপক আলী আসগর যদিও পচিঁশ গ্রাম ওজনের টুনটুনি পাখিতে রূপান্তরিত হয়েছেন তবুও আবেগ, মনুষ্যত্ব, চিন্তা, বোধশক্তি, প্রতিক্রিয়া, প্রতিশোধস্পৃহা, স্নেহাশীষ সবকিছুই মানুষের মতো বহমান-বর্তমান। রেললাইনের পাত থেকে তিনি হাওয়ায় ভাসলেন। দুটি ছোট পাখায় ভর দিয়ে টুনটুনি পাখির অপরূপ উদ্দাম গতিতে ফুরুত উড়তে আরম্ভ করলেন। নিমেষে মানুষ থেকে রূপান্তরিত অধ্যাপক আলী আসগরের জীবনে ঘটে যায় অভাবনীয়, অলৌকিক ঘটনা। তিনি কথা বলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। টুনটুনি পাখির টুনটুন শব্দই বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। উড়তে উড়তে তিনি একটি গাছের ডালে বসলেন। পুচ্ছ ঝাপটাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে হাসি, অবাক করা গানে পাখি অধ্যাপক আলী আসহর কি করবেন উড়ে কোথায় কোন বাড়িতে যাবেন- বুঝতে পারছেন না।

হায়-প্রতিটি মানুষ যদি জীববনে একবার পাখি হতে পারত- তার মতো। তিনি ভাবছেন। এখন পৃথিবীর কোথাও যেতে তার পাসপোর্ট ভিসা প্রয়োজন হবে না। যেকোনো বাড়ি, যেকোনো গোপন সুরক্ষিত আস্তানায় অনায়াসে চোখের পলকে চলে যেতে পারছেন-তিনি উড়তে আরম্ভ করলেন। দেখতে চান- পৃথিবী কতদূর বিস্তৃত? ছুটতে শুরু করলেন মাঠ, ঘাট, বন, ধানক্ষেত, ঝাউবন, কলাই ক্ষেত, সীম মাচা, নদী পার হয়ে। কী অসীম অপার আনন্দ! মানুষ তিনি কিন্তু আকারে ছোট এক টুনটুনি পাখি!

Series Navigationউপন্যাস।।অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।২য় পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *