কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব নয়
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চার
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পাঁচ পর্ব
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব আট
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব নয়
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। দশ পর্ব
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব এগারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। বারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তেরো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চৌদ্দ
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। শেষ পর্ব
শুনেন খালা, বিজ্ঞানীরা সব সময় আবিষ্কারের চিন্তা করে। তারা ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে। বিজ্ঞান যেভাবে দৌড় পারছে মানুষ কোথায় যাবে,
কী করবে, মানুষ কি মানুষ থাকবে নাকি অন্য কিছু হয়ে যাবে, মানুষ কি ভাত খাবে নাকি হাওয়া খেলেই চলবে এসব চিন্তা করতে করতে আমার জান যায়।
আমি খাওয়া-দাওয়ার কথাই ভুলে যাই, তাহলে ভালোভাবে কথা বলব কীভাবে?
কান্টিবান্টির কথা আতিকনের মনে ধরে। সে সোফায় বসে কান্টিবান্টিকে ভালো করে দেখে বলল, মানুষ কি হাওয়া খেয়ে থাকতে পারবে?
কী বলছে?
হ্যাঁ।
মানুষ এক সময় হাওয়া খেয়ে কী করে বাঁচতে পারে সে চিন্তাই আমি করি।
এটাও কি সম্ভব হবে?
আমার মনে হয় হবে। এক সময় হবে। গাছ যেমন করে বাঁচে, তেমন করে বাঁচার একটা কৌশল শিখে ফেললেই হলো।
আতিকন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়। এক সময় কান্টিবান্টির দিকে তাকায়।
আর তখন এক গভীর মমতায় তার মন ভরে যায়।
সে কান্টিবান্টিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাবাবা কোথায় থাকেন? তুমি তাদের কাছে যাও না?
কান্টিবান্টি উত্তর দিল, আমার মাবাবা নেই। তাদের কথা আমার মনে নেই।
আতিকনের মন খারাপ হয়। সে বলল, তোমার বাড়ি কোথায় বাবা?
আমার বাড়ি? আমার অরিজিন্যাল বাড়ি কোথায় তাও জানি না।
শুধু মনে আছে আমি এক সময় মাবাবার সঙ্গে এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
সে জায়গাটা ছিল মরুভূমি। বিশাল মরুভূমি। হঠাৎ একটা বালিঝড় শুরু হলো।
ভয়ানক ঝড়। আর ঝড়টা আমাদের উড়িয়ে নিলে গেল।
আমাদের গাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। পথের গাড়িগুলোকে কাগজের নৌকার মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল।
এইটুকুই আমার মনে আছে। সেই ঝড়ের পর আমার আর কিছুই মনেই।
মাবাবার মুখের ছায়াটি পর্যন্ত ভুলে গেছি। এরপর এক ইংরেজের বাড়িতে আমি থাকতাম
ইংল্যান্ডে। ওই ভদ্রলোকই আমাকে লেখাপড়া শেখাল। তাকে বাবা ডাকতাম।
একবার তিনি আমাকে বললেন, তিনি তার প্রকৃত বাবা নয়। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন বাংলাদেশে।
বললেন, তোমার আসল বাড়ি বাংলাদেশে।
তিনি আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আমার মাবাবার খোঁজ করার চেষ্টা করলেন। পেলেন না।
একদিন আমার ওই পালক বাবা আমাকে ঢাকায় রেখে দিনাজপুর গেলেন আমার মাবাবার খোঁজে।
কিন্তু আর ফিরে এলেন না। তাকে মেরে ফেলল।
আমার পালক বাবার কাছেই আমার পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র ছিল।
সব হারিয়ে গেছে। ভয়ে আমি কোথাও যাই না। যদি আমাকেও মেরে ফেলে।
তারপর একদিন কাশেম সাহেবের সঙ্গে হোটেল সোনার গাঁওয়ে দেখা হলো।
আমি বললাম আমার কথা। তিনি বললেন, চাকরির কথা।
তার আপনাদের মালিকের কোম্পানিতে একটা চাকরি হয়ে গেল। এখন এখানেই থাকি।
আমি বাংলাভাষা জানতাম না। মানুষের মুখে শুনে শুনে কিছু শিখেছিলাম।
জয়িতা কিছু শেখাল। এ-কারণেই আমার কথা বলাটা ভালো হয় না। ভুলভাল হয়।
তারপর সেই ঝড়টার কথা আর কিছু মনে নেই তোমার?
না, আমার কিছু মনে নেই।
সেই ঝড়টা উঠেছিল মিশরের একটি মরুভূমিতে। সেই মরুভূমি এতই বড় যে তার কূলকিনারা জানা অসম্ভব।
সেই ঝড়ের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। হাজার হাজার গাড়ি বাতাসে উড়ে গিয়েছিল।
এই কথাগুলোর বলার সময় আতিকনের চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে।
আঁচল দিয়ে চোখ ঢেকে হো হো হো করে কেঁদে ওঠে আতিকন।
কান্টিবান্টি কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, আপনি এসব কীভাবে জানলেন?
জয়িতাও কিছু বুঝতে পারেনি। সে শুধু বলল, খালা আপনি কাঁদছেন কেন?
আতিকন আবার বলতে শুরু করে, তখন তোমার বাবা মিশরের একটা তেল কোম্পানিতে কাজ করতেন। তিনিও বিজ্ঞানী ছিলেন।
তিনিও আবিষ্কারের নেশায় মেতে থাকতেন। তেল ছাড়া গাড়ি আবিষ্কারের কথা ভাবতেন। তিনি আসলে সৌরশক্তির ওপরই বেশি নির্ভরশীল ছিলেন।
সৌরশক্তি থেকে বাতাসে আয়নিক শক্তি উৎপাদনের কথা ভাবতেন। কিন্তু তা তিনি করতে পারলেন না। আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় হলেন।
সেই কাল ঝড়ই তোমার বাবার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল।
আপনি কী করে জানেন, উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে কান্টিবান্টি আতিকনকে জিজ্ঞেস করে। আতিকন আবার চোখ মুছে বলে,
তোমার মা ঢাকার একটি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান পড়াতেন। বাবা কান্টিবান্টি, তোমার গায়ের জামাটা একটু খুলবে, আমি একটিবার দেখতে চাই।
আমার চোখ দুটিও মরুভূমি হয়ে আছে। একটু শান্তির জল যদি মরুভূমিতে পাই তাহলে জীবন সার্থক হবে।
কান্টিবান্টি গায়ের জামা খুলে ফেলে।
আর আতিকন কান্টিবান্টিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। বাবা তুমিই আমার হারিয়ে যাওয়া নওশাদ।
ছোট সময় তোমার হার্টের সমস্যা ছিল।
এই যে, অপারেশনের দাগ। আতিকন আর কথা বলতে পারে না। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
আতিকনের কান্নার শব্দ শুনে জয়িতারও কান্না পায়।
মনে মনে বলে, এই বাসার মানুষের বুকে এতো কান্না কেন? কেন এতো কান্না?
জয়িতা এবার সজোরে কেঁদে বলে, খালা কী হয়েছে? কী হয়েছে বলে চিৎকার করে আতিকনকে জড়িয়ে ধরে।
জয়িতার দৃষ্টিশক্তি নেই বলে সে দেখতে পায়নি মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকুটে অস্থির।
পরে আতিকনকে জড়িয়ে ধরার পর অনুভব করতে পারে এটি একটি বিরল মুহূর্ত। মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছে। কান্টিবান্টির প্রকৃত নাম নওশাদ।
শব্দ শুনে জয়িতার বাবাও অন্যরুম থেকে এসে দেখেন কান্টিবান্টিকে জড়িয়ে ধরে আতিকন অঝোর ধারায় কাঁদছে।
অনেকক্ষণ পর সবার মন স্থির হলে আতিকন নিজের জীবনের ঘটনা আরও বিস্তারিত বলে।
কান্টিবান্টিও ঝড়ের পরবর্তী জীবন কীভাবে মিশরেই এক ইংরেজের সঙ্গে কাটিয়েছিল এবং সেখান থেকে পরে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিল বিস্তারিত বলে।
কাশেম পাটোয়ারী এসব ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মানুষের জীবন কোথা থেকে কী হয়ে যায় বলা বড় মুশকিল।
পৃথিবী একটা বিচিত্র স্থান। বড় রহস্যময় জায়গা।
এদিকে কাশেম পাটোয়ারী ও জয়িতার জীবন কী কম বদলে গেছে। ভাবতে ভাবতে, কাশেম পাটোয়ারীর চোখেও পানিতে ভরে যায়।
পরিবেশ আরও স্বাভাবিক হতে অনেকক্ষণ সময় লাগে।
ড্রয়িংরুমের পরিবেশ স্বাভাবিক হলে কাশেম পাটোয়ারী বললেন, আতিকন, আপনি যদিও আমার মেয়ে জয়িতার কেয়ার টেকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এতে জয়িতা ধন্য। আপনার প্রতি আমারও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আপনি একজন মায়ের আদরেই জয়িতার দেখভাল করেছেন। কিন্তু আপনার যোগ্যতার কথা কখনই বলেন নি। আপনি একজন অধ্যাপিকা কিন্তু সে কথা আপনি বলেন নি কেন? যদিও আমরা কেউ আপনাকে সম্মান করতে কার্পণ্য করিনি।
আপনাকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদাই দিয়েছি। সম্মান করেছি।
অবশ্যই আমি আমার প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছি। যদি না পেতাম তাহলে এখানে থাকতাম না। আসলে পরিচয় না দেওয়ারও কারণ আছে।
পত্রিকার বিজ্ঞাপনটি দেখেই আমি মনোস্থির করলাম এমন একটি মেয়ের দায়িত্ব আমাকে নিতেই হবে। তা যে করেই হোক।
পরিচয় দিলে হয়তো আর চাকরিটা পেতাম না। কাশেম পাটোয়ারী বলেন, হ্যাঁ। তা অবশ্যই ঠিক। পরিচয় দিলে আপনি চাকরিটা পেতেন না।
তবে গোপন করেই ভালো করেছেন। জয়িতা পেয়েছে আপনার মতো একজন গর্বিত মায়ের আদর। আর আপনি একজন বিজ্ঞানীর মা।
এ যে বড় আনন্দের বিষয়। এর চেয়ে আনন্দ মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে।
কীভাবে কী হয় তা বলা বড় কঠিন।
আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে জয়িতার কেয়ার টেকার হয়ে আমি ধন্য। এমন একটি মিষ্টি মেয়ে, এতো মেধাবী মেয়ের যত্ন করতে পেরে আমি ধন্য।
আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেই এই মেয়েটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পাগলের মতো হয়ে পড়েছিলাম। থাক সেসব কথা।
আমরা এখন আগামী দিনের কথাই ভাবি। চিন্তা করি।
কাশেম পাটোয়ারী বললেন, আজ থেকে আমি আপনাকে আর বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে আলাদা ফ্ল্যাট দিচ্ছি। আপনারা সেখানেই থাকবেন।
এতোদিন পর মা ছেলেকে পেয়েছেন, ছেলে মাকে পেয়েছে এর চেয়ে আনন্দের বিষয় পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।
ছোট ছোট বাক্যে অসাধারণ বর্ণনা! এ ধরনের লেখা পড়ার মজাই আলাদা।