কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পাঁচ পর্ব

দুজনে খেতে বসেছে। আতিকন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে খাবার পরিবেশন করছে। মেয়েটি বড় অদ্ভুত। লেখাপড়া জানা থাকলেও কিছুটা পাগলাটে। যেদিন এ-বাসায় কাজ নেয়, সেদিন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিল, আমাকে সম্মান না করলে কাজ করব না। বাসায় থাকব না।
কাশেম সাহেব বললেন, সম্মান মানে বুঝিয়ে বলো।
আতিকন বলল, এই যে, আমাকে বলিলেন বলো। মানে তুমি করে বলিলেন। এই রকম হইবে না। আমাকে আপনি করে সম্বোধন করিতে হইবে। আর কখনও বুয়া ডাকা যাইবে না। যারা বয়সে ছোট যেমন ধরেন, আপনার মেয়ে আমাকে বলবে খালা বা ফুফু। আর আপনি বলিবেন আপা। এ রকম সম্মান দেখাইতে হইবে।
কাশেম সাহেব তখন আতিকনের আত্মমর্যাদাবোধ বিবেচনা করেই বাসায় কাজ দিয়েছিলেন। এখনও ঝামেলা ছাড়াই আছে। নিজের বাড়ির মতোই থাকে। কাশেম পাটোয়ারিকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখে।
এ বাসার সবাই একজন মানুষকেই ভয় পায় আর সে মানুষটা হলো আতিকন বেগম। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আতিকন এ বাসার কাজের বুয়া বা গৃহকর্মী।
রাতে শুয়ে শুয়ে জয়িতা ভাবছে দুদিন পরই তারা নতুন গাড়ি নিয়ে কক্সবাজার যাবে। আর মনে মনে খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছে।

দ্বিতীয় পর্ব: কক্সবাজার যাত্রা

কান্টিবান্টিকে নিয়ে রাতে দুদফা মিটিং হয়েছে জয়িতা ও কাশেম পাটোয়ারীর। কান্টিবান্টি কক্সবাজার ভ্রমণে যাবে না। কেন যাবে সে কথাও পরিষ্কার করে বলে না। শুধু বলে, যাব না। নো।
পরদিন রাত বারোটায় কান্টিবান্টিকে ধরে আনা হলো তার মেস থেকে এবং কাশেম পাটোয়ারী তাকে বললেন, তোমাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে। কেন যাবে না?
আমার ভয় হচ্ছে। যদি জয়িতা দুর্ঘটনা করেন। আমি মারা যাবো।
তুমি কি মনে করো আমার জয়িতার জীবন তোমার জীবনের চেয়ে কম মূল্যবান?
কথা সেটি না। সবার জীবনের দামই সমান আছে।
তুমি খুব বেশি তর্ক করো, কান্টিবান্টি। তুমি যদি না যাও তাহলে জয়িতার পাশের সীটে তোমাকে বেঁধে নেয়া হবে কক্সবাজারে। তবু তোমাকে যেতে হবে। কারণ, গাড়িটি এখনও এক্সপেরিমেন্ট স্টেজে আছে। তাই তোমাকে যেতেই হবে। কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে তোমাকেই সাড়তে হবে।
কাশেম পাটোয়ারীর কঠোর মনোভাবে দেখে কান্টিবান্টি অনেকক্ষণ থোম ধরে বসে থেকে বলল, ঠিক আছে। আমি যাবো। তবে আপনাদেরও যেতে হবে। সামনে আর পিছনে একটি একটি করে দুটি গাড়ি থাকবেন যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।
তুমি ভালো করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করো। দেখো গুগলের ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকা থেকে কক্সবাজার, কক্সবাজার থেকে টেকনাফের রাস্তা ঠিক আছে কিনা। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে ভালো করে চেক করো। তোমাকে আরও দুদিন সময় দিলাম। কক্সবাজারের কর্মসূচি দুদিন পিছিয়ে দিলাম।
জি, স্যার। আমি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছি। আপনি কক্সবাজারে যাতায়াত করে এমন বাসের দুজন ড্রাইভারকে পাকড়াও করে আমার সঙ্গে দুদিন কাজ করতে দেন।
তাই করা হবে। আমি রেড ওয়ার্ল্ড বাস সার্ভিসের মালিককে বলে দুজন ড্রাইভারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তারা দুজন তোমার সঙ্গে দুদিন কাজ করবে। তারা পথের ম্যাপটা ঠিক আছে কিনা দেখে দেবে। রেড ওয়ার্ল্ডের মালিক আমার বন্ধু।
জি স্যার। তাই হবে। এখন আমি আসি।
তুমি যেতে পারবে না। তুমি পালিয়ে যেতে পারো। তাই তোমাকে আমার গেস্টরুমে বন্দি থাকতে হবে। আর দুদিন আমার বাসায় বসেই কাজ করবে। বুঝতে পারলে?
স্যার, আমাকে বিশ্বাস করলেন না। আমাকে অপমান করলে?
এসব কথা আমি বুঝতে চাই না। আমি চাই আমার কাজ।
কান্টিবান্টির মুখ চুন হয়ে যায়। সে খুব অপমানিত বোধ করে। তবে তার কিছুই করার ছিল না বলে গেস্টরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

কান্টিবান্টি রেড ওয়ার্ল্ড বাস সার্ভিসের দুজন শিক্ষিত ড্রাইভারের সঙ্গে কাজ করে গুগল ম্যাপের সঙ্গে গাড়ির ইঞ্জিনের প্রোগ্রামিং করে দিল। এর আগে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সির কিছু সমস্যা ছিল তাও দূর করা হয়েছে।
ড্রাইভার দুজন এই কান্ড দেখে হতবাক। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গাড়ি চালাবে! তাও কক্সবাজারের মতো জটিল রাস্তা পাড়ি দিবে। একটা ছোট্ট মেয়ের জীবনের চ্যালেঞ্জ! এই চ্যালেঞ্জে তাকে জিততেই হবে! কী ভয়ানক আর আজগুবি সব কথা। তবে এই আজগুবি গাড়িটির প্রতি দুই ড্রাইভারের লোভ হলো।
তারা ভাবল এই গাড়িটি যেভাবেই হোক চুরি করতে হবে। কয়েক মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা যাবে।
ড্রাইভার দুজন জানে রেড ওয়ার্ল্ডের মালিক খুব খারাপ প্রকৃতির মানুষ। টাকার জন্য সে সব কাজ করতে পারে। ব্যাংকের টাকা চুরি করে এই পরিবহন সংস্থার মালিক হয়েছে। এখন সে কোটি কোটি টাকার মালিক। যদি মালিককে বুঝানো যায় যে গাড়িটি অনেক দামে বিক্রি করা যাবে তাহলে রাজি হয়ে যাবে। তারপর বিদেশি কোনো গাড়ির কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে গাড়ি উৎপাদন করলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাগিয়ে নেয়া যাবে।
ড্রাইভার দুজনের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি। কাজ শেষ হলে ওরা নিজেদের বাসায় না গিয়ে মালিকের বাসায় চলে গেল। মালিককে নিয়ে বাড়ির লনে বসল।
মালিক জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা কইবি, ক।’
‘স্যার এটি এমন গাড়ি, যে গাড়িটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা চালাতে পারবে। ইঞ্জিনের সঙ্গে বিশেষ কম্পিউটার। রোবটও বলা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিও রয়েছে এই কম্পিউটারের। কম্পিটারের সঙ্গে সব প্রোগ্রামিং করা। শব্দের ফ্রিকোয়েন্সিতে প্রোগ্রামিং করেছে। তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে গুগলের ম্যাপ। গুগলের রাস্তার ম্যাপ অনুযায়ী গাড়িটি চলবে নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে।’
‘আরে তোরা কি কইতাছোস? আমার তো মাথা আউলা অইয়া যাইতাছে।’
একজন ড্রাইবার বলল, ‘জি স্যার। কথা সত্য।
অহন কী করন লাগব?’
স্যার, গাড়িটা হাইজ্যাক করা লাগবে। হাইজ্যাক করতে হবে। যেকোনো মূল্যে। তারপর বিদেশি কোনো গাড়ি কোম্পানির কাছে এই গাড়ির টেকনোলজি বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাইতে হবে।
খুব ভালা কইছোস রে। যা, তোরা দুইজন দুইনম্বরি একটা বুদ্ধি বাইর কর।
আরেকজন ড্রাইভার বলল, স্যার, বুদ্ধি আছে।
ড্রাইভার আস্তে আস্তে বলল, আজকে আমরা শুধু কক্সবাজার যাওয়ার পর্যন্ত রাস্তা ঠিক করে দিয়ে এসেছি। কিন্তু ওরা টেকনাফও যাবে। সেখানে গুগল ম্যাপের সঙ্গে আমরা একটা গন্ডগোল পাকিয়ে দেব। তারপর টেকনাফ জঙ্গলে গাড়িটি গায়েব করে দেব। জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে যে রাস্তাটি গেছে আমরা সেটা দিয়ে প্রোগ্রামিং করব। ওদের গুম করে ফেলব। তারপর আমারা দুজন গাড়ির ইঞ্জিন খুলে নিয়ে আসব। আপনি এর মধ্যে গাড়ির কোনো কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা আসবে এবং এখানে বসেই টেকনোলজি বিক্রির চুক্তি হবে।
সম্ভাব অইবো নি?
হবে স্যার। আপনি শুধু বিদেশে টাকাওয়ালা পার্টি জোগার করেন। তবে আমাদের মতো ওদেরও দুই নম্বর হতে হবে।
বুচ্ছি রে। অহন তোরা যা। আমার মাথাডা ঠান্ডা কইর‌্যা একটু চিন্তা কইরা দেহি।
রাতেই রেড ওয়ার্ল্ডের মালিক আজিম সিদ্ধান্তটি নিয়ে নেয়। তারা এই গাড়িটি হাইজ্যাক করবে এবং পরে গাড়ির টেকনোলজি বিক্রি করবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব লোক দিয়ে আমেরিকার এক গাড়ি কোম্পানির মালিক ভেলোরির সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করে। ভেলোরি প্রথমে অবিশ্বাস করে যে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর জন্য কোনো গাড়ি হতে পারে না। এটা অস্বাভাবিক ও অবাস্তব। যাহোক, পরে অনেক ইমেইল চালাচালি করার পর ভেলোরিকে রাজি করানো হলো যে, যদি এই টেকনোলজি তাকে দেয়া হয় তাহলে সে দুই বিলিয়ন ডলার দিবে।
পরদিন ড্রাইভার দুজন যখন গুগল ম্যাপে কাজ করছে তখন দেখালো যে, টেকনাফের আগের ব্রিজটির ছবি অনেক আগের তোলা হয়েছিল। ম্যাপটি আপডেট না করাতে এ ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি যাবে না। গাড়ি চালাতে হবে বিকল্প পথ দিয়ে।
ওরা তখন চালাকি করে টেকনাফের একটি গভীর জঙ্গলের সরু পথ দেখিয়ে দিয়ে বলে এটি ইঞ্জিনের সঙ্গে প্রোগ্রামিং করেন।
কান্টিবান্টি সরল প্রকৃতির মানুষ। সে বিশ্বাস করে সেভাবেই ম্যাপ তৈরি করল।
ম্যাপের প্রোগ্রামিং, শব্দ-তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি ইত্যাদি বাতাসের গতিবেগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রোগ্রাম করা শেষ হয়েছে। কান্টিবান্টি জয়িতাকে খবর দিল সব ঠিক আছে। এখন কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারো।

সকাল দশটায় উত্তরা বাসা থেকে গোলাপি রংয়ের গাড়িটি যাত্রা শুরু করে। জয়িতা ড্রাইভিং সীটে। পাশের সীটে বিজ্ঞানী কান্টিবান্টি। পিছনের সীটে আতিকন। আর পিছনের ফাঁকা জায়গায় কয়েকটি ব্যাগ। পথে খাওয়ার জন্য সবার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার।
গোলাপি গাড়িটি যাত্রা করার সময় কয়েকজন সাংবাদিক এসেছিলেন। তারা জয়িতার সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউ করেছেন। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে খবরটি সম্প্রচার করা হয়েছে সকাল দশটায়। ঢাকা শহরের কর্মরত ট্র্যাফিক পুলিশ গোলাপি গাড়িকে দেখেই তার পথ পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল রুম থেকে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ট্র্যাফিক কন্ট্রোল রুম পর্যন্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চারধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব ছয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *