ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

কান্টিবান্টি গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। অনেকক্ষণ পর সে বলল, মনে হয় সম্ভব হতে পারেন। তবে গবেষণা করিতে হবে।
জয়িতা বলল, হ্যাঁ, আমার মন বলছে সম্ভব। গাড়িটি বানাবেন কম্পিটার প্রোগ্রামিং করে। শব্দের তরঙ্গ-নিয়ন্ত্রিত একটা ইঞ্জিন হবে। তারপর গুগুল ম্যাপ থেকে রোডের ম্যাপ দিয়ে ইঞ্জিনের সঙ্গে সেট করতে হবে। প্রশ্ন আসতে পারে, শব্দের তরঙ্গে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?
যেমন ধরেন, গাড়িটি কত স্পিডে যাবে, সামনে কোনো গাড়ি এলে সেই গাড়ির গতির কারণে শব্দের তরঙ্গ কেমন হবে? কোনো মোড়ে বাঁক নেওয়ার সময় তরঙ্গের কেমন হবে? পিছন থেকে কোনো গাড়ি যদি ওভার টেক করে তাহলে শব্দের তরঙ্গ কত হবে ইত্যাদি এগুলো ক্যালকুলেশন করে আপনি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করবেন এবং এটি গাড়ির ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। মনে করেন, এটি রোবটের মতো। রোবটের যেমন কৃত্রিম কিছু বুদ্ধি দেওয়া যায় সেরকম কিছু বুদ্ধিও দিতে হবে। এই প্রোগ্রাম করা গাড়িটি যখন কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চালাবে তখন তার মস্তিস্কের নিউরনের সঙ্গে গাড়ির প্রোগামের একটা যোগসূত্র থাকতে হবে যাতে দৃষ্টিহীন মানুষটি স্টিয়ারিং এদিক-ওদিক করলে বুঝতে পারে গাড়ি কোন দিকে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিই মানুষের মস্তিস্কের চিন্তার সঙ্গে সংযুক্ত হবে। তারপর গুগল ম্যাপ থেকে নির্দিষ্ট রোডের ম্যাপ দিয়ে যেহেতু প্রোগ্রামিং করবেন সেহেতু গাড়িটি সেই ম্যাপ অনুযায়ীই চলবে। কিছুটা ধারণা পেয়েছেন?
কান্টিবান্টি বলল, তুমি আমার চেয়ে অনেক বড় বিজ্ঞানী আছেন। আমি এই কাজটি করতে পারব। তাহলে একটা অবাক করা কাজ হবে। অনেক সময় লাগবে। আমি ইংল্যান্ডে রোবট বানিয়েছি। সেই জ্ঞানটা কাজে লাগাবে।
আনন্দে জয়িতার চোখে পানি চলে আসে। পারবেন? আপনি পারবেন?
অবশ্যই আমি পারবেন। আমি ছয় মাসের মধ্যে আমি গাড়ির প্রোগ্রামিং করে দিবেন। তুমি চালিয়ে চালিয়ে কক্সবাজার যাবেন। আমি নিতে হবে কিন্তু। আচ্ছা গাড়ির রং কী হবে?
গাড়ির এমন একটা রং দিতে হবে যাতে পৃথিবীর সব মানুষই বুঝতে পারে এই গাড়িটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের। সেটা কী রং হতে পারে?
এ বিষয় পড়ে চিন্তা করা যেতে পারে। হতে পারে বেগুনি বা গোলাপি। পরে দেখা যাবে। তবে এই রংয়ের গাড়ি আর কারো থাকতে পারবে না।
হ্যাঁ। এই রংয়ের গাড়ি আর কারো থাকতে পারবে না। শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদেরই থাকবে।

কাজের মেয়েটা কান্টিবান্টির জন্য চা-নাশতা নিয়ে এসেছে। এতো খাবার দেখে কান্টিবান্টি জয়িতাকে জিজ্ঞেস করে, এসব কি আমি খাবেন?
হ্যাঁ। আপনি খাবেন।
আমার এখন ক্ষিধা হয়েছে। আমি কি খেতে পারবেন?
জয়িতা হাসতে হাসতে বলল, নিশ্চয়ই পারবেন। আপনি খান। তারপর কাজে লেগে যান। আপনার কী কী লাগবে বলুন। আমি বাবাকে ফোন করে দিলেই পাঠিয়ে দেবে।
কান্টিবান্টি বলল, আপাতত একটা কম্পিউটার দেন।
কান্টিবান্টি চা-নাশতা খেতে খেতেই চলে এলো একটা নতুন কম্পিউটার।
সন্ধ্যায় কাশেম পাটোয়ারী বাসায় এসে কান্টিবান্টিকে একটা আলাদা রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন। তার দেখভাল করার জন্য একজন লোকও নিয়োগ করে দিলেন।

কান্টিবান্টি সারা দিন ঘুমায় আর সারা রাত কাজ করে। জয়িতার সঙ্গে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় কথা হয়। জয়িতার কাছ থেকে ধারণা নেয়। ছয় মাসের শেষ দিকেই একটি গাড়ির ডিজাইন হয়ে যায়। ইঞ্জিনের প্রোগ্রামিং হলো চমৎকারভাবে। গুগলের ম্যাপ থেকে বিশেষ কয়েকটি ম্যাপের প্রোগ্রাম সেট করা হলো। একই সঙ্গে সামনে থেকে বা পাশ থেকে কোনো গাড়ি কত গতিতে আসছে, কতটুকু পাশ দিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ছবিগুলোও দেখা যাবে, শোনাও যাবে এবং সেই সঙ্গে সেসব গাড়ির গতিরও সূচকের শব্দ শোনা যাবে। এসব তথ্য আবার বিশেষ রেকর্ডিংয়ের মাধ্যেমে যেকোনো দৃষ্টিহীন ড্রাইভার শুনতে পাবে। তাই দৃষ্টিহীনদের গাড়ি চালানো কোনো সমস্যাই হবে না। শব্দের তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে এই গাড়িটি থামবে বা গতিও বাড়াতে পারবে। কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও যোগ করা দেওয়া হয়েছে।

কান্টিবান্টি বিস্তারিত জানাল জয়িতাকে। জয়িতা বেশ খুশি। তবে কান্টিবান্টি বলল, জয়িতা আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, তোমার ধারণা থেকেই আমি গাড়িটি বানাতে পারলেন।
কান্টিবান্টির কথা শুনে জয়িতা হাসে। এমন উল্টাপাল্টা ভাষা কে বলে? জয়িতা বলল, গাড়ি বানানোর কাজ শেষ হলে আপনাকে ভাষা শেখাব। বুঝলেন?
ভাষা শিখাবি। একটা ভালো কথা বলেন। আমি খুশি হলেন।
জয়িতা আরও জোরে হাসে। এবার থামেন। এমন জঘন্য বাংলা ভাষা শুনতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে।
কান্টিবান্টি আর কথা বলতে সাহস পায়নি। তবে মনে মনে স্থির করে বাংলা ভাষাটা তাকে ভালোভাবে শিখতেই হবে। যত কঠিনই হোক, ভাষা আমাকে শিখতেই হবে।
দুই মাসের মধ্যে গাড়ির সফটওয়ায়ের কাজ শেষ হলো। একটা ডিজাইন কান্টিবান্টি করেছে। এখন সমস্যা দেখা দিল এই গাড়ি কোথা থেকে তৈরি করা হবে? বাংলাদেশে এমন কোনো গাড়ির কারখানা নেই যে এই জটিল গাড়িটি বানাতে পারবে। জয়িতাই শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিটা দিল। সে বলল, আপাতত ধোলাইয়ের খালে যান। সেখানে অনেকে লোখ আছে যারা মানুষে ছাড়া সবই বানাতে পারে।
জয়িতার কথায় কান্টিবান্টি হাসে। এমন সুন্দর করে কথা বলে মেয়েট। অথচ দেখতে পায় না। আহা, ওর মনে না জানি কত দুঃখ।
জয়িতা আরও বলে, আপাতত কারখানা থেকে একটা মডেলটি তৈরি করে আনেন। যদি এটি কাজ করে পরে না হয় মার্সিডিজ কোম্পানি থেকে গাড়ি তৈরি করা হবে। কিন্তু তার আগে গাড়ির টেকনোলজি যাতে ফাঁস না হয় সেজন্য একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতে হবে। দেশে-বিদেশে আমাদের গাড়িটি সম্পর্কে জানাতে হবে।
ধোলাইয়ের খালের কথা শুনে কান্টিবান্টি যেন আকাশ থেকে পড়ে। তবু দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। তারপর কাশেম পাটোয়ারী বাসায় আসার পর দ্বিতীয় দফায় আবার আলোচনা হয়। কাশেম পাটোয়ারী বললেন, সেখান থেকেই আপাতত একটা নমুনা দাঁড় করাও। পরে দেখা যাবে কী করা যায়?

জয়িতার কথাই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। কাশেম পাটোয়ারী কান্টিবান্টিকে কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ধোলাইয়ের খালে পাঠিয়ে দিলেন। যতদিন গাড়ি তৈরি না হয় তারা সেখানেই থাকবে। কোম্পানিতে তাদের কাজ করার প্রয়োজন নেই। এই দলে বিভিন্ন ধরনের এক্সপার্ট রয়েছে। সবাই অত্যন্ত মেধাবী।
ধোলাইয়ের এক কারখানার মালিকের সঙ্গে যখন কথা হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের গাড়ির কথা শুনে কারখানার মালিক প্রথমে হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, মানুষ ছাড়া আমার কারখানা থাইকা, বুঝলেন নি, মানে, সবই বানানো যায়। তবে, বুঝলেন নি, মানে টাকার পরিমাণডা কিন্তু বাড়াইয়া দেওন লাগব। বুঝলেন নি?
কর্মকর্তাদের একজন বলল, টাকা যা লাগে তা নিবেন। আপনারা শুধু আমাদের কথা মতো কাজ করবেন। এই হলো চুক্তি ও যুক্তি। এটাই আমাদের শেষ উক্তি।
কর্মকর্তা কবিতার মিশেল দিয়ে কথা বলে। মালিকের হাসি পায় আবার রাগও হয়। মালিক বলল, কবিতামার্কা কথা কইবেন না বেপারি সাব। আমরা কবিতা বুঝি না, বুঝলেন নি। শ্রমিক থাইক্যা মালিক অইছি, বুঝলেন নি, শুধু কাম কইর‌্যা। কবিতা লেইখ্যা না। বুঝলেন নি, মানে কবিতা লেখলে এইসব কাম করন যায় না।
কর্মকর্তা বলল, আমারে বেপারি কইলেন? আমি হলাম একজন বিজ্ঞানী। বিশেষ জ্ঞানী। আপনি মানের করলেন হানী।
আমার এইহানে যারা আইয়ে সবাই বেপারি, বুঝলেন নি, মানে কেনাকাটার লাইগ্যাই আহে, বুঝলেন নি। মানে, তারাই বেপারি।
যাক, আলোচনা দীর্ঘ হয় না। অন্য কর্মকর্তারা নীরবই ছিল। কান্টিবান্টি বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে না। তার খুব ভয়। তার কথার মধ্যে সব সময় উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। সে মনে মনে কষ্ট পায়।
কান্টিবান্টির নেতৃত্বে দিনরাত কাজ করে একটি অভিনব গাড়ি তৈরি হলো।
জয়িতাকে প্রতিদিনই আপডেট করা হতো। তাই আজকে একটি দিন জয়িতা আর কান্টিবান্টির জন্য বিশেষ দিনে। আনন্দের দিন। বলা যায় ঐতিহাসিক দিন।
জয়িতা কাশেম পাটোয়ারীকে বিকেলে বাসায় আসতে বলেছে। কাশেম পাটোয়ারীও বাসায় চলে এসেছেন। আতিকনও ওদের দলে ভিড়েছে। তিনজন এখন নিচে বাড়ির লনে অপেক্ষা করছে। কখন গোলাপি গাড়িটি এসে লনে ঢুকবে।
গোলাপি রঙের গাড়িটি ধোলাইর খাল থেকে যাত্রা শুরু করে। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার আগে কান্টিবান্টি ফোন জানায়। আমরা রওনা হয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আসবেন।
ফোন পেয়ে তিনজনই হাসতে হাসতে কুটিকুটি।
গাড়িটি চলছে। ধোলাইয়ের খাল থেকে উত্তরায় আসবে। কান্টিবান্টির চোখ বেঁধে দেওয়া হলো। অন্য কর্মকর্তারা এই গাড়িতে উঠেনি। তাদের ধারণা গাড়িটির দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। অনর্থক মরে কী লাভ? যতদিন ঝুঁকিমুক্ত হয়ে থাকা বাঁচা যায় ততদিনই লাভ। তারা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে কান্টিবান্টির পিছনে রওনা হলো।
গাড়ির ছাদ নেই। খোলা ছাদ। ছাদ পরে লাগানো হবে। গাড়ি চালিয়ে আসছে কান্টিবান্টি। কিছুক্ষণ আসার পরই ট্র্যাফিক সার্জেন্ট ধরেছে। এই মিয়া চোখ বেঁধে গাড়ি চালান কেন?
কান্টিবান্টি বলল, এটা দৃষ্টিহীনদের গাড়ি, তাই। এখন ফিল্ড টেস্ট হচ্ছে।
ট্র্যাফিক সার্জেন্ট বললেন, এমন আজিব মানুষ তো জীবনে দেখি নাই। কী বলেন এসব?
তোর জ্ঞান কম। তাই দেখেন নাই এবং বুঝেন নাই।
কান্টিবান্টির কথা শুনে ট্র্যাফিক সার্জেন্ট বলল, এই ব্যাটা, আমারে তুই করে বলেছিস, তোর সাহস কম নয়। নাম গাড়ি থেকে, নাম বলছি।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুইকিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *